Sunday 4 September 2016

রাজাকার মীর কাশেমকে নিয়ে টিপু ভাইয়ের বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন এবং আমার উত্তর

যুক্তরাজ্য প্রবাসী বড় ভাই মোহাম্মদ হামিদ টিপু আইনী জগতের একজন বিজ্ঞ লোক। সাম্প্রতিক সময়ে মীর কাশেমের ফাঁসী ও তার কার্যকর নিয়ে তিনি তাঁর ফেসবুকে সরকারের ও আদালতকে তীব্র সমালোচনা করছেন। তিনি এই বিচারকে প্রহসন ও “মিসক্যারেজ অফ জাস্টিজ” বলে অভিহিত করেছেন।
টিপু ভাই তাদেরও অত্যন্ত তীব্র ভাষায় ভৎসনা করেছেন যারা এই কাশেমের ফাঁসীতে অত্যন্ত উদ্বেলিত ও আনন্দিত। তিন ই এসব আনন্দকে কুৎসিত, বর্বর, রক্ত পিপাসু ও একটি পর্যায়ে ফেরাউনের সাথেও তুলনা দিয়েছেন।

ব্যক্তি তাঁর মত প্রকাশ করবেন। আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমি এও মনে করি যে কোনো ব্যাক্তির মতামত পছন্দ না হলে আইদার সেটিকে আমি এড়িয়ে যেতে পারি বা সেই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পাল্টা বক্তব্য দিতে পারি।

টিপু ভাইয়ের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমি পাল্টা বক্তব্য দেয়াকে বেছে নিয়েছি। তিনি আমার একটি পোস্টে মীর কাশেমের মামলা নিয়ে কয়েকটি মন্তব্য করেছেন। এই মন্তব্যের সূত্র ধরেই আমার এই লেখাটির সূচনা। লেখাটি আরো দীর্ঘ ও গভীর হবার দাবী রাখে। কিন্তু এটি যেহেতু কয়েকটি মন্তব্যের উত্তর তাই ঠিক সেভাবে গভীর ভাবে লিখিনি। ঠিক উত্তরের জন্য যতদূর প্রয়োজন ঠিক ততটুকু লিখেছি। কাশেমের ব্যাপারে একটি দীর্ঘ পর্যবেক্ষন আমার প্রকাশিতব্য গ্রন্থ “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালঃ আইন, বিচার, বিশ্লেষন ও পর্যবেক্ষন”-এ থাকবে যেটি আগামী বই মেলায় বাজারে আসবে বলেই আশা করি।

এই লেখাটিকে তাই কয়েকটি মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আমার জবাব হিসেবে দেখলেই আমার জন্য সু-বিচার হবে। মন্তব্যের উত্তর অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে যাবার কারনে আমি এই লেখাটি আমার অফিসিয়াল সাইটে পোস্ট আকারে দিচ্ছি, যাতে করে সবার জন্য পড়তে ও জানতে সুবিধা হয়।
টিপু ভাই তার মন্তব্যে বলেছেন-

“আসলে আমি কোন দলের সমর্থক হিসেবে যুক্তি তর্কের অবকাশ করতে চাই না। তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি সামান্য তথ্য দিতে পারি তর চেষ্টা করব । ডিফেন্স টিমের পক্ষ থেকেও মীর কাশেম আলী যে বেঙ্গল খান নয় তার যথেষ্ট প্রমাণ দিয়েছেন । অপর দিকে প্রসিকিউশন তাদের যুক্তি স্বপক্ষে তেমন কোন প্রমাণ দিতে পারে নি। আসলে এই কাসেম যে সেই বেঙ্গল খান তা যাচাই বাচাই করলেই তো সব যট খুলে যেত ।

সতের বছর বয়সে এমন দুর্দান্ত এবং দুধর্ষ হও এই ডিজিটাল যোগেও যেখানে প্রায় অসম্ভব সেখানে পঁয়তাল্লিশ বছর আগের যুগে তো কল্পনার অতীত । এই মামলার শেখানো সাক্ষীরাও বলতে পারেনি মীর কাসেম কোন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন । রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। দুর্বল সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেয়া কি ঠিক ? মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গত বিয়াল্লিশ বছর কখনও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ করা হয়নি। হঠাৎ করেই তাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য এ সব অভিযোগ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সরাসরি অপরাধে জড়িত থাকার কোন অভিযোগ নেই। আর কোন মামলাও নেই।

শেখানো সাক্ষীরাও বলতে পারেননি তিনি কোথাও ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন। অনেক সাক্ষী বলেছে তাকে কখনও দেখে নি। আলোচিত জসিম হত্যার বিষয়ে তার বোন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তার বোন স্বীকৃতি পত্রিকার সম্পাদক। মীর কাসেমের বিরুদ্ধে এখন এসে তিনি সাক্ষ্য দিলেও স্বাধীনতার পর ৪০ বছরে তার নিজের পত্রিকাতেও কখনও তিনি জসিম হত্যায় মীর কাসেমের জড়িত থাকার কথা বলেননি।তাছাড়া নিহত জসিমের ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এই হত্যাকাণ্ডে মীর কাসেম জড়িত থাকলে তিনি সাক্ষ্য দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।ভাই কি ভাইয়ের হত্যার বিচার চান না ?

