Sunday 20 October 2013

মাসুদ রানা জানেন নাঃ “যা লয়ে বিচার”

লন্ডনে অন্যান্য খবরের কাগজের মধ্যে “পত্রিকা”-ই আমার সবচাইতে পছন্দের সুতরাং গ্রোসারীতে গেলে এক কপি “পত্রিকা” আমার বাজারের ঝুড়িতে অবধারিত ভাবে স্থান পায় সব সময়ই। গতকালও বাজার থেকে এক কপি পত্রিকা নিয়ে আসতে আমার ভুল হয়নি। কিন্তু বাসায় এসে যখন “পত্রিকা” তে প্রকাশিত কলামিস্ট মাসুদ রানার একটি লেখা “গোলাম আজমের আটকঃ কি লয়ে বিচার” এই শিরোনামে একটি লেখা পড়ি, তখন মনে হচ্ছিলো এই ইস্যুটি না কিনলেই হয়ত পারতাম। অযথাই মন খারাপ হওয়া আর একজন দায়িত্বজ্ঞান সম্পূর্ণ মানুষ যাকে মনে করতাম, তাঁর রচিত “যুদ্ধাপরাধের বিচারকে ধোঁয়া গ্রস্থ করা ধরনের লেখা” (অন্ততঃ আমার মতে ও পর্যবেক্ষনে) সম্ভবত পড়তে হোতো না। ঠিক এমন করেই যখন ভাবনা এগোচ্ছিলো তখন নিজেকেই প্রবোধ দেই এই বলে যে, অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে? বরং চোখ খুলে রেখে এই প্রলয় কে ঠেকাতে হয়। প্রলয়কে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হয় যে, “তুমি এসে যে ক্ষতি করেছো মানব জাতির, সমাজের, সংসারের তার প্রভাব তোমার মত প্রলয়কারীর হয়ত জানা নেই”। সেই ভাবনা থেকেই আজকে এই লেখা লিখতে বসা। উক্ত লেখার লেখক জনাব মাসুদ রানা তাঁর লেখায় যেসব ভুল তথ্য, গোলাম আজমের গ্রেফতার নিয়ে ব্রিক লেইনে আনন্দিত মানুষের প্রতি যে সুক্ষ্ণ ঠাট্টা করবার ক্ষীন চেষ্টা করেছেন এবং সর্বপোরি যেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এসেছেন, সেগুলোর একটা জবাব খুব প্রয়োজনীয় বলেই আমার মনে হয়েছে। সে কারনের আজকের এই লেখা লিখতে বসা।


কলামিস্ট মাসুদ রানা তার লেখার শুরুই করেছেন একটা সারকাস্টিক টোন এবং বিলেতের একজন সঙ্গীত শিল্পী শাহীনূর হীরককে একজন নাইভ আর অসেচতন ব্যাক্তি প্রমাণ করে। (জানিনা শাহীনূর হীরক এই লেখা পড়েছেন কি না, কিংবা পড়ে থাকলেও তাকে এইভাবে প্রকাশ করবার ব্যাপারে তার আপত্তি রয়েছে কি না) ২০১০ সালের ২৫ শে মার্চ থেকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হলেও আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার আগ থেকেই শুধু চারিদিকে একই দাবী ও আলোচনার কথা আমরা শুনতে পেয়েছিলাম। ইনফ্যাক্ট মূলত এই দাবী প্রথমে তত্ত্বাবাধায়ক সরকারের সময়েই ওঠে এবং সেক্টর কমান্ডার ফোরাম সহ দেশের সকল মুক্তবুদ্ধির মানুষ, যারা এই অপরাধীদের বিচার দেখতে চান তারা সকলেই এক কাতারে এসে দাবী তোলেন অভিন্ন পাল্টফর্ম থেকে। এটা বিশ্বাস করা কিংবা মনে করাটাও এক ধরনের নির্বোধীয় চিন্তার প্রতিফলন বলে আমি মনে করি যে লন্ডনে থাকেন কেউ এমন বলছেন যে, গোলাম আযম ব্রিক লেইন থেকে গ্রেফতার হয়েছেন। তার থেকেও অধিক হাস্যকর কথা হচ্ছে যে, এই ব্যাপারটি যাচাই করবার জন্য সঙ্গীতজ্ঞ ভদ্রলোক আবার মাসুদ রানা সাহেবকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছেন। ব্যাপারটি আমার কাছে বিষ্ময়ের তো বটেই, তারচেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে ব্যাপারটি চিন্তা জাগবার মত যে, একজন সচেতন নাগরিক, কি করে বিশ্বাস করেন যে গোলাম আজম ব্রিক লেনের সঙ্গীতা থেকে গ্রেফতার হয়েছেন বা হতে পারেন? তাহলে তাঁকে যদি বলা হয় যে প্রাক্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ গ্রীণ স্ট্রীটের “দামীনি” থেকে গ্রেফতার হয়েছেন, সেটিও কি তিনি বিশ্বাস করবেন? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে আসলে আর কিছু বলবার থাকে না।


