ওই রাতের সর্বশেষ হত্যাকান্ডের শিকার তিনি। মা'র কাছে যেতে চাইতেই এক সৈন্য তাঁকে মা'র কাছে পৌঁছে দেবে, এই কথা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো দোতলায়। যাবার আগে মহিতুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "ভাইয়া আমাকে মারবে না তো?"
যাবার পথে রাসেল বাবার রক্তমাখা দেহের উপর দিয়ে হেঁটে গেছে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে। হয়ত বাবার দেহ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলো শিশুটি। যে বাবার এত প্রিয় ছিলো, তাঁর রক্তাক্ত দেহ দেখে কি রাসেল যেতে চেয়েছিলো আর?
তিনি কি বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাঁর নরম তুলতুলে পবিত্র হাতে? বাবাকে একবার ছুঁয়ে কি দেখেছিলেন তিনি? একটিবার কি বাবার মৃত দেহের উপর আছড়ে পড়েছিলো রাসেল? বাবাকে কি শেষবারের মত চুমু খেয়েছিলো আমাদের রাসেল? ঠিক মানুষের মত দেখতে সৈন্যগুলো কি সে সুযোগ দিয়েছিলো রাসেলকে?
সে কথা আমরা আর জানতে পারিনা। আমরা সাক্ষীর বয়ানে কেবল একটি আর্ত চিৎকারের শব্দ শুনবার কথা জানতে পারি।
রাসেলকে যখন খুনীরা শক্ত করে ধরে উপরে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন সে পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই। মাত্র ৯ বছরের ছোট বাচ্চাটি একা এক গ্রীক পুরাণের ট্র্যাজেডির নায়কের মত মাড়িয়ে গেছেন পিতার রক্ত, নীচ তলায় বড় ভাইয়ের মৃত দেহ।
মায়ের ঘরে ঢুকে রাসেল কি চিৎকার করে উঠেছিলো মা'র মৃত দেহ দেখে? রাসেল কি তাঁর মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ভয়ে, বেদনায়? দুঃখে ? কষ্টে? যাতনায় কিংবা তীব্র বিষাদে?
রাসেল কি তাঁর মেজ ভাইয়ের নিথর দেহ দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলো? এক ভয়ংকর ঘরে একা একা এই শিশুটি ঠিক কেমন করে তাঁর শেষ মুহুর্ত গুলো কাটিয়েছিলো? একটিবার কি অনুরোধ করেছিলো শিশুটি, তাঁকে খুন না করবার জন্য? সৈন্যটিকে কিছু বলেছিলো কি? বড় বোনের কথা শিশুটির কি মনে হয়েছিলো একটিবারের জন্য? শেষবারের মত? বাবার মুখ, মায়ের মুখ, ভাইদের মুখ?
যে সৈন্যটি রাসেলকে গুলি চালিয়েছিলো সে এখন কেমন আছে? কোথায় আছে? তার কি ঠিক রাসেলের বয়সী সন্তান ছিলো কখনো? একটিবারের জন্য কি সে তাকিয়েছিলো রাসেলের দিকে? রাসেলের চোখের দিকে? রাসেলের চোখে, রাসেলের বুকে গুলি করবার জন্য ঠিক কতটা...ঠিক কতটা নিষ্ঠূর হতে হয়েছিলো সেই সৈন্যটিকে?
সেই রাতে সেই সৈন্যটি কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলো? ঘুমের মধ্যে এপাশ-ওপাশ করেছিলো কি? কিংবা তারপর কোন রাত? তারপর কি সেই সৈন্যটির কখনো মনে পড়েছিলো রাসেলকে? ঘুমের ঘোরে, দুঃস্বপ্নে? কিংবা তার নিজের সন্তানকে আদর করবার সময় কিংবা কোনো নির্জনে? মনে কি পড়েছিলো কখনো? একটিবারের জন্য কি তার মনে পড়েছিলো সেই ছলের কথা? সেই চাতুরীর কথা? মা'র কাছে পৌঁছে দেবার নাম করে খুন করে ফেলবার কথা?
সৈন্যটি যখন তার স্ত্রীর সাথে মিলনে যায় কিংবা ঝাঁ ঝাঁ তপ্ত দুপুরে স্নান করতে নেমে পড়ে শান্ত পুকুরে কিংবা সন্তানদের ভাত তুলে খাইয়ে দেয় পরম আদরে কিংবা একা হাঁটে স্নিগ্ধ ঘাস মাড়াতে মাড়াতে, মনে কি পড়ে তার রাসেলের কথা? রাসেলের সুতীব্র কান্না, আহাজারি, কষ্ট সব কিছু কি সৈন্যটিকে প্রতিরাতে চৌচির করে দেয়?
সেই সৈন্যটিকে কি রাসেলের মায়াবী দুটো চোখ প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন দেয়? ওই দুটো চোখ, সেই ভয়ার্ত আহাজারি কিংবা মায়ের কাছে নিয়ে যাবার মিথ্যে ছলনা কি সেই মানুষের মত দেখতে পশুটির আজও বুক শুকিয়ে দেয়? মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সৈন্যটির কি খুব তৃষ্ণা পায়? কখনো কি সে তার সন্তানদের হারাবার ভয়ে কাতর থাকে কিংবা আতংকিত?
সৈন্যটি কি বেঁচে রয়েছে? বেঁচে থাকলে কোথায় রয়েছে? কি নাম তার জননীর? অথবা তার পিতা? কার গর্ভে জন্মেছিলো সৈন্যটি? কার বীর্য এতটা পাপের জন্ম দিয়েছিলো? কি নাম ছিলো পিতার? সৈন্যটির জননী কি কখনো জানতে পেরেছিলো তার পেটের পশুটির কথা? অভিশাপের কথা? তিনি কি জেনেছিলেন একদিন তার গর্ভে জন্মাবে একটা চকচকে খুনী যে কিনা একটি শিশুকে খুন করে এসে নিশ্চিন্তে পানি খাবে, ভাত খাবে...
আমাদের অশ্রু ফুরোয়...আমাদের কষ্ট হিমাংকের নীচে নেমে নেমে হারিয়ে যায়...আমাদের চেপে রাখা কষ্টগুলো প্রতিরাতে ক্রুদ্ধ সাপের মত ফনা তুলে সব ছারখার করে দিতে চায়...
শুধু প্রশ্নের উত্তর আর পাওয়া হয় না...
No comments:
Post a Comment