এ ছাড়া ডালিম হোটেলে স্বপন নামের এক ব্যক্তি খাওয়া পরিবেশন করত। সে ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে আনা হল না কেন? তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট শফিউল আলমের লেখা বই প্রসিকিউশন আদালতে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু ওই বইয়ের কোথাও মীর কাসেমের নাম নেই। ডালিম হোটেলের ঘটনায় তার জড়িত থাকার কথাও বইয়ের কোথাও বলা হয়নি।আদালতও বলেছেন, এ মামলায় প্রসিকিউশন মামলা পরিচালনার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত দিতে পরেনি।

প্রসিকিউশন যখন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়, তখন ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী এর আইনি সুবিধা আসামি পেয়েই থাকেন।’আইনগতভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় এ মামলায় বেনিফিউ অব ডাউটের সুবিধা পেতে পারতেন মীর কাসেম আলি। আদালত বলেছে প্রসিকিউশন সঠিকভাবে তদন্ত করতে পারেনি। সঠিকভাবে তদন্ত না হলে পুনর্বিচার হতে পারত। অথবা আসামি খালাস পেতে পারত। দুর্বল সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেয়া কি ঠিক ?রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্কে বলা হয়েছে মীর কাসেম ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন এবং সেই সূত্রে আলবদরের কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। ডিফেন্স প্রমাণ দিয়েছেন মীর কাসেম আলবদরের সাথে জড়িত ছিলেন না। আলবদরের তালিকার কোথাও তার নাম নেই।এখন প্রশ্ন হচ্ছে যদি এই কাসেম সেই বেঙ্গল খান না হয়ে থাকেন। যদি কোন দিন সত্য বের হয়ে আসে, যদি এই বানানো সাক্ষীরা বিগত মামলার সাক্ষীদের মত সরকার কর্তৃক শেখানোর কথা স্বীকার করে ফেলে, তাহলে কি মিসকারেজ অব জাস্টিস প্রমাণিত হবে না?”

টিপু ভাইয়ের প্রশ্নগুলোর প্রেক্ষিতে আমার উত্তরঃ
টিপু ভাই, ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। গতকাল আপনার মন্তব্যের পর আমি একটু সময় নিয়েছি পুরো মামলার তিনটা রায় আরো একটু ভালো করে পর্যালোচনা করবার জন্য যে আমার তরফ থেকে যাতে কোনো ভুল তথ্য না আসে। এরই মধ্যে যারা আমার এই মন্তব্যের জন্য বা জবাবের জন্য অপেক্ষা করে ছিলেন তাদেরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আপনি বলেছেন যে আপনি নিরপেক্ষ দৃষ্টি থেকে “সামান্য” তথ্য দিতে চান। আপনি নিরপেক্ষ নাকি পক্ষীয় তা আপনার মন্তব্য-ই প্রমাণ করছে। আমার মনে হয় আর এই বিষয়ে বেশী কিছু বলবার দরকার নেই।
আমরা মূল আলোচনাতেই বরং আসি। আপনি আপনার প্রথম মন্তব্যে বলেছেন ডিফেন্স টিমের পক্ষ থেকে “যথেষ্ঠ” প্রমাণ দেয়া হয়েছে যে মীর কাশেম আলী যে বেঙ্গল খান নয় সেটারে ব্যাপারে। আর অপর পক্ষ অর্থ্যাৎ রাষ্ট্র পক্ষ নাকি তাদের যুক্তির পক্ষে তেমন প্রমাণ দিতে পারেন নি।
আপনার এই কথাগুলো দেখে স্পস্টত বুঝতে পারি আপনি খুব সম্ভবত ট্রাইবুনালের রায়আপীলেট ডিভিশনের রায় কিংবা রিভিউ পিটিশানের রায়টি পড়ে দেখেন নি ভালো করে। আপনার অভিযোগ গুলোর সাথে বাজারের গুজবের খুবই মিল। বাঁশের কেল্লা কিংবা জামাতী পেইজে যেসব গুজব ছড়ানো হয় আপনি সেগুলোই রিপিট করেছেন বলেই আমি মনে করি। সেটি বৈ অন্য কিছু নয়।
এই কথা বলবার কারন আছে অনেক। আপনার ডিফেন্স সাক্ষীর যথেষ্ঠ প্রমাণ সম্পর্কে আসুন একটু জেনে নেই। যেই চার্জে কাশেম আলীর ফাঁসী হয়েছে সেই চার্জটি হচ্ছে ১১ নাম্বার চার্জ। যেখানে কাশেমের বিরুদ্ধে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসীমকে হত্যার সাথে জড়িত থাকার চার্জ আনা হয়েছে। এই চার্জের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে ডিফেন্স তিনজন সাক্ষীকে সাক্ষী হিসেবে আনে।
সেই সাক্ষীরা হচ্ছেন- ডিফেন্স সাক্ষী-১ মমতাজ নুর উদ্দিন (কাশেমের ছোটো বোন), ডিফেন্স সাক্ষী-২ মোহাম্মদ আলী যিনি নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিয়েছেন, ডিফেন্স সাক্ষী-৩ আবু তাহের যিনি তৎকালীন সময়ে রেলের স্টোর ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতেন।
আপনার এই “যথেষ্ঠ” সাক্ষীরা এতই যথেষ্ঠ যে ডিফেন্স সাক্ষী ২ আর ৩ এই দুইজন জানেই না যে ১৯৭১ সালে কোনো রাজাকার ছিলো, জামাতি ইসলামীর কোনো ভূমিকা ছিলো কিংবা শান্তি বাহিনী গঠিত হয়েছিলো। এর মধ্যে সাক্ষী-২ বলেছে যে ডালিম হোটেলের নিয়ন্ত্রনে ছিলো মতি রাজাকার অথচ জেরাতে গিয়ে সে বলে রাজাকার এর নাকি এক্সিস্টেন্স-ই ছিলোনা। (আমার এই বক্তব্যের ক্ষেত্রে আমি রেফার করছি আপীলেট ডিভিশানের রায় পেইজ-১৪০ থেকে ১৪২)
