মুক্তিযুদ্ধের কোনো
গল্প শুনলেই আমাদের চোখের সামনে যে ব্যাপারটি ভেসে ওঠে তা হচ্ছে কিছু পাকি হানাদার
ধরে ধরে আমাদের বাবা-ভাইদের মেরে ফেলছে কিংবা আমাদের মা আর বোনদের ধর্ষন করছে আর কিছু
রাজাকার প্রচন্ড দূর্গন্ধযুক্ত মুখে “মারহাবা-মাশাল্লাহ-শুকরিয়া” এই জাতীয় আওয়াজ
তুলছে । দৃশ্যগুলো ভয়াবহ ভাবেই ভেতরে ঘুরপাক খায় । আমি জানিনা যারা আমার মত
মুক্তিযুদ্ধ দেখেন নি, তারা কেমন করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভাবেন বা মনে
মনে কল্পনা করেন । আমার বাবা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতেন মাঝে সাঝে । সে সময়
গল্পগুলো খুব একটা জমত না । দুপুরে ভর-পেট খাবার পর বাবা একটা পান মুখে দিতেন
কিংবা একটা সিগারেট ধরাতেন । সে সময় আমিও যে ক্ষুদার্থ থেকে তার গল্প উপভোগ করতাম
এমনটি নয় । আমিও রুই-কাতলা-মৃগেল-গরু ও মুরগীর বিভিন্ন অংশের মাংশ সাঁটিয়ে,
খাদ্যনালী
ব্যাপক আকারে পরিপুষ্ট করে বাবার কাছে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতাম ।
বাবা বলতেন খুব
সহজেই, তারপর আর কি, “ গুল্লি করি হালাই দিলো আরকি” ।
বাবা খুব স্বাভাবিক
ভাবেই বলতেন । আমি সে সময় অনেকবার ভেবেছি, “গুল্লি করি হালাই”
দেবার
ব্যাপারটা কি বাবা যেভাবে বলেছে অতটাই সহজ ? একটা মানুষ কত
সম্ভাবনাময় ! কত শক্তিশালী ! কতটা ক্ষমতাশালী ! অথচ সেই মানুষটিকেই আরেকটি মানুষ
খুব অবলীলায় মেরে পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে, এই ভাবনার ভেতরেও এক
ধরনের বেদনা কাজ করত আমার ভেতর । আমি আম্মাকেও জিজ্ঞেশ করেছি, মুক্তিযুদ্ধ আসলে
কেমন ছিলো, তাঁর অভিজ্ঞতা কি, আমার মা অবশ্য সেই সহজ সুরে না বলে খানিকটা আবহ
তৈরী করে ফেলতেন তার সহজ সরল কথা বলবার বৈশিষ্ট্য দিয়েই, মা’র গল্পে অনেক লাশের
গল্প থাকত । রাস্তায় পড়ে থাকা, আবর্জনার স্তুপে পড়ে থাকা, ম্যানহোলে পড়ে থাকা
লাশ । মার কাছ থেকে এসব শুনেও আমি খুব একটা নিজের পেট ভরাতে পারিনি । এই গল্প
জানাতে চাওয়ার খিদেয় আমার পেট ক্ষুদার্থ থাকত সব সময়ই ।
আমি এমন করে জিজ্ঞেশ
করেছি অনেককেই । বইয়ে পড়েছি । টিভিতে দেখেছি । গান শুনেছি । শতাধিক কিংবা তারও
উপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই পড়েছি । আর এখনতো লিখবার জন্য রেফারেন্স হিসেবে কত
কিছু রাখতে হচ্ছে সাথে । কিন্তু যেই জিনিসটি কোথাও পাইনি সেই ব্যাপারটি হলো আমাদের
অপমান করবার ব্যাপারটি । অপমান করে যাবার ব্যাপারটি । একটি অসভ্য ও বর্বর জাতি
আমাদের দেশে এসে আমাদের গুলি করে মারলো, আমাদের মাটি চাপা
দিয়ে মেরে গেলো, আমাদের ঘরের আমার ছোট বোন থেকে শুরু করে আমাদের এলাকার সবচাইতে
সুন্দরী মেয়েটিকে মেরে গ্যালো, এর ভেতর আমি গ্লানির পাশা-পাশি ভয়ানক এক অপমানের
স্বাদ পাই ।
আমি অনেক