গোলাম আজম বাঙালী জাতিসত্ত্বার একটি কলংক। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে সারাটা জীবন বেঁচে ছিলেন, এই দেশ, এই দেশের মানুষ আর এই দেশের আলো-বাতাসের সাথে সারাটা জীবন তিনি প্রতারণা করে কাটিয়েছেন। যেই লোক নিজে একাই যুদ্ধাপরাধী আর যুদ্ধাপরাধ ধারনাকে ধারন করেন, যিনি একাই ৩০ লক্ষ খুনের পেছনে অন্যতম একজন সংগঠক ও পরিকল্পনাকারী, তার গ্রেফতারের খবরে বাংলাদেশী সকল জনতা তো উদ্বেলিত হবেই। বরং না হলে সেটি হবে অবাক ও বিষ্ময়ের। কিন্তু মাসুদ রানা সাহেব তার লেখার প্রথম ভাগে বাঙালীর প্রাণ কেন্দ্র ব্রিক লেইনের এই উচ্ছাসকে “আহলাদিত” শব্দ দিয়ে বেঁধে দিয়েছেন। একটি সারকাস্টিক সুর যেন তার পুরো লেখার বর্ণে বর্ণে ফুটে উঠেছে। খুব মন দিয়ে পড়লেই সেটি বোধগম্য হবে। আর সেই আনন্দ উৎসবে কি আওয়ামীলীগ বা তার অংগসংঠনের নেতা কর্মীরাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন? অতি অবশ্যই না। আমার মত দলহীন, গোত্রহীন মানুষরাও সেখানে ছিলো, ছিলো অনেক সাধারণ মানুষ। একটি দেশের একজন বিষ ফোঁড়াকে গ্রেফতারে তো দলভুক্ত নেতা বা কর্মী হতে হয় না, সেই ধারনাটি সম্ভবত নিজের ভেতর এডপ্ট করে নিতে পারেন নি লেখক।

এই লেখার ২য় অংশ যেটি তিনি “গুরুত্বপূর্ণ” অংশ হিসেবে ট্যাগ করেছেন। সেখানে তিনি কিছু মিস কনসেপ্টচুয়াল এবং অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য রেখেছেন। (আমার মতে)। প্রথমত মিলগ্রামের পরীক্ষার কথাটি বলেছেন লেখক। মিলগ্রামের পরীক্ষাটি কোন দিকে নির্দেশ করে? “ভুল জেনেও প্রয়োগ এবং পরবর্তীতে অনুতাপে দগ্ধ” কাদের কে সূচিত করে? পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহায়ক বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন, হত্যা আর ধর্ষনকে কি সূচিত করা হচ্ছে এই মিলগ্রামের এই থিওরী দিয়ে? মিলগ্রামের থিওরী দিয়ে একবার একটি প্রশ্ন এসেছিলো। সেটি হচ্ছে এডলফ আইকম্যান, যিনি নাজি বাহিনীর একজন জেনারেল এবং অসংখ্য ইহুদীকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এই আইকম্যানকে ইসরাইলের গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ আর্জেন্টিনা থেকে অপহরন করে নিয়ে এসে ইসরাইলের ডমেস্টিক কোর্টে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। মিল গ্রামের পরীক্ষা থেকে এই প্রশ্নটি ওঠে যে, আইকম্যান কি শুধু ওপরের ওর্ডার পালন করবার জন্যই এই হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছিলো? যেহেতু মিলগ্রামের ঐ পরীক্ষাটিতে একজন মানুষের ডুয়াল ক্যাপাসিটির কথা বলা হয়েছিলো, যেই ডুয়াল ক্যাপাসিটিতে শুধু মাত্র ওপরের ওর্ডার পালনের জন্য একজন মানুষ পিশাচ হয়ে ওঠে। বিবর্জিত হয় তার নিজস্ব যুক্তির আর বিবেচনা করবার ক্ষমতা।