একই কথা বলেছে ডিফেন্স সাক্ষী-৩ আবু তাহের। (আপীলেট ডিভিশনের রায়ের পেইজ-১৪৩ থেকে ১৪৬, আপীলেট ডিভিশানের রায় দ্রষ্টব্য)। আবু তাহের বলেছে যে, সে নাকি জানেই না শান্তি বাহিনী কে গঠন করেছে, জামাতী ইসলামের ভূমিকা কি, ছাত্র সংঘের ভূমিকা কি, গোলাম আজম যে শান্তি বাহিনীর প্রধান ছিলো, এই কথা সে শুনেই নাই তথা সে চট্রগ্রামে গুডস হিল বা অন্যান্য নির্যাতনের কোনো কথাই সে জানেনা। যে মুসলিম লীগ, পিডিবি, নেজামী ইসলামীর কোনো ভূমিকার কথাই জানে না। কাশেমের সাথে তার পরিচয়ের কথা বলতে গিয়ে তাহের বলে যে কাশেমের সাথে তার পরিচয় হয় ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক থেকে একটা বিজ্ঞাপন আনতে গিয়ে এবং একই সাথে তাহের নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে নিজেকে পরিচয় দেয় এবং কাশেমের পূত্র আরমানের অনুরোধে সে সাক্ষী দিতে আসে।
আপনি-ই এইবার বলেন সাক্ষীদের অবস্থা। এমনই সাক্ষী এনেছে যারা জামাতী ইসলামীর ভূমিকার কথা জানেনা, ছাত্র সংঘ কি জানেনা, পিডিবি, নেজামী ইসলাম চিনে না, শান্তি বাহিনীর কথা জানেনা। এই হচ্ছে আপনার “যথেষ্ঠ” সাক্ষীদের নমুনা।
আদালত এই সাক্ষীদের রীতিমত অযোগ্য এবং শেখানো সাক্ষী বলে অভিহিত করেছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা যদি রাজাকার, নেজামী ইসলামী, জামাতী ইসলামী বা শান্তিবাহিনীর কথাই না জানে তবে সে কেমন মুক্তিযোদ্ধা সেটা আদালত ভালো করেই বুঝে ফেলেছিলো। এই বিষয়ে আমার আর কিছুই বলার নাই।
আবার আসি ডিফেন্স সাক্ষী-১ এর কথায়। মিসেস মমতাজ কাশেমের বোন যিনি দাবী করেছেন যে একাত্তরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কাশেম তার বাসায় থাকতে আসে। সোজা কথা হচ্ছে এলিবাই ডিফেন্স দিয়েছে। অথচ এই বোন জানেই না নভেম্বরের আগে কিংবা তারা ৭২ এর মার্চে কুমিল্লা ছাড়ার পর কাশেমের অবস্থান। জেরাতে মমতাজকে পুরো ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলেছে প্রসিকিউশন আইনজীবিরা। বের হয়ে গেছে যে তিনি ভাইকে বাঁচাতে মিথ্যে সাক্ষী দিচ্ছে। (আপীলেট ডিভিশান মামলার রায় পেইজ ১৩৯-১৪০ দ্রষ্টব্য)
এখন আপনি কিংবা যারা আমার এই মন্তব্য পড়ছেন তাঁরা ভালো করে অনুধাবন করতে পারবেন যে ডিফেন্সের সাক্ষীরা কতটা “যোগ্য” ছিলেন আর তারা কতটা “প্রমাণ” করতে পেরেছিলেন।এইখানে উল্লেখ্য যে- গোলাম আজম ১৯৭১ সালের ২১ শে জুন দৈনিক সংগ্রামে মীর কাশেমকে নিয়ে একটা লেখাও লিখেন যেখানে তাকে ছাত্র সঙ্ঘের প্রধান হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এটিও আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে জমা দেয়া হয়েছিলো। পাওয়া যাবে আপীলেট ডিভিশানের রায়ে।
এইবার আসি আপনার “বেঙ্গল খান” এর কাহিনীতে। বেঙ্গল খানের কথাটা মূলত এসেছে আইনজীবি শফিউল আলমের “সেই সে সময় আনন্দ-বেদনা” গ্রন্থের “দুঃস্বপ্নের নরকেঃ হোটেল ডালিম” চ্যাপ্টার থেকে।
লেখক এখন মৃত। তিনি এই মামলায় সাক্ষী দিতে আসতে পারেন নি স্বাভাবিক ভাবেই। এই বইয়ের লেখকের বইটিকে একটি ক্রেডিবল এবং সঠিক ডকুমেন্ট হিসেবে ডিফেন্স আইনজীবিরাই উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এই বইয়ে লিখিত ডালিম হোটেলের হত্যাযজ্ঞ, সেখানকার নির্যাতন, সেখানে জসীমকে হত্যা, এসব কোনো কিছু সম্পর্কেই ডিফেন্সের ডিস্পিউট নেই আদালত ধরে নিয়েছে।
এখন মূল প্রমাণের বিষয় ছিলো যে মীর কাশেম আসলে এই টর্চার চেম্বারের মূল দায়িতে ছিলো কিনা  এবং আলবদর প্রধান ছিলো কিনা। রাষ্ট্রপক্ষকে এও প্রমাণ করতে হয়েছিলো যে মীর কাশেমের যেখানে এমন ভূমিকা ছিলো কিনা যেখানে তার কথা অনুযায়ী বা তার অধীনে নানাবিধ অপরাধের নির্দেশ বাস্তবায়িত হোতো।
মীর কাশেমের ভূমিকা প্রমানের জন্য এই মামলায় ডকুমেন্টারী এভিডেন্স যেমন সাবমিট করা হয়েছিলো ঠিক একই ভাবে মীর কাশেমের হাতে সরাসরি নির্যাতিত ব্যাক্তিরাও সেখানে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলো। এই সুনির্দিষ্ট চার্জে, মানে জসিম হত্যার ক্ষেত্রে ১১ নাম্বার চার্জে রাষ্ট্র পক্ষের হয়ে যারা যারা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তারা হলেন-
রাষ্ট্র সাক্ষী-১ সৈয়দ মোহাম্মদ এমরান, সাক্ষ্য-২ মোহাম্মদ সানাউল্লাহ চৌধুরী, সাক্ষ্য-৩ নাসির উদ্দিন চৌধুরী, সাক্ষ্য-১৬  জাহাঙ্গীর চৌধুরী, সাক্ষী ১৭-হাসিনা খাতুন, সাক্ষী ১৯- এস এম সানওয়ার উদ্দিন, এবং সারকমান্সটেন্সিয়াল সাক্ষী – সাক্ষী-১৮ এস এম জামাল উদ্দিন, সাক্ষী-২০ লুৎফুর রহমান ফারুক, সাক্ষী-২৪ নুরুল ইসলাম
সাক্ষী ১৯ হাসিনা খাতুন একমাত্র সাক্ষী যিনি তার কাজিন জসীমের খুন হবার কথা শুনেছেন উপরের উল্লেখিত বই এর লেখক জনাব আলমের কাছ থেকে। আর বাকী সাক্ষীরা সরাসরি মীর কাশেমের নির্যাতনের শিকার এবং তার কাছে ইন্টারগেটেড হয়েছিলো।
এখানে একটা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিলো যে এইসব সরাসরি সাক্ষীরা কি জসিমকে হত্যা করতে নিজের চোখে দেখেছিলো কিনা?
