Saturday 15 August 2015

যে দেশে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে না

সংযোজনী তথ্যঃ এই লেখাটি প্রথম লিখেছিলাম আমার ব্লগে ২০০৯ সালের ২০ শে নভেম্বর। খুব সম্ভবত সেদিন আপীলেট ডিভিশন থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় পাওয়া গিয়েছিলো বিচারের সর্বশেষ ধাপ হিসেবে।

আজকে খুব বেশী কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এমন আনন্দের দিনে খুব বেশী কিছু বলারও থাকে না। মাঝে মাঝে এরকম বাক রুদ্ধ হয়ে যেতেই হয়। পত্রিকায় পড়ছিলাম,ব্যারিস্টার তাপস কাঁদছেন। কারন আজ তার বাবার এবং মা হত্যার বিচার হয়েছে। এই অনুভূতিটুকু ব্যারিস্টার তাপসের মত করে না বুঝলেও কিছুটা তো অনুধাবন করতেই পারি। একজন আইনজীবি হিসেবে তিনি অবশ্যই স্বার্থক ও গর্বিত। মৃত বাবা-মা'র জন্য লড়ে আসামীদের শাস্তি দিতে পেরেছেন। এর চেয়ে আনন্দের দিন একজন আইঞ্জীবির আর কিই বা হতে পারে !

শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, তদুপরি সমগ্র বাংগালী জাতির আজ খুশির দিন । গলায় কাঁটা বেঁধে থাকলে যেমন একধরনের প্রবল ব্যাথা বোধ হয় ঠিক তেমনি বংগবন্ধুর ও সেদিন নিহত হওয়া মানুষগুলোর বিচার এই বাংলাদেশে না হলে তা হতো সমগ্র বাঙ্গালী জাতিসত্বার জন্য এক প্রচন্ড ব্যাথাবোধ ও লজ্জার । আমি এখনো ঠিক ওই অর্থে খুশি নই । যদি বংগবন্ধু হত্যাকারীদের প্রতিটি পশুকে এক কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে একই সাথে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করানো যেতো, তবে তা হতো পরম আনন্দের ও আত্ম প্রসাদ লাভের একটি সুযোগ । যেখানে সামান্যও পাইনি এতকাল, সেখানে এই বিচার ও শাস্তি্‌, ওই না পাওয়ার বিচারে অনেক বেশী , তা বলাই বাহুল্য । সে চিন্তায় ও যুক্তিতে আমি আনন্দিত।

আমার মা রাজনীতি তেমন একটা বোঝেন না । রাজনীতি দূরের কথা, জীবনের চলার পথে অনেক দোলচাল আর হঠকারিতা তিনি কোনকালেই বোঝেন নি বলেই আমার ধারনা । আমার বাবা প্রায়ই সংবাদ পত্র জোরে জোরে পড়ে মা’কে শোনাতেন আর দেশের নানা অসংগতি নিয়ে হতাশ হতেন । বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আমার মা নিরবে মাথা নাড়াতেন । কেননা আমার মায়ের তেমন কিছু একটা বলার থাকত না কখনোই । তার পরেও মা’র দু একটা কথা শোনা যেত পাশের ঘর থেকে । যে কথাটি মা’র মুখে প্রায়ই শুনতাম, তা হলো, “মুজিব হত্যার বিচারই বাংলাদেশে হয় নি, আবার এই হত্যার বিচার !!”। 

কোন খুন-রাহাজানির কথা আসলেই আমার মা তাকে মুজিব হত্যার সাথে এক করে একধরনের হতাশা মিশ্রিত উদাহরণ দিতেন । আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন সেসব কথা অত ভালো করে বুঝি নি । কিন্তু মা’র মুখে এই নাতিদীর্ঘ বাক্যটি বার বার শুনে আমাদেরও ধারনা হয়েছিলো, যে দেশে মুজিব হত্যার বিচার হয়না সে দেশে কোন অপরাধের বিচার চাওয়াটা সম্ভবত যৌক্তিক নয় । আমরা ভাইবোনেরা , মুজিব কে? তাঁকে কেন মেরে ফেলা হয়েছে ? কারা মেরে ফেলেছে ? এসব ভেবেই এবং না জেনেই মনে করতাম মুজিব এমন একজন মানুষ ছিলেন যার হত্যার বিচার বাংলাদেশে হয়নি, সুতরাং আর কোন অপরাধের বিচার এদেশে হওয়াও হয়ত সম্ভব নয় ।

আপনাদের মনে আছে কি না জানি না, অনেক দিন আগে একটি হত্যা মামলা হয়েছিলো মুনীর-রীমা হত্যা মামলা । আমার বাবা আইঞ্জীবি বলেই কিনা জানিনা , তবে এ বিচার নিয়ে সে সময় প্রতিদিন আমাদের বাসায় আলোচনা হতো, পত্রিকা পড়া হতো । তখন আমরা মা’র বলা সেই চিরাচরিত উক্তিটি আমি যপে নিতাম । আমি ভেবেছিলাম , মুনিরের ফাঁসি কোনদিনই হবে না , কেননা যেখানে মুজিব হত্যারই কোন বিচার হয় নি । এ ছাড়াও দেশে যদি কোন সামান্য অপরাধও কোথাও হতো, খুন হতো,ডাকাতি হতো, আমরা ধরেই নিতাম এসব অপরাধের কোন বিচারই হয়ত হবে না কারন মুজিব হত্যার বিচার যেখানে হয়নি । প্রকারন্তরে এ চিন্তা ছিলো একধরনের হতাশাবোধ ও গ্লানির সংমিশ্রনে এক ধরনের মেনে নেয়া টাইপ নিজস্ব সমাধান । তা আমরা বুঝতে পারিনি সে সময় ।

আমাদের কৈশোরে এই চিন্তার যৌক্তিকতা কতটুকু ছিলো তা বিচার করাই বাহুল্য কিন্তু আমার মায়ের বলা সে কথার ভেতর যে একধরনের রূপক অর্থ ও দেশের আইন ও বিচার ব্যাবস্থা নিয়ে এক ধরনের তাচ্ছিল্য ছিলো তা আজ আমরা টের পাই তীব্র ভাবে ।

আজ ১৯ নভেম্বর ২০০৯ সাল। গতকাল পর্যন্ত আমার মা’র বলা সে কথা আমি বিশ্বাস করেছিলাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, এ দেশে কোন অপরাধের কোন বিচারই হয়ত হবে না,কেননা এদেশে বংগবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার কোন বিচার হয় নি ।

অথচ আজ ? অনেক দিন পর এক ধরনের কষ্টকর ও গ্লানিকর চিন্তা থেকে যেন নিজেকে মুক্তি দিয়েছি । মুক্তি পেয়েছি । আমি নিশ্চিত, দেশে যখন পরের বার মা’র সাথে কথা হবে তখন মা’র হাসির আর আনন্দের কন্ঠ ফোনে ভেসে আসবে। মা নিশ্চই আমাকে বলবেন,

“এ দেশে মুজিব হত্যার বিচার হয়েছে । এ দেশে বিচারের বাণী কখনই নিভৃতে কাঁদবে না ।”

No comments:

Post a Comment