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নাটক সিনেমাতে দেখেছি স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষন করা
হয়েছে কিংবা বাবার চোখের সামনে কন্যাকে ধর্ষন । আমি জানি অনেকেই এই ব্যাপারগুলোকে
তীব্র কিছু বিশেষন দিয়ে প্রকাশ করে ফেলেন । যুদ্ধে মানুষের প্রচন্ড ভোগান্তি থাকে,
রক্তের
বন্যা থাকে, কেউ মাকে হারান, কেউ বাবাকে কেউবা ভাইকে, বোনকে । কিন্তু সব
কিছু ছাপিয়ে এই পুরো ব্যাপারটিতেই যে এক ধরনের ভয়ানক অপমানের ব্যাপারগুলো রয়েছে
তা কেউ লক্ষ্য করে দেখেছেন ? জানিনা আপ্নারা কি করে চিন্তা করছেন কিন্তু অপমান
শব্দটি এই ক্ষেত্রে আমার কাছে একধরনের বোঝার মত মনে হতে থাকে । আমি মাঝে মাঝেই
কল্পনা করতে থাকি এবং আমার বুক ধীরে ধীরে অত্যন্ত ক্রোধ ও ঘৃণায় কাঁপ্তে থাকে ,
আমি খুব
স্পষ্ট চোখে দেখতে পাই,
“একজন পাকি হানাদার
আমাদের ঘরে তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে আসলো । দলের বড় কুকুর শাবকটি দলের একজন
নেকড়েকে হুকুম দিলো আমার বাবাকে বুট দিয়ে লাত্থি দেবার জন্য । আমার বাবা সেই
পাকি নেকড়ে পা ধরে তীব্র চিতকার করে বাঁচার জন্য আকুতি করতে লাগলো । সেই কুকুরটি
আবার নির্দেশ দিলো আমার মা আর বোনকে ধর্ষন করবার জন্য । আমার মা আর বোনেরা
অসহায়ের মত আমাদের দিকে তাকিয়ে চিতকার শুরু করলো ।
আমার মায়ের তিনটি শব্দ আমি শুনতে পারলাম, “ বাবা বাঁচাবি না?”
আমি
কেমন যেন স্পষ্ট চোখে দেখতে পেলাম আমার ছোট ভাইকে একজন রাজাকার জবাই করে ফেলল এবং
আমি নিজে বাঁচবার জন্য প্রাণ-পণে ছুটতে শুরু করলাম ।” আমি সেই কল্পিত
দৃশ্যেও মাকে বাঁচাতে পারিনা , পারিনা ভাইকে বাঁচাতে ।
এই দৃশ্যটি আমি
যতবার ভাবি আমি ততবার দাঁতে দাঁত চেপে আমার রাগ সামলাই । আমি প্রাণ পণে ছুটতে শুরু
করেছি এই কথাটি ভাবলে আমার ভেতর ক্রোধটি আরো প্রবল হতে থাকে । একটি যুদ্ধ কত কিছুই
না বদলে দিতে পারে ! একটি যুদ্ধ একটি মানুষকে কতটুকু অসহায় করে দিতে পারে ! আমি
যেই কল্পিত দৃশ্যের কথা আপনাদের শোনালাম সেই দৃশ্যটি বাস্তবে হয়ত ঘটেছে । আমার
মাঝে মধ্যে প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা ধরেন এমন একটি ঘটনা ১৯৭১ সালে ঘটে গেছে কোন
এক দূর্ভাগা কিশোরের জীবনে । এই তীব্র অপমানের পর বেঁচে থাকা কিশোরটি কি বেঁচে
থাকতে পেরেছে ? ধরা যাক পেরেছে । এবং এও ধরা যাক, ২০০১ সালে সেই
কিশোরটির বয়স গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো ৪৭ ।
আচ্ছা , রাজাকার- আলবদররা সে
বছর যখন মন্ত্রী হলো , ক্ষমতায় এলো , এই স্বাধীন সার্বভৌম
রাষ্ট্রে যখন তারা কিরিচ দিয়ে ধরে ধরে মানুষের রগ কাটতে লাগলো সেদিন কি সেই বেঁচে
থাকা একাত্তরের কিশোর তার এই মধ্য বয়সে এসে একা কোনো অন্ধকার ঘরে বসে মুখ লুকিয়ে
থেকেছে ? কিংবা ক্রোধে উন্মক্ত হয়ে নিজের ভেতর নিজেই কি অনেক বার মরে গ্যাছে ?
