Monday 22 April 2024

সায়েমের ক্ষমতা গ্রহণ এবং জিয়ার ক্ষমতা দখল


ভুমিকা

বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে ঠিক কোন প্রেক্ষাপটে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সালের ২১ শে এপ্রিল ক্ষমতা ছেড়েছিলেন; এই বিষয়েই আজকের এই দীর্ঘ লেখাটি। সায়েমের ক্ষমতা ছাড়বার ৩৭ বছর পূর্তি হলো গত ২১ শে এপ্রিল ২০২৪ ইং তারিখে। 

(উল্লেখ্য যে, আমি উপরে অবৈধ শব্দটি ব্যবহার করেছি এই বিষয়ে উচ্চ আদালতের ৫ম সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হয়েছে, সে রায়কে রেফারেন্স ধরে। উক্ত রায়ে খন্দকার মোশতাক আহমদ, আবু  সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও জিয়াউর রহমানের  শাসনকে অবৈধ ঘোষনা করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এও বলে নেয়া ভালো যে, ৭ম সংশোধনীকেও উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষনা করেছে ফলে এরশাদের ক্ষমতা দখলও উচ্চ আদালতের রায়ের বদৌলতে অবৈধ বলে সূচিত করাই যৌক্তিক ) 

যখনই বিচারপতি সায়েমের অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণ প্রসঙ্গ আসবে ঠিক তখনই স্বাভাবিকভাবেই ১৯৭৫-এর ৩ ও ৭ নভেম্বরে ঘটে যাওয়া সমস্ত বিষয়াদি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কেননা এই বিষয়ের বিস্তারিত আলাপ ছাড়া মোশতাক কেন তার অবৈধ ক্ষমতা ছেড়েছে আর তার পর পরই ঠিক কিভাবে বিচারপতি সায়েম ক্ষমতার প্রাঙ্গনে এসে হাজির হলেন তা বোঝা যাবে না। ৩ ও ৭ নভেম্বরের পেছনের প্রেক্ষাপট দীর্ঘভাবে এই সুনির্দিষ্ট লেখায় না লিখেও এর একটা সারাংশ টানা যেতে পারে সে সময়ের প্রেক্ষাপট বুঝবার জন্য।


অভ্যুত্থানের নায়ক কি বঙ্গবন্ধুর খুনী?


৩ নভেম্বর প্রত্যুষে (২ নভেম্বর দিন গত হয়ে গভীর রাতে) খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থানের ফ্যাক্ট, পর্যালোচনা করা হয় সেটির পুরোচিত্র আমাদের সামনে আসবার পর খালেদ মোশাররফ সাহেবকে একজন মোশতাক বিরোধী ও বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী বলেই মনে হতে পারে যা আসলে তিনি নন। অবশ্য এই মনে হওয়াটি যে কেবল নিছক ঘটনার সারাংশপাঠে ইতিহাস পাঠকদের মনে উঠে আসে তাই নয় বরং সে অভ্যুত্থানের সময়ে এই বিষয়টিই বরং খালেদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এটিকে উপজীব্য করেই জাসদ ও কর্ণেল তাহের খালেদের বিরুদ্ধে (ক) আওয়ামীলীগের উদ্দেশ্য প্রণয়ণকারী (খ) ভারতের অনুচর এবং সাহায্যে সংগঠিত বলে অভিহিত করেছে এবং সেনাবাহিনীর উন্মক্ত খুনে সৈনিকদের লেলিয়ে দিয়েছে। 

[এই দুইটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে দীর্ঘ ও সংক্ষেপ বিশ্লেষন পড়া যেতে পারে কয়েকটি বই থেকে যেমন (১) মেজর জেনারেল মইনুল ইসলামের লিখিত গ্রন্থ- এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্যঃ স্বাধীনতার প্রথম দশক, (২) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইব্রাহীমের লিখিত গ্রন্থ -সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর, (৩) মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদের লিখিত গ্রন্থ- সৈনিক জীবনঃ গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর, (৪) ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেনের রক্তাক্ত দিনগুলো ১৯৭৫-১৯৮১, (৪) মেজর নাসির উদ্দিনের লিখিত গ্রন্থ- বাংলাদেশঃ বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর , (৫) লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এম এ হামিদের লিখিত গ্রন্থ- তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, (৬) কর্ণেল শায়াত জামিলের বক্তব্যে (সুমন কায়সারের টাইপকৃত) লিখিত গ্রন্থ- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য অগাস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, (৭)  বি যেড খসরুর লিখিত গ্রন্থ- দি বাংলাদেশ মিলিটারি ক্যু এন্ড দি সি আই এ লিংক, (৮) শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের লিখিত গ্রন্থ- বলেছি বলছি বলবো, (৯) মতিউর রহমান সম্পাদিত পঁচাত্তরের অস্থির সময়ঃ ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের অকথিত ইতিহাস, (১০) লরেন্স লিফশুলযের লিখিত গ্রন্থ-দি আনফিনিশড রেভ্যুলিউশন, (১১) এন্থনি মাসকারেনহাসের লিখিত গ্রন্থ- আ লিগেসি অফ ব্লাড, (১২) ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের লিখিত গ্রন্থ- বাংলাদেশঃ এরা অফ শেখ মুজিবর রহমান, (১৩)নজরুল সৈয়দের লিখিত গ্রন্থ- নভেম্বর ১৯৭৫, (১৪) সুবেদার মাহবুবুর রহমানের লিখিত গ্রন্থ- সৈনিকের হাতে কলম, (১৫) অধ্যাপক আবু সাইয়িদের লিখিত গ্রন্থ, জেনারেল জিয়ার রাজত্ব, (১৬) এম শফিক রবিনের সম্পাদিত গ্রন্থ- প্রত্যক্ষদর্শীদের দৃষ্টিতে সাতই নভেম্বর ও কিছু অজানা কথা, (১৭) লেঃ কর্ণেল শরিফুল হক ডালিমের লিখিত গ্রন্থ- যা দেখেছি-যা বুঝেছি- যা করেছি, (১৮) আলতাফ পারভেজের লিখিত গ্রন্থ- অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধে কর্ণেল তাহের ও জাসদ রাজনীতি, (১৯) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল যোবায়ের সিদ্দিকীর লিখিত গ্রন্থ-আমার জীবন আমার যুদ্ধ, (২০) কবি নির্ম্লেন্দু গুণের লিখিত গ্রন্থ- রক্তঝরা নভেম্বর, (২১) পংকজ ভট্টাচার্যের লিখিত গ্রন্থ-আমার সেইসব দিন, (২২) নাজমুল আহসান শেখের লিখিত গ্রন্থ- পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর অংশগ্রহণকারী বৈমানিকদের বর্ণনায় বিমান বাহিনীর ভূমিকা, (২৩) মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দীনের লিখিত গ্রন্থ- নভেম্বর ক্যু ৭৫ অন্ধকার সময়ের সংবাদচিত্র, (২৪) এম আর আখতার মুকুলের সমাপদিত গ্রন্থ- আমিই খালেদ মোশাররফ, (২৫) আবীর আহাদের লিখিত গ্রন্থ- জেনারেল জিয়ার রাজনীতি]




বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পেছনে যে কয়জন ক্রীড়ানক ছিলেন খালেদ মোশাররফ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম সক্রিয় ক্রীড়ানক। তিনি হত্যাকারীদের পেছন থেকে অন্যতম সাহায্যকারী ও মদতদাতা ছিলেন। শুধু খালেদ মোশাররফই নন, খালেদের সাথে থাকা এই ৩ নভেম্বরের আরেকজন চরিত্র ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিলও এই হত্যাকান্ডের ঘটনা জানতেন এবং খালেদের নির্দেশেই তিনি ১৫-অগাস্টের দিন তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন বলে আমার ইতিহাস পাঠ ও যুক্তি আমাকে সে কথা জানাচ্ছে। আমার এইসব বক্তব্যের স্বপক্ষে কিছু রেফারেন্স নিয়ে আসা এই ক্ষেত্রে জরুরী।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ৪৬ ব্রিগেড আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে। লেঃ কর্ণেল হামিদের বই থেকে জানা যায় যে তিনি যখন ৪৬ ব্রিগেডে ঐদিন পৌঁছুলেন খালেদের ফোন পেয়ে তখন কর্ণেল শাফায়াত জামিলের ব্যাপক উল্লাস তিনি নিজ চোখেই দেখেছেন। তিনি হামিদকে দেখে বলেছিলেন, ‘ফ্রিডম ফাইটার্স হ্যাভ ডান ইট বিফোর এন্ড দে হ্যাভ ডান ইট এগেইন’[1] এই সময়ে খালেদের ব্যাস্ততা ছিলো দেখার মতন। খুশিতে ডগমগ অবস্থায় তিনি একবার এর সাথে হাত মেলাচ্ছেন, আবার অন্যের সাথে কোলাকুলি করছেন আবার অমুককে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। সি এজ এস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের যেন সেদিন ঈদ লেগে গিয়েছিলো যা তিনি লুকোতেই পারছিলেন না।[2]

১৯৮৭ সালে, মাসিক নিপুন পত্রিকার নভেম্বর সংখ্যায় ফারুক এক সাক্ষাৎকারে পরিষ্কারভাবে জানায় যে ১৫-ই অগাস্টের হত্যাকান্ডের পর তারা খালেদ মোশাররফ থেকে যথেষ্ঠ সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়েছেন। ফারুক সেই সাক্ষাৎকারে বলে-

নিপুনঃ ১৫-ই অগাস্টের অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফের ভূমিকা কি ছিলো?
কর্ণেল ফারুকঃ খালেদ মোশাররফ প্রকৃত দেশ প্রেমিক ছিলেন। ১৫ই অগাস্টের বিপ্লবে ব্যবহৃত ট্যাঙ্কে গোলাবারুদ ছিল না-এটা জেনে তিনি গোলাবারুদের ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয়, খালদে মোশাররফই কর্ণেল রশীদের ঢাকা থেকে যশোরে বদলির আদেশ বাতিল করেছিলেন। বেঙ্গল ল্যান্সারে তিনি আমার ডাইরেক্ট কমান্ডার ছিলেন। আমাদের তৎপরতা সম্পর্কেও অবহিত ছিলেন।[3]
মাসিক নিপুন ম্যাগাজিন, নভেম্বর ১৯৮৭

 

ফারুক ও রশীদের যৌথ লিখিত ‘মুক্তির পথ’ পুস্তিকাতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ফারুক এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। ফারুক বলে-


‘এই প্রসঙ্গে আমরা আর একটি সত্য ঘটনা প্রকাশ করার দায়িত্ব তীব্রভাবে অনুভব করছি। অন্যরকম গুজব যাই থাকনা কেন এবং ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে সাধারণভাবে যে ধারনাই প্রতিষ্ঠিত হোকনা কেন জেনারেল খালেদ মোশাররফ পূর্বাপর ছিলেন ১৫ অগাস্টের বিল্পবী পদক্ষেপের অন্যতম জোরালো সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক’[4]


 


মুক্তির পথ, ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩, পৃষ্ঠা-৭৫

এন্থনি মাসকারেনহাসের, ‘বাংলাদেশঃ দি লিগ্যাসি অফ ব্লাড’ গ্রন্থ অনুযায়ী ১৯৭৫ এর জুলাই মাসে ফারুকের বোন এসে রশিদকে জানায় যে ঢাকা শহরে এটি চাউর হয়ে গেছে যে রশিদের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান হতে যাচ্ছে।[5] 

রশীদ এই সংবাদে অত্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং এই কারনে তার ব্রিগেড কমান্ডার কর্ণেল শাফায়েত জামিলের অফিসেও রশিদের ডাক পড়ে। শাফায়াত জামিলের অফিসে যাবার পর তাকে যখন এইসব ‘চাউর হয়ে যাওয়া গুজব’ নিয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন রশিদ উল্টো কর্ণেল জামিলকে বলেন- 

‘If anything is done to me then I will involve you as the ringleader. I will say that whatever I have done have done under your instructions. I have proof. I will say how you arranged for me to be posted to 2nd Field artillery to be with you in Dhaka after cancelling my transfer to the gunnery school in Jessore.[6]


শাফায়েত জামিলের জড়িত থাকার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর আত্নস্বকৃত খুনী রশীদের স্ত্রী যোবায়দা রশীদ আদালতে চাঞ্চল্যকর এক জবানবন্দী দেয় যেখানে খালেদ মোশাররফ ও শাফায়েত জামিলের নাম উঠে আসে।



 বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারে উচ্চ আদালতে দাখিলকৃত পেপারবুক, পৃ-৭৭৭


উপরের আলোচনাতে হয়ত এটি অনেকটা স্পস্ট যে তৎকালীন সেনাবাহিনীর সাথে বঙ্গবন্ধু বেশ বড় দূরত্বই তৈরী হয়েছিলো এবং এরই সাথে সাথে তাঁর পেছনেই চলছিলো ষড়যন্ত্র এবং হত্যার নিখুঁত পরিকল্পনা। জেনারেল শফিউল্লাহ তার বইতে ঘাতক রশিদের উদ্বৃতি দিয়েই লিখেছিলেন যে, সেনাবাহিনীর মোটামুটি সব সিনিয়র আর জুনিয়র অফিসাররাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা জানতেন। শুধু জানানো হয়নি জেনারেল শফিউল্লাহকে। রশিদ জেনারেল শফিউল্লাহকে আরো নিশ্চিত করেন যে, রশিদরা এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটাতে সিনিয়রদের সাহায্য চাইতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল শাফায়াত জামিল, জিয়া সকলের কাছেই গিয়েছেন এবং তাদের এক ধরনের মৌন সমর্থন পেয়েছেন[7]