এই ব্যাপারে আদালতের ফাইন্ডিং বেশ দীর্ঘ। অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনায় এক এক করে মীর কাশেমের জড়িত থাকবার ব্যাপারে আদালত সবিস্তারে তাদের রায় দেন। আদালত বার বার বলেছে যে ডালিম হোটেল ছিলো একটা নির্যাতন কেন্দ্র। প্রথমেই এটা প্রমাণ করা দরকার যে এটি আসলেই নির্যাতন কেন্দ্র ছিলো কিনা। তারপর প্রমাণ করতে হবে যে এই নির্যাতন কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রন মূলত কার কাছে ছিলো।
এই দুইটি ব্যাপার প্রমান কর‍তে যেয়ে আদালত একাধিক প্রত্যক্ষ্য সাক্ষী পেয়েছিলো যাদের নাম আমি উপরে উল্লেখ করেছি। এদের প্রত্যেকে মীর কাশেম ও তার চ্যালাচামুন্ডাদের মাধ্যমে নিগৃহিত হয়েছিলো এবং সেটির সবিস্তার বর্ণনা তারা আদালতে দিয়েছিলো। নির্যাতনের শিকার ব্যাক্তিরা যখন আদালতে এসে বলেন যে তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন সেখানে কেউ যদি বলেন যে উনারা শেখানো সাক্ষী তাহলে এটা প্রমাণ করবার দায় হচ্ছে ডিফেন্স পক্ষের।কিন্তু ডিফেন্স পুরো মামলায় কোথাও দ্বিমত করেনি যে ঐ সাক্ষীরা মিথ্যে বলছেন কিংবা তারা আসলে নির্যাতনের শিকার হন নি। এটা নিয়ে তারা পাল্টা সাবমিশনও কোথাও দেন নি।
এখন আপনি একজন ডিফেন্সের আইনজীবি না হয়ে, মেয়ারলি একজন বাইরের মানুষ হয়ে (ইংল্যান্ডে বসবাসকারী) এই দাবী কিভাবে করেন যে এই সাক্ষীরা শেখানো সাক্ষ্য? আপনি কি ডিফেন্সের আইনজীবি থেকেও বেশী উৎসাহী? আপনার কাছে কি এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো প্রমাণ রয়েছে? থাকলে আশা করি সেটি দেখাবেন।
ডিফেন্সের আইনজীবিরা শুধু বার বার এটা প্রমাণ করতেই ব্যাস্ত ছিলেন যে প্রসিকিউশনের সাক্ষীরা নির্যাতন, নিগৃহিত হলেও এবং তা সত্য হলেও অন্তত মীর কাশেম সেটা করেনি বা এসবের সাথে কাশেমের কোনো সংযোগ নেই।এই টুকুই। আর আপনি ডিফেন্সের আইনজীবিদের ছাপিয়ে এত দীর্ঘদিন ধরে চলা একটা মামলাকে এক বাক্যে বলে দিলেন যে এইগুলা শেখানো সাক্ষ্য? এইসব প্রতিটি সাক্ষীকে ক্রস এক্সামিন করবার সুযোগ পেয়েছিলো ডিফেন্স পক্ষ, একটি সাক্ষীকেও কি মিথ্যে প্রমাণ করতে পেরেছে ডিফেন্স? প্রমাণ করতে কি পেরেছে যে তারা শেখানো সাক্ষী? উত্তরটি আশা করে দিয়ে যাবেন।
অথচ ডিফেন্সের যেই তিন সাক্ষীর কথা বললাম এই সুনির্দিষ্ট চার্জের ক্ষেত্রে সেখানে সেই সাক্ষীরা রাজাকার কাকে বলে সেটাই জানেনা। তারা জানেই না যে গোলাম আজমের ভূমিকা। তারা নেজামী ইসলামী বা পিডিবি বা শান্তি বাহিনীর কথাই জানেনা। এদের একজন জানেই না যে নভেম্বরের আগে তার ভাই কই ছিলো বা পরে ঢাকা থেকে কোথায় গেছে। অত্রহচ তাদেরকে আপনার শেখানো সাক্ষ্য মনে হয় না। আপনার সব নজর খালি প্রসিকিউশনের সাক্ষীর দিকে, আপনার সব চিন্তা তাদের নিয়ে। বলিহারি ভাই আপনার চিন্তা। কুদোস!!!! আপনার নিরপেক্ষ চিন্তার মানদন্ড নিয়ে আসলে বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
আপনি কথায় কথায় কোরানের বানী ফেসবুকে দেন, আল্লাহর নাম নিতে নিতে হয়রান হয়ে উঠেন। কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন তো যে আসলেই কি আপনি নির্মোহ ভাবে ভাবতে সক্ষম?
