Sunday 27 April 2014

যেসব কারনে রাজাকার সাঈদীর ফাঁসী হওয়া যৌক্তিকঃ কিছু আইনী পর্যবেক্ষন

প্রাথমিক ভাষ্যঃ একাত্তরের ঘাতক দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যে রায় দিয়েছিলো গত ২৮ শে ফেব্রুয়ারী। ২০১৩ সালে সেই মামলাটির উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ২৮ শে মার্চে সাঈদীর আইনজীবিরা বাংলাদেশ সূপ্রীম কোর্টের আপীলেট ডিভিশানে আপীল করেন। অবশ্য যেসব বিষয়ে সাঈদীর শাস্তি প্রদিত হয়নি ট্রাইবুনাল থেকে এবং যেসব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাঁদের আপত্তি ছিলো সেসব বিষয়ে ন্যায় বিচার পাবার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র পক্ষও আরেকটি পৃথক আপীল করেন ২৮ শে মার্চ ২০১৩ তারিখে।


২০১৩ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর থেকে আপীলেট ডিভিশানে এই মামলার দুই পক্ষের শুনানী, যুক্তি-তর্ক ইত্যাদি শেষে এই বছর অর্থ্যাৎ ২০১৪ সালের ১৬-ই এপ্রিল আপীলেট ডিভিশান এই মামলার রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করেন। ইংরেজীতে যেটিকে বলে CAV [ Case awaiting verdict]. কাদের মোল্লার ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়েছিলো এবং রায় প্রদান করতে আমাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রথমে রায়ের শর্ট ভার্সন প্রদান করা হয় এবং তারও বেশ কিছুদিন পর এই রায়ের ফুল ভার্সন প্রদান করা হয়।

সাঈদীর মামলার ক্ষেত্রে আদালত কতদিন সময় নিবে কিংবা কি সিদ্ধান্ত তথা রায় কি হবে তা আমরা কেউই জানিনা। বিজ্ঞ আদালত তার সিদ্ধান্ত নেবেন তাদের পর্যালোচনা, বিবেচনায়। তবে বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এবং আইন জগতের এক সামান্য পথচারী হিসেবে সাঈদীর মামলা নিয়ে আমার কিছু নিজস্ব বক্তব্য রয়েছে। এই লেখায় আমি আমার সেই বক্তব্য গুলো তুলে ধরব।

আমার প্রত্যাশা ও পর্যবেক্ষন শেষে ধারনাঃ

এই মামলার সকল বিষয় অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ে, বিশ্লেষন করে, পর্যালোচনা করে আমার মনে হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দেয়া পূর্বতন রায় একদম সঠিক, যথোপযুক্ত এবং সঠিক বিবেচনা প্রসুত। আমি সেই একই সাথে এটিও আশা করি যে, ট্রাইবুনাল-১ এর দেয়া রায় আপীল বিভাগে বহাল থাকবে। আমার এই মনে করা কিংবা আশাবাদী হবার কারনগুলো আমি নীচে পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করব। আমি চেষ্টা করব সাঈদীর মামলার রায়ের প্রেক্ষিতে এর সাথে যুক্ত থাকা কন্টেন্টগুলোর সঠিক আইনী ব্যখ্যা দেবার জন্য।

এই প্রবন্ধে যে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হবেঃ

১) সাঈদীর মামলা ও বিচারের একটা সারমর্ম২) মূল রায় থেকে বিভিন্ন জেরার বিশ্লেষন৩) ইব্রাহিম কুট্টির মামলা৪) সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যের অসাঞ্জস্যতা৫) সাঈদীর পূর্বতন ডকুমেন্ট জালিয়াতির ইতিহাস।

সাঈদীর মামলা ও বিচারের একটি সংক্ষিপ্ত সারমর্মঃ

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় গ্রেফতারঃ [ কারন সাঈদী নিজেকে রাসুল (সাঃ) এর সাথে তুলনা করে] ২৯ শে জুন ২০১০। সাঈদীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অপরাধের তদন্ত শুরুঃ ২১-০৭-২০১০। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়ঃ ২ নভেম্বর ২০১০ [গ্রেফতারের পর থেকেই তদন্ত চলছিলো সাঈদীর বিরুদ্ধে, সাঈদীকে গ্রেফতার করা হয় যাতে করে এই তদন্তে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ কিংবা প্রভাব বিস্তার না করতে পারে।]

সাঈদীর মামলা শুরু হয়ঃ ট্রাইবুনাল-১ এ, এবং এটি-ই এই ট্রাইবুনালের প্রথম মামলা।
তদন্ত রিপোর্ট প্রসিকিউটরদের প্রদান করা হয় ৩১-০৫-২০১১ [ ৪ হাজার ৭৪ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট]। মোট তদন্ত চলেঃ ৩১৩ দিন। আদালতে অভিযোগ উত্থাপন করে ১১-০৭-২০১১ তারিখে। অভিযোগ আনা হয়ঃ ৩১ টি। আদালত অভিযোগ গ্রহণ করেঃ ২০টি। আদালত অভিযোগ আমলে নেয়ঃ ১৪ ই জুলাই ২০১১। আদালত ফর্মাল চার্জ গঠন করেঃ ০৩-১০-২০১১

সাঈদীর বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত লে-আউটঃ

saidee

সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০ টি অভিযোগের টেক্সট ভার্সনঃ 

অভিযোগ-১: ১৯৭১ সালের ৪ মে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতৃত্বাধীন দলের সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের খবর দিয়ে পিরোজপুর সদর এলাকার মধ্য মাসিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে নিয়ে যান। সেখানে পরিকল্পিতভাবে আগে থেকে জড়ো করা ২০ জন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

অভিযোগ-২: ৪ মে সাঈদী ও তার দল পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে মাসিমপুর হিন্দুপাড়ায় যান। সেখানে হিন্দু বাড়িগুলোতে লুট করেন এবং আগুন ধরিয়ে দেন। মানুষ পালাতে শুরু করলে সাঈদী ও তার দলের সদস্যরা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করলে ১৩ জন শহীদ হন।

অভিযোগ-৩: ৪ মে সাঈদী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে মাসিমপুর হিন্দুপাড়ায় মনীন্দ্রনাথ মিস্ত্রী ও সুরেশ চন্দ্র মণ্ডলের বাড়ি লুট এবং আগুন ধরিয়ে দেন। সাঈদী নিজে বিভিন্ন গ্রামের রাস্তার পাশের অসংখ্য বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন।

অভিযোগ-৪: ৪ মে সাঈদী তার রাজাকার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে ধোপাবাড়ির সামনে এবং পিরোজপুর সদর পুলিশ স্টেশনের এলজিইডি ভবনের পেছনের হিন্দুপাড়া ঘিরে ফেলেন। এ সময় গুলি চালানো হলে দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল, জগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, পুলিন বিহারী ও মুকুন্দ বালা মারা যান।

অভিযোগ-৫: তৎকালীন পিরোজপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহমান সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। সাঈদী ও তার সহযোগী শান্তি কমিটির সদস্য মন্নাফ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে নিয়ে ৫ মে পিরোজপুর হাসপাতাল থেকে তাকে ধরে বলেশ্বর নদের তীরে নিয়ে যান। একই দিনে পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ (লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাবা) এবং ভারপ্রাপ্ত এসডিও আবদুর রাজ্জাককেও কর্মস্থল থেকে ধরা হয়। সাঈদীর উপস্থিতিতে এ তিন সরকারি কর্মকর্তাকে গুলি করে লাশ বলেশ্বর নদে ফেলে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-৬: ৭ মে সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির একটি দল পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে পারেরহাট বাজারের আওয়ামী লীগ, হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের বাড়িঘর ও দোকান চিনিয়ে দেয়। এসব দোকান ও বাড়িতে লুটপাট করা হয়। এ সময় তারা মাখন লাল সাহার দোকান থেকে ২২ সের স্বর্ণ ও রুপা লুট করে।

অভিযোগ-৭: ৮ মে বেলা দেড়টার দিকে সাঈদী পাকিস্তানি সেনাদের নেতৃত্ব দিয়ে বাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম খানের ছেলে শহীদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে নুরুল ইসলাম খানকে আওয়ামী লীগার ও শহীদুল ইসলামকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের হাতে সোপর্দ করেন। পরে তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-৮: ৮ মে বেলা তিনটার দিকে সাঈদী ও তার দলের সদস্যরা চিথোলিয়া গ্রামের মানিক পসারির গ্রাম লুট করেন। এখানে পাঁচটি ঘরে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মানিক পসারির ভাই মফিজুদ্দিন ও ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে সেনা ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার সময় সাঈদীর প্ররোচনায় পাকিস্তানি সেনারা ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করে। মফিজকে সেনাক্যাম্পে নির্যাতন করা হয়।

