Monday 23 November 2015

দায়টা শুধু আওয়ামীলীগের উপরেই কেন বর্তালেন আপনারা?

এই বিচারের বিরুদ্ধে যে প্রোপাগান্ডা সবার আগে আমাদের শুনতে হয় সেটি হচ্ছে, এই বিচার আওয়ামীলীগ সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্যই করেছে। শুনতে শুনতে কান পঁচে গিয়েছে। কিন্তু যখনই আমি এই অসভ্য প্রচারণার বিরুদ্ধে যৌক্তিক কিছু প্রশ্ন করি তখন শুনতে হয় “শালা আওয়ামীলীগের দালাল” বাক্যটি।
ব্যাক্তিগত ট্যাগিং-এ আমি কখনো আওয়াজ দেই না। ট্যাগিং হচ্ছে আক্রমণের অস্ত্র। যে যুদ্ধে আছি সেখানে এইসব অস্ত্রের আঘাত সইতে হবে এটা জেনে আর বুঝেই মাঠে নেমেছি। সুতরাং ট্যাগবাজেরা ব্যার্থ হবেই, এতে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু যে বিষয় নিয়ে আমি এই লেখাটি শুরু করেছি সেটিতেই বরং ফিরে যাই। এই বিচারটা যখন শুরু হোলো তখন এই বিচারবিরোধীরা আর কিছু বিভ্রান্ত মানুষেরা ঠোঁট উল্টে বলা শুরু করলো আরেহ... আওয়ামীলীগ ১৯৯৬ সালে জামাতের সাথে জোট করে এখন আবার ২০১০ সালের বিচার করে, ভাওতাবাজির আর যায়গা পায়না। এই সুনির্দিষ্ট অভিযোগটি দেবার আগে আমাদের কিছু কথা জেনে রাখা খুব বেশী মাত্রায় প্রয়োজন।
সেটি কি?
জামাতের গঠনতন্ত্রের ২য় অধ্যায়ের সপ্তম ধারায় যেখানে রুকন হবার নিয়ম, রীতি নীতি ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে যে-
৭) এমন কোনো পার্টি বা প্রতিষ্ঠানের সহিত সম্পর্ক না রাখেন যাহার মূলনীতি, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ইসলামের আক্বীদা এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ,লক্ষ্য ও কর্মনীতির পরিপন্থী।
আবার ১ম অধ্যায়ের ৪র্থ ধারার স্থায়ী কর্মনীতি অংশের ২য় পয়েন্টে বলা হয়েছে যে-
২) উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের জন্য বাংলাদেশ জামাতী ইসলামী এমন কোনো উপায় ও পন্থা অবলম্বন করিবে না যাহা সততা ও বিশ্বাসপরায়নতার পরিপন্থী।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় এই যে, রুকন রিক্রুট করবার যদি এই রীতি হয়, যেখানে জামাতের আকীদা কিংবা বিশ্বাসের পরিপন্থী এমন কোনো দলের সাথেই সম্পর্ক রাখা যাবেনা, সেখানে ১৯৯৬ সালে জামাত আওয়ামীলীগের সাথে তাহলে কিভাবে যুগপৎ আন্দোলন করেছে বলে কিংবা জোটবদ্ধ আন্দলোন করেছে বলে প্রকাশ করে?
