উৎসর্গঃ আরিফ রহমান। অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এই তরুনের হাত ধরে বহুদূর যাবে এই কথা আমি আজকে নির্দ্বিধায় বলি। আমি আগুন চিনি, আমি আগুনের উত্তাপ পাই...
আমরা মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কিংবা হারাবার কথা এলেই সবার আগে বলি ৩০ লক্ষ বা
তারো বেশী শহীদের কথা এবং ৪ লক্ষ নির্যাতিত মা বোনদের কথা। এটা আমিও নিজে
অসংখ্যবার বলেছি, লিখেছি।
ইনফ্যাক্ট আমরা সকলেই এই তথ্য বলি কিংবা লিখি। আজকে হঠাৎ করেই আরেকটা ভাবনা মাথায়
এসে গেঁথে রইলো। এই ভাবনা যে আগে আসেনি তা না, এই ব্যাপারটি নিয়ে অনেক আগে একটা লেখা
লিখেছিলাম, লেখাটা আর খুঁজে
পাইনি, কোথায় যে হারিয়ে
গেলো।
ভাবনাটা হচ্ছে এমন- শুধু ৩০ লক্ষ কিংবা তারও অধিক প্রাণ বা ৪ লক্ষ বা তারও অধিক মা-বোনই কি নির্যাতিত হয়েছে? আমাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অসংখ্য দিক থেকে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, আত্নিক, চিন্তাগত, এমন অসংখ্য অসংখ্য কথা। সুনির্দিষ্ট কিছু নয়, কিন্তু কয়েকটি ঘটনার কল্পিত দৃশ্যগুলো মগজটা এলোমেলো করে দিচ্ছে আজকে সারাটা দিন ধরেই...
ধরা যাক, মুক্তিযুদ্ধের আগে আনিস নামে এক তরুন ভালোবাসত রাবেয়া নামে এক
তরুনীকে। রাবেয়াকে তার ভালো লাগতো। প্রতিদিন মেয়েটির বাসার পাশ দিয়ে যাবার সময় হয়ত
উঁকি দিত রাবেয়াকে একটু দেখবে বলে, রাবেয়াও হয়ত
আনিসকে পাত্তা না দেবার ভান করে মনে মনে চাইত আনিসকে, চাইত আনিস তার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকুক। একটা
পর্যায়ে হয়ত সম্পর্কটি আরো দৃঢ় হোলো, আনিস রাবেয়াকে কথা দিলো, ইউনিভার্সিটির
পাট চুকিয়ে একটা ভালো চাকুরী করেই রাবেয়ার বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়াবে। কিন্তু
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পরপরই দেশকে বাঁচাতে আনিস চলে গেলো যুদ্ধে। আর রাবেয়া আর
রাবেয়ার পরিবার প্রাণ বাঁচাতে চলে গেলো বর্ডার পার হয়ে।
আবার ধরা যাক আরেকটা ঘটনা- জাহিদ নামে এক যুবকের সদ্য বিয়ে হয়েছে সুমির সাথে।
সুমির হাতের মেহেদীর রঙ শুকোয়নি, কিন্তু অল্পদিনের
ভেতরই জাহিদের জন্য এক নামহীন-ব্যাখ্যাহীন এক ভালোবাসা জন্মে গেছে জাহিদের জন্য।
ঠিক তার কিছুদিনের ভেতর শুরু হয়ে গেলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। জাহিদ সুমিকে ফেলে চলে
গেলো যুদ্ধে দেশকে বাঁচাতে। আর সুমি নিজেকে বাঁচাতে পারলো না। দেশের জন্য
নৃশংসভাবে নির্যাতিত হলো পাকিস্তানী হানাদার আর তাদের এই দেশীয় দালালদের মাধ্যমে।
সব কিছু পালটে গেলো।
আবার যদি কল্পনা করি ৬ বছরের শিশু টগরের কথা। টগরের চমৎকার একটা পরিবার ছিলো।
ওর ছিলো অনেক খেলনা, ওর চারিদিকে ছিলো