আপনি যদি সত্যি-ই নির্মোহ ভাবে সক্ষম হন তাহলে এই নির্যাতন সেলে যতসব নির্যাতিত মজলুম সাক্ষীরা এসেছেন অন্ততপক্ষে সে মজলুমদের পক্ষে আপনি দুটো কথা হলেও বলতেন। আপনার কথা শুনে মনে হয় ডালিম হোটেলে একটা মানুষও নির্যাতন হয়নি কিংবা জসীম আসলে মারাই যায়নি, সে হারিয়ে গেছে।
যাই হোক, আমরা ফিরে আসি আমাদের আইনী পর্যালোচনায়।
আমি আগেই বলেছি যে মূল প্রমাণের বিষয় ছিলো যে মীর কাশেম আসলে এই টর্চার চেম্বারের মূল দায়িতে ছিলো কিনা  এবং আলবদর প্রধান ছিলো কিনা। রাষ্ট্রপক্ষকে এও প্রমাণ করতে হয়েছিলো যে মীর কাশেমের যেখানে এমন ভূমিকা ছিলো কিনা যেখানে তার কথা অনুযায়ী বা তার অধীনে নানাবিধ অপরাধের নির্দেশ বাস্তবায়িত হোতো।
এখন আদালতে যখন উল্লেখিত এসব সাক্ষীদের সাক্ষ্য গুলো গৃহীত হোলো ও ডিফেন্সও তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করেনি তাদের নির্যাতিত হবার ব্যাপারে বা ফ্যাক্টের ব্যাপারে সুতরাং এখানে মীর কাশেমের দুটো ব্যাপার প্রমাণিত হয়।
[এক]- মীর কাশেম এই সাক্ষীদের নির্যাতন করেছে এটি সত্য আর [দুই]- কাশেম এই টর্চার চেম্বারের প্রধান ছিলো।
এই দুই নাম্বার-এর বেলাতে কিছু ডকুমেন্টারী এভিডেন্স, যেটি আদালতে সাবমিটেড হয়েছে সেটি আলোচিত হওয়া দরকার যেখানে ক্লিয়ারলি বলা হয়েছে যে ছাত্র সঙ্ঘের তৎকালীন চট্রতগ্রাম অঞ্চলের প্রধান কাশেম বদর বাহিনীর প্রধান হিসেবেই নিযুক্ত হন। কেননা আদালত এটাকে জুডিশিয়াল নোটিশ হিসেবেই নিয়েছেন ঐতিহাসিক ফ্যাক্টকে বিবেচনা করে যে ছাত্র সঙ্ঘের কর্মীরাই আল-বদর বাহিনী তৈরী করে এবং সেখানের যে হায়ারার্কি বিদ্যমান ছিলো সে অনুযায়ী আল বদরের হায়ারার্কি বিন্যাস্ত হয়েছিলো।
বাঙ্গালী খানের বিষয়টাও ক্ল্যারিফায়েড হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। পাকিস্তানী সেনাদের সাধারণত বাংলাদেশে অনেকেই খান সেনা বলে উল্লেখ করত মুক্তিযুদ্ধের সময়। এটা ছিলো সামগ্রিক পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর একটা লোকাল নেইম। এই পাকিস্তানী বাহিনীকে যেভাবে ট্যাগ করা হোতো ঠিক একইভাবে বাংলাদেশী কাউকে এমন নৃশংস বা খুনে প্রকৃতির দেখলে তাকেও শর্ট নামে ডাকা হোতো বাঙ্গালী খান বলে। মূলত এইখানে “খান” শব্দটা আসলে একটা গোত্রকে বা নির্যাতনের একটা সামগ্রিক অভিধা হিসেবে পদবী হয়েই উল্লেখিত হোতো।
সুতরাং এইখানে দুইটি বিষয় আদালতের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। যে কাশেমের যুক্ত থাকবার প্রমাণ ক্লিয়ারলি প্রমাণিত সাক্ষীদের সাক্ষ্য দ্বারা আর সেই সাক্ষ্য গুলোই মূলত প্রমাণ করেছে কাশেম সেখানে মূল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলো।
রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলাকে কোট করেছে। এগুলোর একটি হচ্ছে- “বাগিলিশেমা” [ইয়াগোস্লাভিয়া ট্রাইবুনাল] মামলা যেখানে বলা হচ্ছে যে “প্রেজেন্স হোয়েন কম্বাইন্ড উইথ অথরিটি মে কন্সটিটিউট এসসিটেন্স ইন দা ফর্ম অফ মোরাল সাপোর্ট”
একটা কথা আদালত বার বার বলেছে জসিমকে যখন খুন করা হয়েছিলো তখন সেখানে অপরাধীরা ছাড়া আর কেউ থাকবে না এটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক। এটা ওপেন ফিল্ডে যুদ্ধের সময় গুলি করে হত্যা করা হলে হয়ত সুযোগ থাকত অন্য নির্যাতিত বা বন্দীর সামনে এই ঘটনাগুলো ঘটাবার এবং পরবর্তীতে সেই বন্দী বেঁচে থাকলে সে ঘটনার সাক্ষী হবার। কিন্তু এই ডালিম হোটেলের ব্যাপারটাই ছিলো ভিন্ন। এখানে বন্দীদের জন্য রুম ছিলো আটকে রাখার, টর্চাররের জন্য রুম ছিলো। সেখানে কার এত সাহস হবে যে কাউকে টর্চার করা হবে আর সেটি গিয়ে অন্যজন দেখতে সামনে এগিয়ে যাবে। আদালত কিন্তু এ কথা স্পস্ট করেই তার রায়ে বএলছেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী মীর কাশেম যদি জসিম কে নিজ হাতে হত্যা না করেও থাকে তাহলেও সে দায় এড়াতে পারেনা কেননা সেই টর্চার সেলের যে আদর্শ, যে কর্মকান্ডের জন্য সেটিকে তৈরী করা হয়েছে বা সেখানে যা হোত সেটি কাশেমের নিয়ন্ত্রনেই ছিলো মূলত। সুতরাং আইনের ৪ ধারা ২ উপধারাতে কাশেম আটকে যায়।
টিপু ভাই দাবী করেছেন যে, গত ৪২ বছরে মীর কাশেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় নাই কেন? তিনি এও দাবী করেছে যে কোনো সাক্ষীরা নাকি বলতে পারেনি ( যাদের তিনি শেখানো সাক্ষ্য বলেছেন) কাশেম কোথাও জড়িত ছিলো। তার এই বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ আমি এরই মধ্যে প্রমাণ করেছি মিথ্যে দাবী হিসেবে কেননা কাশেমের হাতে নির্যাতিত ও ইন্টারোগেটেড ব্যাক্তিরা আদালতে এসে সাক্ষী দিয়ে গেছেন। সুতরাং টিপু ভাইয়ের বলা কথাটি মিথ্যে ও এই মামলা সম্পর্কে না জানবার ফসল বৈ অন্য কিছু নয়।