অভিযোগ-৯: ২ জুন সকাল নয়টার দিকে সাঈদী ও তার সশস্ত্র সহযোগীরা ইন্দুরকানি পুলিশ স্টেশনের নলবুনিয়া গ্রামের আবদুল হালিম বাবুলের বাড়িতে লুটপাট করে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট এবং আগুন ধরিয়ে দেন।

অভিযোগ-১০: ২ জুন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে সশস্ত্র দল উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। সাঈদীর ইন্ধনে বিসা বালী নামের একজনকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়।

অভিযোগ-১১: ২ জুন সাঈদী টেংরাখালী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে যান। সেখানে তার বড় ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নির্যাতন করা হয়। এরপর সাঈদী নগদ টাকা লুট ও মূল্যবান জিনিস নিয়ে যান। পরে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-১২: সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি সশস্ত্র দল পারেরহাট বাজারের ১৪ জন হিন্দুকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে নিয়ে যায়। পরে তাদের গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-১৩: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই-তিন মাস পর সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা নলবুনিয়া গ্রামের আজহার আলীর বাড়িতে যায়। সেখানে আজহার আলী ও তার ছেলে সাহেব আলীকে ধরে নির্যাতন করা হয়। সাহেব আলীকে পিরোজপুরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-১৪: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের একটি রাজাকার বাহিনী হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়ায় যায়। রাজাকারদের আগমন দেখে গ্রামের অধিকাংশ হিন্দু নারী পালিয়ে যান। কিন্তু মধুসূদন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামী ঘর থেকে বের হতে পারেননি। তখন সাঈদীর নেতৃত্বে রাজাকাররা তাকে ধর্ষণ করেন। এর ফলে স্বাধীনতার পর তিনি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেন। এ নিয়ে গ্রামে বিভিন্ন কথা ওঠায় শেফালী ঘরামী দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। পরে এই হিন্দুপাড়ার ঘরে আগুন দেওয়া হয়।

অভিযোগ-১৫: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের রাজাকার দল হোগলাবুনিয়া গ্রামের ১০ জন হিন্দু নাগরিককে ধরে। পাকিস্তানি সেনারা তাদের সবাইকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

অভিযোগ-১৬: সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জনের রাজাকার দল পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তার তিন বোন মহামায়া, অন্ন রানী ও কমলা রানীকে ধরে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তিন দিন ধরে ধর্ষণ করে পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-১৭: সাঈদী ও তার নেতৃত্বের রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পারেরহাটের বিপদ সাহার সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে তার বাড়িতে আটকে নিয়মিত ধর্ষণ করেন। এক সময় ভানু সাহা দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।

অভিযোগ-১৮: ভাগীরথী পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে কাজ করতেন। সাঈদী এক দিন খবর দেন, ভাগীরথী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত নানা খবরা-খবর দেন। পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যা করে লাশ বলেশ্বর নদে ফেলে দেয়।

অভিযোগ-১৯: সাঈদী প্রভাব খাটিয়ে পারেরহাটসহ অন্য গ্রামের ১০০-১৫০ জন হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে রূপান্তর করে। তাদের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য করা হতো।

অভিযোগ-২০: নভেম্বরের শেষ দিকে সাঈদী খবর পান, সাধারণ মানুষ ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। তার নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি সশস্ত্র দল পরিকল্পিতভাবে ইন্দুরকানি গ্রামের তালুকদার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। ৮৫ জন ব্যক্তিকে আটক করে তাদের কাছ থেকে মালামাল কেড়ে নেওয়া হয়। ১০-১২ জন বাদ দিয়ে বাকিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।


অভিযোগের উপর সূচনা বক্তব্য শুরুঃ ২০-১১-২০১১ থেকে ২১-১১-২০১১ [৮৮ পৃষ্ঠা]। সূচনা বক্তব্য দেনঃ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু এবং সৈয়দ হায়দার আলী। সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষ্যঃ ০৭-১২-২০১১। সাঈদীর বিরুদ্ধে আদালতে এসে সাক্ষী দেনঃ ২৮ জন । সাঈদীর বিরুদ্ধে জবানবন্দী প্রদান (যা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়) করেনঃ ১৫ জন। সাক্ষ্য শেষ হয়ঃ ১৩-০৮-২০১২ ( এ থেকেই বুঝা যায় যে আসামী পক্ষকে কত সময় দেয়া হয়েছে প্রসিকিউশনের সাক্ষীকে জেরা করবার জন্য, প্রায় ৯ মাসেরো বেশী সময়!!!)

সাক্ষীদের নামঃ ঘটনার সাক্ষীরা হলেন, মাহাবুব উদ্দিন হাওলাদার, রুহুল আমীন নবীন, মিজানুর রহমান তালুকদার, সুলতান আহমেদ হাওলাদার, মাহতাব উদ্দিন হাওলাদার, মানিক পসারি, মফিজ উদ্দিন পসারি, মোঃ মোস্তফা হাওলাদার, মোঃ আলতাফ হোসেন হাওলাদার, বাসুদেব মিস্ত্রি, আব্দুল জলিল শেখ, আব্দুল আওয়াল এমপি (বর্তমান), গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহা, আব্দুল হালিম বাবুল, মোঃ সেলিম খান, জুলফিকার আলী, মধুসূদন ঘরামী, মোঃ হোসেন আলী, মোঃ মোবারক হোসেন ও সাইফ হাফিজুর রহমান। আর জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেন, পিআইবির ক্যাটালগার মোঃ রবিউল আলম খান, পিআইবির চতুর্থ শ্রেণীর বুক সার্টার এসএম আমিরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের গাইড কাম কম্পিউটার অপারেটর ফাতেমা বেগম, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের গাইড মোঃ নেছার, বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারিক ইজাব উদ্দিন মিয়া, বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারিক ডিস্ট্রিবিউটর মাসুম উল কবির এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান। রাষ্ট্রপক্ষের ২৮তম ও শেষ সাক্ষী হিসেবে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলালউদ্দিন

যে ১৫ জনের জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়ঃ উষা রানী মালাকার, সুখরঞ্জন বালি, আশীষ কুমার ম-ল, সুমতি রানী ম-ল, সমর মিস্ত্রি, সুরেশ চন্দ্র ম-ল, গণেশ চন্দ্র সাহা, শহিদুল ইসলাম খান সেলিম, মোঃ মোস্তফা, আব্দুল লতিফ হাওলাদার, আইয়ুব আলী হাওলাদার, সেতারা বেগম, অনিল চন্দ্র ম-ল, রানী বেগম ও অজিত কুমার শীল।

সাঈদীর পক্ষে সাক্ষীঃ ১৭ জন। সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য শুরুঃ ০২-০৯-২০১২। সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য শেষ হয়ঃ ২৩-১০-২০১২ ( অথচ আসামী পক্ষের সাক্ষীকে জেরা করতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি পেয়েছে মাত্র ১ মাস ১০ দিন সময়। আসামীদের আইনজীবি পেয়েছে ৯ মাসের বেশী সময় আর রাষ্ট্রের আইনিজীবিরা পেয়েছেন ১মাস ১০ দিন, চিন্তাই করা যায় না। এর পরেও বলে, বিচার নাকি নিরপেক্ষ নয়!!!)

সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের নামঃ শামসুল আলম তালুকদার, আব্দুর রাজ্জাক আঁকন, নুরুল হক হাওলাদার, আবুল হোসেন, খসরুল আলম, রওশন আলী, জামাল উদ্দিন ফকির, কুবাত আলী, হেমায়েত উদ্দিন, গোলাম মোস্তফা, আনোয়ার হোসেন, হাফিজুল হক, সাঈদীর ছেলে মাসুদ বিন সাঈদী, এমরান হোসাইন, আব্দুস সালাম হাওলাদার, আব্দুল হালিম ফকির ও গণেশ চন্দ্র সাহা। 

রাষ্ট্রপক্ষের চূড়ান্ত যুক্তি তর্কঃ ০৫-১১-২০১২ থেকে ১৫-১১-২০১২, আসামীপক্ষের চূড়ান্ত যুক্তি তর্কঃ ১৮-১১-২০১২ থেকে ৩০-১১-২০১২। রাষ্ট্রপক্ষ আসামী পক্ষের যুক্তি খন্ডান ০৪-১২-২০১২ থেকে ০৬-১২-২০১২ ,মামলার রায় যে কোনো দিন হবে জানানো হয়ঃ ০৬-১২-২০১২। ট্রাইবুনাল-১ এর চেয়ারম্যান ব্যাক্তিগত কারনে পদত্যাগ করেনঃ ১১-১২-২০১২, বিচার পুনরায় শুরুর আবেদনঃ ২৩-১২-২০১২। এর জন্য শুনানী চলেঃ ২৪-১২-২০১২ থেকে ০১-০১-২০১৩, রাষ্ট্রপক্ষে শুনানী করেনঃ এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলম ও সৈয়দ হায়দার আলী, শুনানীর পর আবেদন খারিজঃ ০৩-০১-২০১৩ (শুধু চূড়ান্ত যুক্তি তর্ক শুনবেন বলে ঘোষনা), নতুন ভাবে যুক্তি তর্ক শোনা শুরু হয়ঃ ১৩, ১৪ জানুয়ারী (রাষ্ট্রপক্ষ), আসামী পক্ষের জন্য বরাদ্দ হয় ১৫, ১৬, ১৭। 

আসামী পক্ষ সময় বাড়াবার জন্য আবেদন করে। রাষ্ট্র পক্ষে যুক্তি তর্ক প্রদান করেঃ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। অবশেষে আসামী পক্ষ ২০-০১-২০১৩ থেকে ২৮-০১-২০১৩ পর্যন্ত যুক্তি উপস্থাপন করে। আসামী পক্ষে যুক্তি তর্ক প্রদান করে মিজানুল ইসলাম ও আব্দুর রাজ্জাক। ২৮-০১-২০১৩ তারিখের দুপরের পর রাষ্ট্রপক্ষ আসামী পক্ষের যুক্তি খন্ডানোর সময় পান ১ ঘন্টা। সাঈদীর পক্ষে এ পর্যন্ত জামিনের আবেদন হয়ঃ ৭ বার। ফলাফলঃ আবেদন খারিজ। ট্রাইবুনাল ২৯-০১-২০১৩ তে জানায় যে সাঈদীর মামলার রায় যে কোনো দিন দেয়া হবে সাঈদীর বিচারে জনতার মধ্যে যে শব্দগুলো জনপ্রিয়তা পায়ঃ লইট্টা ফিস, টেবিল, ময়না পাখি, কলিজু, গজব পড়বে, মেশিন চলবে ইত্যাদি

শেষ পর্যন্ত সাঈদীর মামলার রায় দেয়া হয় ২৮-০২-২০১৩ তারিখে রাজাকার সাঈদীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছিলো সেটির মধ্যে ৬,৭,৮,১০,১১,১৪,১৬ এবং ১৯ নাম্বার অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বিচারকেরা ৮ এবং ১০ -এ বর্ণিত অভিযোগের ব্যাপকতা অন্য প্রমাণিত অভিযোগের তুলনায় অনেক বেশী মনে করেছেন এবং এই দুটি ক্ষেত্রেই সাঈদীর মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন। অন্য অপরাধগুলো সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হলেও যেহেতু ৮ আর ১০ নাম্বার এর ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন তাই বাকী গুলোতে আর আলাদা করে কোনো শাস্তি দেননি।

সাঈদী এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে ২৮-০৩-২০১৩। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সাঈদীর মামলায় প্রথম আপিল শুনানি শুরু হয়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করে গত ১০ এপ্রিল যুক্তি উপস্থাপন শেষ করে। এর আগে গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আপিল বিভাগে আসামীপক্ষ তাদের যুক্তির্তক উপস্থাপন করেন। ১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার শেষ হয় আপিল মামলাটির শুনানি। সেদিন রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যের জবাবে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন সাঈদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট এএসএম শাহজাহান। এরপর সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ২৪ শে সেপ্টেম্বর থেকে মামলার শুনানী শুরু হলেও এর ভেতরে রাজনৈতিক সহিংসতা, আদালতের অবকাশ এবং আরো নানা কারন শেষে সর্বমোট ৪৭ কার্য দিবসে দুই পক্ষের শুনানী, যুক্তি-তর্ক ইত্যাদি শেষে এই বছর অর্থ্যাৎ ২০১৪ সালের ১৬-ই এপ্রিল আপীলেট ডিভিশান এই মামলার রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করেন।

প্রধান বিচারপতি মো. মোজ্জাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৫ সদস্যের বেঞ্চ এসব আদেশ দেন। অন্য ৪ বিচারপতি হচ্ছেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

আপীলেট ডিভিশানে শুনানী চলাকালীন সময়ের কিছু গুরুত্বপূর্ন ঘটনাঃ

সাঈদীর আপীল শুনানি সময়ে এই পুরো সময়টিতেই বলা চলে ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা মামলাটি-ই সবচাইতে বেশী আলোচিত হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে যে গুরুত্বপূর্ন ঘটনা গুলো ঘটে তা হোলো-

[ক] কুট্টি হত্যা মামলার নথি তলবের আবেদন খারিজ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে দু’টি হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছেন, তার মধ্যে একটি ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা। আসামিপক্ষ দাবি করেছেন, স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে দায়ের হওয়া ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা মামলার আসামিই ছিলেন না সাঈদী। আসামিপক্ষ ওই মামলার রেজিস্ট্রার খাতা তলবের আবেদন করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ এ বিষয়ে আসামিপক্ষের জমা দেওয়া মামলার নথি ও ডকুমেন্ট জাল, মিথ্যা এবং মামলার প্রয়োজনে সৃজনকৃত বলে উল্লেখ করে এসব কাগজ বিবেচনায় না নেওয়া এবং মামলাটির নথি তলবের আবেদন করেন।

শহীদ ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে তার স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে পিরোজপুরে একটি মামলা করেছিলেন। ওই মামলায় তিনি মোট ১৩ জনকে আসামি করেন। আসামির সেই তালিকায় সাঈদীর নাম নেই বলে দাবি করে আসামিপক্ষ মমতাজ বেগমের দায়ের করা সেই মামলার এফআইআর নথির একটি সত্যায়িত কপি ২০১১ সালে ট্রাইব্যুনালে জমা দেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এসব নথি সংগ্রহে পিরোজপুর এবং বরিশাল সফর করেছেন। সফর শেষে গত ৯ এপ্রিল আদালতে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, পিরোজপুর এবং বরিশালের জেলা জজ আদালতে কোথাও এ মামলার কাগজ পাওয়া যায়নি। 

আসামিপক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার নথি মর্মে যে ডকুমেন্ট জমা দিয়েছেন তা জাল, মিথ্যা এবং মামলার প্রয়োজনে সৃজনকৃত। তাই এ কাগজ বিবেচনায় না নেওয়ার লিখিত আবেদন জানান তিনি। ১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার আসামিপক্ষের আবেদনের সপক্ষে শুনানি করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। এর জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের সপক্ষে বক্তব্য দেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ১৬ এপ্রিল বুধবার এ দুই আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

[খ] দুই পক্ষের আরজি

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহাবুবে আলম বলেন, বুধবার (১৬ এপ্রিল) সকালে এ আদেশ দেওয়ার আগে সাঈদীর বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলোর মধ্যে ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯নং অভিযোগ এবং দেলোয়ার শিকদার, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এসব বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ বাধাই করে আদালতে জমা দিয়েছি। আপনারা আদালতের কাছে কী আশা করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পাবো। আমরা এখানে ৮টি অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি। যেখানে হত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিতকরণ, পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে হস্তান্তর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মতো অভিযোগ রয়েছে।

এই সাঈদী সেই সাঈদী নন, আসামিপক্ষের এমন বক্তব্যের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আসামিপক্ষ বলেছিলেন, এই কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা নন। এখানেও তারা একই অভিযোগ করেছেন। কিন্তু তারা তাদের সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিয়ে এটি প্রমাণ করতে পারেননি। শুনানিতেও রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় বহাল রাখার আরজি জানান। তিনি বলেন, এই মামলায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় যথার্থ হয়েছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে অবশ্যই এ রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকা উচিত।