যদিও খালেদ মোশারফফের ভাই রাশেদ মোশাররফের ভাই এই ‘মুক্তির পথ’ পুস্তিকায় থাকা বক্তব্যকে ‘সর্বৈব মিথ্যা’ বলে অভিমত দেন এবং তিনি জানান যে তাঁর মা ১৯৭৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর বঙ্গববন্ধুর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মৌন মিছিলের প্রথম সারিতে ছিলেন কারন তাদের পুরো পরিবার বঙ্গবন্ধুর অনুসারী।[8] প্রয়াত রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্যের ভাষ্য এইক্ষেত্রে অত্যন্ত চমকপ্রদ। তাঁর লিখিত গ্রন্থ 'আমার সেইসব দিন' এর ২১০ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করে বলেন যে, এই  মিছিলে রাশেদ মোশাররফ অংশগ্রহন করলেও এখানে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের আনীত 'কাঁদো দেশবাসী কাঁদো' শিরোনামে আনা ব্যানার নিয়ে তিনি প্রচন্ড রাগ করেন এবং এটি নিয়ে লেখকের সাথে প্রবল তর্কাতর্কি হয়।

তবে এই মিছিলের ব্যাপারে খালেদ মোশাররফ তার ক্রোধও প্রকাশ করেন এবং তিনি তার মায়ের ও ভাইয়ের প্রতিও বিরক্ত হন। কেননা এই ক্ষেত্রে খালেদ যেই ভয়টা পাচ্ছিলেন যে এতে করে তিনি একজন আওয়ামীলীগার হিসেবে সূচিত হবেন এবং তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন বলেই পরিচিত হবেন। একই রকমভাবে অভিমত দিয়েছেন খালেদ মোশাররফের স্ত্রী সালমা খালেদ বলেন ১৫-ই অগাস্টের পুরো ঘটনা ‘খালেদ মোশাররফ কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি’[9]। অবশ্য এন্থনি’র বইতে এটিও স্পস্ট ফারুকের জবানিতে লেখা হয়েছে যে ফারুক হত্যাকান্ডের আগেই নিশ্চিত হয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ এই ঘটনার পর চুপ থাকবেন এবং আদতে হয়েছেও তাই।[10]

মৌন মিছিলের সম্মুখভাগে খালেদ মোশাররফের মাকে দেখা যাচ্ছে

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মৌন মিছিলের আরেক অংশ



মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ তাঁর গ্রন্থ ‘সৈনিক জীবন, গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর গ্রন্থে’ ২ তারিখ রাত থেকে শুরু করে ৩ তারিখ সারাদিনের যে ঘটনাবলী তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সেখানে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে ৪ নভেম্বর বিকেলে খালেদ মোশাররফের মা, ছাত্র ইউনিয়নের অন্যান্য নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে যে শোক মিছিল বের করেছিলো সেটিতে এই ৩ নভেম্বরের ক্যু’র কুশীলবরা আতংকিত হয়ে পড়েন। আতংকিত হন এই ভেবে যে এই মিছিলের পর অনেকের সামনে এটিই প্রতিভাত হয়ে উঠবে যে যেহেতু খালেদ মোশাররফ এই ৩ নভেম্বরের ক্যু’র অগ্রভাগে রয়েছেন এবং যেহেতু মোশতাককে অপসারিত করা হয়েছে এবং একইসাথে খালেদ মোশারফফের মা ও ভাই বঙ্গবন্ধুর জন্য শোক মিছিল বের করেছে ফলে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গিয়ে এই অভ্যুত্থান ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামীলীগের-ই ভূমিকায় হয়েছে বলে মনে করা হবে। 

অবশ্য পরবর্তী সময়ে এই দুইটি বিষয়ই মূলত জাসদের কর্ণেল তাহের তার অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কর্মীদের বুঝাতে সক্ষম হন এবং এর প্রেক্ষিতে সৈনিকদের উষ্কে দিয়ে তিনি ক্যান্টনমেন্টে হাজার হাজার লিফলেট বিতরণ করাতে সক্ষম হন যার একটি দীর্ঘ বর্ণনা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অন্যতম সদস্য হাবিলদার আব্দুল হাই মজুমদারের লিখিত প্রবন্ধ, '৭ নভেম্বরঃ এক অভ্যুত্থানকারীর জবানবন্দী' শীর্ষক প্রবন্ধতে স্পস্ট হয়ে ওঠে স[৫-৭ নভেম্বর, ১৯৯৭ ভোরের কাগজ]



বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ফর্মেশন



১৯৯৩ সালের সাপ্তাহিক সুগন্ধা ম্যাগাজিনে[11] ‘মুজিবের নেপথ্য খুনী খালেদ মোশাররফ’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যেখানে দাবী করা হয় লে কর্ণেল ফারুককে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন খালেদ মোশাররফ আর ডালিম-নূর গ্রুপকে করতো জিয়াউর রহমান। 

এই প্রবন্ধে আরো দাবী করা হয়- বঙ্গবন্ধুকে খুনের পর ঘাতক ফারুক-রশীদকে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিলেন খালেদ মোশাররফ এবং এই হত্যাকান্ডের অন্যতম বেনিফিশিয়ারী জিয়াউর রহমান। এই প্রবন্ধে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনমতের একটি সংবাদের বরাত দিয়ে বলা হয় এই হত্যাকান্ডে জিয়া সব কিছু জানতেন এবং খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলের ভূমিকা ছিলো ‘রহস্যজনক’। 

বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমণ হবার পর শফিউল্লাহ খালেদ মোশাররফকে অনুরোধ করেন যে তিনি যেন শাফায়াত জামিলকে বলেন ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের ট্রুপ মুভ করায় ফারুক-রশীদ গংদের আক্রমণের বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য যে সে সময় ফারুকের ল্যান্সার আর রশীদের টু ফিল্ড আর্টিলারীর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবার মত অবস্থাতে ছিলো ৪৬ ব্রিগেডের শাফায়াত জামিল আর শাফায়াত জামিলের অধীনে যে ৪ টি ইনফ্র্যান্টি আর একটি আর্টিলারী রেজিমেন্ট ছিলো, এগুলোর সব কিছুর অধিনায়ক ছিলো শাফায়াত জামিল। শফিউল্লাহ ১৫ অগাস্টে ট্যাংক বাহিনী শহরে ঢুকেছে এই ঘটনা জানতে পারেন মিলিটারী ইন্টেলিজিন্সের প্রধান লে কর্ণেল সালাউদ্দিনের মাধ্যমে। পরবর্তীতে শফিউল্লাহ শাফায়াত জামিলকে টেলিফোন করলে শফিউল্লাহর মনে হয়েছিলো যে শাফায়াতকে তিনি ঘুম থেকে উঠিয়েছেন।[12]

সাপ্তাহিক সুগন্ধা, ১৩ অগাস্ট ১৯৯৩



শফিউল্লাহ খালেদ মোশাররফকে অনুরোধ করেন আক্রমণে যাবার। খালেদ মোশাররফ শফিউল্লাহকে জানান যে, সেখানকার অবস্থানরত সৈনিক খালেদকে আসতে দিচ্ছেনা। এই বক্তব্যে মনে হতে পারে শাফায়াত জামিলের ৪৬ ব্রিগেডও এই হত্যাকান্ডের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে কিন্তু পরবর্তীতে তৎকালীন স্টেশন কমান্ডার লে কর্ণেল আব্দুল হামিদের বরাত দিয়ে উক্ত প্রবন্ধের তথ্যে জানা যায় যে খালেদকে এবং শাফায়াত জামিলকে ৪৬ ব্রিগেডের সৈনিকদের সাথে অত্যন্ত উল্লাসিত অবস্থায় দেখা গেছে।[13] 

খালেদ মোশাররফের ভূমিকা নিয়ে খুবই পরিষ্কারভাবে আরো জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৯ম সাক্ষী কর্ণেল আব্দুল হামিদ। তিনি এই মামলাতে জেরার জবাবে পরিষ্কার করে তাঁর ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’র বক্তব্য নিশ্চিত করে জেরাতে জানান এবং বলেন, ১৫-ই অগাস্টের দিন অপারেশন নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং রক্ষীবাহিনী সহ অন্যান্য সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করে শান্ত রাখতে মহাব্যাস্ত ছিলেন। এমনকি তিনি জয়দেবপুর সেনানিবাসে যোগাযোগ করে খালি ট্যাংকে গোলাবারুদ ভরে দেবার নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছিলেন বলে জানায় কর্ণেল হামিদ।[14]

ফারুক-রশীদের সাথে জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলের আলাদা আলাদা বোঝাপড়া এবং অন্তরঙ্গতা ছিলো। বিশেষ করে ফারুক যেমন খালেদ মোশাররফের প্রতি দূর্বল ছিলো, একইভাবে খালেদ মোশাররফও ঘাতক ফারুকের প্রতি ছিলো দূর্বল। ৩ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুথানের পর সেনাপ্রধান কে হবেন এতা নিয়ে বঙ্গভবনে যখন বিতর্ক চলছিলো তখন ঘাতক ফারুক মামা খালেদ মোশাররফকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে গিয়েছিলো অন্যদিকে খালেদ মোশাররফ এক সময় ফারুককে অনিয়মের মাধ্যমে ফারুককে মুক্তিযদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে[15]। 

যে ট্যাংকবহর নিয়ে ফারুক এতবড় একটি হত্যাকান্ড নেতৃত্ব দিলো সেই ট্যাংকে যে গোলাবারুদ ছিলোনা তা খালেদ মোশাররফ এবং শাফায়াত জামিল জানবার পরেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি এই দুইজন। অন্যদিকে খালেদ মোশাররফ রক্ষী বাহিনীকে বরং চুপ থাকবার পরামর্শ দিয়েছিলেন[16]। 



ঘাতক রশীদ ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরলে তার পোস্টিং হয় যশোরের আর্টিলারী স্কুলে অথচ সেখান থেকে বদলী করে আনে এই খালেদ মোশাররফ। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের অন্যতম পরিকল্পনা ও সংগঠক মেজর নাসির উদ্দিন সাহেবের বইতেও খালেদের ব্যাপারে ভারতীয়দের একটি আশংকার কথা জানা যায়। নাসির তখন প্রশিক্ষনের জন্য ভারতে অবস্থান করছিলেন। ১৫ অগাস্টের ঘটনার পর ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তার কামরায় এসে বারবার জানতে চাইছিলেন নাসিরের কাছে কাকে মনে হয় এই অভ্যুত্থানের মূল মদতদাতা? জিয়া? নাকি খালেদ?

২ শরা নভেম্বর রাত থেকেই মোশতাকের সাথে খালেদের দর কষাকষি শুরু হয়ে যায়। খালেদ চাইছিলেন সেনা প্রধান হতে এবং একই সাথে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে এই খালেদ মোশাররফ-ই মোশতাককে অনুরোধ করে যাচ্ছিলেন যে তিনিই রাষ্ট্রপতি থাকুক। এই কথা আমরা সাপ্তাহিক মেঘনা ম্যাগাজিনে ১৭ অগাস্ট ১৯৮৬ ইং তারিখে দেয়া মোশতাকের একটি সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত জানতে পারি। একইভাবে মেজর হাফিজের উপরে উল্লেখিত গ্রন্থের ১৯৮ পৃষ্ঠাতেও খালেদের এমন চেষ্টার কথা জানা যায়। যদিও পরবর্তী সময় আরেকটি পালটা ক্যু’তে খালেদকে হত্যা করা হয় এবং তাকে ভারতীয় চর হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু ততকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে যে তারবার্তা প্রেরণ করেন ( মার্কিন সরকারের গোপন নথি (উইকিলিক্স থেকে প্রাপ্ত), 1975 November 10, 10:10 (Monday), DACCA 05470 01 OF 02 101306Z) সেখানে তিনি খালেদের উপর আরোপ করা এই তথ্যর ভিত্তি নেই বলে দাবী করেন।


সাপ্তাহিক মেঘনা পত্রিকা, ১৭ অগাস্ট ১৯৮৬

লেখার এই পর্যন্ত যে চেষ্টাটি আমি করেছি তা হচ্ছে ৩ শরা নভেম্বরের ক্যু কোন ক্রমেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যে করা হয়নি তা প্রমাণ করা। খালেদ-শাফায়াত গং ক্ষমতার কেন্দ্রে যেতে চেয়েছিলো এবং তাদেরই অধীনস্তরা ছড়ি ঘুরাচ্ছিলো এবং এই ফাঁকে জিয়া সেনা প্রধান হয়ে গেলো, এই ছিলো খালেদের ও শাফায়াতের ক্ষোভ। ইগো, ক্রোধ আর ক্ষমতার নির্লজ্জ বাসনা এই ব্যার্থ ক্যুর পেছনে মূল চালিকা শক্তি ছিলো। অন্য কিছু নয়। ৭-ই নভেম্বর শের-ই-বাংলা নগরে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফকে আরেক অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার শিষ্যরা নির্মমভাবে খুন করে। সাথে আর হত্যা করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার এবং কর্ণেল নাজমুল হুদাকে। এখানে উল্লেখ্য যে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা যখন একটি ফ্রেন্ডশিপ ফকার বিমানে করে ব্যাংককের পথে যাবার জন্য চট্রগ্রামে যাত্রা বিরতি করছিলো রাত ১১ টায়, এর আগে তখন কর্ণেল হুদা এই খুনীদের যাতে ১০ টায় সৈয়দপুর বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেয়া হয় সেই ব্যাপারে অনুমতি চাওয়া হয় মেজর জেনারেল খালেদের কাছে। কিন্তু খালেদ বঙ্গবন্ধুর খুনীদের নির্বিঘ্নে ব্যাংককে পৌঁছানোর সমস্ত ব্যবস্থা করে দেন ফলে নাজমুল হুদার এই ইচ্ছে আর পূর্ণ হয়নি। 