আর ৪১ বছরে কেন মামলা হয়নি এটা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরবর্তন আর বিচার নিয়ে নানাবিধ কালক্ষেপন এগুলো সবাই জানেন। যাদের বিরুদ্ধে সে সময় মামলা হয়েছিলো যেমন গোলাম আজম, কামারুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের তাদের বিচারও কি গত ৪২ বছরে হয়েছিলো? উত্তর হচ্ছে না হয়নি। সুতরাং যাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ এর পর মামলা হবার পরেও এই দেশে তাদের বিচার একটা সময় পর্যন্ত হয়নি সেখানে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি তাদের কথা বলে পুরো ব্যাপারটিকে দীর্ঘায়িত করবার কিছুই নেই।
টিপু ভাই আরো দাবী করেছেন যে-
আলোচিত জসিম হত্যার বিষয়ে তার বোন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তার বোন স্বীকৃতি পত্রিকার সম্পাদক। মীর কাসেমের বিরুদ্ধে এখন এসে তিনি সাক্ষ্য দিলেও স্বাধীনতার পর ৪০ বছরে তার নিজের পত্রিকাতেও কখনও তিনি জসিম হত্যায় মীর কাসেমের জড়িত থাকার কথা বলেননি।
এখানে একটা কথা উল্লেখ্য যে জসীমের বোন যে সাক্ষ্য দিয়েছেন সেটি সেটি প্রত্যক্ষ্য ঘটনা দেখেছেন এমন ক্যাপাসিটিতে নয়। তিনি আইনজীবি শফিউল আলমের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনেছেন এবং সেখান থেকেই জানতে পেরেছেন তার ফুফাত ভাইয়ের খুন হয়ে যাবার কথা ও কে খুন করেছে সে কথা।
গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন গেছে আমরা জানি। সামান্য রাজাকার শব্দটা এক সময় বাংলাদেশে কেউ বলতে সাহস করেনি। এক সরকার গেলে আরেক সরকার আসে এবং এক সরকারের আমলে সাহস দেখানে অন্য সরকার কি করবে সেটি বাংলাদেশের মানুষ ভালো করেই জানে এবং সে কারনেই সাহস দেখাতে অনেকেই পেছপা হন। আর শবচাইতে বড় কথা হচ্ছে আইনজীবি শফিউল আলমের কাছ থেকে তিনি যা শুনেছিলেন সেটি তখনো কোনো আদালতে প্রমাণিত ছিলোনা। আর প্রমাণ ছাড়া কারো নাম উল্লেখ করলে পত্রিকায় লিখলে স্বাভাবিক ভাবেই তাকে মানহানির মামলা বা আইনী ঝামেলায় পড়তে হোতো। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি এসব ঝামেলা এড়াতে মুখ বুঁজে সব সহ্য করেছিলেন। এখন ৩৯ বছর পরে যখন বিচার শুরু হয়েছে প্রোপারলি, স্বাভাবিক ভাবেই তিনি সেখানে সাক্ষ্য দিয়েছেন যতটুকু জানেন ততটুকু দিয়ে। তাঁর সাক্ষ্য দিয়েই তো কাশেমের ফাঁসী হয়নি সুতরাং এটি বলাও যাবে না। ফাঁসী হয়েছে সব সাক্ষ্যের সম্মলিত বক্তব্য ও তার প্রেক্ষিতে নানাবিধ পর্যালোচনার ফলে।
টিপু ভাই এও বলেছেন যে-
তাছাড়া নিহত জসিমের ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এই হত্যাকাণ্ডে মীর কাসেম জড়িত থাকলে তিনি সাক্ষ্য দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।ভাই কি ভাইয়ের হত্যার বিচার চান না? এ ছাড়া ডালিম হোটেলে স্বপন নামের এক ব্যক্তি খাওয়া পরিবেশন করত। সে ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে আনা হল না কেন?
স্বপনকে কেন আনা হয়নি বা জাহাঙ্গীর সাহেবকে কেন আনা হয়নি এইটা অবান্তর প্রশ্ন। প্রসিকিউশন যাদের যাদের এভেইলেভেল পেয়েছেন, যারা যারা সাক্ষ্য দিতে আসবার আগ্রহ দেখিয়েছেন তারাই সাক্ষ্য দিতে আসবেন। জাহাঙ্গীর সাহেব সাক্ষ্য দিতে আসাটাই আসলে মুখ্য নয়। দেখতে হবে পুরো ঘটনা সম্পর্কে উনি কতদূর জানেন বা সে সময় তিনি কোথায় ছিলেন। ভাই, বো্‌ বাবা-মা, হলেই যে তিনি ভালো সাক্ষী হবেন তা নয়। একজন আইনী ঘরানার লোক হিসেবে এইসব ব্যাপার টিপু ভাইয়ের ভালো জানার কথা। তারপরেও তিনি কেন অবান্তর প্রশ্ন করেন এইটাই আমার মাথায় ঢুকে না। তিনি কি প্রশ্ন গুলো জাস্ট মানুষকে বিভ্রান্ত করবার জন্য করেন নাকি আসলেই না বুঝে করেন এটা আসলে পর্যালোচিত হবার দরকার আগে।
আর স্বপন নামের ব্যাক্তির কথা টিপু ভাই যা বলেছেন সেটাও আগের উত্তরের মত বলব। স্বপন কে যদি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে ডিফেন্স মনে করে থাকে বা টিপু ভাই মনে করে থাকে তবে আমি পাল্টা প্রশ্ন উনাকে করব যে স্বপনকে কেন ডিফেন্স পক্ষ সাক্ষী হিসেবে আনেনি?
এনে তার কাছ থেকে বের করে দেখাতো যে সেখানে কাশেম নামের কারো অস্তিত্ব ছিলোনা, তাহলেই ল্যাটা চুকে যেত। সেটি না করে কাকে সাক্ষী হিসেবে আনতে হোতো বা না হোতো সেসব ডিরেকশন টিপু ভাই কেন দিচ্ছেন?