তিনি আরও বলেন, এক মোমেনার সাক্ষ্যে কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। মোমেনার মতো নির্ভরযোগ্য সাক্ষী এ মামলাতেও রয়েছে। তাদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, সাঈদীর অপরাধ আরো ঘৃণ্য ও মারাত্মক। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, পাকিস্তানি বাহিনীকে আমন্ত্রণ ও অভ্যর্থনা, অগ্নিসংযোগসহ সব ধরনের অপরাধ তিনি করেছেন। হত্যার চেয়েও ভয়ানক আরেকটি অপরাধ তিনি বলেছেন। সেটা হচ্ছে, মানুষকে জোর করে ধর্ম পরিবর্তন।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহাবুব হোসেন বলেন, ঘটনা সত্যি হতে পারে। কিন্তু এই দেলোয়ার সেই দেলোয়ার নন। আমরা এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত আদালতে দাখিল করেছি। আদালতে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে রায় দেবেন। আমরা আশা করছি, তিনি খালাস পাবেন। আসামিপক্ষ শুনানিতে বলেন, সাঈদী নির্দোষ। যে ৮টি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে দণ্ড দিয়েছিলেন, সেগুলো মিথ্যা ও খালাসযোগ্য। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে সাঈদীকে খালাস দেওয়ার আরজিও জানান আসামিপক্ষ।




ইব্রাহিম কুট্টির মামলা এবং আমার পর্যবেক্ষনঃ

যেই দুইটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজাকার দেইল্লা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে সেই অভিযোগ দুইটির একটি হচ্ছে ইব্রাহিম কুট্টির হত্যাকান্ড এবং সেইসাথে এই অভিযোগের সাথে সংশ্লিষ্ঠ অন্যান্য অপরাধের সত্যতাও বের হয়ে এসেছে।
(অভিযোগ-৮ দ্রষ্টব্য)। সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে এই অভিযোগটি নিয়ে ডিফেন্স বরাবরি যুক্তি দেখিয়ে আসছে যে ১৯৭২ সালে যখন ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার প্রেক্ষিতে যে মামলা হোলো সেখানে সে মামলার বাদী ইব্রাহিমের স্ত্রী মমতাজ বেগম যে কয়জনকে আসামী করেছিলেন তার মধ্যে সাঈদীর নাম নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগায় যে তাহলে কি সাঈদী নির্দোষ? যেখানে ভিকটিমের স্ত্রী-ই প্রথম মামলায় সাঈদীকে আসামীর লিস্টে রাখেন নি, সেখানে এখন কেন রাখা হচ্ছে এবং কেনই বা তাকে শাস্তি দেয়া হোলো?

এখানে আসলে অনেকগুলো ব্যাপার বিবেচ্য-

প্রথমতঃ লক্ষ্য করুন, ডিফেন্স মমতাজ বেগমের করা মামলার কথা বলছেন অথচ এই কথার প্রেক্ষিতে কখনই মমতাজ বেগমকে আদালতে হাজির করাতে পারে নি? এই মমতাজ বেগমকে আদালতেই এনেই তো ডিফেন্স তাদের আর্গুমেন্টের প্রেক্ষিতে তাদের অবস্থান সত্যায়িত বলে প্রমাণ করতে পারত, কিন্তু সেটি না করেই তারা কেন শুধু ডকুমেন্টের উপর আর্গুমেন্ট করছে? এখন পর্যন্ত সাঈদীর পক্ষের আইনজীবিরা মমতাজ বেগমের করা মামলার সার্টিফায়েড কপির কথা বল্লেও কখনোই মমতাজ বেগমকে আদালতে সাক্ষী হিসেবে আনবার জন্য আবেদন করেন নি। মমতাজ বেগম এখনো জীবিত রয়েছেন এবং তারপরেও কেন তাঁকে সাক্ষী করেন নি সেটা আজ পর্যন্ত একটি রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে।

দ্বিতীয়তঃ মনে রাখতে হবে ইব্রাহিম কুট্টি মানিক পসারীর বাড়ীতে একজন কাজের মানুষ ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর যুদ্ধপরবর্তী মানসিক অবস্থাও আমাদের বুঝতে হবে। স্বামীকে হত্যা করেছে পাক হানাদার আর রাজাকাররা মিলে। সে সময় তিনি মামলা করেছেন, কে তাকে সাহায্য করেছিলো, ওই সময়ে কে তাকে তথ্য দিয়েছিলো, তিনি আদৌ কাউকে দেখেছেন কিনা, অপরাধীদের ব্যাপারে এসব সকল কিছুই কিন্তু এখানে খতিয়ে দেখতে হবে। সবচাইতে স্ট্রাইকিং পয়েন্ট হচ্ছে ডিফেন্সের এই এই বক্তব্যের ও প্রদর্শিত সাক্ষ্যের প্রেক্ষিতে ডিফেন্স মমতাজ বেগমকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করতে পারেনি। প্রশ্নটা আসতেই পারে, "কেন পারেনি?", আবার নীচে উদাহরণ দিয়ে বলেছিই, এমন ভুরি ভুরি মামলার উদাহরন যেখানে মূল অপরাধীর বিরুদ্ধে শুরুতে কোনো মামলাই হয়নি, অন্য ব্যাক্তিকে ধরা হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে যে মূল অপরাধী ধরা পড়েছে।

অন দা কন্ট্রারি:

আইন যদি বিবেচনা করি তাহলে বলতে হয় এটা একটা যুক্তি হলেও এর মানে এই দাঁড়ায় না যে, কোনো হত্যা মামলায় প্রথমবারে কারো নাম অন্তর্ভূক্ত না করাটাই শেষ কথা এবং সেখানে পরবর্তীতে আর কারো নাম আসবে না কিংবা আসলেও প্রথমবার কেন এসেছে এই যুক্তিতে একজন সাসপেক্ট পার পেয়ে যাবে। এরকম অসংখ্য মামলা পৃথিবীতে রয়েছে যেখানে শেষ পর্যন্ত যাকে অপরাধী হিসেবে পাওয়া গিয়েছে প্রথম দফায় তার নাম কেউ জানতও না। বাংলাদেশেই এমন নিদর্শন ভুরি ভুরি। 

এই জাতীয় মামলার কয়েকটা উদাহরণ প্রাসঙ্গিক ভাবেই দেয়া যেতে পারে ইন কেইস যদি এই প্রেক্ষিত বিবেচনা করে কেউ পাল্টা যুক্তি দিতে আসেন  "শুধু মাত্র" সেটি বিবেচনা করেই।

1) Timothy Evans's wife and young daughter were killed in 1949. Evans was convicted of the murder of his daughter and was hanged in 1950. An official inquiry conducted 15 years later determined that the real killer of Evans's daughter had been Evans's co-tenant, serial killer John Reginald Halliday Christie. [England]

2) Andrew Mallard was convicted for the murder of jeweler Pamela Lawrence in 1994 after eight unrecorded hours of police interrogation and a brief recorded "confession" that followed. In 2005, the High Court of Australia was advised that the prosecution and/or police had withheld evidence which showed his innocence, and overturned his conviction. As such, Mallard was released from prison. A "cold case" review of the murder conducted after Mallard's release implicated one Simon Rochford as the actual offender and Mallard was exonerated. [Australia]

আবার ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টারের এমন আরেকটি কাহিনী যেখানে মূল অপরাধীকে না ধরে অন্য একজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো এখানে দেখা যেতে পারে 

ডিফেন্সের প্রদর্শিত এই তথাকথিত মামলার কাগজপত্র কি সত্য?