মোশতাকের পদত্যাগ




১৯৭৫ সালের ৬-ই নভেম্বরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের সাথে খালেদের নেগোসিয়েশন অর্থপূর্ণ না হবার কারনে, মোশতাক তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। কিন্তু এর ঠিক আগেই বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি নির্মম ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে যায়। ৩ শরা নভেম্বর খুব ভোরে খন্দকার মোশতাকের নির্দেশেই কারাগারে আটক অবস্থাতে খুন করা হয় জাতীয় চার নেতাদের।  জেল হত্যা মামলা থেকে জানা যায় সেই খুনের নির্মম বর্ণনা। তাজউদ্দিন আহমদ সহ বাকি তিন নেতাকে যেদিন খুন করতে এলো রিসালদার মোসলেম উদ্দিন সহ আরো চার খুনির দল। তাদের হাতে কালো অটোমেটিক মেশিনগান। সেই মুহুর্তে আমরা চলে যাবো এবং দেখবো কি ঘটছে সেখানে। হাইকোর্টের রায় থেকে [বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিচারপতি আতাউর রহমান খান] আমরা জানতে পারি (৫ নং প্যারাগ্রাফ) আই জি প্রিজন নুরুজ্জামান হাওলাদারের কাছে বঙ্গবভন থেকে একটি ফোন আসে। যেখানে আইজি প্রিজনকে স্পস্টত বলা হয় এই ৫ খুনীর দলকে যেন কারাগারে ঢুকতে দেয়া হয় এবং তাদের যা খুশি তারা যেন সেখানে করতে পারে। আদালতের ভাষায়- 

Mr Nuruzzaman wanted to know the purpose of such segregation of those inmates of the jail, on such query those armed personnel disclosed that they would be done to death; hearing such reply Mr. Nuruzzaman (P.W.3) then wanted to have a telephonic call to the president of the Republic then he made a telephonic call to the President; thereafter the jailor also received a telephonic call from president Mostaq who also desired to have a talk to Mr. Nuruzzaman, the IG (prison) and ultimately talk took place between the president and the IG (prison). Thereafter the DIG (prisons) wanted to know as to what sort of instructions he received from the president in reply Nuruzzaman disclosed that president ordered him to allow the 5 army personnel to do whatever they wanted
মোশতাক জেল কর্তৃপক্ষকে নিজে ফোন করে জানিয়ে দিলো এই খুনীরা যা করতে চায়, তা করতে দেয়া হোক আর তোমরা সরে দাঁড়াও। চুপচাপ থাকো। আদালত বলেন-

'Admittedly, these four leaders were the architects of the liberation of the country and presented to the people the fruits of liberation within a shortest period of time. They organized the unarmed young and adolescent boys to become freedom fighters for liberating the country and fought against an organized Pakistani army equipped with modern sophisticated arms, collected arms for them for fighting with them and convinced the world leaders that they were fighting for political, social and economic independence from the oppressive Government'
আদালত এই জাতীয় চার নেতাকে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের আর্কিটেক্ট বলে অভিহিত করেন। পুরো মুক্তিযুদ্ধকে এই জাতীয় চার নেতা কি করে সংঘঠিত করে এগিয়ে নিয়েছেন এই ছোট্ট প্যারা থেকে আমরা তা জানতে ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি।




ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে জাতীয় চার নেতার এই খুনের কথা তখনও জানতে পারেননি খালেদ মোশাররফ সহ সেদিনের অভ্যুত্থানের নেতারা। এই খবর ততকালীন পুলিশের ডি আই জি আই ই চৌধুরীর মারফত জানাজানি হতেই দৃশ্যপট পালটে যায় দ্রুত। কিন্তু তার আগে খালেদের সাথে বেশ কয়েক দফা দর কষাকষি চলছিলো মোশতাক আর তার সভাসদদের। একবার মোশতাক রাজী হয় তো পরক্ষনেই বেঁকে বসে। খালেদ একটা বলেন, তো মোশতাক আরেকটা বলতে থাকেন। এই পর্যায়ে অভ্যুত্থানের অন্যান্যদের মধ্যে বিরক্তি আর বিষ্ময় উভয়ই দেখা যায়। এই অবস্থানকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন মেজর হাফিজ, মেজর নাসির এবং লেঃ কর্ণেল শাফায়াত। তাঁরা তাঁদের গ্রন্থে এই বিষয়ে দীর্ঘ আলোকপাত করেছেন। অবশ্য উপরে উল্লেখিত মোশতাকের প্রদত্ত সাক্ষাতকারেও এই তিন লেখকের বক্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যে ব্যাক্তি একটি অভ্যুত্থানের নায়ক কিংবা নেতা, তিনি দর কষাকষি করছিলেন ক্ষমতার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে যাওয়া মোশতাকের সাথে। যার বা যাদের কথায় সরকার পরিবর্তিত হতে যাচ্ছিলো তিনিই তখন ব্যাস্ত ছিলেন পতিত প্রেসিডেন্টের কাছে তাঁর র‍্যাংক পরিবর্তন করে সেনাপ্রধান হবার 'আইনি কারেক্টনেস' প্রক্রিয়ার মধ্যে। এই বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে মেজর হাফিজ উদ্দিন তাঁর গ্রন্থে এই অবস্থাকে বিষ্ময়কর বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন-

মেজর হাফিজ উদ্দিন, সৈনিক জীবনঃ গৌরবের একাত্তর-রক্তাক্ত পঁচাত্তর, পৃ-২০৪


একই বিরক্তি আর বিষ্ময় পাওয়া যায় মেজর নাসিরের গ্রন্থেও। তিনি বলেন-

বাংলাদেশঃ বাহাত্তর থেকে পাঁচাত্তর, মেজর নাসির উদ্দিন, পৃ-১৯০


রাজনৈতিক অপরিপক্কতা, দূরদর্শিতা আর শুধু সেনাপ্রধান হিসেবে নিজের আখের গোটানোই যে খালেদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো এটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হওয়া শুরু করলো। এদিকে দেশের মানুষ তখন পূর্ণ অন্ধকারে। কেউ জানেন না কি ঘটছে ক্যান্টনমেন্টে এবং কেনই বা ঘটছে। ফলে ঢাকা তখন হয়ে উঠেছিলো এক গুজবের শহর। জিয়া ফার্স্ট বেঙ্গলের অফিসারদের মাধ্যমে অন্তরীণ হয়ে ঘরে বন্দী আর অন্যদিকে খালেদের এমন হটকারিতা এই দুইয়ে মিলে পরিস্থিতি ক্রমাগত খালেদের বিরুদ্ধেই যাওয়া শুরু করে দিয়েছিলো। খালেদ একটিবারের জন্য প্রয়োজনবোধ করেন নি যে রেডিও বা টিভিতে এই পুরো বিষয়টি জনসাধারণকে জানিয়ে দেয়া জরুরী। অন্যদিকে ৪ নভেম্বরের মিছিল, যেটির কথা উপরেই বলা হয়েছে, সেটির ফলে শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে এই অভ্যুত্থান ভারতের সাহায্যে হয়েছে। 

জেলহত্যার বিষয়টা জানাজানি হবার পর খালেদ মোশাররফ ৪ নভেম্বর সকাল ১০ টায় বঙ্গভবনে হাজির হন কিন্তু সে সময় মোশতাক জানায় বিকেলের ক্যাবিনেট মিটিং-এ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। খালেদ এ কথা শুনে ক্যান্টনমেন্টে চলে আসেন। এই সময় একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, এই যে খালেদ বঙ্গভবনে যাচ্ছেন, মোশতাকের সাথে অনুনয় বিনয় করছেন তাকে সেনাপ্রধান ঘোষনা দেবার জন্য, অত্যন্ত নুয়ে ও ঝুঁকে পড়ে অতি সম্মানের সাথে মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে থেকে যেতে বলছেন, অনুরোধ করছেন, অপেক্ষা করছেন সব কিছুই কিন্তু খালেদের নেতৃ্ত্বে এই রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানকে ও অভ্যুত্থানের নেতাদের হতাশায় পর্যবসিত করে দিচ্ছে। পুরো আবহটাই এমন ছিলো যেন খালেদের সামনে দেশ নেই। দেশের কি হবে সেটি নেই। পেছনের এমন অন্ধকার সময়ের পরে যে আলোর দেখা পাবার আকাংখা এই অভ্যুত্থানের অন্যান্য নায়কেরা দেখেছিলেন তা ক্রমাগত ধূসর হয়ে উঠছিলো। মেজর নাসিরের গ্রন্থ থেকে এমনও জানা যায় যে ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে এরই মধ্যে খালেদকে সরিয়ে দেবার জন্য আরেকটি অভ্যুত্থানের চিন্তাও তখন শুরু হয়ে গিয়েছিলো। [নাসির, পৃ- ১৯৭]



৪ নভেম্বর বিকেলে খালেদ যখন বঙ্গভবনে যান এবং যখন দেখেন যে মোশতাক আর তার সভাসদ লম্বা সময় ধরে মিটিং করছেন, খালেদ তখন আর ধৈর্য্য রাখতে পারেননি। মিটিং রুম থেকে তিনি ওসমানিকে ডেকে আনেন এবং তাঁর সেনা প্রধান হিসেবে আলাপের কতদূর কি হয়েছে জানতে চান। ওসমানী এতে প্রবলভাবে রেগে যান এবং এমন অবস্থাতেই খালেদ ওসমানীর সাথে কথা বলতে বলতে ক্যাবিনেট মিটিং এ প্রবেশ করেন। সেখানে মোশতাক খালেদকে দেখতে পেয়ে উত্তপ্ত ভঙ্গিতে জানিয়ে দেন যে তিনি পাকিস্তানেরত অনেক জেনারেল-ব্রিগেডিয়ার দেখেছেন তার জীবনে ফলে তাকে এসবের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এই সময় শাফায়াত জামিলের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। মেজর ইকবাল, মেজর দীপক, লে কর্ণেল জামিল এই সময়ে ক্যাবিনেট মিটিঙ্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। মেজর ইকবাল মোশতাককে লক্ষ্য করে বলেন, 'আপনি পাকিস্তানী জেনারেল দেখেছেন কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মেজরদের দেখেননি'। ক্যাপ্টেন দীপক তার অস্ত্র তাক করে বসেন মোশতাকের দিকে। [নাসির, পৃঃ১৯৩] অবশ্য মেজর হাফিজের ভাষ্য অনুযায়ী মেজর ইকবাল মোশতাকের দিকে অস্ত্র তাক করে। [হাফিজ, পৃঃ ২০০] দুই গ্রন্থে অস্ত্র তাক করবার কথা এক হলেও কে অস্ত্র তাক করেছেন সে বর্ণনায় দুইজন আলাদা ব্যাক্তির নাম আসে। এই সময় শাফায়াত জামিল সহ বাকিরা অকথ্য ভাষায় মোশতাককে গালাগাল করতে থাকেন। এই মুহুর্তের আরেকটি বর্ণনা পাওয়া যায় শাহ মোয়াজ্জেমের গ্রন্থে। তিনি বলেন-


এই সময় প্রাণ বাঁচাতে মোশতাকসহ অনেক মন্ত্রী, উপদেষ্টারা যে যেভাবে পারেন টেবিলের নীচে, প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেন। চারিদিকে প্রাণ বাঁচাবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। মোশতাকও ঠিক তার পরপর আর একটি শব্দ ব্যয় না করে সমস্ত নথি-পত্রে সাক্ষর করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদত্যাগ করেন। সেনাপ্রধানের র‍্যাংক পরেন খালেদ মোশাররফ।


বিচারপতি সায়েমের আগমন


বাংলাদেশের আইনে প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না। তাহলে সে সময়ের প্রধান বিচারপতি সায়েম কি করে রাষ্ট্রপতি হলেন? মূলত রাষ্ট্রপতি হবার জন্য বিচারপতি সায়েমকে যখন থেকেই অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ থেকে ভাবা শুরু হয়েছে, ঠিক সেইসাথে তাকে বঙ্গভবনে নিয়ে আসবার প্রক্রিয়াও তখন শুরু হয়ে গেছে। মোশতাকের পদত্যাগ পরবর্তী প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করলেও প্রধান বিচারপতির রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া ছিলো আইন বহির্ভূত বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশ ১৫ অগাস্টের পর আইন-কানুন ছাড়াই চলছিলো। অনেকটা অধ্যাদেশ জারি আর কাল্পনিক মার্শাল আইনের সমন্বয়ে এক অদ্ভুত-উদ্ভট দেশের মতন।

খুব সম্ভবত সে কারনেই যখন মন্ত্রী পরিষদ সচিব কুদ্দুস চৌধুরী এই নিয়ে প্রশ্ন তুল্লেন তখন মেজর হাফিজ তাকে 'হরফুন-মাওলা' বা সব কাজের কাজী বা পেছনে মূল মাস্টারমাইন্ড ইঙ্গিত করে জানিয়ে দিলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঠিক যে প্রক্রিয়ায় মোশতাক অবৈধ উপায়ে রাষ্ট্রপতি হওয়া জায়েজ করে নিয়েছিলো ঠিক একইভাবে প্রধান বিচারপতিও রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন। [হাফিজ, পৃঃ ২০৮], একই বক্তব্যের সুর দেখা যায় কর্ণেল শাফায়াত জামিলের বক্তব্যে কিংবা মেজর নাসির উদ্দিনের গ্রন্থেও। মোশতাক মন্ত্রী সভার অধ্যাপক ইউসুফ; প্রধান বিচারপতি থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়া সম্ভব নয়, এমন কথা বলতেই শাফায়াত জামিল বলে ওঠেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মোশতাক যেভাবে প্রেসিডেন্ট হয়েছে সেভাবে প্রধান বিচারপতি থেকেও রাষ্ট্রপতি হওয়া সম্ভব। [নাসির, পৃঃ১৯৩]  পুরো ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এমন যে অস্ত্রের মুখে যিনি ক্ষমতায় রয়েছেন তাকে নামিয়ে দাওয়া আর তারপর পর অধ্যাদেশ জারি করে শুধু নিজের মনের মত কথা বসিয়ে নেয়া আর ইচ্ছেমত কাউকে ধরে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেয়া, এমনই চলছিলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে। মোট কথা যা ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে হচ্ছে সামরিক কর্মকর্তাদের, ঠিক সেভাবেই তাদের ইচ্ছেমত বাংলাদেশ চলছিলো। আইন-আদালত-সংবিধান-নাগরিক-জনতা এগুলো তখন কেবলমাত্র সংবিধানের পাতায় আর আইনের পাতাতেই চোখ বন্ধ করে পড়ে রয়েছিলো। মগের মুল্লুক বলতে মূলত যা বোঝায়, সে সময়টা ছিলো ঠিক তেমন।