মিল গ্রামের এই পরীক্ষার উদাহরন দিয়ে আর শেষ বাক্যে “অনুতাপে দগ্ধ” হওয়া দিয়ে কি বুঝাতে চাইলেন লেখক? বর্তমানে ধৃত যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তরা কি ডুয়াল ক্যাপাসিটিতে লড়তে গিয়ে ওবিডিয়েন্স ক্যাপাসিটিতে নুয়ে পড়েছিলেন নাকি পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলের জন্য, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে, এই ভুখন্ডে সব সময় একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার বেদনা থেকেই তারা অমানুষিক অত্যাচার করেছে নিরীহ বাংলাদেশীদের ওপর? কে তাদের অর্ডার করেছে। কোন দায় থেকে তারা ওর্ডার মানতে বাধ্য ছিলো? যেখানে লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলো? মাসুদ রানার আরেকটি বাক্য “অনুতাপে দগ্ধ হওয়া” আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। সেই শিক্ষকদের মত কি যুদ্ধাপরাধীরা অনুতাপে দগ্ধ হয়েছিলো? এই কথাই কি বুঝাতে চেয়েছেন লেখক? যদি এই কথা বুঝাতেই চান জনাব মাসুদ রানা, তবে শর্মিলা বসু কিংবা ইয়াসমিন সাইকিয়াদের মত সুক্ষ্ণ ভাবেই কি তিনি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে একটি আবেগীয় অনুরণ ঘটাতেই চাননি এই লাইনের মাধ্যমে? আর যদি না বুঝাতে চান, (আমি বিশ্বাস করতে চাই তিনি বুঝান নি) তবে এই লাইনটি এখানে সম্পূর্ণ ভাবে অপ্রাসঙ্গিক এবং অপ্রয়োজনীয় বলেই প্রতীয়মান হয়।


লেখক এই লেখার আরেকটি প্যারাতে বলেছেন যে, “সু-নির্দিষ্ট আচরণের নিন্দা” এবং “শায়েস্তা”র কথা। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু ভারতের সহযোগিতায় পাকিস্তান ভাঙ্গার ধারনাটি কি ওই “সু-নির্দিষ্ট আচরণের নিন্দা”র তত্ত্বে কোনো ভাবেই ফেলা যায় সব ক্ষেত্রে? যদি এই ধারনা পাকিস্তানীরা করেও থাকে তবে তা করেছে অনেক পরে। এবং সেটিও তারা করেছে বাঙালীকে হত্যা করার কারন হিসেবে একটা যুক্তি দাঁড় করাবার জন্য। কেননা তারা নিজেও জানত তাদের করা বৈষম্যের কথা আর অত্যাচারের কথা। ৬৯ এর গণ আন্দোলন, ছয় দফা কিংবা তারও আগে ভাষা আন্দোলন, এ সকল ইতিহাস কারো অজানা নয়। অন্তত লেখকের তো নয়ই। পাকিস্তান শাষকগোষ্ঠী বাঙালীর শায়ত্ত্ব শাষনের দাবী, পাওনা অধিকার এসব সব কিছুর ব্যাপারেই জানত, এবং এই দাবী আর অধিকারের কথা যে ভারত থেকে আমদানীর দরকার হয়না তাও জানতো। অথচ এই বিশ্লেষনগুলো থেকে পাঠককে বঞ্চিত করে তিনি খুব সহজেই সিদ্ধান্তে চলে আসছেন। এখানে পাকিস্তানের গণহত্যার কারনের পূর্বভাগকে অত্যন্ত সরলীকরণ করা হয়েছে এবং সিদ্ধান্ত হাতে রেখে শুধু মঞ্চস্থ করছেন বলেই আমার প্রতীয়মান হয়।

লেখকের “নাটকীয়” শিরোনামের অংশটিতে কয়েকটি প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে ভুল তথ্য দিয়ে। জামায়াত কর্মীরা যেমন বলে থাকে যে এই বিচার ও ব্যাবস্থা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রহসনে আক্রান্ত, লেখক যেন/হয়ত একটু ইনিয়ে বিনিয়ে সেই কথাই আরো খানিকটা মাধুরী মিশিয়ে লিখেছেন। (দেখে আমার তাই-ই মনে হয়) এটা কি লেখক তার নিজের অজান্তেই করেছেন নাকি ভিন্ন কোনো সূত্র বা তত্ত্ব নতুন করে পাঠকদের বোঝাতে চাইছেন, এটি আমার বোধগম্য হয় নি।

আওয়ামীলীগ এর আগে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে গোলাম আজমের ব্যাপারে কি মনোভাব দেখিয়েছিলেন, কিংবা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ (নেতা বলতে একজন নেতা বোঝায় আর নেতৃবৃন্দ বলতে অবশ্যই একাধিক নেতাকে বোঝায় সাধারণ জ্ঞানে) কারা কারা গোলাম আজমের কাছে দোয়া চাইতে গিয়েছিলেন এই উক্তির কোনো রকমের ডিটেইলস বলেন নি লেখক। পাঠকদের ঝুলিয়ে রেখে এবং এই বিচারকে “আওয়ামী রাজনৈতিক প্রহসন” নির্দেশ করে লেখক কতটা শান্তি পেলেন কিংবা সুখ পেলেন আমি জানিনা। তবে এই “আওয়ামী প্রহসন” প্রমাণিত করবার জন্য জামায়াতে ইসলামী সকাল সন্ধ্যা আমরণ পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এটি প্রমাণ করতে পারলেই জামায়াতের পেটের চাল যেখানে হজম হয়, যেখানে বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তাদের গুরুদের ছিনিয়ে আনার প্রক্রিয়া ও স্লোগান এটি, যেখানে এটাই হচ্ছ এখন জামায়াতী ইসলামের মূল কথা, সেখানে লেখক এই লেখায় অযৌক্তিক ভাবে ও ভুল তথ্য দিয়ে কেন জামায়াতের সেই প্রচেষ্টাকে আরো বেগবান করবেন? যদি ধরেই নেই যে এটি অনিচ্ছাকৃত, কিন্তু সেই দায় লেখককেই নিতে হবে। কেননা এই লেখাটিকেই দেখা যাবে একদিন জামায়াতের কর্মীরা লিফলেট বানিয়ে ছাপছে লেখকের লেখার রেফারেন্স দিয়ে।