এই ব্যাপারটির পরবর্তী বিশ্লেষন পর্যন্ত যাবার আগে দেখে নেয়া যাক সাঈদীর আপীল চলাকালীন সময়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি এই বিষয়ে কি মতামত দিয়েছেন- 

এই বিষয়ে এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলমের বক্তব্যঃ

মাহবুবে আলম জিআর তলব  না করে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের নথি তলবের আবেদন করেন প্রথমে। অ্যাটর্নি বলেন, আসামিপক্ষ যে ডকুমেন্ট দাখিল করেছেন তা মিথ্যা। কেননা তাদের ডকুমেন্টে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের কোনো নম্বর নেই। তিনি বলেন, বরিশালের আদালত ঘুরে এসেছি। তাতে এ ধরনের কোনো ডকুমেন্ট নেই। তাই তিনি আসামিপক্ষের আবেদন গ্রহণ না করার দাবি করেন।

গত ৯ এপ্রিল শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, ‘আমি নিজে পিরোজপুর এবং বরিশাল সফর করেছি। সেখানে জেলা জজ আদালতে কোথাও এ মামলার কাগজ পাওয়া যায়নি। আসামিপক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার নথি মর্মে যে ডকুমেন্ট জমাদিয়েছে তা জাল, মিথ্যা এবং মামলার প্রয়োজনে সৃজনকৃত।’ তিনি বলেন, ‘আসামিপক্ষ দাবি করেছে এ মামলায় চাজশিট হয়েছিল, কিন্তু তারা সেই চার্জশিট জমা দেয়নি। একটি মামলার প্রাথমিক অভিযোগে সব বা মূল আসামির নাম নাও থাকতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে চার্জশিটে মূল আসামির নাম আসতে পারে বা অন্য আসামির নাম যোগ হতে পারে। আসামিপক্ষ মামলার এফআইআরের কপি জোগাড় করতে পারল আর চার্জশিট তারা জোগাড় করতে পারল না? তারা কেন চার্জশিট তুলতে পারল না?’  [ সূত্রঃ www.ictbdwatch.wordpress.com ]

 ডিফেন্স ১৯৭২ সালে দায়ের করা যেই মামলাটি আদালতে প্রদর্শিত করেছে আদালতে সেটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য সেটি আমাকে আসলে বলতে হয়না। মাননীয় আদালত এই সাক্ষ্যের ব্যাপারে কিছু বলেন নি বলেই আমরা রায়ে দেখতে পাই এবং সাঈদীর বিরুদ্ধেই রায় আসে। সুতরাং এই ব্যাপার থেকেই আমরা ধরে নিতে পারি যে ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী’র নাম ব্যাবহার করে এই মামলার কাগজটি আদালত যথাযথ মনে করেন নি। যেখানে সাঈদী নিজেই তার নাম ও বয়স নিয়ে জালিয়াতী করেছে সেখানে মমতাজ বেগমের এই মামলা নিয়ে জালিয়াতী যে করেনি তার গ্যারান্টি নেই।

 উপরের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক ভাবে বলা যায়ঃ

এর আগেও সাঈদী তার নিজের বয়স, নাম এমনকি নিজের ছেলেদের বয়স নিয়েও জালিয়াতি করে ধরা খেয়েছে সুতরাং এই ধরনের কাগজ পত্র জালিয়াতি সাঈদীকে দিয়ে কিংবা তার আইনজীবিকে দিয়ে অবশ্যই সম্ভব। আসুন নীচে একটু জেনে নেই এই ঘটনাগুলো-

নাম জালিয়াতিঃ

দেইল্লার এইসব কর্মকান্ডের বিচার যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ট্রাইবুনাল-১ এ চলছিলো তখন দেইল্লা রাজাকারের আইনজীবিরা ট্রাইবুনালে প্রমাণ করবার চেষ্টা করছিলো যে একাত্তর সালের যে দেলু শিকদার বা দেইল্লা রাজাকারের কথা অভিযোগে বলা হচ্ছে সেই ব্যাক্তি আর বর্তমানের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দেলোয়ার হোসেন সাঈদী এক ব্যাক্তি নয়। এই প্রমাণ করবার চেষ্টা হিসেবে দেলু রাজাকার আদালতে এও বলেছে যে তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট যদি দেখা হয় তবে সেখানে তার নাম দেলোয়ার হোসেইন সাঈদী লেখা রয়েছে। সুতরাং অভিযোগের দেলু বা দেইল্লা রাজাকার সে নয় বরং ভিন্ন ব্যাক্তি।

কিন্তু বিধি বাম। এডুকেশন ডট নেট নামে একটি ওয়েব সাইট একদিন প্রকাশ করে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর নাম ও বয়স কেলেংকারীর কথা। তাদের অনুসন্ধানী রিপোর্ট টি ছিলো অত্যন্ত তথ্যবহুল এবং সেখানে সকল প্রমাণ দিয়েই কথা বলা হয়েছিলো।

এই ওয়েব সাইটের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে যে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী বলে আজকে আমরা যাকে চিনি সেই সাঈদী দাখিল এবং আলিম পরীক্ষার সার্টিফিকেটে নাম দেয় আবু নাঈম মোঃ দেলোয়ার হোসাইন। উল্লেখ্য যে সাঈদী দাখিল পাশ করে ১৯৫৭ সালে দারুস সুন্নাত শর্শীনা মাদ্রাসা থেকে এবং আলীম পাশ করে ১৯৬০ সালে বরই পাড়া মাদ্রাসা থেকে।
এসময় সাঈদী তার জন্মতারিখ ব্যাবহার করে ০১-০১-১৯৪৫, যার মানে দাঁড়ায় সাঈদী জন্মের ১২ বছর বয়সেই দাখিল পাশ করে যা এক কথায় সম্ভব না। এখানকার প্রাপ্ত তথ্য থেকেই জানা যায় যে সাঈদী তার আলিম ও দাখিল পরীক্ষার উল্লেখিত ওই নামটি পরিবর্তন করতে উদ্যোগী হয় ২০০৮ সালের ৫ ই নভেম্বর। যার মানে দাঁড়ায় দাখিল পাশ করবার প্রায় ৫১ বছর পর এবং আলিম পাশ করবার ৪৮ বছর পর সাঈদী তার নাম পরিবর্তন করে রাখে দেলোয়ার হোসেইন সাঈদী।

নীচে দেলু রাজাকারের সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা আলিম পাশ এর সার্টিফিকেটের স্ক্যান কপি দেয়া হোলোঃ


নাম পরিবর্তন সংক্রান্ত আইনঃ

অথচ নাম পরিবর্তন সংক্রান্ত আইনে আছে যে সার্টিফিকেটে নামে ভুল থাকলে এই ভুল সংশোধন করতে হবে পাশ করবার ২ বছরের মাথায়। কিন্তু ৫১ বছর পর সাঈদী কিভাবে তার নাম পরিবর্তন করলো এটার উত্তর কোনোভাবেই দিতে পারেনি নাম ও বয়স সংশোধন সংক্রান্ত তৎকালীন কমিটির সদস্য সাবেক মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), মাদ্রাসা বোর্ডের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক হাফিজুর রহমান (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও বর্তমান চেয়ারম্যান মোঃ আবদুর নূর, এবং মাদ্রাসা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবু ছালেহ আহমেদ। উল্লেখ্য যে, এই মোহাম্মদ আব্দুর নূর ২০০৩ সালে সাঈদীর সুপারিশেই তৎকালীন সময়ে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। 

নীচের ছবিতে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে সাঈদী যখন নাম পরিবর্তন করে তখন দৈনিক সংগ্রামে যে এফিডিভেটের বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো সেটি।লক্ষ্য করে দেখুন যে এইখানে সাঈদী তার বয়স লিখেছে ০১-০১-১৯৪৫। 


এফিডেভিটে যা লেখা রয়েছে তা হুবুহু নীচে উল্লেখ করা হোলোঃ

‘আমি দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদী জন্ম তাং ০১-০১-১৯৪৫ ইং পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী বাড়ি নং ৯১৪ শহীদবাগ ঢাকা। আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা। আমি পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বর্তমানে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডর অধীনে আলিম ও দাখিল পাস করি, দাখিল পাসের সন ১৯৫৭ ১ম বিভাগ রোল নং ৩৯২০ কেন্দ্র সারসিন । দাখিল পরীক্ষায় ভুলবশত: আমার নাম দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদীর পরিবর্তে আবু নাঈম মোহাম্মদ দেলাওয়ার হুসাইন লিপিবদ্ধ হয়েছে। আলিম পাসের সন ১৯৬০ সাল রোল নং ১৭৬০ কেন্দ্র খুলনা বিভাগ ৩য়। আলিম পরীক্ষায় ভুলবশত: আমার নাম দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদীর পরিবর্তে আবু নাঈম মোহাম্মদ দেলাওয়ার হুসাইন লিপিবদ্ধ হয়েছে।প্রকৃতপক্ষে আমার শুদ্ধ ও সঠিক নাম হবে দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদী । এ ব্যাপারে আমি অদ্য ৫/১১/২০০৮ ইং নোটারী পাবলিক ঢাকা এর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে আমার নাম সংশোধনের বিষয়ে হলফ করলাম। দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদী, পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী, বাড়ি নং ৯১৪ শহীদবাগ, ঢাকা। সংগ্রাম পি-৭২১২/০৮’
পাঠক লক্ষ্য করুন, এই এফিডেভিটের মাধ্যমে সাঈদী ২০০৮ এর নভেম্বর ৫, তারিখে কেবলমাত্র তার নাম পরিবর্তন করে।