ক্ষমতার পালা বদলের মুহুর্তে বঙ্গভবনে সায়েম ও মোশতাক


এই হস্তান্তরের ক্ষেত্রে মোশতাক সামরিক আইনের আদেশে পরিবর্তন এনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব যে কাউকে হস্তান্তরের পদ্ধতি উন্মুক্ত করে দেন।[17] রাষ্ট্রপতির ৮-ই নভেম্বরে ২য় সামরিক ফরমানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি বনে যান। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের ২৯ শে নভেম্বর তৃতীয় সামরিক ফরমান দ্বারা জেনারেল জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। ৭-ই নভেম্বরে জিয়াকে অন্তরীন অবস্থা থেকে কর্ণেল তাহের ও জাসদ তাদের উষ্কে দেয়া ও নিয়ন্ত্রিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে মুক্ত করেন। এই লেখাতে ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের বিস্তারিত চিত্র, ঘটনা প্রবাহ তেমন বিস্তারিত আলোচনা না করবার পেছনে মূল কারনটিই হচ্ছে, এই লেখাটি মূলত সায়েমের ক্ষমতা গ্রহণ এবং জিয়ার সে ক্ষমতাকে কেড়ে নেয়া বিষয়ক। ফলে যতটুকু এখানে এসেছে তা প্রাসঙ্গিকতার খাতিরে।



সায়েমের ক্ষমতা গ্রহণ প্রক্রিয়াও ছিলো বড় অদ্ভুতুড়ে। তিন বাহিনী প্রধান ও শাফায়াত জামিল সহ সেনাবাহিনীর একটি দল বিচারপতি সায়েমের বাসায় যায় এবং সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ নেয়ার জন্য অনুরোধ করে। কেন সায়েম এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন পুস্তকে বর্ণিত ব্যখ্যা বলছে সে সময়ে একজন নিরপেক্ষ ও আস্থা রাখা যায় এমন একজন ব্যাক্তিকেই দরকার ছিলো খালেদ বাহিনীদের। একদিকে প্রধান বিচারপতি অন্যদিকে দলীয় তেমন আনুগত্য নেই, এসব ভেবেই খুব সম্ভবত সায়েম ছিলো সামরিক কর্তাদের প্রথম পছন্দ। অবশ্য এই সময়ে অন্য কারো নাম বিবেচনায় এলে হয়ত তাকেও নিজেদের মনের মত আইন পরিবর্তন ও সংবিধান পরিবর্তন সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি করে ফেলতো সামরিক বাহিনীর এই আলোচিত কর্তারা তা বলা বাহুল্য। আগেই বলেছি এই সময়ে সংবিধান, আইন, রাষ্ট্র সব কিছুই আসলে চলছিলো কার বন্ধুকের কতগুলি, কার কত ক্ষমতা সেটির নিরিখে। কার্যত এই সময়ে আইন কানুন বলতে কিছু ছিলোনা। নির্মোহভাবে বিবেচনা করলে বলা যায় দেড়দিন থেকে দুইদিনের মত দেশে রাষ্ট্রপতিও মূলত ছিলোনা। ছিলো সামরিক উর্দিপরা কর্তারা যারা সে সময় তাঁদের ইচ্ছেমত দেশ পরিচালনা করছিলেন।

বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি হবার জন্য যখন অনুরোধ করা হলো, ইতিহাস বলছে সায়েম সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে এক ধরনের নাটক করেন। নাটকটা হচ্ছে এমন যে তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না, কেন তিনি রাষ্ট্রপতি হবেন, তিনিই বা কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমার ইতিহাসপাঠ বলছে সে সময় উনার মনে যে লাড্ডু ফুটছিলো তা ইতিহাস লেখকদের সবার বক্তব্যেই মোটামুটি পরিষ্কার। অনুরোধের পর ,'একটু পরিবারের সাথে কথা বলে জানাই' বাক্যটি বলে কিছু মিনিটের মধ্যে সামরিক কর্তাদেরকে রাষ্ট্রপতি হবেন বলে অভিমত দেয়াটার মধ্যে কোথায় যেন একটা কৌতুক রয়েছে। [নাসির, পৃ-২০২] এই একই ঘটনার অনেকটা একই বর্ণনা পাওয়া যায় মেজর হাফিজ ও ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত সহ বাকিদের বইতে। 

যদিও জাতীয় জাদুঘরের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পে সালাউদ্দিন আহমেদের কাছে সায়েমের ইংরেজিতে সাক্ষাতকার এবং সায়েমের নিজের লিখিত বই এট বঙ্গভবন~ লাস্ট ফেস গ্রন্থে সায়েম এমনভাবে নিজের কথা লিখেছেন যাতে করে দেশ ও জাতির স্বার্থে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। তিনি ক্ষমতা না নিলে দেশ ও জাতি এই দুটিই উদ্ধার হতোনা। একজন প্রধান বিচারপতি ঠিক কতটা নির্লজ্জ হতে পারে এসব সাক্ষাতকার ও নিজের লিখিত গ্রন্থ পড়লেই বুঝতে পারা যায়। একটি দেশের প্রধান বিচারপতি কি জানতেন না যে মোশতাকের মার্শাল বলে প্রচারিত বিষয়টির আসলে কোনো অস্তিত্বই নেই? তিনি কি জানতেন না যে মোশতাকের ক্ষমতা দখল হয়েছে এই দেশের একটি নির্বাচিত প্রতিনিধির পুরো রক্তের উপর দাঁড়িয়ে করা? তিনি কি জানতেন না যে যেখানে মোশতাকের ক্ষমতা দখলই ছিলো পূর্ণ অবৈধ সেখানে মোশতাক যতই তার ২০ অগাস্টের ফরমানকে পরিবর্তন ও সংশোধন করুন সেটি কার্যত অবৈধই থেকে যায়? তিনি শেষ বয়সে প্রেসিডেন্ট হবার লোভে যা সেদিন ইচ্ছে করে বুঝতে চাননি বা বলেন নি সেটিই কিন্তু বহু দশক পর এসে বাংলাদেশের বিচারলয়ের আরেক বিচারপতি তফাজ্জল হোসেন পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন এই সমস্ত ক্ষমতা দখল যে অবৈধ, সেটি ৫ম সংশোধনী বাতিলের রায়ে উল্লেখ করে। এই রায়ে আদালত যা বলেন তা এখানে প্রাসঙ্গিক বলে কিছু আলোচনা জরুরী।


৯৭২ সালে রাজধানীর পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে মুন সিনেমাহল পরিত্যাক্ত সম্পত্তি হিসেবে রাষ্ট্র এই সম্পতিকে নিজস্ব মালিকানায় নিয়ে নেয়। মুন সিনেমাহলের মালিক, ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস কোম্পানি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে আবেদন জানালে সরকার এই জমিটি পরিত্যাক্ত সম্পত্তি নয় বলে ঘোষনা দেয় এবং তা মূল মালিকের কাছে ফেরত দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সেটি আর না হওয়াতে, মুন সিনেমা হলের মালিক সম্পত্তি ফিরে পেতে ১৯৭৬ সালে একটি রিট আবেদন দায়ের করেন উচ্চ আদালতে। সে সময়েও আদালত মুন সিনেমা হলের মালিককে তাঁর সম্পত্তি ফেরত দেবার নির্দেশ দেন। কিন্তু যেহেতু ওই সময় দেশে সামরিক আইন জারি ছিলো ফলে ১৯৭৭ সালে প্রধান সামরিক এইন প্রশাসকের সামরিক ফরমানের ৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী (যেখানে লেখা ছিলো কোনো আদালতের রায় থাকলেও, সামরিক ফরমানের ৭ অনুচ্ছেদ ‘প্রিভেইল’ করবে। মানে দাঁড়ায়- উক্ত অনুচ্ছেদ আদালতের রায়ের থেকেও সর্বোচ্চ অবস্থায় থাকনে এবং সেটাই পালনীয়। আদালত তাঁর রায়ে বলে-

‘The apprehensions of the framers of the Constitution proved to be right. In 1975, Martial Law was imposed in the country and brick by brick, the various provisions of the Constitution was wrecked by the usurpers. The Second paragraph of the Preamble, the Article 8 and many other Provisions containing the fundamental principles of the State Policy was deleted on April 23, 1977, by the Proclamations (Amendment) Order, 1977 (Proclamation Order No. 1 of 1977), proclaimed by Major General Ziaur Rahman, BU psc, the President and the Chief Martial Law Administrator of Bangladesh’

মুন সিনেমাহল ফেরত না পাওয়ায় জনাব মাকসুদুল হক (মুন সিনেমা হলের সত্ত্বাধিকারী) ২০০০ সালে উচ্চ আদালতে আরেকটি রিট আবেদন করেন। ২০০৫ সালের ২৯ শে অগাস্ট একটি রায়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে দুই বিচারপতির একটি বেঞ্চ ৫ম সংশোধনীকে সংবিধান পরিপন্থী বলে অবৈধ ঘোষনা করেন। উক্ত রায়ের ফলে খন্দকার মোশতাক আহমেদের (১৫/০৮/১৯৭৫-০৬/১১/১৯৭৫), বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্নমদ সায়েমের (০৬/১১/১৯৭৫-২১/০৪/১৯৭৭) এবং জেনারেল জিয়া’র (২১/০৪/১৯৭৭-০৯/০৪/১৯৭৯) পর্যন্ত, অর্থ্যাৎ ১৫/০৮/১৯৭৫ থেকে ০৯/০৪/১৯৭৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে বিরাজমান সকল সামরিক শাসনকে অবৈধ ও ‘শুরুতেই বাতিল’ বলে উল্লেখ করা হয়। অবশ্য জনস্বার্থে করা কিছু বে-আইনী কাজকে আদালত মওকুফ করে দেয়। আদালত বলেন-

(i) The Constitution (Fifth Amendment) Act, 1979 (Act 1 of 1979) is declared illegal and void ab initio, subject to condonations of the provisions and actions taken thereon as mentioned above

হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র আপীল করে এবং আপীলেট ডিভিশানে শুনানীর আগেই সরকার পরিবর্তিত হয়। পরবর্তীতে রাষ্ট্র 'লিভ টু আপিল' দায়ের করেছিলঠিক কিন্তু ৩ মে ২০০৯ সরকার সে আবেদন প্রত্যাহার করে নেন। এই মামলাটি আর না চালাবার সিদ্ধান্ত নিলে উক্ত মামলায় বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও জামাতের তিন আইনজীবি এই মামলার পক্ষভুক্ত হবার জন্য আবেদন করেন। ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারী তারিখে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তোফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে আপীলেট ডিভিশানের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ হাইকোর্টের মূল রায়কে বহাল রেখে সেখানে নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণ ও কিছু সংশোধনী দেবেন এই মর্মে ঘোষনা দেন। এই ঘোষনার পর একই বছরের, অর্থ্যাত ২০১০ সালের ২৭ শে জুলাই আপীলেট ডিভিশান ৫ম সংশোধনীকে বাতিলের রায়কে বহাল রেখে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। হাইকোর্ট এই পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ও ‘শুরুতেই বাতিল’ বলতে গিয়ে মার্শাল ল নামের কোন ধারনা আমাদের দেশের সংবিধানে বা আইনে নেই বলেই অভিমত দেন। আদালত তাঁর রায়ে বলেন,

766. The very endeavor to change the basic features of the Constitution by the Martial Law Proclamations was illegal, void and non est. in the eye of law. By the said Martial Law Proclamations, the secular Bangladesh was transformed into a theocratic State and thereby not only changed one of the most basic and fundamental features of the Constitution but also betrayed one of the dominant cause for the War of Liberation of Bangladesh.
সংবিধানকে সামরিক আইনের অধীনে এনে এর মৌলিক চরিত্রকে সংশোধন করা আইনের চোখে অবৈধ এবং বাতিল। এসব সামরিক আইনের ফলে একটি ধর্ম্নিরএক্ষ বাংলাদেশ ধর্মভিত্তিক গোঁড়া দেশের রূপ নিয়েছে যেটি ছিলো মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সাথে স্পস্ট বেঈমানী করা। একইভাবে ৫ম সংশোধনীর রায় দিতে গিয়ে আপীলেট ডিভিশান হাইকোর্ট বিভাগের কিছু বিষয়ের উপর সংশোধনী দেন এবং কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্তও করেন। আপীলেট ডিভিশান বলেন-