যদি তাই হয় তবে জামাতের সংবিধান অনুযায়ী ২য় অধ্যায়ের ৭ম ধারা মোতাবেক জামাত তা করতে পারে না। এবং জামাতের সংবিধানের ১ম অধ্যায়ের ৪র্থ ধারার ২ নাম্বার পয়েন্ট অনুযায়ী তারা সততা ও বিশ্বাসপরায়নতার পরীপন্থির কাজ করেছে। এখানে ঘটনা দুইটা।
হয় (১) জামাতের সংবিধানে যা আছে তা মিথ্যা ও কথার কথা। আর সেক্ষেত্রে সংবিধান যেখানে মিথ্যা সেখানে তাদের সবকিছুই মিথ্যা।
আর যদি সংবিধান যদি সত্য হয়, তাহলে- (২) ১৯৯৬ সালে তারা আওয়ামীলীগের সাথে যুগপৎ আন্দোলোন করে নি। কারন লীগের বিশ্বাস ও আকীদা নিশ্চয়ই জামাতের সাথে মিলে না বা এক নয়।
যদি জামাত বলে তারা লীগের সাথে ছিলো তবে তাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে তারা তাদের সংবিধান মানেনি এবং তাদের সংবিধানে যা আছে তা শুধু কথার কথা। আর যদি ওরা বলে যে লীগের সাথে জোট করেনি, তাহলে ল্যাটা চুকেই যায়।
আবার এটিও এখানে আলোচ্য যে, তত্ত্বাবাধায়ক ইস্যুতে তখন জামায়াতও সোচ্চার ছিলো আর সেটিও হয়েছিলো সেই একই রাজপথে। এখন কোনো একটি আন্দোলনের ভাষা ও লক্ষ্য যদি আওয়ামীলীগের সাথে মিলে যায় জামায়াতের, তবে সেটির দায়ভার কেন আওয়ামীলীগ নেবে? কেনই বা নেয়া উচিৎ? আজকে আমি যদি একজন সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হই এবং সেই একই ইস্যুতে যদি একজন দূর্নীতিবাজ লোক একই সময় রাজপথে সেই সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে থাকে, তবে কি তার সাথে একই সাথে আমিও স্লোগান তুলেছি বলে আমাকে দূর্নীতিবাজ বলে প্রচার করাটা যৌক্তিক হবে? কিংবা এটা বলা কি উচিৎ হবে যে আমি একজন দূর্নীতিবাজের সাথে জোট করে কাজ করছি? এই ফাইন লাইন তো দৃষ্টিগ্রাহ্য এবং আলোচ্য প্রোপাগান্ডাটি তো জামায়াতের সেই পুরোনো এক “তথ্য পান্ডামি” ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই আলোচনার সাথে আমি একটি ঐতিহাসিক তথ্য যোগ করতে চাই। সেটি হচ্ছে ৭-ই মার্চ ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সে সময়ে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করে আওয়ামীলীগের দাবী দাওয়া সম্পর্কিত ৫ দফা দাবী তুলে ধরেন। ঐ একই দিনে জামাত, বাম দল ও অন্যান্য দলের নেতারা রাষ্ট্রপতির সাথে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন। একই সাথে জোট করলে এই আলাদা আলাদা দফা দেবার তাহলে কারন কি ছিলো? ইনফ্যাক্ট ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হবার সময় তাদের প্রোয়োজনীয় তিনটি সিটের জন্য আওয়ামীলীগ কি আদৌ জামাতের কাছে গিয়েছিলো? উত্তর হচ্ছে না, যায়নি। ১৯৯৬ সালে যদি জোটই হবে তবে সিট ভাগাভাগি কিংবা একসাথে জোটবদ্ধ নির্বাচন কেন করেনি?
উপরের এই আলোচনার প্রেক্ষিতে একটা সিদ্ধান্তে খুব সহজেই আসা যায় যায় যে, জামাতের সাথে আওয়ামীলীগ কখনই জোটবদ্ধ আন্দোলন করেনি এবং জোটও বাঁধেনি। তত্বাবধায়ক সরকারের আন্দলোনে সব দলই তাদের নিজেদের আলাদা আলাদা অবস্থান থেকে রাজপথে নেমেছিলো। আজকে আমার এই লেখার বিষয়ও এটি নয়। এইসব কথা এখানে মূল আলোচনা হিসেবে আমি বলতে আসিনি।
আমার বক্তব্য হচ্ছে, যদি আওয়ামীলীগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য এই বিচার করছে এমনটাই ধরে নেয়া হয় তবে কেন ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা অধিঃগ্রহন করবার পর পর এই বিচার করেনি? কেন লেঃ জেনারেল এরশাদ এই বিচার করেনি ১৯৮২ সালে ক্ষমতা অধিঃগ্রহন করার পর? কেন ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ গণ আন্দলোন সেই শহীদ জননীর গণ আদালত হবার পরেও বি এন পি এই বিচার করেনি? কেন ২০০১ সালে বি এন পি পুনরায় ক্ষমতায় যাবার পর এই বিচার করেনি? কেন সাধারণ জনতা শুধু আওয়ামীলীগের কাছেই এই বিচারের দাবী করে? তাহলে কি এই বিচার একমাত্র আওয়ামীলীগের মাধ্যমেই করা সম্ভব? এমনটা ভেবেই কি জনতা আওয়ামীলীগের কাছেই বিচারের দাবী করে?