বয়স জালিয়াতিঃ

পাঠক, নীচের এই ছবিটির দিকে তাকিয়ে দেখুন। সাঈদী নভেম্বর ৮, ২০০৮ সালে তার বয়স পরিবর্তন করবার জন্য এফিডেভিট জমা দিচ্ছে। সাঈদী তার সার্টিফিকেটে এতদিন লিখে রেখেছিলো যে তার জন্ম ১৯৪৫ সাল যেই হিসেবে সাঈদী ১২ বছর বয়সে দাখিল পাশ করে। যেহেতু সাঈদী বুঝতে পেরেছে যে এত কম বয়সে দাখিল পাশ করা যায়না, সেহেতু সে আবার তার বয়স পরিবর্তন করছে। কিন্তু এইখানেও সাঈদী আইন ভঙ্গ করেছে। কেননা বয়স সংক্রান্ত এফিডেভিটের ক্ষেত্রে এফিডেভিট করতে হয় ব্যাক্তির মাকে কিংবা বাবাকে যদি জীবিত থাকে। কিন্তু ২০০৮ সালে সাঈদীর মা জীবিত থাকতেও সাঈদী নিজে নিজে সাক্ষর করে এফিডিভেট করছে যেটি সম্পূর্ণ রূপে অবৈধ।


আবার, নীচের ছবিটি লক্ষ করুন। যেখানে সাঈদী ২০০৮ সালের নভেম্বরের ৮ তারিখে সাক্ষরের স্থানে লিখেছে "দেলোয়ার হোসেন সাঈদী" সেখানে মাত্র ২২ দিনের মাথায় নির্বাচনী প্রত্যয়ন পত্রে সাঈদী তার সাক্ষর পরিবর্তন করে লিখেছে "আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী", মানে দাঁড়াচ্ছে সাঈদীর সাক্ষর দুই যায়গায় দুই রকম মাত্র ২২ দিনের ব্যাবধানে।


সার্টিফিকেটে জন্ম সাল ১৯৪৫ হলেও নির্বাচনের সময় ১৯৪০


সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা আলিম পাশ কিন্তু নামের আগে আল্লামাঃ

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় সাঈদী কি তার নামের আগে আল্লামা লিখতে পারে ? কেননা ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রত্যয়ন পত্রে সাঈদী লিখেছে যে তার সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা হচ্ছে আলীম পাশ। মানে ইন্টারমিডিয়েট সমতূল্য। সুতরাং আলীম পাশ যেখানে সাঈদীর সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা সেখানে নামের আগে সাঈদী কোন হিসেবে আল্লামা লিখে? এই কথাটি সাঈদীর বিরুদ্ধে আসা রায়ের ৮ নাম্বার পাতায় লেখা রয়েছে। সাঈদীর ২০০৮ সালের প্রত্যয়নপত্রে উল্লেখিত সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং রায়ে উল্লেখ করা সেই অংশটি নীচে দেয়া হোলোঃ




সাঈদী তার নাম ও বয়স নিয়ে যেই জালিয়াতী করেছে এবং অন্যান্য যে সকল অপরাধ করেছে তার আরো বিবরন এই লিঙ্কে গেলে পাবেন

 ট্রাইবুনালে সাঈদীর ছেলেদের জন্ম ও বয়স নিয়ে খোদ সাঈদীর জালিয়াতী এবং সাঈদীর আইনজীবির স্বীকারোক্তিঃ

সাঈদী শুধু নিজেই যে তার বয়স, নাম ইত্যাদি নিয়ে ডকুমেন্ট জালিয়াতি করেছে তা নয়। এমনকি তার ছেলেদের জন্ম ও বয়স নিয়েও মিথ্যাচার করেছে। এই বিষয়ে এমনকি আদালতের এক প্রশ্নের জবাবে সাঈদীর-ই আইনজীবি এস এম শাহজাহান বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, সাঈদীর পক্ষের এক সাক্ষী তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈদীর দুটি ছেলে সন্তান ছিল। অথচ জাতীয় সংসদে জমা দেওয়া হলফনামায় সাঈদী বলেছেন, তাঁর বড় ছেলের জন্ম ১৯৭০ সালে এবং দ্বিতীয় ছেলের জন্ম ১৯৭২ সালে।এখানে সাক্ষী ও সাঈদীর দেওয়া তথ্যের মধ্যে গরমিল।’ তিনি বলেন, শুধু এই একটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর পক্ষে দেওয়া ডকুমেন্টস অবিশ্বাস করেছে। [ সুত্র]

যেই ব্যাক্তি নিজের নাম, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা নিজের ছেলেদের নাম নিয়ে জালিয়াতি করেছে তার পক্ষে তো একটা ভুয়া মামলার নথি বের করা অত্যন্ত সহজ একটি কাজ। আবার লক্ষ্য করলে দেখতে পাই আলোচ্য অভিযোগ ৮ এর ক্ষেত্রে কিন্তু শুধুমাত্র ইব্রাহিম কুট্টিকেই যে হত্যা করা হয়েছে সেটি বলা নেই। এখানে আরো অন্যান্য অপরাধ রয়েছে। আসুন অভিযোগগুলো পড়ি-

That on 8th May, 1971 at about 3.00 p.m. under your leadership you and your accomplices accompanied with Pakistani Army raided the house of Manik Posari of village-Chitholia under Pirozpur Sadar Police Station and caught his brother Mofizuddin and one Ibrahim @ Kutti therefrom. At your instance other accomplices after pouring kerosene oil on five houses, those were burnt to ashes causing a great havoc. On the way to Army Camp, you instigated Pakistani Army who killed Ibrahim @ Kutti by gun-shot and the dead body was dumped near a bridge, then Mofiz was taken to army Camp and was tortured. Thereafter, you and others set fire on the houses of Hindu community at Parerhat Bandar causing huge devastations. The acts of looting goods and setting fire on dwelling houses are considered as persecution as crimes against humanity on religious ground. You directly participated in the occurrences of abduction, murder and persecution which are identified as crimes against humanity. 

এখানে দেখা যাচ্ছে যে শুধু ইব্রাহিম কুট্টিকেই শুধু হত্যায় সহযোগীতাই কিংবা হত্যাকান্ডের পুরো প্রক্রিয়ার একজন ব্যাক্তি হিসেবে উপস্থিতই নয় বরং এটি ছাড়াও লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতনের অভিযোগও সাঈদীর বিরদ্ধে রয়েছে

এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রসিকিউশনের সাক্ষী ছিলেন মোট নয়জন। সাক্ষীরা হলেন-

২য় সাক্ষীঃ রুহুল আলম নবীন
৪র্থ সাক্ষীঃ সুলতান আহমেদ হাওলাদার
৬ষ্ঠ সাক্ষীঃ মানিক পসারী
৭ম সাক্ষীঃ মফিজুদ্দিন পসারী
৮ম সাক্ষীঃ মোহাম্মদ মোস্তফা হাওলাদার
৯ম সাক্ষীঃ মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন
১০ম সাক্ষীঃ বাসুদেব মিস্ত্রী
১১তম সাক্ষীঃ আবদুল জলিল শেখ
১২ তম সাক্ষীঃ আলহাজ্ব এ কে এম এ আওয়াল ওরফে সাইদুর রহমান(এম পি)

আপনারা যদি পুরো রায়টি পড়েন তবে মোটামুটি সব সাক্ষীর সাক্ষ্যের সামঞ্জস্যতা এবং বক্তব্য একই ধরনের দেখা যায়। যেখানে আমরা দেখতে পাই যে, সাক্ষীরা সকলেই কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাঈদীকে শনাক্ত করেছে এবং বলেছে যে, ১৯৭১ সালের ৮ই মে তে পাকিস্তানীরা বেশ কিছু রাজাকারকে সঙ্গে করে চিথুলিয়া গ্রামে আসে (পিরোজপুর থানার অধীনে) এবং সেখানে তারা মানিক পসারীর ( ৬ষ্ঠ সাক্ষী) বাড়ী যায়। রাজাকার আর হানাদার বাহিনী দেখেই ইব্রাহিম কুট্টি এবং মফিজুদ্দিন পসারী (৭ম সাক্ষী) পালাবার চেষ্টা করে এবং তখন দূর্বৃত্তরা উক্ত দু’জনকে বেঁধে ফেলে। 

