Saturday 4 October 2014

নেই


আমার খুব স্পস্ট মনে আছে জায়গাটার নাম। একটা রিকশায় আমি আর লিমন। নাকিবের বাসার দীর্ঘ আড্ডা শেষে কোনো এক রাতে আমরা ফিরছিলাম কোথাও যেন। খুব সম্ভবত ২০০২ সালের শুরুর কথা। আমাদের রিকশাটি শ্যামলীর শিশুমেলা শেষ করে আগারগাঁ এর রাস্তাটি মাত্র ধরেছে। আমরা ফিরছিলাম মোহাম্মদপুর শেরশাহশুরী রোড থেকে। লিমন তখন সবে মাত্র নতুন ক্যাডেট। ভাটিয়ারীতে লং কোর্সের জওয়ান। খুব সম্ভবত ঈদের ছুটিতে এসেছিলো ঢাকায়। লিমন আমার শৈশবের বন্ধু। বলা যেতে পারে প্রাণের বন্ধু। আমরা শৈশবের যতগুলো বন্ধু রয়েছি তাঁদের এক একজন, এক একজন বন্ধুদের শ্বাস চিনি, প্রশ্বাস চিনি। আমরা আসলে আলাদা আলাদা প্রাণের হয়ে বেঁচে থাকি বাহ্য জগতে কিন্তু ঐ শৈশবের বন্ধুদের জন্য আমরা একসাথে একটি এক কোষী প্রাণ। তাই লিমন যখন রিকশায় বসে ওঁর বেদনার কথা বলছিলো আমি তখন চুপ করে শুনছিলাম। ওঁর দীর্ঘঃশ্বাস বুঝতে পারছিলাম বলেই হয়ত চুপ করে থাকাটাই সেদিনের জন্য যথার্থ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

লিমনের প্রেমটা ছিলো অদ্ভুত। ওঁরা একজন আরেকজনকে দেখেনি প্রেমের প্রথম ৪ বছর। যতদূর মনে পড়ে আমার, খুব সম্ভবত পত্র মিতালিতে ওদের প্রেম। সেদিনই লিমন রিকশায় আমাকে বলেছিলো তাঁদের এই প্রেমের কথা। খুব সম্ভবত একটা পর্যায়ে ওঁরা পরিবারের অমতে বিয়েও করে। প্রথম প্রেমে ব্যার্থ হওয়া সেই আমার তখন ত্রাহি অবস্থা। অসহ্য একটা সময় পার করছিলাম দিন-রাত। নিজেকে গুটাতে গুটাতে একাকার করে ফেলেছিলাম । মুখে দাড়ি আর গোঁফের জঙ্গলে বড় অচেনা করে তুলেছিলাম বাইরের জগতের মানুষগুলোর কাছে। সে সময়ে লিমনের ঐ দূর্দান্ত প্রেমের কথা শুনে বুক চিরে খানিকটা দীর্ঘঃশ্বাস বেরিয়ে গিয়েছিলো। কি এক অলীক যন্ত্রণায় আমি বার বার হারাচ্ছিলাম আমার যাবতীয় স্মৃতি থেকে। লিমন বলছিলো সেদিন যে, মিলিটারী একাডেমী থেকে পাস আউট করে বেরিয়ে যেদিন কাঁধে র‍্যাংক ব্যাজ পরবে সেদিন বুক ফুলিয়ে তাঁর স্ত্রীকে ঘরে তুলবে। পারিবারিক যে নানান অসম্মতি আর অভিভাবকদের রাজ্যের বাঁধা রয়েছে সেগুলো সব জয় করে তাঁরা সংসার করবে সুখের। শান্তির।

