রিচার্ড আর ক্রিস্টিনা সারা রাস্তা জুড়েই কথা বলছিলো স্কেট বোর্ডিং নিয়ে, ক্যানাল বোটিং নিয়ে, কবে কে কখন বাঙ্গি জাম্প দিয়েছে, স্কাই ডাইভ করেছে সেসব নিয়ে। আমিও সে আলোচনায় মাঝে মধ্যে ঢুকি, টুকটাক অন্য কিছু নিয়েও আমাদের কথা হয়, তারপরেও আমি কেন জানি আনন্দ পাইনা।আমি ওদের পেছনে পেছনে হাঁটি আর ওরা সামনে দু’জন কথা বলে জীবনের অসংখ্য আওনন্দের ঘটনা নিয়ে। কোন দেশের কোন খাওয়া ভালো, কোন রাস্তা ভালো, কোন শহর ভালো...আর কত কি...
কি এক শূন্য চাহনি নিয়ে বেইজিং এর ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এত ঘন বসতিপূর্ণ একটা দেশ অথচ কি চমৎকার করে সাজিয়ে রেখেছে। চায়না ছাড়া এই পৃথিবী মোটামুটি অচল আর আমি সেই চায়নাতে দাঁড়িয়ে আছি ভাবতেই আবার দ্রুত চারিদিকে তাকিয়ে নেই এক নজর। আর ঘন্টা দশেক পর এই শহর ছেড়ে পাড়ি দেব লন্ডনে, তাই শুধু যত দ্রুত দেখে নেয়া যায়...
বেইজিং এর নিষিদ্ধ নগরীর লাল লাল প্রাসাদের ফাঁকে ফোকরে কখনো কখনো মাও এর বিশাল বিশাল ছবি। অসংখ্য পর্যটক একের পর এক ছবি তুলছে, কেউ কেউ নোট বুকে টুকে রাখছে অনেক কথা। ঘুরি ফিরি আর সেসব দেখি। কত অচেনা মানুষ, কত অচেনা জাতি, কত অচেনা দেশের পর্যটকেরা ঘুরে বেড়ায় এক কালের মিং সম্রাটদের এই নিষিদ্ধ নগরীতে তার ইয়ত্তা নেই। নতুন শহর দেখবার মধ্যে আনন্দ আছে, আছে উত্তেজনা কিন্তু আমি কেন জানি সে আনন্দ উপভোগ করতে পারিনা। এক একটা দেশে যাই আর সেই দেশের সাজানো-গোছানো অবয়ব, শৃংখলাবদ্ধ নগরী, মানুষ দেখে আমার এক ধরনের হতাশা হয়। আমাদের দেশটা ঠিক এমন হতে পারত, এই কথা ভেবেই আমি এসব সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে পারিনা। নৈরাশ্যবাদীর মত ঘুরে বেড়াই...ঘুরে বেড়াতে থাকি।
নিষিদ্ধ নগরীর প্রাসাদ ঘুরে দেখতে দেখতে আমাদের খুব ক্লান্তি এসে যায়। আমরা তিনজন বেছে বেছে একটা রেস্তোঁরায় বসে যাই। খাবার অর্ডার করি। ক্রিস্টিনা আমার দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, “তারপর নিঝুম তোমাদের দেশের অবস্থা কি? পলিটিকাল সিচুয়েশন এখন কেমন?”