191. According to the spirit of the Preamble and also Article 7 of the Constitution the military rule, direct or indirect, is to be shunned once for all. Let it be made clear that military rule was wrongly justified in the past and it ought not to be justified in future on any ground, principle, doctrine or theory whatsoever. Military rule is against the dignity, honour and glory of the nation that it achieved after great sacrifice; it is against the dignity and honour of the people of Bangladesh who are committed to uphold the sovereignty and integrity of the nation by all means; it is also against the honour of each and every soldier of the Armed Forces who are oath bound to bear true faith and allegiance to Bangladesh and uphold the constitution, which embodies the will of the people, honestly and faithfully serve Bangladesh in their respective services and also see that the Constitution is upheld, it is not kept in suspension or abrogated, it is not subverted, it is not mutilated, and to say the least it is not held in abeyance and it is not amended by an authority not competent to do so under the Constitution.
আপীলেট বিভাগের অবস্থান খুব স্পস্ট। তঁদের বক্তব্যের ‘মর্মার্থ’ বা মোদ্দা কথা হচ্ছে সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং অনুচ্ছেদ ৭ বিবেচনায় সামরিক বিধি বা কোনো নির্দেশনা একেবারে সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হিসেবে বিবেচিত হবে। অতীতে এই সামরিক আইন-বিধি ইত্যাদিকে ভুলভাবে সঠিক বা বৈধ করা হয়েছে কিন্তু এটিকে ভবিষ্যতে এই সামরিক আইনকে এভাবে যে কোনো কারনেই অতীতের মত সঠিক বা যথার্থতা প্রধান করা যাবে না যে কোনো তত্ব, নীতিমালা ইত্যাদির কথা বলে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই মহান আত্নত্যাগের যে মূল্যমান এই সামরিক শাসন সেটির প্রেক্ষিতে খুবই অসম্মানের। এটি বাংলাদেশের মানুষের আত্নমর্যাদারও পরিপন্থি। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে হাইকোর্ট মনে করে তাঁরা এই দেশের সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করবার জন্য এবং দেশের মাঁথা উঁচু করবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাঁদের মাধ্যমেই যখনেমন সংকীর্ণ কাজগুলো করা হয় বা অবৈধ পদ্ধতিগুলো বেছে নেয়া হয় তখন তা হয় অত্যন্ত লজ্জার এবং দেশের প্রতি তাদের চুক্তি ভঙ্গের সামিল। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা দেশের সংবিধানকে সমুন্নত রাখবে এবং এটাও লক্ষ্য রাখবে যে সংবিধান যেন তাদের কর্মকান্ডের ফলে ক্ষুদার্থে পরিণত না হয়ে তার সর্বোচ্চ মর্যাদা হারায় এবং এমন কারো হাতে না পড়ে যারা এটিকে সংশোধিত করে এটিকেই বরং কারো অধীনস্থ করে তোলে।

দি মাস্টারমাইন্ড

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের অন্যতম কুশীলব ও মাস্টারমাইন্ড জিয়া শুধু প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসবেই যে নিরাপদ ও স্বস্তিবোধ করছিলেন তা নয় বরং সায়েমের পদটাতে যাবার তার তাড়না বগু আগ থেকেই। যে তাহের ১৯৭৫ সালের ৭-ই নভেম্বর জিয়াকে বাঁচিয়ে এনে নতুন জীবন দিলেন সেই তাহেরকে খুন করেই জিয়া তার সামনের রাস্তা আরো প্রশস্ত করতে চাইলেন এবং নিজের সত্যকারের 'জাত' চেনালেন। বঙ্গবন্ধুর খুনের মদতদাতা ও অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে নিজেকে ন্যস্ত রেখে প্রাথমিকভাবে হাত পাকানো এবং তার কিছুদিনের ভেতরেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্ণেল তাহেরকে বিচারের নামে খুন এই দুই ঘটনায় জিয়া ততদিনে খুন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ হয়েছে। তার সামনে থেকে আস্তে আস্তে দূর হয়েছে নানান বাঁধা। এইবার ক্ষমতায় যাবার পালা। ১৯৭৫ এর ৭-ই নভেম্বরের পর বিচারপতি সায়েমের হাতে ক্ষমতার গল্পটা মূলত আসলে গল্পই। পেছন থেকে সমস্ত কলকাঠি জিয়াই নেড়ে যাচ্ছিলো এবং সে সময়ের কেবিনেটে থাকা বেসরকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই পরোক্ষভাবে চাপ প্রয়োগ করে জিয়ার কাছে ক্ষমতা ন্যস্ত করে সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করে [বঙ্গভভনে শেষ দিনগুলো, পৃষ্ঠা-৩৫, আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মাওলা ব্রাদার্স]

কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার ভূমিকাও আসলে এখানে বেশ প্রাসঙ্গিক। কেননা সায়েমের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবার যে ঘটনা সেটির আয়োজন তো অনেক আগের থেকেই। জেনারেন শফিউল্লাহ ১৯৭৩ সালে যখন সেনাবাহিনীর চীফ হলেন, এই পদ পেয়ে শফিউল্লাহ ভীত হয়ে পড়েন। যদিও বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ট্রায়ালে তিনি এই ভীত শব্দকে ‘প্রতিবাদ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং শফিউল্লাহর ভাষ্য অনুযায়ী তিনি এই পদোন্নতির ‘প্রতিবাদ’ করেছিলেন।

একটা কথা বরাবরই আমার কাছে অত্যন্ত দূর্বোধ্য যে, কাউকে পদোন্নতি দিলে সেই ব্যাক্তি সেটি না নিয়ে ঠিক কিভাবে প্রতিবাদ করেন। সেই ব্যাক্তি অনীহা প্রকাশ করতে পারেন, বিনীতভাবে সেই পদ না নিতে পারেন কিন্তু 'প্রতিবাদ' আবার কেমন ধরনের শব্দ? কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ট্রায়ালে শফিউল্লাহর জবানবন্দীতে তিনি এই শব্দটিই ব্যবহার করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যদিও শফিউল্লাহকে বলেছিলেন অনেক সিদ্ধান্ত থাকে যা রাজনৈতিক এবং সে কারনেই শফিউল্লাহকেই সেনাপ্রধান হিসেবে বেছে নেয়া। [সুত্র-১]
শফিউল্লাহর নিজের জবানীতেই আমরা জানতে পারি পদোন্নতি পেয়েই তিনি তার বন্ধু জিয়াকে ফোন দেন [সূত্র-২] এবং এই পদোন্নতির সংবাদ জানান। শফিউল্লাহর এই ফোন নিছকই এক বন্ধুকে আনন্দের সংবাদ জানাবার জন্য যে নয় সেটি শফিউল্লাহর বক্তব্য থেকেই খুবই পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়। 

এই ফোন কল ছিলো একজন ভীত-কাপুরুষের ফোন কল যেখানে নিজেকে ‘অপরাধী ও অযোগ্য’ মনে করা এক মানুষ তার চাইতে ‘যোগ্য’ মনে করা ও যাকে ‘সব সময় ভয় পেয়ে এসেছে’ সেই মানুষটির অভিব্যাক্তি বুঝবার জন্যই ছিলো সেই ফোন কল। এই ফোন পেয়ে জিয়া টেলিফোনের ওপাশ থেকে ‘ওকে শফিউল্লাহ, গুড বাই’ বলে ফোন রেখে দেন। [সূত্র-৩]

বন্ধু শফিউল্লাহকে ‘অভিনন্দন’, ‘ধন্যবাদ’, ‘ওয়েল ডান’ কোনো শব্দেই জিয়া ভূষিত করেনি। ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দেয়া আমার দৃষ্টিতে এক ধরনের উগ্রতার/রুড বিহেইভিয়ার-এর পরিচায়ক এবং পরিষ্কারভাবে জিয়া যে ক্রোধান্বিত ছিলো সেটির স্পস্ট ইঙিত আমাদের জানিয়ে যায়। জিয়া সেনাপ্রধান হতে চেয়েছিলো এই ধারনাটি আজকে ২০২২ সালে এসে আমার পঠিত প্রতিটি তৎকালীন সময়ের গ্রন্থ, লিখিত ইতিহাস সু-স্পস্টভাবে সাক্ষ্য দেয়। জিয়াকে সেনাপ্রধান ‘না করে’ বঙ্গবন্ধু সরকার শফিউল্লাহকে কেন সেনপ্রধান বানিয়েছেন এই ব্যাপারটি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর এত বেশী পরিষ্কারভাবে সামনে এসে যায় যেটিতে আর পরবর্তী প্রশ্নও করতে হয় না। তবে বঙ্গবন্ধু সরকার জিয়াকে প্রধানের কাছেই রেখেছিলেন। নতুন পদ তৈরী করে রেখেছিলেন 'ডেপুটি চীফ' হিসেবে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই যে আমি ‘না করে’ শব্দটা ব্যবহার করেছি এটিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদোন্নতি’র ক্ষেত্রে সরকারের কোনো দায়কে কি ইঙ্গিত করে? অর্থ্যাৎ বঙ্গবন্ধু সরকার কি বাধ্য ছিলেন অমুক কে সেনাপ্রধান করতে হবে এই এই ক্রাইটেরিয়া পূরণ করতঃ কিংবা এমন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম কি আসলে ছিলো? আমার জানা মতে; ছিলোনা। আর যদি থাকেও তাহলে জিয়া আর শফিউল্লাহর ক্ষেত্রে দুইজনের পজিশন, অবস্থান, মুক্তিযুদ্ধকালীন হিসেব-নিকেশ একই রকম বলা যেতে পারে। ফলে বঙ্গবন্ধু সরকারের সামনে নানাবিধ অপশনের মধ্যে শফিউল্লাহকে বেছে নেয়াটা আইনী, কনভেনশনাল কোনোদিকেই অন্যায় ছিলোনা।

শফিউল্লাহর উল্লেখিত জবানবন্দীতেই আমরা স্পস্ট দেখতে পাই জিয়া নানাভাবে শফিউল্লাহকে তার পদে অযোগ্য দেখাবার জন্য বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করে যাচ্ছিলো। এটি যেমন শফিউল্লাহ তার জবানীতে আমাদের জানাচ্ছেন যে তিনি তা শুনেছেন একইভাবে সরাসরি সোর্স উল্লেখ করে শফিউল্লাহ আমাদের জানাচ্ছেন যে খোদ বঙ্গবন্ধু তাঁকে এসে এই কথা বলেছেন। [সূত্র-৪]।

শফিউল্লাহ ১৯৭৫ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে যখন সেনাপ্রধান নির্বাচিত হলো, জিয়ার ক্রোধ আরো প্রবলভাবে বেড়ে যায় এবং জিয়া শুরু থেকেই মনে করে শফিউল্লাহর থেকে জিয়া অনেক বেশী ‘বেটার’ সেনাপ্রধান পদটির জন্য। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের আরেক সাক্ষী কর্ণেল শাফায়াত জামিল তার নিজের জবানবন্দীতে তো জিয়ার ভূমিকা বলেনই উপরন্তু শফিউল্লাহর জবানবন্দীতেও আমরা দেখতে পাই তিনি (জামিল) শফিউল্লাহকে এসে বলেছেন যে, যা কিছু ঘটে গেছে বা ঘটছে, তার পুরোটার পেছনে রয়েছে ‘ডেপুটি চীফ’ অর্থ্যাৎ জিয়া। [সূত্র-৫] জিয়া সেনাবাহিনীতে প্রাক ১৫-ই অগাস্ট ১৯৭৫ পর্যন্ত ছিলেন একজন অসম্ভব রকমের ‘মিচকা শয়তান’ এবং খুনের পরিকল্পনাকারী। তলে তলে বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরকে পরামর্শ দেয়া, রাস্তা দেখিয়ে নানাভাবে সাহায্য করা এগুলো ছাড়াও তার একটা প্রধান কাজ ছিলো ‘চোগলখুরি’ করা। এটি একটা প্রচলিত বাংলা শব্দ। অনেকেই বুঝবেন সে কারনেই ব্যবহার করেছি।

অনেকেই জানবেন এবং স্বীকার করবেন যে একটা কাজের মধ্যে বা অফিসে এমন দুই একজন থাকেন যাদের কাজই হচ্ছে এক কলিগের সাথে আরেক কলিগের প্যাঁচ লাগানো, বসের কাছে গিয়ে অন্য কলিগের নামে দূর্নাম রটানো এই জাতীয়। জিয়ার চরিত্র ছিলো একেবারেই তেমন।

সে সময়ে নানা কারনে সেনাবাহিনী থেকে যত সেনা অফিসারের চাকুরী গিয়েছে এবং যতগুলো অফিসারকে নিয়ে সমস্যা তৈরী হয়েছে কোনো এক অদ্ভুত কারনে আমরা দেখতে পাই জিয়ার কাছেই সেসব অফিসাররা কোননা কোনো ভাবে আশ্রয় পেয়েছে এবং তার সাথেই যোগাযোগ রেখেছে।
আমরা এই কথার সত্যতা পাবো বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় জিয়ারই খুব বিশ্বস্ত বন্ধু লে কর্ণেল আব্দুল হামিদ সাহেবের জবানীতে। (ফুটবলার কায়সার হামিদের বাবা)

হামিদ সাহেব এই মামলার নবম সাক্ষী ছিলেন। তিনি তার জবানবন্দীতে পরিষ্কার করে আমাদের জানান যে, ১৪-ই অগাস্টের বিকেলে হামিদ সাহেব তাঁর বন্ধু জিয়া, কর্ণেল খুরশিদ ও কর্ণেল মামুনের সাথে লন টেনিস খেলবার সময় টেনিস কোর্টের আসে পাশে বঙ্গবন্ধুর খুনী নুর-ডালিমদের ঘোরাঘুরি করতে দেখেন। এরও আগে এই চাকুরীচ্যুত অফিসারদের এখানে ঘোরাঘুরি করতে দেখে চীফ শফিউল্লাহর নির্দেশে নূর-ডালিমদের এখানে আসতে নিষেধ করতে গিয়েই তিনি জানতে পারেন জিয়ার সাথে দেখা করতে ও তার অনুমতি নিয়েই নূর ও ডালিম এই টেনিস কোর্টে আসা-যাওয়া করছে। [সূত্র-৬]