প্রসিকিউশন যেটা সঠিক মনে করেছেন, যাদের যাদের এভেইলেবল পেয়েছেন তাদের এনেছেন। অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং কাকে আনলে ভালো হোতো বা কাকে আনে নি এটা দিয়ে কি কাশেমের অপরাধ অ-প্রমাণিত হচ্ছে বা সে ভালো লোক এটি প্রমাণ হচ্ছে? পুরো অবান্তর কথা বার্তা। টিপু ভাইয়েরর কথা শুনলে মনে হয় উনি রাষ্ট্রপক্ষের জন্য বড় ব্যাথিত। ওই সাক্ষী কেন আনেনি বা সেই সাক্ষ্য কেন নেই ইত্যাদি বলে বড় ব্যাথিত হয়েছেন। আসলে কি তাই?
সাক্ষী কে আসবে বা না আসবের সেগুলো নির্ধারিত হবে প্রসিকিউশনের সিদ্ধান্তের পর। যেহেতু উনারা মামলার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন সুতরাং সবচাইতে ভালো সিদ্ধান্ত তাঁরা নেবেন। আমিও নেবনা বা টিপু ভাইও না। পর্যবেক্ষক হিসেবে হয়ত আমরা মতামত দিতে পারি বা বিশ্লেষন করতে পারি কিন্তু একটা সাক্ষী না আসলে একিউজড তাতে করে ভালো লোক হয়ে গেলো এমন সিদ্ধান্ত আমরা নিতেও পারিনা কিংবা আমাদের লেখাতে তেমন ভাইব আনাটাও অনুচিৎ।
টিপু ভাই আবার বলেছেন যে শফিউল আলম তার বইতে কাশেমের নাম আনেনি। এই প্রসঙ্গে বলব-এতে করে কিছুই প্রমাণিত হয়না। শফিউল সাহেব এই বই প্রকাশ করেছেন ২০০৬ সালে এবং খুব সম্ভবত এই বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছে তারও আগে। ২০০৬ সালের টা ২য় সংস্করন হতে পারে। এই সময়টা বি এন পি-জামাত ছিলো ক্ষমতায়। আর এই বইয়ের কথার উপর ভিত্তি করেই মামলার রায় হয়নি এই ব্যাপারটা সবার আগে বুঝতে পারা হচ্ছে জরুরী। এটা সহজেই অনুমেয় যে সে সময়ে (২০০৬) কার ঘাড়ে কয়টা মাথা ছিলো যে কাশেমের বিরুদ্ধে একটা বইয়ে তিনি উল্লেখ করবেন খুনী হিসেবে। সে কারনেই তিনি বাধ্য হয়ে তার কোড নেম বাঙ্গালী খান বলে উল্লেখ করেছেন।
সে সময়ে কাশেমের বিরুদ্ধে এই আন্তর্জাতিক অপরাধের আইনে কোনো মামলাও হয়নি যে তিনি সাহস করে সেটি বলবেন। সুতরাং এই ক্ষেত্রে মানহানি বা রাজনৈতিক হ্যারাসম্যান্টের শিকার হবার সম্ভাবনা থেকেই হয়ত জনাব আলম কাশেমের নাম আর বলেন নি বইতে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে যে ডিফেন্স সাক্ষীরা এইসব বই পত্র, ডকুমেন্ট, ঐতিহাসিক নথিকে বার বার সমালোচনা করেছে এবং এগুলোকে হিয়ার্সি এভিডেন্স বলে তাকে হেয় করেছে। আবার সেই ডকুমেন্টের কোনো একটি লেখা বা লাইন তাদের পক্ষে যাবার সুযোগ থাকলে সেটি কিন্তু এরা হাত ছাড়া করেনি।
ভন্ড, প্রতারকদের চরিত্র বড় অদ্ভুত। যেসব বইপত্র তাদের পক্ষে যাচ্ছে বা তাদের নাম উল্লেখ নেই এমন দেখলেই সেগুলো আদালতে হাজির করছে আর বলছে “দেখেন আমাদের অমুক নেতার নাম নাই, তার নাম নাই ইত্যাদি”। এগুলো রাজাকার সাকাও করেছে, কামারুজ্জামান, নিজামী সবাই করেছে। আবার অন্যদিকে তাদের নাম থাকলে সেগুলোকে তারা ভুয়া ভুয়া বলে অভিহিত করছে। ভন্ডামীর একটা সীমা থাকা উচিৎ আসলে।
টিপু ভাই বলেছেন আদালত নাকি বলেছে-
এ মামলায় প্রসিকিউশন মামলা পরিচালনার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত দিতে পরেনি। প্রসিকিউশন যখন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়তখন ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী এর আইনি সুবিধা আসামি পেয়েই থাকেন। আইনগতভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় এ মামলায় বেনিফিউ অব ডাউটের সুবিধা পেতে পারতেন মীর কাসেম আলি।
টিপু ভাই আবারো না জেনে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রথমেই উনার জানা থাকা দরকার যে বেনিফিট অফ ডাউট পেয়েছেন বলেই কাশেম তার ১২ নাম্বার চার্জে মৃত্যু দন্ড থেকে বেঁচে গেছে। আর কংক্রীট তথ্য প্রমাণ ছিলো বলেই ১১ নাম্বার চার্জ থেকে তার রেহাই মিলেনি। আদালতের রায়ে টিপু ভাইয়ের উল্লেখিত কথাটি কোথায় লেখা রয়েছে যে প্রসিকিউশন কোথায় তথ্য বা উপাত্ত দিতে পারেনি?  দয়া করে আমাদের কি তিনি দেখাবেন? আমরা অধীর আগ্রহে তার এই রেফারেন্সের জন্য অপেক্ষা করব। তিনি যদি না দেখাতে পারেন তাহলে ধরে নেব তিনি মিথ্যে বলছেন ও মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।