রিচার্ডের সাথে ক্রিস্টিনা এতক্ষন আলাপ করেছে স্কেট বোর্ডিং, স্কাই ডাইভ কিংবা ক্যানাল বোটিং নিয়ে অথচ আমার সাথে আলাপ শুরু হোলো আমাদের দেশের পলিটিকাল অবস্থা নিয়ে, এই পুরো প্রশ্নের ভেতর আমি কেমন যেন এক ধরনের তাচ্ছিল্যের গন্ধ পাই। হতে পারে একেবারে টিপিকাল সন্দেহযুক্ত মানুষের মত চিন্তা কিন্তু কেন যেন নিজের অজান্তেই আলোচনার প্রকারভেদগুলোকে এড়াতে পারিনা।
আমাকে প্রশ্ন করতে হলে বেছে বেছে প্রশ্ন করতে হয় আমাদের পলিটিকাল সিচুয়েশন নিয়ে, আমাদের বন্যা নিয়ে, আমাদের প্রাকৃতিক দূর্যোগ নিয়ে, আমাদের দারিদ্রতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে অথচ পাশের ভারতকে নিয়ে আলোচনাতেও উঠে আসে তাজমহলের সৌন্দর্য্যের কথা, রাজস্থানের কথা, হায়দারাবাদের কথা। আমি ম্রিয়মান কন্ঠে উত্তর দেই, “ভালোই” বলে। ক্রিস্টিনা হয়ত কিছুটা আঁচ করতে পারে। প্রসঙ্গ পাল্টে আলাপ শুরু হয় চাইনিজ খাদ্য নিয়ে, তাদের সংস্কৃতি নিয়ে।
সিডনীতে ঘুরেছি, লন্ডনের অলিতে গলিতে ঘুরেছি, দুবাই, সিঙ্গাপুর ঘুরেছি। সেখানকার মানুষের জীবন যাপন দেখেছি, তাদের শহর দেখেছি। একটা টাওয়ার ব্রীজ দেখতে সারা বছর লন্ডনে লক্ষ লক্ষ পর্যটকেরা আসেন, একটা অপেরা হাউজ দেখতে অস্ট্রেলিয়ায় সারা বছরে ঠিক এমন সংখ্যক মানুষ ভীড় করেন। বুর্জ খলিফা নামে একটা সামান্য হোটেল দেখতে মানুষ চলে আসে দুবাইয়ে, অসুস্থ হলেই মানুষ চলে আসে সিঙ্গাপুরে। অথচ, কি ছিলোনা আমাদের?
এত সুন্দর একটা বাংলাদেশ, কথায় কথায় বলি পৃথিবীর দীর্ঘতম সমূদ্র সৈকতের কথা, সেন্ট মার্টিনের কথা, কুয়াকাটার কথা, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির সৌন্দর্য্যের কথা, সিলেটের অপরূপ রূপের কথা। কিন্তু আমরা কি করেছি এই দেশটাকে পর্যটকদের পরম কাংখিত করে তুলবার জন্য? ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে একজন সাধারণ মানুষের কি প্রতিক্রিয়া হয় কিংবা সেখান থেকে দূরপাল্লা বা কাছের কোথায় যাবার সময়ে?
দেশকে নিয়ে ভাবতে গেলে রাজ্যের সব হতাশা এসে জড়ো হয় মনের ভেতর।পশ্চিমের দেশ, পূর্বের দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সবাই এগিয়ে যাচ্ছে আর আমরা পড়ে রয়েছি এক আদিম অন্ধকারে। আমাদের নিয়ে আলোচনা আজও জমে ওঠে আমাদের বন্যা,খরা,জলোচ্ছাস,ঘুর্ণিঝড় কিংবা ভঙ্গুর রাজনীতি নিয়ে অথচ এর থেকেও অনেক কিছু রয়েছে এই দেশটিকে নিয়ে যেগুলো নিয়ে কথা বলা যেতে পারত কিংবা এগুলোকে আমরা কথা বলবার মত উপকরণ হিসেবে গড়ে তুলতে পারতাম। হতাশ না হতে চাইলেও হতাশা জুড়ে বসে উপরে...ভেতরে...সবখানে..
এত রক্ত দিয়ে পাওয়া দেশটির এমন তো হবার কথা ছিলো না...
লিখাটা পড়ে চোখে পানি চলে আসলো নিঝুম ভাই ... দেশ নিয়ে চিন্তা করলে , কিছু ভাবলে এক শ্রেণীর মানুষ আছে তারা বলে ভাই আপনার আর কোন কাজ নাই?... আপনার কথা দিয়েই শেষ করি " হতাশ না হতে চাইলেও হতাশা জুড়ে বসে উপরে...ভেতরে...সবখানে..এত রক্ত দিয়ে পাওয়া দেশটির এমন তো হবার কথা ছিলো না..."
ReplyDelete