একই সাথে এই অংশে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ হওয়া গোপনীয় মার্কিন নথির রেশ ধরে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারীতে বঙ্গবন্ধুর খুনী ফারুক রহমান মার্কিন এম্বেসিতে যান এবং ১৯৭৩ সালের ১১-ই জুলাই আরেক খুনী মেজর রশীদও আকষ্মিকভাবে মার্কিন দূতাবাসে যান জিয়াউর রহমানের পক্ষে। সেই সময় ‘আরমামেন্টস প্রকিউরমেন্ট কমিটি’ নামে সেনাবাহিনীতে একটি কমিটি গঠিত হয় যার প্রধান ছিলো জিয়া।

অবমুক্ত হওয়া মার্কিন নথিতে পরিষ্কারভাবে ফারুক ও রশীদের জিয়ার পক্ষে এই দূতাবাসে যাওয়া এবং অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে মার্কিন পলিসি জানবার আলাপ আমরা জানতে পারি। এই বিষয়ে মার্কিন নথিতে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে নিউবেরি, ক্লিভ ফুলার্স প্রমুখদের পত্র-চালাচালি দেখে। বিশেষ করে রশীদ মার্কিন দূতাবাসের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিভাগের কর্মকর্তার সাথে যে অস্ত্র সরবরাহের কথা বা যেসব অস্ত্র মার্কিনিদের কাছে চান তার মধ্যে রয়েছে ১০৫ থেকে ১৫৫ মিলিমিটার কামান ও হালকা বিমান বিধ্বংসী কামান। এই ঘটনার পর অর্থ্যাৎ রশীদের ১১ জুলাই ১৯৭৩ সালের মার্কিন দূতাবাসের গমনের পর ১২-ই জুলাই ১৯৭৩-এ ফারুক রহমানও পুনরায় মার্কিন দূতাবাসে যান এমং নিজেকে 'আর্মার্ড কোরের প্রধান' হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার, হালকা ট্যাংক ও আম্ফিভিয়াস বা উভজান সরবরাহের বিষয়ে কথা বলেন। মাথায় রাখতে হবে এই দুই খুনী ভায়রাভাই কিন্তু একজনের কথাই সেখানে গিয়ে বলেন, আর তার নাম হচ্ছে জিয়াউর রহমান। [সূত্র-৭]

এখানে আরেকটি তথ্য জরুরি। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনী মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধুকে ঘরোয়া পরিবেশে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করতো এবং জিয়াকে ‘বস’ বলে। জিয়াকে আর্মি চিফ না করবার কারনে ডালিম তার লিখিত বই ‘যা দেখেছি, যা বুঝেছি, যা করেছি’তে তার সমস্ত ক্রোধ উগড়ে দেন। [সূত্র-৮]। 

ডালিমের এই একই বই থেকে আমরা জানতে পারি ডালিম বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে জিয়াকে চীফ করবার জন্য ক্রমাগত অনুরোধ করতে থাকেন এবং বঙ্গবন্ধু এই সময়ই জানান যে জেনারেল ওসমানীর পরামর্শেই জিয়াকে চীফ করা হয়নি [সূত্র-৯] একইভাবে জিয়াকে যখন ডিফেন্স এটাচে হিসেবে বার্মায় পাঠাবার কথা হচ্ছিলো সেই সময় ডালিম নিজে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে বারবার অনুরোধ করতে থাকে যে জিয়াকে যেন কোনোভাবেই বার্মায় পাঠানো না হয়। এবং ডালিম জানাচ্ছে সেদিন তার অনুরোধের প্রেক্ষিতেই জিয়ার বার্মা ট্রান্সফার আর হয়নি।

ডালিম বঙ্গবন্ধুর বাসায় সেদিন যখন যায় শেখ কামালের সাথে ঘটনা চক্রে তার সাথে দেখা হয়। কথার এক প্রসঙ্গে যখন কামাল হাসির ছলে বলেন 'আপনি আব্বার সাথে খালি ঝগড়া করেন', তখন ডালিম জবাব দেয় যে, সে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে বলেই দাবী নিয়ে কথা বলে। [সূত্র-১০]

বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসার কথা বলা একদিকে আর অন্যদিকে জিয়ার সাথে গোপনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মিশন সাজানোর অংশ হিসেবে তাকে বার্মায় ট্রান্সফার বন্ধ করা তাও খোদ বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে, ইতিহাসে এইসব নির্মম প্রতারনা, এইসব সমস্ত বেঈমানী লেখা থাকবে। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, ডালিম নিজের হাতেই যেই বই লিখেছে, সেই বইতেই ডালিমের চরিত্র ডালিম নিজেই উন্মোচন করেছে। সাথে জিয়ারও। জিয়াকে শুধু ডালিমই ‘বস’ ডাকতো না, ডাকতো আরেক খুনী নূরও। জিয়া যে গোপন আলাপ হলেই নূর-ডালিম গংদের বাসায় ডাকতো সেটাও জানা যায় ডালিমের গ্রন্থে এবং বার্মায় ট্রান্সফারের পুরো বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য জিয়া বঙ্গবন্ধুর দুই খুনীকে ডেকে নিয়ে যান বাসায়। [সূত্র-১১]

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ঠিক ৯ দিন পর শফিউল্লাহকে সরিয়ে দিয়ে জিয়া সেনাপ্রধান হয়। তার দীর্ঘদিনের কাংখিত পদ যেটির জন্য জিয়া এমন কোনো ষড়যন্ত্র নেই যেটি করেনি, এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেটি করেননি। জিয়া যখন তার এই পদোন্নতির জন্য খুনী মোশতাকের কাছ থেকে অফিসিয়াল পত্রটি পান সে সময়ে যে কয়েকজনের সাথে শুরুতেই জিয়া তার উল্লাস প্রকাশ করেন তাদের একজন জিয়ার বন্ধু লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আব্দুল হামিদ পি এস সি। শফিউল্লাহকে তখনও জানানো হয়নি। সরকারি চিঠি জিয়ার হাতে এবং তাতে জিয়া তার উল্লাস কোনোভাবেই দমিয়ে রাখতে পারছিলোনা।

হামিদকে দেখেই জিয়া ডাঁট মেরে গর্জে উঠলো, ‘Salute properly you guffy, you are entering chief of staff’s office’. [সূত্র-১২] হামিদকে এও নির্দেশ দেয়া হলো যাতে পরদিন সকালে সমস্ত জওয়ানকে একত্রিত করা হয় কারন জিয়া তাদের প্রতি নির্দেশ দেবে। জওয়ানরা জড়ো হলে জিয়া চিৎকার করে মঞ্চ থেকে বলে উঠে, ‘আজ থেকে আমি চীফ অফ স্টাফ। আপনারা সবাই আপনাদের ডিসিপ্লিন ঠিক করেন, তা না হলে কঠোর শাস্তি হবে’ এই বলেই জিয়া মঞ্চ থেকে নেমে পড়ে।

হামিদ সাহেব জিয়ার সাথে অফিসে গিয়ে বসতেই অবাক হয়ে জিয়াকে জিজ্ঞেস করেন যে এতটা বাজেভাবে চড়াগলায় কথাগুলো না বললেই হতো না? জবাবে জিয়া বলেন, ‘শাট আপ। এটা তো কেবল শুরু। দেখনা আমি কিভাবে সব ব্যাটাকে ডিসিপ্লিন শিখিয়ে দেই’ [সূত্র-১৩] জিয়া ‘সব ব্যাটাকে’ শুধু নয় পুরো দেশকেই এক গভীর অন্ধকারের শিক্ষা দিয়ে গেছেন আসলে। এই প্রসঙ্গে আরো একটি সূত্রের বক্তব্য দেয়া যেতে পারে। জিয়া তার নিহত হবার ঠিক একদিন আগে চট্টগ্রামে আসেন এবং রাস্তার বেহাল অবস্থা দেখে গাড়িতে থাকা চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরীকে অত্যন্ত রাগত কন্ঠে জানিয়ে দেন ‘Bangladeshis need to learn discipline’ [সূত্র-১৪]।



জিয়ার এই যে এমন এক ক্ষমতার দিকে যাত্রা সেটি বাংলাদেশের ইতিহাসকে বারবার বদলাতে বদলাতে গিয়েছে। জিয়া কিংবা জিয়ার সমর্থকেরা বার বার বলে এসেছে ‘সময়ের প্রয়োজনে’ কিংবা ‘জাতির কঠিন বা নাজুক সময়ের’ মুহূর্তে জিয়া ক্ষমতা দখল করেছে। জিয়ার এই ক্ষমতা দখল আর খুনের ইতিহাসও দীর্ঘ। এই লেখার বিষয় বস্তুতে এত দীর্ঘ আলাপের হয়ত প্রয়োজন নেই কিন্তু প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু কথা এসে যায়। Lawrence Lifschultz তাঁর 'Bangladesh: The Unfinished Revolution' গ্রন্থের ৮ নাম্বার পাতায় পরিষ্কার করে লিখেছেন ৩ নভেম্বর রাতে জেনারেল জিয়া যখন বুঝতে পারে জেনারেল খালেদ মোশাররফ জিয়াকে ঘিরে ফেলেছে ঠিক তখন পাগলের মত হয়ে জিয়া তাহেরকে ফোন করে এবং তাঁর কাছে সাহায্য চায় বাঁচানোর জন্য। লিফশুলজের ভাষায়-

'Zia awoke in his quarters, he made an urgent and desperate call to the outskirts of Dacca. The man on the other end was Abu Taher, once a close personal friend and battlefield comrade from 11th Sector. Zia reportedly appealed to Taher to do something. This time Zia's own life was at risk. The conversation was never completed for the line was cut.' [Bangladesh: The Unfinished Revolution', Page-8, Para 3]

মানে দাঁড়ায় জেনারেল খালেদের ব্রিগেডের কাছে জিম্মি হবার পর-পরি জিয়া তাহেরের কাছে প্রাণ ভিক্ষার জন্য আবেদন জানায় এবং দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি তাহের জিয়াকে বাঁচাতে উদভ্রান্তের মত সমস্ত চেষ্টাই করে। লিফশুলজ আবার বলেন-

There were to be 'two prongs' to the uprising. On the evening of November 6th, at a meeting chaired by Taher which included representatives from every military unit in the capital, final instructions were issued for the first stage of the revolt. Simultaneously orders went out to others cantonments around the country. In the First Prong Major General Zia was to be rescued from detention, and if at all possible, Brigadier Khaled Musharraf and his associates were to be captured alive. [Bangladesh: The Unfinished Revolution', Page-9, Para 2]

লেখকের ভাষ্যে ব্যাপারটা একেবারেই পরিষ্কার যে এই বন্দিদশা থেকে যিয়া তাহেরকে ফোন দেয় আর তাহের-ই বাঁচাতে চলে আসে জিয়াকে। তাহের সমস্ত পরিকল্পনা এবং পরিকল্পনার দুইটি দিকও বিবেচনায় রাখা হয়। জিয়া এই দেশের প্রেসিডেন্ট হবার সমস্ত বাসনা বুকে পুষে রেখেছিলো বহু আগেই। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের সমস্ত পরিকল্পনা জানার পরেও তার চুপ করে থাকা ছিলো নিজস্ব আকাঙ্ক্ষার সর্বশেষ সিঁড়িতে পা রাখবার প্রাথমিক পদক্ষেপ। জিয়ার এই বাসনার কথা আমরা জানতে পারি জিয়ার-ই বন্ধু-কোর্স মেট লেঃ কর্ণেল (অবঃ) এম এ হামিদ পি এস সি সাহেবের গ্রন্থ 'তিনটি সেনা অভুথ্যান ও কিছু না বলা কথা'-তে। লেঃ কর্ণেল হামিদ বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনী রশিদের সাথে সাক্ষাৎকারের উদ্বৃতি দিয়ে তাঁর ঐ বইয়ের ৮৯ পৃষ্ঠায় লিখেছে-

'রশিদ তার সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছে, জিয়া এই সময় সরাসরি দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। আমি তাকে কত বুঝালাম, স্যার আপনি এখনো অনেক ইয়াঙ। এখন আপনাকে প্রেসিডেন্ট মানাবে না। একটু অপেক্ষা করুন। এখন চীফ আছেন ভালোই আছেন। কিন্তু জিয়া অস্থির'


সায়েমকে সরিয়ে জিয়া

অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীঃ সায়েম বামে, জিয়া ডানে



২১ শে এপ্রিল ১৯৭৭ ইং তারিখের ৪র্থ ফরমান দ্বারা বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম জিয়ার কাছে রাষ্ট্রপতির পদটুকুও হস্তান্তর করে দেন। যদিও এই হস্তান্তর প্রক্রিয়াও ছিলো সায়েমের প্রতি ক্রমাগত চাপ, হুমকি এবং তাঁকে মিথ্যে মিথ্যে অসুস্থ বানাবার অজুহাতের মাধ্যমে। এই বিষয়ে বিচারপতি সায়েমের নিজের লেখা আত্নজীবনী থেকে জানা যায়-

“On the 21st day of April, 1977 some senior civilian members of the Council of Advisers, headed by the Special Assistant, approached me with a request to relinquish the office of President. They said that they wanted to serve under Major General Ziaur Rahman, then army Chief and C.M.L.A. Does it not clearly prove that civilians, even though in office, want to serve under the army? Then and there, though tentatively, I agreed to resign.[18]

মানে দাঁড়াচ্ছে সায়েম নিজে এই পদটি ছেড়ে দিতে চাননি বরং কিছু তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের কিছু জ্যোষ্ঠ সদস্য এসে তাঁকে সরাসরি এই পদটি থেকে সরে যেতে বলেন। জিয়ার সাথে এই পরিষদের সদস্যদের পূর্ব শলা-পরামর্শ কিংবা পরিকল্পনা ছাড়া এটি যে হয়নি সেটা সায়েমের এই বইতেই স্পস্ট ইঙ্গিতে লেখা রয়েছে। তিনি হতাশা প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে-