মাওলা পরিচালনার জন্য তথ্য প্রমাণ না দিতে পারলে কি কারো ফাঁসী হয় কিংবা জেল? টিপু ভাই রায় পড়ে দেখেন নি, বাঁশের কেল্লা পড়ে দেখেছেন। আর সে কারনেই তার এইসব বিপত্তি হচ্ছে। সুতরাং তার কাছে আমার অনুরোধ যে দয়া করে তিনি যেন আমাদের দেখান কোথায় তার বলা কথাগুলো লেখা রয়েছে।
টিপু ভাই অবশ্য কাশেমের বয়স দু বছর কমিয়ে ১৭ বছরের একজন হিসেবে মন্তব্যে বলেছেন। কিন্তু আমরা ট্রাইবুনালের রায়ের ২য় পৃষ্ঠাতেই দেখতে পাই যে কাশেমের জন্ম ১৯৫২ সালে। অর্থ্যাৎ ১৯৭১ সালে তার বয়স ১৯। চট করে দুই বছর কমিয়ে দিয়ে তাকে বালক হিসেবে দেখাতে চাইবার ও এই মিথ্যাচারের কারন কি? এই ১৯ বছরের যুবক নাকি এত বড় অধীন থাকতেই পারেনা অথচ ৭ ই নভেম্বর ১৯৭১ সালে কাশেম চট্রগ্রাম অঞ্চলের ছাত্র সংঘের প্রধান হিসেবেই নিযুক্ত হয়। টিপু ভাইয়ের ভাষায় এই বালককে এই কম বয়সে কিভাবে একটি ছাত্র সংগঠনের এত বড় পদে দেয়া হোলো? মুক্তি যুদ্ধের সময় ছাত্র সঙ্ঘের ভূমিকা কি ছিলো? কি করেছিলো তারা সে সময়? এইসব কি এখন ইতিহাসের বই খুলে খুলে টিপু ভাইকে দেখাতে হবে? নাকি উনি তার মাসুম বাচ্চা থিওরি নিয়েই পড়ে থাকবেন?


[উপরের ছবিতে নিয়াজীর সামনে বাচ্চা বাচ্চা রাজাকারদের দেখা যাচ্ছে। অনুমান করেই হয়ত বয়স বলে দেয়া সম্ভব। টিপু ভাই আসা করি সেটি নিজে নিজেই করে নেবেন]
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৪ বছরের ছেলেদের নিয়ে শাহীন ফৌজ নামে একটি দল গঠন করা হয় পাকিস্তানী আর্মির আন্ডারে যার তত্বাবধায়নে ছিলো এসব উল্লেখিত রাজাকাররাই।
shahin
             [উপরের ছবিতে শাহীন ফৌজের সদস্যদের দেখা যাচ্ছে। সূত্রঃ একাত্তরের দালালেরা, শফিক আহমেদ]
এই ছাড়াও বয়সে ছোট দেখায় এমন রাজাকারের ছবি পর্যন্ত আমার কাছে আছে যা উপরে দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫ বছর বয়সী বাচ্চা ছেলে ইমরান দেশকে বাঁচাতে যুদ্ধে গিয়েছিলো, ১১ বছর, ১৪ বছর, ১৫ বছরের ছেলেরা যুদ্ধে গিয়েছিলো আর ১৯ বছরের ধাড়ি 375482_266539986746799_100001724008590_703879_334761070_nকাশেম রাজাকার হতে পারবে না যে কিনা তৎকালীন ছাত্র সঙ্ঘের প্রধান ছিলো, এটা নিয়ে কথা বলাটাই এক ধরনের মূর্খতা।
অভিযুক্তের আইনজীবি এই বয়স ইস্যুতে কি আদালতে কোনো কথা বলেছেন? অভিযুক্ত নিজে কি কিছু বলেছে এই ব্যাপারে? উত্তর হচ্ছে, না বলেনি। যেখানে অভিযুক্তের লইয়ার বলেনি, অভিযুক্ত নিজে বলেনি সেখানে টিপু ভাই যেচে পড়ে এই বয়স ইস্যু সামনে নিয়ে এসে যুক্তি দিচ্ছেন ঠিক কোন কারনে? অভিযুক্তের চেয়ে কি আপনি তার মামলা বেশী বুঝেন?
আমিএটি বলে নেই যে ট্রাইবুনালের রায়, আপীলেট ডিভিশানের রায় এই দুটো রায়ে আসলে পুরো মামলার সকল বিষয় বস্তু পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে। কেন কাশেমকে ফাঁসী দেয়া হয়েছে, কেন তার শাস্তি হয়েছে, কোন কোন মাওলায় তার খালাশ হয়েছে বা জেল হয়েছে বা কেনই বা তা হয়েছে সেসব সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।
উপরে উল্লেখিত সাক্ষীদের কথা আমি যা বলেছি সেসব আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে রায়ের মধ্যে। আমার পক্ষে হয়ত সম্ভব না যে ট্রাইবুনালের রায়ের ৩৫১ পাতার পুরো আলোচনা এখানে করবার কিংবা আপীলেট ডিভিশানের রায়ের ২৪৪ পাতার আলোচনা এখানে করবার কিংবা রিভিউ পিটিশানের রায়ের ২৯ পাতা এখানে আলোচনা করবার।
আমি শুধু মাত্র টিপু ভাইয়ের উল্লেখিত ইস্যু গুলোকে খন্ডন করে সংক্ষেপে বলছি মাত্র। যারা আরো বিস্তারিত জানতে চান বা বুঝতে চান তাদের অনুরোধ করব মূল রায়গুলো সময় নিয়ে পড়তে। এতে করে সকলেই বুঝতে পারবেন যে কাশেমের ফাঁসী কেন হয়েছে। আপনারা একই সাথে দেখতে পারবেন যে ডিফেন্স কি কি ভুল করেছে, তাদের সাক্ষী কতটা বাজে ছিলো, তাদের দেয়া আইনী তর্কগুলোর ফাঁক ফোকর গুলোও কিভাবে আদালতে পর্যালোচিত হয়েছে সেসব সব কিছুই আপনারা দেখতে পাবেন।

No comments:

Post a Comment