এরপর আমি ঢাকার বেদনাময় স্মৃতিকে ভুলতে চলে আসি ভীনদেশ এই বিলেতে। দীর্ঘ সময় আর রজনী অতিক্রান্ত হয়েছে এরই মধ্যে। লিমন নৌবাহিনীতে কমান্ডার হয়েছে। বন্ধু লিমন আর ভাবীর ঘর আলো করে ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম নেয় ২০০৯ সালে। অপ্সরা তাঁর নাম। সবকিছু হয়ত চলছিলো ভালোই কিংবা ভালো চলছিলো না। সেসব কথাতে না যাই আজ। তবে বন্ধু লিমনের সেই দূর্দান্ত প্রেমের গল্প আমি করেছি বহুবার। কখনো আড্ডায়, কখনো প্রেমের গল্পের যতসব স্মৃতি রোমন্থনে কিংবা একাধিকবার আমার স্ত্রীর কাছে। সেই একজন আরেকজনকে না দেখে ৪ বছরের প্রেম, আমাকে আজও ভাসিয়ে নেয়।

লিমনের স্ত্রী চলে গেলো না ফেরার দেশে গত সোমবার। ২৯ শে অগাস্ট, ২০১৪। লিমনকে ফোন দিয়েছিলাম এখান থেকে। দিতে চাইনি আসলে। কেননা মৃত্যু পরবর্তী সময়ে বেঁচে থাকা মানুষদের আসলে কি করে সান্তনা দিতে হয়, আমার জানা নেই। তারপরেও ফোন দিয়েছি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো লিমনের সাথে আবার সেই রাতের মত গল্প করি। যে রাতে এক নিঃশ্বাসে সেই তরুন ক্যাডেট বলছিলো তাঁর প্রেমের গল্প, ঠিক তেমন। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো এই স্মৃতির এলোপাথারি গহীনে একটা ডুব দিয়ে লিমনকে নিয়ে চলি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো আবারও শেরশাহশুরী রোডের সেই নাকিবের বাসার আড্ডা থেকে আরেকটা নতুন জীবন শুরু করি আমরা। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো লিমনকে বলি সে কথা। এসব সময়গুলোতে মূলত এমন গল্প কিংবা প্রস্তাব করা যায় না বলেই  আর গল্প করা হয়ে ওঠে নি আমাদের।

তবে লিমনের সাথে কথা বলতে গিয়ে সেই এক যুগ আগের মত এবারও আমার বুক বেয়ে একটা চাপা দীর্ঘঃশ্বাস বেরিয়ে গিয়েছিলো। ঠিক সেই আগের মতন, ঐ যে...প্রথম প্রেমে ব্যার্থ হয়ে যেমন যন্ত্রণায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম...ঠিক তেমন। কোনো কারন ছাড়াই আবার সেসব হাহাকার দল বেঁধে নিমিষেই চারপাশে তীব্র সন্ত্রাসীর মত ঘিরে ধরলো। এতকালের হারানো হাহাকার আজও এমন চকচকে, ঝকঝকে আর নতুন হয়ে সামনে দাঁড়াবে, ভাবিনি কখনো।

এত অজস্র প্রেম, ভালোবাসা, সন্তান, সংসার, স্মৃতি, উচ্ছাস, আনন্দ, বেদনা, সুখ, দুঃখ নিয়ে একটা মানুষ এভাবে চলে যায়। স্রেফ "নেই" হয়ে ওঠে একটা মানুষ। একটা রক্ত মাংশের জ্বলজ্বলে মানুষ চকিতেই অদৃশ্য হয়ে ওঠে...

কোনো মানে হয়?

1 comment:

  1. পড়ে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। শুধু অনুভব করতে পারছি চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে অসছে। বন্ধু তোকে অনেক ধন্যবাদ এরকম একটি লেখা উপহার দেওয়ার জন্য। আল্লাহ অনেক সময় আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নেন, আবার অনেক মূল্যবান কিছু উপহার দেন। যেমন আমায় দিয়েছেন। নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হয় যখন আমার প্রানপ্রিয় বন্ধুদের কথা মনে করি। Really you all are precious gift of my life. May our bondage last forever. Ameen.

    ReplyDelete