লেখক তাঁর লেখায় লিখেছেন যে, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসবার আগে আওয়ামীলীগ নাকি জামাতের সাথে জোট বেঁধেছিলো এবং ১৯৯১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী নাকি আওয়ামীলীগের প্রার্থী হয়ে গোলাম আজমের কাছে দোয়া চাইতে গিয়েছিলো। ( যদিও তিনি নাম উল্লেখ করে বলেন নি, কিন্তু যেহেতু এটি সার্বজনীন একটি অপঃপ্রচার, তাই এই বিষয় দুইটির কথাই লেখক উল্লেখ করেছেন, এমনটাই ধরে নেয়া যৌক্তিক। কেননা লেখকের যে দুইটি বিষয় নিয়ে আওয়ামীলীগের তরলায়িত হবার কথা ফুটে উঠেছে, সেই দুইটি বিষয়ের উপমা হিসেবে ও প্রোপাগান্ডা হিসেবে উক্ত ঘটনা দুইটিকেই সব সময় কুমিরের সাত সন্তানের মত প্রদ্রর্শিত করা হয়)। এই দুটি তথ্যই অত্যন্ত বিভ্রান্তময় ও মিথ্যা। অন্তত পক্ষে আমার অনুসন্ধানে তো বটেই।

জামাতের গঠনতন্ত্রের ২য় অধ্যায়ের সপ্তম ধারায় যেখানে রুকন হবার নিয়ম, রীতি নীতি ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে।


৭) এমন কোনো পার্টি বা প্রতিষ্ঠানের সহিত সম্পর্ক না রাখেন যাহার মূলনীতি, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ইসলামের আক্বীদা এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ,লক্ষ্য ও কর্মনীতির পরিপন্থী।

আবার ১ম অধ্যায়ের ৪র্থ ধারার স্থায়ী কর্মনীতি অংশের ২য় পয়েন্টে বলা হয়েছে যে-


২) উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের জন্য বাংলাদেশ জামাতী ইসলামী এমন কোনো উপায় ও পন্থা অবলম্বন করিবে না যাহা সততা ও বিশ্বাসপরায়নতার পরিপন্থী।


এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় এই যে, রুকন রিক্রুট করবার যদি এই রীতি হয়, যেখানে জামাতের আকীদা কিংবা বিশ্বাসের পরিপন্থী এমন কোনো দলের সাথেই সম্পর্ক রাখা যাবেনা, সেখানে ১৯৯৬ সালে জামাত আওয়ামীলীগের সাথে তাহলে কিভাবে যুগপৎ আন্দোলন করেছে বলে কিংবা জোটবদ্ধ আন্দলোন করেছে বলে প্রকাশ করে?

যদি তাই হয় তবে জামাতের সংবিধান অনুযায়ী ২য় অধ্যায়ের ৭ম ধারা মোতাবেক জামাত তা করতে পারে না। এবং জামাতের সংবিধানের ১ম অধ্যায়ের ৪র্থ ধারার ২ নাম্বার পয়েন্ট অনুযায়ী তারা সততা ও বিশ্বাসপরায়নতার পরীপন্থির কাজ করেছে।

এখানে ঘটনা দুইটা। হয় জামাতের সংবিধানে যা আছে তা মিথ্যা ও কথার কথা। আর সেক্ষেত্রে সংবিধান যেখানে মিথ্যা সেখানে তাদের সবকিছুই মিথ্যা। আর যদি সংবিধান যদি সত্য হয়, তাহলে ১৯৯৬ সালে তারা আওয়ামীলীগের সাথে যুগপৎ আন্দোলোন করে নি। কারন লীগের বিশ্বাস ও আকীদা নিশ্চয়ই জামাতের সাথে মিলে না বা এক নয়।