ফুল, প্রজাপতি, সুন্দর নদী, পাখি, পাখির গান, খেলার মাঠ আর
সবচাইতে প্রিয় মা আর বাবা। যুদ্ধ শুরু হোলো। ২৫ শে মার্চের রাত্রে টগরের বাবা ও
মাকে খুন করে পালালো কাপুরুষ পাকিস্তানী বর্বরেরা। টগর একটা ঘরে লুকিয়ে ছিলো বলে
বেঁচে রইলো। যুদ্ধের পরে যানা গেলো টগরের দাদা, নানা, চাচা, খালা, ফুফু, নানী, দাদী সকলকেই
হত্যা করা হয়েছে। টগরের আর কেউ রইলো না।
******************
মুক্তিযুদ্ধের পর রাবেয়ার বিয়ে হয়ে গেলো একটি ছেলের সাথে। রাবেয়া আর বিয়ে করতে
চায়নি, কিন্তু সমাজ,
সংসার, পরিবার সব কিছুর সাথে একটি মেয়ের পেরে ওঠা
কঠিন। রাবেয়া নতুন সংসারে ঢুকে গেলো। মুক্তিযুদ্ধের পর সুমি সেই অন্ধাকার
সময়গুলোতে আর কুলিয়ে না উঠতে পেরে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে গেলো। তাঁর স্থান
হোলো একটি মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে। একটি বিদেশী অর্গানাইজেশন টগরকে নিয়ে গেলো
অস্ট্রেলিয়ায়।
********************
কল্পনা করতে গিয়ে বুকটা আর্তনাদে ভ'রে ওঠে। বুকটা খা খা করতে থাকে। এক বিভৎস স্মৃতি এসে ভর করে আমার সমস্ত মন আর
মননে। আমার বুকটা নিঃসীম অন্ধকারে কেবল হারায় ক্রমশ... রাবেয়া আজো আনিসের জন্য
গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে...সুমি কিছু মনে করতে পারেনা, শুধু পারে জাহিদের হো হো শব্দের হাসির
আওয়াজটুকু মনে করতে, তাও আবার মাঝে
মাঝে...সুমির মনে থাকেনা কিছুই। টগর যে বয়সে বাবা আর মাকে হারিয়েছিলো সে বয়সে সব
মন থাকে সবার। আজ টগর অনেক বড় হয়েছে। একটা অস্ট্রেলিয়ার একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়
ও। মাঝে মাঝেই সিডনীর আকাশের দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদে। তাঁর মনে পড়ে আব্বুর কথা,
আম্মুর কথা। ফুলগুলোর কথা,
পাখিদের কথা। আম্মুর তাঁর
চুলে বিলি কেটে দিত, আব্বু টগর সোনা
ডাকত, সে কথা...
***********************
এই দেশ রক্ত দিয়ে স্বাধীন হয়েছে কিংবা নিজের সম্ভ্রম দিয়ে স্বাধীন হয়েছে এটাতো
সর্বজন বিদিত। সকলেই জানেন। কিন্তু কান পাতলেই যে হু হু কান্নার শব্দ সব ছারখার
করে দেয়, কেউ কি সে শব্দ
শুনতে পান??? কেউ কি শুনতে পান
লক্ষ লক্ষ স্বপ্ন ভঙ্গের আর্তনাদের শব্দ? কেউ কি শুনতে পান একটা ভালোবাসা হারিয়ে যাবার হাহাকারের তীব্র শব্দ? কেউ কি শুনতে পান একটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া পরিবারের প্রচন্ড কষ্টের প্রতিটি চিৎকার???
আমি শুনতে পাই প্রিয় বন্ধুরা। খুব স্পষ্ট শুনতে পাই। জন্মের পর থেকেই তাই
আগুনে জ্বলছি কি এক তীব্র প্রতিশোধের বাসনায়। প্রচন্ড প্রতিশোধ। প্রচন্ড প্রতিশোধ।
বুকে জ্বলে আশ্চর্য আগুন...
No comments:
Post a Comment