The people now in politics, here in Bangladesh, have been accustomed to seeing their elders and forebears being in the permanent services under the British for a long time; and towards the close of the British days, ruling within a very limited range in a province of an empire under the British. Subsequently, they did so under the Paskistanis or the Pakistan army leadership. They believe, think, that now that the British have left, and so Pakistanis, it is not possible to rule or govern the country in the absence of the army leadership, even if the army be their own. Hence they cluster around a person wielding the might of government and governmental forces that make up its physical power. It will be for the politicians to examine and find out whether it is the result only of an inferirioty complex which is comparatively easy to remove, or over-all deficiency in the political leadership.The above seems to be precisely the reason why the politicians went to the cantonment for consultations, even at a time when a civilian President was available at Bangabhaban--a President who himself wanted them to go in for elections, with a view to the country being ruled by them after the elections. Surprisingly, the Special Assistant who is a retired Judge of the High Court and also of the Supreme Court was a party to this.[19]

বিচারপতি সায়েমের এই বক্তব্যে তো এটা অত্যন্ত স্পস্ট যে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা তৎকালীন সময়ে ক্যান্টনমেন্টের সিদ্ধান্তের দিকেই ঝুঁকে থাকতেন এবং সেটি কেন্দ্রিক-ই ছিলো তাঁদের রাজনৈতিক আনুগত্য।


পোস্ট কলোনিয়ান হ্যাংওভার’ নাকি পাকিস্তানী সদ্য সমাপ্ত অধ্যায়ের স্মৃতি তাঁদের এমন মোহমুগ্ধ করে রেখেছিলো তা বুঝতে পারাটাও দুষ্কর। ফলে সায়েম তাঁর এই হতাশার মধ্যেও যে সত্য কথাটা আসলে আমাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন সেটি হচ্ছে তিনি যে তাঁর স্বাস্থ্যগত সমস্যার কথা বলেছিলেন ক্ষমতা ছাড়বার কারন হিসেবে কিংবা এটির সাথে নানাবিধ আনুসঙ্গিক বিষয়াদি উল্লেখ করে সেটি আসলে তাঁর সেই পদত্যাগের মূল কারন ছিলোনা। বরংচ এই পদত্যাগ পুরোটাই হয়েছে বঙ্গভবনে বা তৎকালীন রাজনৈতিক বলয়ে থাকা জেনারেল জিয়ার অনুগতদের চাপে এবং এই বেসামরিক ব্যাক্তিরা সামরিক বলয়ের অধীনেই থাকতে চাইতেন এমন মনস্তাত্বিক অবস্থানের কারনে।

উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের প্রাথমিক চাপের পর যখন খোদ বিচারপতি সায়েম জিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তিনি রাষ্ট্রপতি হবার পর পরিস্থিতি সামলাতে পারবেন কিনা; জিয়ার ভেতরে কিন্তু সামান্য বিষ্ময়ভাব লক্ষ্য করা যায়নি কিংবা সায়েম কেন সরে যাচ্ছেন এই নিয়ে সামান্য কৌতূহলও যে প্রকাশ করেছেন তার কোন নিদর্শন অন্তত বিচারপতি সায়েমের বইতে পাওয়া যায়না। মনে হতে পারে এই পদ অলংকৃত করবার জন্য জেনারেল জিয়ার প্রস্তুতি যেন অনেক দিনের। তারপরেও সামরিক কোয়ার্টারে খানিকটা সমস্যার আঁচ করতে পারছেন কিন্তু সেগুলোও তিনি ঠিক করে ফেলবেন বলে সায়েমকে জানাচ্ছেন। বিচারপতি সায়েম তাঁর গ্রন্থে বলেন-

‘Since Zia desired to be President, and I felt that most of the members of the Council of Advisers supported him, I asked him again as to whether he would be able to cope, without any risk to himself, with the responsibilities of the office of President. He answered in the affirmative. After a few minutes, however, he said that there could be some trouble in the armed forces, but he would be able to get over it.’[20]

জিয়া যে রাষ্ট্রপতি হতে চাচ্ছেন সে ‘ইচ্ছের কথা’ বিচারপতি সায়েমই শেষ পর্যন্ত লিখে ফেলেন। স্বাস্থ্যগত সমস্যা, নিজেকে সময় দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়াদিগুলো যে সায়েমের চলে যাবার পেছনে মূল কারন ছিলোনা তা এই উপরে উল্লেখিত পরিচ্ছদ থেকেই স্পস্ট হয়ে ওঠে। এমনকি বিচারপতি সায়েমের পরিচিতজনেরা যখন তাঁকে বলেন এমন অবস্থায় রাষ্ট্রপতি পদ থেকে চলে যাওয়া এক ধরনের ব্যার্থতা তখন সায়েম বলেন-

‘I told them that it would not be a failure on my part alone but a failure of the whole nation, especially of those who called themselves politicans and were yet averse to elections without the help of the cantonment.’[21]
আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমের লিখিত গ্রন্থ


ইঙ্গিত তো স্পস্ট। এই ক্যাণ্টনমেন্ট মানে কাকে বোঝাতে চেয়েছেন সায়েম? এই গোপন দীর্ঘশ্বাস আর অভিমান কোন ‘ক্যান্টনমেন্ট’এর প্রতি? এটি বুঝবার জন্য কি খুব বেশী গবেষনা করবার প্রয়োজন হয়? তবে বিচারপতি সায়েম নিজেও ছিলেন একটি অবৈধ শাসন ব্যবস্থার অংশ। অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমদ কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই বিষয়টি আরো স্পস্ট করেন। তিনি বলেন-

S. A. Then next question I would like to ask you is, in your address to the nation soon after assumed the office of the President you had pledged that as soon as possible your government would hold free and fair election and through this process the democratic system would be restored. Under what circumstances or rather who prevented you from fulfilling that pledge? 
Justice Sayem: Towards the end of my days at Bangabhaban I was feeling that I was progressively getting ineffective that was because the manner of the government civil servants, the advisors including the special Assistant Mr. Justice A.Satter whom I trusted most as well as the politicians were behaving; this resulted in the foiling and frustrating the plan and purpose which had persuaded me to go to Bangabhaban,[22]

যদিও বিচারপতি সায়েম তাঁর লিখিত বইতে খানিকটা পাপমুক্ত হতে চেয়েছেন এই বলে যে, তিনি এর মধ্যেও সাংবিধানিক বিষয়াদি যথাসম্ভব সম্পন্ন করবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শুরুর প্রশ্নেরই তো জবাব নেই কোনো। একজন বিচারপতি হিসেবে তিনি জানেন মার্শাল বলে এমন বায়বীয় কোনো পদ্ধতি বাংলাদেশের সংবিধান বা আইনী কাঠামোতেই নেই, তাহলে এমন কথিত সামরিক আইনের মধ্যে থেকে তিনি ঠিক কিসের বিষয়াদি সূচারুভাবে সম্পর্ন করতে চেয়েছেন? যেই ভূতের অস্তিত্বই নেই, সেই ভূতের গল্প হয় কি করে? সে কারনেই বিচারপতি সায়েমের বক্তব্যগুলো বরংচ এটা মনে করিয়ে দেয় যে বিগত স্বৈরশাসক থেকেও সায়েমের দায় বেশী। কেননা আইনটা তিনি অন্য সবার থেকে বেশী বুঝতেন। তিনি জানতেন এই মার্শাল আইনের কোনো ধরনের নাম বা নিশানা আমাদের দেশের আইনী কাঠামোতে নেই বা এর অস্তিত্ব নেই। তিনি এও জানতেন এই ক্ষমতা দখল আইনীভাবে ছিলো অবৈধ এবং মোশতাকের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং স্পীকার থাকার পরেও সংবিধানের নিয়ম ভঙ্গ করে মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়। সেই অবৈধ রাষ্ট্রপতি থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরও যে আসলে অবৈধ এটি অন্য কারো থেকে বিচারপতি সায়েমেরই বেশী জানার কথা ছিলো। সায়েম যখন তাঁর বইতে বলেন- As far as practicable, I tried to give a civilian and democratic color to the Government over which I presided though it was a martial law government.[23]



বিচারপতি সায়েম হয়ত জানতেন না অবৈধ ব্যবস্থায় বসে যতই সেটিকে ‘সিভিলিয়ান’ রূপ দেয়া হোক না কেন এবং কাল্পনিকভাবে বৈধ মনে করুকনা কেন, আদতে সেটি রাতারাতি বৈধ হয়ে যায়না। বিচারপতি সায়েম ক্ষমতা ছাড়ার আগে একটি আইনগত জটিলতায় পড়েন। মোশতাক নিজেই প্রধান সামরিক প্রশাসক ছিলেন এবং রাষ্ট্রপতিও ছিলেন। মোশতাকের এই ক্ষেত্রে দুইটি সুবিধা ছিলো। সামরিক প্রশাসক হিসেবে যখন তখন ফরমান, আদেশ ইত্যাদি জারি করে বসতেন। মোশতাক তার পদ থেকে সরে যাবার আগে বিচারপতি সায়েমের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তর প্রক্রিয়া কেমন হবে সেই প্রশ্নের ক্ষেত্রে তিনি সামরিক আইনের আদেশে পরিবর্তন এনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব যে কাউকে হস্তান্তরের পদ্ধতি উন্মুক্ত করে দেন নিজেই ফরমান জারি করে। কিন্তু সায়েমের ক্ষেত্রে এই ফরমান জারি করবার বিষয়টা উত্থাপিত হলে জিয়াই সেটি জারি করবেন বলে জানান। সায়েমের ভাষায়-

The absence of a Vice President and also the absence of a power to amend the Proclamation and /or the Constitution stood in the way of my resignation. The special Assistant realised the difficulty. He rose and proceeded towards the door for consulting the Law Secretary. He was, however, asked to resume his seat. Zia, said that since he had already been appointed Chief Martial Law Administrator, he would manage such a crisis, by using the authority of Martial Law.Thus satisfied, I directed putting up a resignation order in favour of Zia, mentioning the reason for relinquishment of the office as of ill-health and in national interest.[24]

জেনারেল জিয়ার অতি উৎসাহের আরো একটি প্রমাণ। কিন্তু প্রশ্ন এসেই যায় যে, ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য যদি বিচারপতি সায়েম সরেই যাবেন তাহলে মাঝে আবার ‘এবং’ যুক্ত করে ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে; বাক্যটি কেন? দুটোর একটিও আরেকটির সাথে মেলেনা কেননা রুগ্ন স্বাস্থ্যের কথা ছিলো সবার চোখে ধুলো দেবার জন্য আর সত্যটা হচ্ছে জিয়া সামরিক উর্দি ও ক্ষমতা আর তার সিভিলিয়ান অনুগত উপদেষ্টাদের ভয়েই সায়েম এই পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। বিচারপতি সায়েম ক্ষমতা ছাড়ার আগে জিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন যেহেতু তিনি একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে যেতে পারেন নি সুতরাং সেই কাজটা যাতে জিয়া করে। তিনি পরবর্তীতে বিষ্ময় প্রকাশ করেন যে তিনি সে সময় ভাবতেই পারেনি যে একজন সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি উভয় পফদে থাকা অবস্থায় তিনি নিজেই এই রাষ্ট্রপতি পদে দাঁড়িয়ে যাবেন। বিচারপতি সায়েমের ভাষায়-

Before relinquishing the office of President, I told Zia that since I could not hold the elections, I would request him to hold these. He assured me that he would hold the elections. This made me happy. I could not, however, think then of his own participation in them. In such a case Zia, while continuing as the army Chief, would already be in power, and that also under Martial Law as President and Chief Martial Law Administrator

বিচারপতি সায়েম ঠিক যেখানে এসে জেনারেল জিয়াকে চিনেছেন বা নতুন রূপে দেখলেন মূলত বিগত বছরগুলোতে এটিই ছিলেন জেনারেল জিয়া। ক্ষমতার সর্বোচ্চ সীমানায় উঠবার জন্যই ছিলো তার এত বছরের সমস্ত কর্মকান্ড। জিয়া তার অনুগতদের চাপ দিয়েই অনেকটা আধা সামরিক কায়দায় রাষ্ট্রপতির পদটাও দখল করে নিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়ার জীবনটাই এমন অদ্ভুত। সামনাসামনি তিনি কিছুই করেননি কখনো। সব করেছেন পেছনে। বরাবরই নিজের অনুগতদের দল বানিয়েছেন আর সেই অনুগতদের দিয়ে কার্যসিদ্ধি করেছেন। জেনারেল জিয়ার জীবনের প্রতিটি ধাপে বিবর্তনগুলো ছিলো বিষ্ময়কর! পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে দীর্ঘ পাঁচবছর গোয়েন্দা সংস্থাতে কাজ করা, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৭ মার্চ বেলাল মোহাম্মদের লিখে দেয়া স্বাধীনতার একটি ঘোষনাপত্র পাঠ করা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থেকে মৌনব্রত পালন, ঘাতকদের নানাভাবে সহযোগিতা করা। ২৪ শে অগাস্ট ১৯৭৫ সালে জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে দিয়ে নিজে সেনাবাহিনী প্রধান হওয়া[25], ১৯৭৬ সালে প্রধান সামরিক শাসক হওয়া, ৪ দিনের ভেতর তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্ণেল তাহেরের বিচার সামরিক আদালতে করা, ১৯৭৭ সালের ২১ শে এপ্রিল বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতি বনে যাওয়া[26], ১৯৭৭ সালের ৩০ মে নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক অবস্থায় আস্থা গণভোটের হ্যাঁ/না আয়োজন[27], একই অবস্থায় থেকে ১৯৭৮ সালের ১২ জুনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে জয়ী হওয়া,[28] ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারীতে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা[29], ১৯৭৯ সালের এপ্রিলের ৫ তারিখে মোশতাক, সায়েম ও তার নিজের সমস্ত কর্মকান্ড সংসদের প্রথম অধিবেশনে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে সন্নিবেশিত করে সেটিকে বৈধ করে নেয়া,[30] প্রায় রকম তথ্য ১৯৭৯ সালের সংসদ অধিবেশনে দিয়েছিলেন আংসদ শাহজাহান সিরাজ। তিনি বলেছিলেন জিয়ার উত্থানের গল্প-