যদি তাই হয়ে থাকে তবে এখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারনে বিচার হচ্ছে এই কথা কেন বলা হচ্ছে? সাধারণ জনতার যে ম্যান্ডেট কিংবা যে আগ্রহ সেটিকে উপেক্ষা করে আর সেটি না বলে শুধু আওয়ামীলীগকে কেন এই দোষ দেয়া? আপনি এই একটি দলের কাছে বিচার চাইবেন আবার বলবেন ১৯৯৬ সালে কেন করে নাই, এখন কেন করেছে, এগুলো তো স্পস্ট ভাবে মোনাফেকি ধরনের কাজ। পবিত্র ইসলাম ধর্মে এই মোনাফেকদের সম্পর্কে-ই বা কি বলা রয়েছে কিংবা অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থে?
ইনফ্যাক্ট ১৯৭২ সালেই তো বঙ্গবন্ধু বিচার শুরু করেছিলেন এবং তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করবার আগ পর্যন্তও বিচারের রায় হচ্ছিলো বাংলাদেশে। এই বিচার জিয়াউর রহমান বন্ধ করে দেয়। এর পরেও সকল দোষ আওয়ামীলীগের?
সাকা চৌধুরীসহ চট্টগ্রামে অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের মামলাগুলোর পুনঃতদন্তের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৮ সালের ১৫ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। সে সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিআইডির তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল কাদের খান মামলার তদন্তকাজ চালাতে গিয়ে প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাবে আর অগ্রসর হতে পারেননি। চট্রগ্রাম আদালতের রেকর্ডরুমে এ সংক্রান্ত নথিপত্রের খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেছে, এসব মামলার নথিপত্রের আর কোনো হদিস নেই ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে রাউজান থানাতেই ফকা চৌধুরী ও তার ছেলে সাকা চৌধুরীসহ অন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৬টি মামলা হয়েছিল। মামলাগুলোর নম্বর হলো ৪১(১)৭২, ৪(৩)৭২, ৯(৩)৭২, ১৮(৪)৭২, ৪(৪)৭২ ও ৫(৪)৭২। এসব মামলার তদন্ত শেষে ফকা চৌধুরী ও সাকা চৌধুরীসহ অন্যদেরকে আসামি করে চার্জশিটও দেওয়া হয়। কিন্তু,পরবর্তী সময়ে এসব মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করে (পিটিশন নং-৩৬৫/৭৩) তা স্থানান্তর করা হয় সাকা চৌধুরীদের পক্ষ থেকে । এরপর থেকে এ সব মামলার আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। সত্যরঞ্জন সিংহ’র মৃত্যূর পর এই মামলা যে মুখ থুবড়ে পড়বে তা আমাদের মত দেশের দৃষ্টিকোন থেকে বলাই বাহুল্য ।
আরেকটি তথ্য আপনাদের জেনে রাখা দরকার যে বি এন পি আমলেই সাকার’র বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এক ডজনের বেশী (২৩-২-৯১, ধারা ১৪৭,১৪৮,১৪৯,৪২৭,৪৩৫ ও ৩০২ দন্ডবিধি, মামলা নং- ৭(৯)৯১ ধারা ১৪৩,৪৩৫,৪২৭, ৩০৭ দন্ডবিধি মামলা নং ২২(০৩-০৩-৯১) ধারা ৩৬৪/৩২৩/১১৪ দন্ডবিধি ) তার উপর প্রাথমিক অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার চার্জশীট( নম্বর ৬৪, তাং-৮-৬-৯১,চার্জশীট ৫৫(১৯-৫-৯১) চার্জশীট ৮৮ (৩১-৭-৯১)
এখন স্বভাবতই আমার প্রশ্ন এসে যায় যে, যেই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৭২ সালে মামলা হোলো ৬ টা, আওয়ামীলীগ ১৯৯৮ সালে পুনঃতদন্ত করতে চেয়েছিলো কিংবা ১৯৯১ সালে বি এন পি ১২ টার উপরে মামলা দেয়, সেখানে ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে একাত্তরের অপরাধের জন্য বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড় করানো হলে কেনই বা আওয়ামীলীগকে দোষী হতে হবে? কেন তাদের বলা হবে যে এই বিচার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার?
তাহলে ৭২ সালের মামলা গুলো কি মিথ্যা ছিলো? ৯১ সালে তার বিরুদ্ধে আসা মামলাগুলোও কি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য ছিলো? বিচার যদি আওয়ামীলীগের কাঁধেই আমরা সাধারণ মানুষ চাপিয়ে দেই, আবার সেই বিচার যদি তারা করেও তারপরেও কোন মুখে আমরা বলি এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা?
কেন আপনি এই বিচারের প্রত্যাশা বি এন পি, জাতীয় পার্টি কিংবা বাম দলের উপর করেন না? দয়া করে জানতে পারি কি?

No comments:

Post a Comment