আবার এটিও এখানে আলোচ্য যে, তত্ত্বাবাধায়ক ইস্যুতে তখন জামায়াতও সোচ্চার ছিলো আর সেটিও হয়েছিলো সেই একই রাজপথে। এখন কোনো একটি আন্দোলনের ভাষা ও লক্ষ্য যদি আওয়ামীলীগের সাথে মিলে যায় জামায়াতের, তবে সেটির দায়ভার কেন আওয়ামীলীগ নেবে? কেনই বা নেয়া উচিৎ? আজকে আমি যদি একজন সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হই এবং সেই একই ইস্যুতে যদি একজন লুটেরাও একই সময় রাজপথে সোচ্চার হয়ে থাকে, তবে কি তার সাথে একই সাথে আমিও স্লোগান তুলেছি বলে প্রচার করাটা যৌক্তিক হবে? এই ফাইন লাইন তো দৃষ্টিগ্রাহ্য এবং আলোচ্য প্রোপাগান্ডাটি তো জামায়াতের সেই পুরোনো এক “তথ্য পান্ডামি” ছাড়া আর কিছুই নয়।

উপরের এই আলোচনার প্রেক্ষিতে একটা সিদ্ধান্তে খুব সহজেই আসা যায় যায় যে, জামাতের সাথে আওয়ামীলীগ কখনই জোটবদ্ধ আন্দোলন করেনি এবং জোটও বাঁধেনি। একটি ছবি প্রায়ই ইন্টারনেটে দেখা যায় , সেটি হোলো একটি মিটিং চলছে এবং তার কয়েক চেয়ার পরেই নিজামী বিরস মুখে বসে রয়েছে। আজকে “আওয়ামীলীগ এক সময় জামাতের সাথে ছিলো” এই কথাটি প্রমাণ করবার জন্যও এই ছবিটি ব্যাবহার করা হয়। আসল সত্যটি হলো এই কক্ষটি ছিলো তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রীর অফিস মানে শেখ হাসিনার সংসদীয় কার্য্যালয়। এই অফিসে আমন্ত্রন জানানো হয় অন্যান্য সকল দলকে তত্ত্বাবাধায়ক সরকারের ইস্যুতে কথা বলবার জন্য এবং আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী নির্ধারণ করবার জন্য। অথচ সেই সভাতে জামাতের কয়েকজন নেতা সেই সভায় দাওয়াত ছাড়াই হাসিনার এক সে সময়কার একজন সচিবের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে মতিউর রহমান নিজামী এই সংবাদ সম্মেলনে ঢুকে পড়েন এবং নেতাদের বসার সারিতে একটি খালি চেয়ারে বসে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গেই জামায়াতের পরিকল্পনা মত একজন ফটোজার্নালিস্ট তার একটি ছবি তুলে নেয়। পরবর্তীকালে এই ছবিটির কথা উল্লেখ করেই অনেক লেখা আসে এবং এটিকেই ছড়িয়ে দেয়া হয় এই বলে যে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ জামাতের সাথে মিটিং করেছে ও জোট করেছে।

এই বিষয়ে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবি আব্দুল গাফফার চৌধুরী বলেন-

“এই ছবিটি এখনো ঢাকার বহু কাগজে সেই বছরের সেইদিনের সংখ্যায় মুদ্রিত অবস্থায় আছে। ছবিটিতে দেখা যায়, মতিউর রহমান নিজামী মোটেই শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে বসার সুযোগ পাননি। তিনি নেতাদের বসার সারিতে শেখ হাসিনার বহু দূরে এক কোণে অনাহূত অতিথির মতো বসে আছেন। এই ঘটনাটি যে আওয়ামী লীগকে বিব্রত ও সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য পূর্ব পরিকল্পিত তা ঘটনার পরদিনই জানাজানি হয় এবং এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি বিশেস্নষণ করে একটি বিবৃতিও দেওয়া হয়। বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া সচিবকে শেখ হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে নিজামীর সঙ্গে গোপন যোগসাজশ দ্বারা সংবাদ সম্মেলনে তার আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য অপসারণ করেন” ( সূত্রঃ ১৪ ই জানুয়ারী, ২০১১। দৈনিক ইত্তেফাক)

কলামিস্ট ও সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী বিচারপতি বদরুল হায়দার বিষয়েও দৈনিক ইত্তেফাকে গত ১৬ই জানুয়ারী ২০১১ সালে একটি লেখা লিখেন। তিনি সেখানে এই দোয়া সঙ্ক্রান্ত পুরো ব্যাপারটিকেই মানুষের সামনে নিয়ে এসে একটি ধোঁয়াশা মিথ থেকে আমাদের মুক্তি দেন। তিনি সেখানে লিখেন যে-