জনাব শাজাহান সিরাজ (টাঙ্গাইল-৪) : মাননীয় স্পীকার সাহেব, আমার যে প্রস্তাব, সে প্রস্তাব রাখছি। তার সঙ্গে আমি কিছু বক্তব্য পেশ করব। আমি আবার এই হাউসের সামনে বলতে চাই। মেনন ভাই বলেছেন। অন্যান্য সদস্যও বলেছেন। তাঁদের প্রতিধ্বনি করে আমি আবার বলতে চাই, কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না দেখে, আসুন, আমরা সবাই মিলে একটা বাছাই কমিটি করি। সেই বাছাই কমিটিতে আমরা আলোচনা করি যে, যে আইনগুলি আছে যা গণ-বিরোধী, সেগুলি বাদ দিয়ে এই পার্লামেন্টে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা এই পার্লামেন্টকে সার্বভৌম পার্লামেন্টে পরিণত করি। অর্থাৎ করার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। আজকে মাননীয় Leader of the House তাঁর বক্তব্যে একটি কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেব ৭ই নভেম্বরে ক্ষমতায় এসেছেন সিপাহী-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে সে আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর পর সমস্ত দুনিয়ার কাছে সমস্ত বাঙালী জাতির কাছে তিনি যে ওয়াদা করেছিলেন সেই ওয়াদার অনেকগুলি তিনি রক্ষা করেন নাই তাঁর এক নম্বর ওয়াদা ছিল : আমি সেনাবাহিনীর লোক । কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নাই। আমি রাজনীতি করতে চাই না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্ধারিত দিনে আমি ব্যারাকে ফিরে যাব।

মাননীয় স্পীকার সাহেব, আমি আজকে এই হাউসকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, জনাব জিয়াউর রহমান সাহেব কি ৭ই নভেম্বরের পর যে নির্ধারিত দিন ছিল খন্দকার মোশতাক আহমদ কর্তৃক নির্বাচন দেওয়ার, সেই নির্ধারিত দিনে নির্বাচন দিয়েছিলেন ? না কি, তিনি কী করেছিলেন। তিনি কী করলেন ? তিনি ছিলেন ডেপুটি চীফ মার্শাল ল' এ্যাডমিনিস্ট্রেটর। সেখান থেকে হলেন চীফ মার্শাল ল' এ্যাডমিনিস্ট্রেটর । সেখান থেকে হলেন প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট "হাওয়ার জন্য “হাঁ”, “না” একটা ভোট দিলেন। সেই ভোট দিয়ে তিনি নিজে “হাঁ”- এর বাসে ভোট নিয়ে নির্বাচিত হলেন। তারপর দিলেন আর একটা ভোট। এইভাবে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, সবই আসলে নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা। তারপর নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই সামরিক আইনের সমস্ত বিধান জারী করে, মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করে… এমন কি multi-party system বাতিল হওয়ার পরে one-party system - এও কোন রাজনৈতিক দলকে কাজ করতে দেওয়া হয় নাই। উপরন্তু আমরা দেখেছি, জিয়া- উর রহমান সাহেব সারা বাংলাদেশের জনগণের কাছে তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করেছেন। অথচ তিনি কোন রাজনৈতিক দলকে বক্তব্য রাখতে দেন নাই। আমাদের ঘরের মধ্যে পুরে রেখে, আমাদেরকে ঘরোয়া রাজনীতির মধ্যে বেঁধে রেখে তিনি সমস্ত বাংলাদেশ চষে ফেলেছেন । এইভাবে এই সমস্ত আইন এই সমস্ত কালা-কানুন নিজের কাজে ব্যবহার করেছেন।[31]




শাহজাহান সিরাজের বক্তব্যেই পরিষ্কার জেনারেল জিয়ার বিষ্ময়কর উত্থানের ইতিহাস। ১৯৮১ সালের ৩০ শে মে আরেক ঘনিষ্ট বন্ধু মেজর জেনারেল মঞ্জুরের পরিকল্পনায় মর্মান্তিকভাবে নিহত হন জিয়া। বোধকরি যেই রক্ত স্রোতের ধারায় তিনি হাঁটছিলেন, এটাই ছিলো তাঁর অবশ্যম্ভাবি ও অনুমেয় নিয়তি।[32] উল্লেখ্য যে, ১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান বিএনপি’র হয়ে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তখনো দেশে সামরিক শাসন চলমান এবং জিয়াউর রহমান খোদ নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবেই তাঁরই প্রশাসন এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পরিচালনা করেন এবং তিনি জয়ী হন। ১৯৭৯ সালের ১৮-ই ফেব্রুয়ারী মার্শাল আইন চলাকালীন অবস্থাতেই দেশে দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যেটি নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক ছিলো[33]। একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে যে ৭৫-এ জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ তখনও বাতিল করা হয়নি বরং তা বহাল অবস্থাতেই ছিলো।


*******************************************************

সূত্র সমূহঃ

[1] তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে কর্ণেল এম এ হামিদ পি এস সি, প্রথম প্রকাশ-জুন ১৯৯১, মোহনা প্রকাশনী, পৃ-৪৭


[2] তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে কর্ণেল এম এ হামিদ পি এস সি, প্রথম প্রকাশ-জুন ১৯৯১, মোহনা প্রকাশনী, পৃ-৪৭-৪৮

[3] মাসিক নিপুন, নভেম্বর-১৯৮৭, পৃষ্ঠা-৩৩

[4] ‘মুক্তির পথ’ পুস্তিকা, লেখক-লে কর্ণেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান ও লে কর্ণেল (বরখাস্ত) খন্দকার আব্দুর রশিদ, ১৯৮৩ সালে ১ম প্রকাশিত, প্রকাশক- মেজর (অব) সৈয়দ আতাউর রহমান, পৃষ্ঠা-৭৪

[5] Bangladesh: A legacy of Blood by Anthony Mascarenhas, Hodder & Staughton Publication, 1986, Page-62

[6] Bangladesh: A legacy of Blood by Anthony Mascarenhas, Hodder & Staughton Publication, 1986, Page-62 (5th para)

[7]15th August: A Tragedy, Majur Generel KM Safiullah, Agami Publications-204, Page:96-99

[8] সাপ্তাহিক কিন্তু, ১৫-ই অগাস্ট-১৯৯১, পৃষ্ঠা-১৪

[9] সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র, বর্ষ-২, সংখ্যা-৩৫, ৬-১২ নভেম্বর ১৯৯২, পৃষ্ঠা-১১

[10] Bangladesh: A legacy of Blood by Anthony Mascarenhas, Hodder & Staughton Publication, 1986, Page-51

[11] ‘মুজিবের নেপথ্য খুনী খালেদ মোশাররফ’, প্রবন্ধ লেখক- মাসুদ কামাল,আলম হাসনাইন, ইকবাল কবীর। সাপ্তাহিক সুগন্ধা, ৬ বর্ষ, ২৯ সংখ্যা, ১৩/০৮/১৯৯৩ ইং, পৃষ্ঠা-১০-১৩,

[12] বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারে সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ্র জবানবন্দী ও জেরা, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা” সাক্ষীদের জেরা-২য় খন্ড’, আবুল হোসেন, মীরা প্রকাশনী-২০১৩, পৃষ্ঠা-৩১৩-৩১৪

[13] ‘মুজিবের নেপথ্য খুনী খালেদ মোশাররফ’, প্রবন্ধ লেখক- মাসুদ কামাল,আলম হাসনাইন, ইকবাল কবীর। সাপ্তাহিক সুগন্ধা, ৬ বর্ষ, ২৯ সংখ্যা, ১৩/০৮/১৯৯৩ ইং, পৃষ্ঠা-১৩ (১ম কলাম)

[14] বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ৯ নং সাক্ষী লে কর্ণেল আব্দুল হামিদের জবানবন্দী ও জেরা দ্রষ্টব্য

[15] ‘মুজিবের নেপথ্য খুনী খালেদ মোশাররফ’, প্রবন্ধ লেখক- মাসুদ কামাল,আলম হাসনাইন, ইকবাল কবীর। সাপ্তাহিক সুগন্ধা, ৬ বর্ষ, ২৯ সংখ্যা, ১৩/০৮/১৯৯৩ ইং, পৃষ্ঠা-১৩ (৩য় কলাম)

[16] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৩, (২য় কলাম)

[17] বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনী ১৯৭২-১৯৮৮ঃ প্রেক্ষাপট ও পর্যালোচনা, ড কাজী জাহেদ ইকবাল, ধ্রুবপদ প্রকাশনী, ২০১৬, পৃষ্ঠা-৭১

[18] At Bangabhaban: Last Phase, Abusadat Mohammad Sayem, Hakkanai Publishers Dhaka, September,1988, Page-39

[19] At Bangabhaban: Last Phase, Abusadat Mohammad Sayem, Hakkanai Publishers Dhaka, September,1988, Page-36-37

[20] At Bangabhaban: Last Phase, Abusadat Mohammad Sayem, Hakkanai Publishers Dhaka, September,1988, Page-41

[21] Ibid. Page-38

[22] বাংলাদেশের তিন রাষ্ট্রপতির আত্নকথন, মোহাম্মদ সেলিম,সুবর্ণ, ফেব্রুয়ারী-২০১২, পৃষ্ঠা-১৯০

[23] At Bangabhaban: Last Phase, Abusadat Mohammad Sayem, Hakkanai Publishers Dhaka, September,1988, Page-28

[24] At Bangabhaban: Last Phase, Abusadat Mohammad Sayem, Hakkanai Publishers Dhaka, September,1988, Page-40-41

[25] বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় জেনারেল শফিউল্লাহ জবানবন্দী,বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও বিচার, মোস্তফা ফিরোজ, পূর্বা প্রকাশ, নভেম্বর ১৯৯, পৃষ্ঠা-১৭৫

[26] At Bangabhaban: Last Phase, Abusadat Mohammad Sayem, Hakkanai Publishers Dhaka, September,1988, Page-39

[27] সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতিঃ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, মোঃ আব্দুল হালিম, সিসিসবি ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা-৪৫০

[28] Ibid. Page.450

[29] Bangladesh: The 1979 Elections, S.R. Chakravarty,Page.73

[30] খন্ড ১, সংখা ৩, সংসদ বিতর্ক, সংবিধান পঞ্চম সংশোধনী বিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ২৫৬

[31] পৃষ্ঠা ২০৪- ২০৫, খন্ড ১, সংখ্যা ৩, সংবিধান পঞ্চম সংশোধন বিল ১৯৭৯

[32] দৈনিক ইত্তেফাক, ১ জুন ১৯৮১

[33] ১৯৭৯ নামের বইটির রেফারেন্স হবে এখানে

'দি মাস্টারমাইন্ড' শিরোনাম অংশের সূত্র সমূহঃ

সূত্র-১ -বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা-সাক্ষীদের জেরা, পৃষ্ঠা-৩১১, আবুল হোসেন কর্তৃক সম্পাদিত, মীরা প্রকাশনী
সূত্র-২ -বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা-সাক্ষীদের জেরা, পৃষ্ঠা-৩১২, আবুল হোসেন কর্তৃক সম্পাদিত, মীরা প্রকাশনী
সূত্র-৩ -বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা-সাক্ষীদের জেরা, পৃষ্ঠা-৩১২, আবুল হোসেন কর্তৃক সম্পাদিত, মীরা প্রকাশনী
সূত্র-৪ -বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা-সাক্ষীদের জেরা, পৃষ্ঠা-৩১৩, আবুল হোসেন কর্তৃক সম্পাদিত, মীরা প্রকাশনী
সূত্র-৫ -বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা-সাক্ষীদের জেরা, পৃষ্ঠা-৩১৭, আবুল হোসেন কর্তৃক সম্পাদিত, মীরা প্রকাশনী
সূত্র-৬ –বঙ্গবন্ধুর দ’টি ঐতিহাসিক মামলার জেরা ও জবানবন্দী, পৃষ্ঠা-১৩২, এডভোকেট সাহিদা বেগম, গতিধারা প্রকাশনী

সূত্র-৭ – মার্কিন দলিলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড, পৃষ্ঠা-১৩-১৬, মিজানুর রহমান খান, প্রথমা প্রকাশনী
সূত্র-৮-‘যা দেখেছি, যা বুঝেছি, যা করেছি, পৃষ্ঠা-৪০৭, শরিফুল হক ডালিম, নব জাগরন প্রকাশনী
সূত্র-৯-‘যা দেখেছি, যা বুঝেছি, যা করেছি, পৃষ্ঠা- ৪১০ শরিফুল হক ডালিম, নব জাগরন প্রকাশনী
সূত্র-১০-যা দেখেছি, যা বুঝেছি, যা করেছি, পৃষ্ঠা-৪৩৫-৪৩৬, শরিফুল হক ডালিম, নব জাগরন প্রকাশনী
সূত্র-১১-যা দেখেছি, যা বুঝেছি, যা করেছি, পৃষ্ঠা-৪৩৩, শরিফুল হক ডালিম, নব জাগরন প্রকাশনী
সূত্র-১২-‘ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, দুই রাষ্ট্রপতি হত্যা’, পৃষ্ঠা-৬৩, মুনতাসীর মামুন, কথা প্রকাশ
সূত্র-১৩-‘ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, দুই রাষ্ট্রপতি হত্যা’, পৃষ্ঠা-৬৪, মুনতাসীর মামুন, কথা প্রকাশ
সূত্র-১৪-‘Assasination of Ziaur Rahman and the aftermath’, Page-17, Ziauddin M. Chowdhury, UPL


No comments:

Post a Comment