কিংবা
প্রচন্ড অপমানে সে কি বোধশক্তিহীন কোনো প্রাণীতে পরিণত হয়েছে ? অথবা সে কি কেঁদেছে ?
গোপনে ?
নিরবে ?
যে কিশোরের চোখের
সামনে তার মায়ের শাড়ি খুলে ফেলা হয়েছিলো , যেই কিশোরের সামনে
তার বোনকে কদর্য কিছু পোকারা নোংরা হাতে অপমান করেছিলো , যেই কিশোরের সামনে
তার বাবার কে সেই পোকারা নাকে খত দিয়েছিলো এবং গুলি করে মেরে লাথি দিয়ে সরিয়ে
রেখেছিলো সে কিশোরের কথা মনে করে আমার ক্রোধ-ক্ষোভ এগুলো ছাপিয়ে এক ধরনের
হীনমন্যতা আমার ভেতর এসে ভর করতে থাকে । কেন জানি এই কিশোরের স্থানে মাঝে মাঝে
নিজেকে কল্পনা করি । ঠিক কি ধরনের অনুভূতি হলে আমি আমার কল্পিত কিশোরটির অনুভূতি
বুঝতে পারব ? ঠিক কতটা অপমান সহ্য করবার ক্ষমতা থাকলে এমন একটি দুঃসহ অবস্থায়
এভাবে বেঁচে থাকা যায় ?
পরিশিষ্টঃ
জীবনে অনেক দৌড়ুতে
হয় । পেটের জন্য , সংসারের জন্য , স্ত্রীর জন্য ,সন্তানের জন্য , ভাইয়ের জন্য । খুব গভীর রাতে বাবার কথা মনে এলে কাঁদতে হয় , মায়ের কথা মনে এলে
আর্তনাদ করতে হয় , ঘরে যুদ্ধ করতে হয়, বাহিরে যুদ্ধ করতে
হয় । অনেক কিছুই ভুলে যাই যা ভুলে যাওয়া উচিত নয় । অনেক কিছুই মনে করতে পারি না
যা মনে করতে পারা উচিত ।
তারপরেও অনেক রাতে
সেই কল্পিত কিশোরটির কথা মনে হয় । মধ্য এই বয়সে সে কিশোরটি কি করে এই তীব্র
অপমান নিয়ে বেঁচে আছে এমনটি চিন্তা না করলেও আমার হয় । তারপরেও হয়ে ওঠেনা ।
সৌজন্যতা বশত নয়, রোমান্টিসিজম আমি চিনি-এটি সেই অনুভূতিও নয় । এটি অন্যরকম অনুভূতি ।
নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে গ্লানিতে ভোগা । দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে
হাহাকার আর বেদনায় জড়িয়ে থাকা একটি অপমানের অনুভূতি । ক্ষত হতে হতে সেটি ছড়াতে
থাকে এভাবেই ।
কল্পিত কিশোরটির এক
আজব ক্ষত নিয়ে আমি কাউকে কিছু না বলেই এমন করে বেঁচে থাকি…সন্তর্পণে…
No comments:
Post a Comment