“বিচারপতিকে তার জয় কামনা করে একটা ছোট্ট চিঠি লিখেছিলাম এবং জানতে চেয়েছিলাম, সংসদের বিরোধী দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হয়েছেন কিনা? তিনি কয়েকদিন পরেই আমার চিঠির উত্তরে জানালেন, তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাননি এবং পাননি। তবে আওয়ামী লীগের সমর্থন তার পেছনে রয়েছে। এমনকি সংসদে যে দু'একজন বামদলীয় সদস্য আছেন, তারাও তাকে সমর্থন দেবেন। তিনি রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। আমি এই নির্বাচনের গতি প্রবাহ জানার জন্য খুবই আগ্রহী ছিলাম। সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি জয়ী হন এই কামনা সর্বান্তকরণে করেছিলাম। কিন্তু যখন জানলাম, তিনি সংসদের জামায়াতি সদস্যদের সমর্থন লাভের জন্য গোলাম আজমের কাছে গেছেন তখন ক্ষুব্ধ হয়েছি এবং এই নির্বাচনে কে জয়ী হবেন বা হবেন না তা নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। তথাপি কানে খবর এসেছে। তিনি নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের কোনো সংসদ সদস্যের ভোট তো পানইনি; এমনকি সংসদের বামদলের সদস্যেরও ভোট পাননি। সেই সদস্য তার আত্মীয় আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ভোট দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী লন্ডনে এসেছিলেন। এসেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেন্ট্রাল লন্ডনে বেকার স্ট্রিটের কাছে 'রাজদূত রেস্টুরেন্টে' আমাদের সাক্ষাৎকার ঘটে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এবং রাজদূত রেস্টুরেন্টের মালিক আতাউর রহমান খান। বিচারপতির কাছে আমার প্রথম প্রশ্নই ছিলো, বদরুল ভাই, আপনি গোলাম আজমের মতো লোকের কাছে ভোটের জন্য ধর্না দিলেন কিভাবে?

তিনি আমার প্রশ্ন শুনে গভীরভাবে লজ্জিত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, "সংসদে জামায়াতের বেশ কয়েকজন সদস্য আছেন। তাদের ভোটটা বিএনপি প্রার্থীর কাছ থেকে ভাগ করতে পারলে হয়তো জয়ী হয়ে যাব বলে ভেবেছিলাম।" আমি তাকে বলেছি, আপনি জামায়াতের ভোটে জয়ী হলে সেটা কি গৌরবের জয় হতো ? না কি পরাজিত হলে সেটা গৌরবের পরাজয় হতো? তিনি বলেছেন, "তুমি ঠিকই বলেছো, জামায়াতের ভোটে জয়ী হলে সেটা আমার জন্য গৌরবের জয় হতো না। আমি শুধু ভুল সিদ্ধান্ত নয়, গর্হিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।"

অথচ ইতিহাসকে এইভাবে প্রকাশ করে করে লেখক কি আনন্দ পেলেন আমি জানিনা। আওয়ামীলীগের অনেক দূর্নাম রয়েছে, সমালোচনারও অনেক অসংখ্য ক্ষেত্র রয়েছে যেটি আমি নিজে অসংখ্যবার করেছি, লিখেছি ও বলেছি। কিন্তু ইতিহাসকে ভুল ভাবে ও নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে প্রকারান্তরে কাদের সাহায্য করতে চাইছেন লেখক? কারা তার লেখার বেনিফিশিয়ারী একবার কি ভেবে দেখেছেন তিনি? আর জামায়াত আওয়ামীলীগের সাথে আসলে বা সহযোগী হিসেবে আসলে দৃশ্যপট পালটে যাবে এই ধরনের অদ্ভুত হাইপোথেটিক কল্পনা কি একজন সাধারণ মানুষ এই মূহূর্তে করবেন? এটা কি সম্ভব? এত বড় “বেঈমানীর এলিগেশন” কিন্তু তদন্তের দাবী রাখে। আর যদি সেটি কেবল ধারনাই হয়, তবে “পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো” বাক্যটি ছাড়া আর কিছু বলবার থাকে না।

অনেক কলামিস্টরা, কল্পনায় কার্ল মার্ক্স আর সেই সাথে বেশ আরামদায়ক জীবন যাপন করে অভ্যস্থ। তারা বসে বসে ইতিহাসের বোতলে একবার ঢালেন মার্ক্স, আবার ঢাকেন থিসিস, আবার ঢালেন সিন্থেসিস। এই করে তারা রচনা করেন ইতিহাসের পাঁতিহাস, পাঁতিহাসের জন্য একটা দীঘি, দীঘির আবার নাম-ধাম দিয়ে সেটিকে ছেড়ে দেন অকূল পাথারে। যদিও “মার্ক্স ভাইয়ের দর্শনের সাথে আরামদায়ক জীবনের সংঘর্ষ আছে” এই জাতীয় সম্ভাবনা সেইসব চিন্তাবিদেরা দেখেন না ও মানেন না, তারপরেও অন্যের আরামদায়ক জীবনকে তারা “বুর্জোয়া জীবন” নামে অভিহিত করে নিজের ভেতরের অন্তঃদগ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে চান। সেই ধরনের লেখকদের লেখায় হয়ত ইতিহাসের এমন দীঘল ও কিদ্ভুতকিমাকার ব্যখ্যা, তথ্য, আর উপমা আসবে। সেটি আমরা মেনে নেই, কারন আমরা তাদের “তথাকথিত” আদর্শকে জানি ও চিনি।