ওইদিনই তারা মানিক পসারি সহ ওই এলাকার অনেকের বাসায় লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। যেসব বাসায় লুটপাট ও অগ্নসংযোগ করা হয়েছে তাদের মধ্যে ছিলো রইসুদ্দিন পসারী, হেলালুদ্দিন পসারী, সাইজুদ্দিন পসারী ও মানিক পসারীর বাড়ী ঘর। এসব লুটপাট, অগ্নিসংযোগের পর পলায়নের চেষ্টার জন্য তারা ধরে নিয়ে যায় ইব্রাহিম কুট্টি এবং মফিজুদ্দিন পসারীকে। হাত বাঁধা অবস্থায় রাজাকার ক্যাম্পে ধরে নেবার পথেই পাকিস্তানী হানাদার আর্মি সেখানকার স্থানীয় ব্রীজের কাছে ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে মারে এবং মফিজুদ্দিন পসারীকে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে প্রচন্ড টর্চার করে। মফিজুদ্দিন পসারী এক সময় রাতের দিকে কোনোভাবে জান হাতে রেখে সেখান থেকে পালিয়ে আসে।
এই পুরো ঘটনাটির ক্ষেত্রে ৯ জন সাক্ষীর ক্ষেত্রে দেখা যায় কেউ কেউ পুরো অগ্নিসংযোগের সময়, হত্যার সময় কিংবা লুটের সময় প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং কেউ কেউ পরে ঘটনাটি শুনেছেন।

এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলো কি?

ডিফেন্স পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে যে সাঈদীর মামলায় কোনো অভিযোগের ক্ষেত্রেই নাকি কোনো প্রতক্ষ্যদর্শী ছিলো না। কতটা ভয়াবহ মিথ্যাচার করেছে ডিফেন্স পক্ষ সেটি এই মামলার রায় পড়েই অনুধাবন করা যায়। বিশেষ করে এই ৮ নাম্বার অভিযোগটির প্রেক্ষিতে যে সাক্ষী এসেছেন সেই সাক্ষ্যের বিস্তারিত পড়লে। আপনারা উপরে নিশ্চই লক্ষ্য করেছেন উক্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমি অনেক সাক্ষীর সাথে সাথে এই মামলার ৭ম সাক্ষী মফিজুদ্দিন পসারীর নাম উল্লেখ করেছি। 

মজার ব্যাপার হচ্ছে এই মফিজুদ্দিন পসারী কিন্তু ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকান্ডের একেবারে চাক্ষুস সাক্ষী। রাজাকার আর পাকিস্তানী হানাদারেরাই সেদিন চিথুলিয়া গ্রামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে মানিক পসারীর বাড়ী থেকে মফিজুদ্দিন পসারী আর ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো এবং রাজাকার ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাবার পথেই হত্যা করে ইব্রাহিম কুট্টিকে আর তখন সেখানে মফিজুদ্দিন পসারীও ছিলেন। সুতরাং এর পরে আর আসলে কিছু বলার থাকে না। এই হত্যাকান্ডের এতবড় চাক্ষুস প্রমাণ থাকার পর বাকী সাক্ষীরা যদি মিথ্যাও প্রমাণিত হয় সেক্ষেত্রে এই একটি সাক্ষীর সাক্ষ্যই আসলে যথেষ্ঠ।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করেছে পাকিস্তানী হানাদার, সাঈদী তো নিজ হাতে হত্যা করেনি, তাহলে সাঈদীকে কেন অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর সাঈদীর রায়ের ৭৬ পাতার শেষ দিকে এবং বাকিটা ৭৭ পাতার শুরুর দিকে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা রয়েছে যে-

He categorically testified that accused Delowar Hossain Sayeedi as a member of razakar Bahini caught them at crime site and ultimately Ibrahim was killed by Pak-Army, under the above circumstances, we find no reason to disbelieve evidence of P.W 7 as to murder of Kutti, destruction of houses of civilians in a large scale by setting fire which constitute crimes against Humanity.

আবার ১১৬ পৃষ্ঠাতেও আমরা দেখতে পাই বিচারকদের ভাষ্য- 

The accused is found GUILTY to the offences of murder, abduction, torture and persecution which fall within the purview of crimes against Humanity as specified in section 3 (2) (a) of the I.C.T. Act of 7973 and he be convicted and sentenced under section 20(2) of the said Act.

এই মামলাতে সাইদীর পক্ষে যেসব সাক্ষী এসেছিলো তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলো আব্দুর রাজ্জাক আঁকন। আরো অনেক সাক্ষী ছিলো। কিন্তু আজকে আমি এই একটা সাক্ষীর সাক্ষ্য দিয়েই প্রমাণ করে দিব যে এই পার্টিকুলার এই অভিযোগে কিভাবে মিথ্যা কথা বলছে সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীরা।

সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যের অসাঞ্জস্যতা/ মিথ্যাচারঃ ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা অভিযোগের অংশ

৮ নাম্বার অভিযোগের প্রেক্ষিতে [ইব্রাহিম কুট্টি ইস্যু] সাঈদীর পক্ষে আসা একজন সাক্ষী হচ্ছে আবদুর রাজ্জাক আকঁন। জেরা ও জবানবন্দী থেকে জানা গেলো যে আব্দুর রাজ্জাক আঁকনের বয়স বর্তমানে হচ্ছে ৬৫ বছর। অতএব মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুর রাজ্জাক আকঁন সাহেবের বয়স ছিলো ২৩-২৪ বছর। ইনি মুলত সাক্ষী দিচ্ছে এই বলে যে, তার ভাগ্নে আবদুল হালিম বাবুল সাঈদীর বিরুদ্ধে যে সাক্ষী এর আগে দিয়েছিলো তা মিথ্যা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবুলের বাসায় কোনো পাক বাহিনী যায়নি, রাজাকার যায়নি এবং আগুন দেয় নাই। জবানবন্দীতে আব্দুর রাজ্জাক বাবুলের বয়স আট কিংবা নয়, এটি বলতে পারলেও জেরার সময় বলতে পারেন নি যে বাবুলের জন্ম কবে। বাবুলের জন্মের আগে তার আরো চার ভাই মারা যায় জন্মের পরপরই। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই বাবুলের বেঁচে থাকাটা ওই পরিবারের জন্য একটা মস্ত বড় স্বরণীয় ব্যাপার হবার কথা ছিলো। কিন্তু কোনো এক কারনে মামা আবদুর রাজ্জাক আকঁন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবুলের বয়স কত ছিলো এটি বলতে পারলেও কবে বাবুল জন্ম নিয়েছে এটি তার মনে নেই। ভালো কথা। আসুন তার জবানবন্দী আরেকটু ভালোভাবে পর্যালোচনা করি।

সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী আব্দুর রাজ্জাক আঁকনের জবানবন্দী এবং মিথ্যাচারঃ ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা অভিযোগের অংশ



“১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের নলবুনিয়ায় একটা ঘটনাই ঘটেছে। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ একদিন শেষ রাত্রে একটা আওয়াজ হয়। আমি অনুমান করলাম এটা গুলির আওয়াজ। তারপর দেখি যে, ফজরের টাইম হয়ে গেছে। আমি আযান দিয়া নামাজ পড়ি। নামাজ পড়ার পর উত্তরদিকে রাস্তার পাশে যাই কোথায় কি হয়েছে জানার জন্য। তখন গিয়ে দেখি উত্তর দিক থেকে সামনের খাল দিয়ে নৌকায় করে ইব্রাহিম কুট্টির লাশ নিয়ে পাড়ের হাটের দিকে আসতেছে। নৌকায় কালাম চৌকিদার, আইয়ুব আলী চৌকিদার এবং হাকিম মুন্সিকে দেখি। এরপর দেখি আরও কয়েকজন লোক খালের পাড় দিয়ে উত্তর দিক থেকে আসতেছে। যে সব লোক আসতেছে তাদের মধ্যে দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, মোসলেম মাওলানা, রুহুল আমিন, মোমিন রাজাকার ছিল। আরও দেখি উক্ত লোকেরা আজু হাওলাদারের বৌ এবং তার ছেলে সাহেব আলীকে বেঁধে নিয়ে আসতেছে এবং পাড়েরহাটের দিকে নিয়া যাচ্ছে। তারপর দিন শুনি আজু হাওলাদারের বৌ বাড়িতে আসে এবং সাহেব আলীকে পিরোজপুরে নিয়ে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে। এটাই আমার বক্তব্য। স্বাধীনতার কিছুদিন পরে শুনেছি যে, ইব্রাহিম কুট্টির বৌ একটা মামলা করেছে” 


সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী আঁকনকে করা ক্রস এক্সামিনেশনের পুরো ডকুমেন্টঃ ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা অভিযোগের অংশ







  • আবদুর রাজ্জাক আকঁন জেরাতে বলছে যে সে তার ভগ্নীপতিকে নিয়ে পালিয়ে থাকত গ্রামের বিভিন্ন বাসায় বা তাদের বাড়ীতে। কিন্তু নামাজ পড়ত আজান দিয়ে। পালানোর নমুনা শুনে আমি খানিকটা হতবাক। তার থেকেও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে ফজরের নামাজের সময় সূর্য পুরোপুরি উঠে না। তখনও আবছা অন্ধকার থাকে সব জায়গায়। কিন্তু সাক্ষী উত্তর দিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই অন্ধকারেই দেখে ফেললেন যে খালে করে নৌকা দিয়ে ইব্রাহিম কুট্টির লাশ নিয়ে আসছে। সাক্ষীর চোখ যেনো এক অটোমেটিক বাইনোকুলার। অন্ধকারের মধ্যে রাস্তা থেকে খালের মধ্যে থাকা লাশ দেখে ফেললেন। এবং সেই লাশের সাথে তিনজন মানুষ বসে ছিলেন। একটা নৌকায় যখন তিনজন মানুষ বসে থাকেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই তিনজন এক সাইডেই বসে থাকবেন না। এটা কমন সেন্স। আমরা যদি ধরে নেই যে নৌকার দুই দিক থেকে মানুষ বসা ছিলো তাহলে সেটি ডিঙ্গিয়েও নৌকাতে কার লাশ ছিলো এটা বোঝা দুষ্কর হবার কথা। কিন্তু এক আশ্চর্য কারনে সাক্ষী আবদুর রাজ্জাক আকঁনের তা হয়নি।
  • আর যেহেতু সাক্ষী গুলির শব্দ শুনেই সেখানে গিয়েছেন ও রাজাকারদের দেখেছেন, স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ভয়ে খুব সামনে যাবেন না ঘটনা দেখতে। দূর থেকে লুকিয়েই দেখবেন। তার ঝুঁকি আরো বেশী। কেননা তার দুলাভাই আওয়ামীলীগ করতেন বলে তিনি জেরাতে বলেছেন। এসব দিক বিবেচনা করে যা বোঝা যাচ্ছে তা হোলো সাক্ষী দূর থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খালে থাকা নৌকা এই অন্ধকারে দেখে এবং নৌকার তিনজন মানুষকে ডিঙিয়ে লাশ যে ইব্রাহিম কুট্টির তা দেখে ফেলেছেন। চমৎকার!!!
  • আবার লক্ষ্য করুন- সাক্ষীর গ্রাম নলবুনিয়াতে কোনো রাজাকার আসেনি বলে জেরাতে বলছেন সাক্ষী। অথচ উপরের জবানবন্দী লক্ষ্য করুন, সেখানে বলা হচ্ছে যে তিনি তিনজন রাজাকারকে দেখেছেন যে আজু হাওলাদারের বউ ও ছেলেকে বেঁধে নিয়ে যেতে পাড়ের হাটের দিকে।
  • আবার জেরাতে গিয়ে লক্ষ্য করুন পাঠক। সাক্ষী বাবুল বলছে যে, যুদ্ধের সময় তার ভাগ্নে মানে বাবুলের আরো দুই ভাই বাহাদুর ও মধু বাড়িতেই থাকতেন। কিন্তু এর পরেই মধুর বয়স জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন মধুর বয়স ৩৫ বছর। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৪১ বছর আগে। মধুর বয়স বর্তমানে ৩৫ বছর। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সময় মধু আর বাহাদুর কিভাবে একসাথে ছিলো? মধুতো হিসাব মতে মুক্তিযুদ্ধের ৬ বছর পরে জন্মেছে।
  • তবে প্রসিকিউশনের আইনজীবিরা নিশ্চই ক্ষতিয়ে দেখে থাকবেন কিংবা হয়ত দেখেছেনও যে রাস্তা থেকে খালের দুরুত্ব, ফজরের সময়ে একজন মানুষ ঠিক কতটুকু দেখতে পারেন সেটার একটি চক্ষু বিশেষজ্ঞ এর মতামত, খাল দিয়ে যদি নৌকা পাড়ের হাটে যায়, তাহলে সে সময় রাস্তা কতটা স্পষ্ট দেখায় ফজরের ওয়াক্তে ইত্যাদি।
  • সাক্ষী জেরাতে আরো বলেছেন যে তিনি তার ভগ্নীপতিকে নিয়ে পালিয়ে থাকতেন বিভিন্ন জায়গায়। এবং পাড়ের হাটের বিভিন্ন রাজাকারের নামও বলতেন। অথচ বাজার করতে তিনি পাড়ের হাটেই যেতেন। বড়ই আজব ঘটনা। পাঠক একটা পয়েন্ট নোট করে রাখবেন যে সাক্ষীকে ঢাকায় খরচ পাতি ইত্যাদি করে নিয়ে এসেছে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর শালা। সুতরাং ঘটনা কি হচ্ছে, টাকা কোত্থেকে আসছে, সাক্ষীর কথা বার্তা আপনারা দয়া করে একটু ভাবুন। আশা করি বুদ্ধিমান মানুষ আপনারা। বুঝতে পারবেন
  • একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী আব্দুর রাজ্জাক আঁকনের জবানবন্দী ও জেরার এই অসামঞ্জস্যগুলো আমার চোখ ধরা পড়লো। সাঈদীর উকিল, ছেলে, শালারা মিথ্যে সাক্ষী নিয়ে এসে জবানবন্দী দিচ্ছে এটা খন পানির মত পরিষ্কার। মিথ্যে সাক্ষী দেবার জন্য আমাদের প্রচলিত আইনেই ব্যাবস্থা নেবার কথা বলা হয়েছে। এরা এতই ভয়ংকর যে মামাকে টাকা দিয়ে কিনে সাক্ষী দেয়াচ্ছে ভাগ্নের বিরুদ্ধে।

ট্রাইবুনালের প্রথম রায়ে বিচারকরা বলেন-



শেষ কথাঃ

পুরো লেখাটি পড়বার পর একজন পাঠকের অবশ্যই একটা নিজস্ব মন্তব্য ও বক্তব্য থাকতে পারে। মতামত, পালটা মতামত থাকবেই। তবে আমার নিজস্ব বিশ্লেষন ও নানাবিধ কাগজপত্র, সাক্ষী ইত্যাদি বিবেচনা করে এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে দেলু একজন রাজাকার, ধর্ষক, গণহত্যাকারী, লুটপাট, অগ্নিসংযোগে একজন এক্সপার্ট অপরাধী। মামলায় উপস্থাপিত সাক্ষ্য, আসা সাক্ষী সব কিছু ভালো করে পর্যবেক্ষন করে এই কথাটি খুব সহজেই বলা যায় যে উক্ত অভিযোগের ক্ষেত্রে সাঈদী সম্পূর্ণ ভাবে একজন দোষী ব্যাক্তি এবং ইব্রাহিম কুট্টিকে তার নির্দেশে ও পরিকল্পনাতেই হত্যা করা হয়েছে। সেই সাথে আরো বলা যায় যে পার্টিকুলারলি এই অভিযোগের ক্ষেত্রে বর্ণিত যে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটিও সম্পূর্ণরূপে সত্য।

এসব সব কারন বিবেচনা করে আমি দৃড় ভাবে বিশ্বাস করি, ট্রাইবুনাল-১ এ সাঈদীর বিরুদ্ধে যে রায় দেয়া হয়েছে, আপীলেট ডিভিশানের মহামান্য বিজ্ঞ বিচারকেরাও এই একই রায় বজায় রাখবেন।


No comments:

Post a Comment