শ্রদ্ধা রেখেই বলি, আমাদের আলোচ্য লেখক কোনোভাবেই এই গোত্র ভুক্ত তা আমি কখনই ভাবিনা। ভাবতে চাইও না। তবে তার ভুল-ভাল ইতিহাসের কল্প কথা আর অপ্রাসঙ্গিক উপমা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ঠেলে ঠুলে “আওয়ামী রাজনৈতিক প্রহসনের” কাতারে নিয়ে আসাটা সেই দিকেই কি সূচিত করে না? এবং লেখকের সম্পর্কে কি একটি ভিন্ন চিন্তার জায়গা ও সুযোগ করে দেয় না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি খুবই দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ি। বাকি চিন্তা পাঠকদের উপরেই ছেড়ে দিলাম।

লেখক তার লেখার শেষ দিকে যা বলেছেন তার একটি অংশকে আমি সমর্থন করি। সেটি হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাথে সাথে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ধারনা। যেহেতু ধর্মকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যাবহার করে এবং এটির মূলো ঝুলিয়েই তারা একাত্তরে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলো। যদি সেটি গণ হত্যার মূল কারন হিসেবে আবির্ভূত নাও হতো, তথাপিও আমি ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ধারনাকেই একটি অসাড় ধারনা হিসেবেই অভিহিত করতাম। কেননা ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা স্পিরিচুয়াল প্র্যাক্টিস কখনো রাজপথের ব্যানার হতে পারে না। এটি আপন আপন ব্যাক্তির নিজস্ব চর্চা তার সৃষ্টকর্তার সাথে। এটি সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত একটি বিষয়ও বটে। কিন্তু লেখক যখন এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সম্পূর্ণ নির্মূল না করাকে গোলাম আজমের গ্রেফতার অসাড় ও অর্থহীন বিবেচনা করেন তখন নড়ে চড়ে বসতে হয়। যেই নাজি বাহিনীর উদাহরণ তিনি টেনেছেন তার লেখার ফাঁকে সেই নাজি বাহিনীর আদর্শকে কি এক দিনে “চোপরাও, উল্লুক কাঁহাকা” কিংবা “কালকে থেকেই নাজি বাহিনীর আদর্শ নিষিদ্ধ” এই ফরমান জারী করে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো? উত্তর হচ্ছে, না। হয় নি। প্রক্রিয়া গুলো ছিলো আস্তে আস্তে। হ্যাঁ, দল ও কার্যক্রম হয়ত নিষিদ্ধ হয়েছে যেমনটি আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেরপর পরেই সে রকম একটি স্টেপ নেয়া হয়েছিলো। নাজিদের শাস্তি প্রক্রিয়া যতই তরান্বিত হয়েছে ততই নাজিদের ব্যাপারে সাধারণ জার্মান থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পেরেছিলো।

একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর পর আমাদের যে সংবিধান আসে সেখানে যে কোনো ধর্ম ভিত্তিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয় ৩৮ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে। পরবর্তীতে জেনারেল জিয়ার আমলে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চা আবার শুরু হয় ৩৮ অনুচ্ছেদে এই সংক্রান্ত বিধি নিষেধ উঠিয়ে দিয়ে এবং দেশে শুরু হয় সেই প্রাচীন নৈরাজ্য। কিন্তু নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায়ও কি আদর্শ বন্ধ করা গ্যাছে? যদি যেতই তবে ৩৮ অনুচ্ছেদ উঠিয়ে দেয়ার সাথে সাথেই আবার ধর্ম ভিত্তিক দলগুলো রাতারাতি চাগাড় দিয়ে উঠতে পারত না। এটি একমাত্র সম্ভব হয়েছে এবং ধর্ম ভিত্তিক দলগুলো টিকে থেকেছে কারন এই দলগুলোতে লেপ্টে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের, দালাদের, রাজাকার, আলবদর, আলশামস দের বিচার হয়নি বলেই। যদি সেইসময় আজকের অভিযুক্ত অপরাধীদের বিচার হতো পরিপূর্ণভাবে ও ওই সময়েই তাহলে মানুষ দেখতে পেতো যে এই আদর্শ ধারনকারীরা কিভাবে ধর্মকে ব্যাবহার করে আমাদের সন্তান-ভাই-বোন-মা-বাবাদের খুন করেছে, ধর্ষন করেছে, লুট করেছে, ডাকাতি করেছে। সেক্ষেত্রে আদর্শের পথ অ্নেকটুকুই স্তিমিত হতো এবং তখন হয়তো ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির অসুস্থ ধারাটিই বন্ধ করে দেয়া যেতো। ঠিক আজকে যেমন মুকুরেই হিজবুত তাহরীর কে স্তব্ধ করে ফেলা হয়েছে এবং তাদের মূল আদর্শ জণগনের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।

“কিন্তু ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চার ব্যাবস্থা রেখে কোন যুক্তিতে গোলাম আজমের বিচার হবে”, এই কথাটি এতই হাস্যকর ও অযৌক্তিক যে এর উত্তরে কিছু বলাই যেন অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে কি কেউ খুন করলে কিংবা ধর্ষন করে এলে সমাজে আমরা খুন ও ধর্ষনের যে চিন্তা বা “মেন্স-রিয়া” সেটিকে নস্যাৎ করতে অগ্রসর হই প্রথমে? নাকি অপরাধীর বিচারের মাধ্যমে সেই “মেন্স-রিয়া”কে হতোদ্যোম করে দেই? আজ গোলাম আজমের বিচার হলে মানুষ যখন ধর্মকে ব্যাবহার করা একজন খুনীর, ধর্ষকের ও নোংরা মানুষের পরিণতি দেখতে পাবে, তখন এই ধারাতে একটি আঘাত আসবে। ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির বিষয়ে রি-থিংকিং প্রসেস আরো শক্তিশালী হবে এবং এই সুযোগেই হয়ত আমরা সমগ্র চর্চাটিকে স্তব্ধ ও নিঃশেষ করতে পারব।

আজকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জীবনের সব কিছুই বলতে গেলে ত্যাগ করে রাস্তায় নেমেছি। দিন-রাত আলাদা করতে পারিনা আজ কয়েকটা বছর। এই যুদ্ধে জামায়াত আর তাদের সহযোগীরা তো ওৎ পেতে রয়েছে সেই কবে থেকেই। তাদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে যখন সামনে আগাই তখন দেখি কিছু মানুষের লেখা ও তত্ত্ব। যেই তত্ত্ব শুধু ক্ষতি নয়, “প্রচন্ড” রকম করে আঘাত হানে এই বিচারের এত চেষ্টার পেছনে। তারা এই ব্যাপারটি বোধকরি একবারও ভাবেন না যে, তাদের লেখাটি যখন প্রকাশিত হয় তখন মূলত এর বেনিফিশিয়ারী হয় কারা। কারা এর সুযোগ নেয় বা নিতে পারে। তারা তো লিখেই খালাশ। ইচ্ছে মতন তারা লিখেন। কোনো যুক্তি বা সঠিক ইতিহাসের ধার ধারেন না, রেফারেন্সের ধার ধারেন না, প্রাসঙ্গিকতার ধার ধারেন না তারা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কি শুধু সরকারের বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব? এটা কি জনগণের সম্পৃক্ততার একটি প্লাটফর্ম নয়? এই গণহত্যা কি আমাদের উপরেই চালানো বর্বরতা ছিলো না? আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যদি সম্পৃক্ত হতে না-ও পারি, তবে সেটিকে নস্যাৎ বা সামান্যতম প্রশবিদ্ধ করবার কোনো অধিকার কি আমরা রাখি? আজকে তাদের বিচার প্রক্রিয়ার চুল থেকে পান খসলেই জন্ম নেয় কলাম। তেড়ে আসেন বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, নেতা, লেখক। কিন্তু ৩০ লক্ষ প্রাণ কেড়ে নেবার সময় কই ছিলেন তারা? কই ছিলো সব আন্তর্জাতিক কনভেনশন ? রীতি কিংবা নীতি?

১৯৭১ সালের ৩০ লক্ষ শহীদের অশ্রুজল, রক্তের বন্যা, নির্যাতন আর ত্যাগের ঋণ শোধ না করাতে যেই গ্লানি বয়ে বেড়িয়েছি আজ ৪০ টি বছর, তার থেকেও বড় বেশী গ্লানি বোধ হয় এই ধরনের দায়িত্ব-জ্ঞানহীন লেখা দেখে। যেই লেখাটির প্রভাব আমরা জানি ও সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষদের কথাও আমরা বুঝি, সেখানে এই ধরনের লেখা এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত ট্রাইবুনাল, এর পেছনে জড়িত মানুষ, শ্রম, চেষ্টা সব কিছুকেই আঘাত করে।

যদিও সে আঘাত এই “জর্জরিত ও যোদ্ধা” মনের মানুষদের কাবু করে না, করতে পারে না। কিন্তু বিরক্ত যে করে, এটি বলবার অপেক্ষা রাখে না।

2 comments:

  1. নিঝুম ভাই, মাসুদ রানার 'গোলাম আজমের আটকঃ কি লয়ে বিচার' লেখাটা অনলাইনে কোথাও পাওয়া যাবে কি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. http://portal.ukbengali.com/columns/%E0%A6%97%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%86%E0%A6%AF%E0%A6%AE-%E0%A6%86%E0%A6%9F%E0%A6%95%E0%A6%83-%E2%80%98%E0%A6%95%E0%A7%80-%E0%A6%B2%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E2%80%99

      Delete