Wednesday 26 March 2014

আশ্চর্য ঘুম তুমি জেগে ওঠো


এক

আমার সেঝো কাকা বিলাপ করে কাঁদছেন মেডিকেল কলেজের আই সি ইউ এর সামনের কোনো একটা যায়গায়, স্মৃতি বলতে আমার ওইটুকুই। আমি তখন কিশোর। কাকা হারিয়েছেন প্রাণ প্রিয় স্ত্রী আর আমাদের যৌথ পরিবারে আমার মত সকল কাজিনরা হারিয়েছি "নতুন" চাচীকে। বিয়ের তিন বছর পর্যন্ত যিনি আমাদের নতুন চাচী ছিলেন। যিনি আমাদের চকোলেট দিতেন, আদর করতেন, বাবার মার থেকে বাঁচাতেন। আমার চাচাতো বোনকে জন্ম দিতে গিয়ে তিনি হারিয়ে গেলেন। কাকা সেদিন কিছু একটা বলতে বলতে, চিৎকার করতে করতে কাঁদছিলেন হাসপাতালের বারন্দায়। কি বলছিলেন তা আজ আর মনে নেই। চেষ্টা করলেই হয়ত মনে হবে, কিন্তু চেষ্টা করতে ইচ্ছে হয়না আমার। সব কিছু অর্থহীন লাগে।


চাচীর মৃত্যুর পর কাকা আবার তাঁর ক্যালিফোর্নিয়ার পুরোনো আস্তানায় ফিরে গেলেন। তাঁর সদ্যজাত কন্যা শিশুকে রেখে গেলেন আমার মেঝ চাচীর কাছে। আমার বোনটির দুধ মা আমার মেঝ চাচী। একসময় আমাদের বাকী স্মৃতি নিয়ে সেই বোনও চলে গেলো বাবার কাছে। একদিন আমার মেঝ চাচীও হুট করে মরে গেলেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছে বড় কষ্টের অসুখে। মৃত্যুর আগের দিন তিনি তাঁর শীতল হাতটি আমার গালে স্পর্শ করে ঝর ঝর করে কেঁদেছিলেন। কিছু একটা বলেছিলেন খুব সম্ভবত। আজকে সেটি বেমালুম ভুলে গেছি কিংবা এই মুহুর্তে ভুলে যাবার তীব্র অভিনয় করছি। তবে চাচীর কবর যিনি খুঁড়েছেন সেই বৃদ্ধ রইসউদ্দিনকে আমার মনে আছে। চাচীর মাথার দিকে হাত নিয়ে তাঁকে আমি কবরে নামিয়েছিলাম আরো অনেকের সাথে এটি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। এখনো কবর খুঁড়বার সেই ঝুপ ঝুপ কোদালের শব্দ ভেসে আসে আমার চারদিক থেকে। এই স্মৃতি আজও কেন আমি ভুলতে চেয়েও পারিনি সে কথা মনে করে আমার ভীষন বিরক্তি হয়। আমি ভুলে যেতে চেয়েছিলাম সব স্মৃতি।

আমার সেই বোন আজকে অনেক বড় হয়েছে। ফেসবুকে আমি ওকে দেখি। ওর অপূর্ব সুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি নতুন চাচীকে খুঁজি। কখনো পাই, কখনো পাইনা। পুরো দস্তুর আমেরিকান হয়ে যাওয়াতে আমি ঠিক ওই অর্থে ওকে অনেক কথা বলতে ঠিক সাহসও পাইনা। হয়ত ব্যাপারটা সাহসের নয়, কিংবা সাহসের। কি জানি... মিলিকে আমার প্রায়ই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় ওর কষ্টের কথা। তাঁর মা তাঁকে জন্ম দিতে গিয়ে অচিনপুরে চলে গেছেন, আর ফিরে আসেন নি এই পুরো ব্যাপারটি নিশ্চয়ই ওকে বড় কষ্ট দেয়।এই অদম্য কৌতূহল আমি চেপে রাখি। মিলি নিশ্চয়ই এমন প্রশ্ন শুনলে কষ্ট পাবে। হয়ত কাঁদবে, হয়ত কাউকে বলবেনা সে কষ্টের কথা । ২১ বছর আগের কথা নিয়ে আমি ভাবতে না চাইলেও ভাবনা আমাকে রেহাই দেয়না। আজ প্রায় দুই যুগ ধরে নতুন চাচীর চোখ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

আমি লন্ডনে চলে আসবার পর হারিয়েছি অনেককে। দাদীকে, নানুকে, আমার ছোট ফুপা, প্রিয় মেঝো ফু্পাকে। যে ফুপা এক কাপ গরম চা হাতে নিয়ে আমাকে তাঁর হোয়াইট স্যারের গল্প শোনাতেন। তিনি প্রায়ই তাঁর এই স্যারের গল্প বলতেন আমাকে। সেই একই গল্প। তারপরেও আমি শুনতাম মোনোযোগী শ্রোতার মতন।

দুই

উপরে যে ছবিটি রয়েছে সেটি প্রায় একযুগ আগের তোলা। আমার বড় বোনের বিয়ের দিন কমিউনিটি সেন্টারের সিঁড়িতে। কে তুলেছে এই ছবিটি, আমি জানিনা। এই ছবির দু'জন এখন আর নেই। তাওহীদ আর শাহীন। তাওহীদ ২০০৬ সালের এক রাতে আত্নহত্যা করলো। ভালোবেসে প্রতারিত হবার অভিমানে আত্নহত্যা। তাওহীদের মৃত্যুর খর পেলাম কোনো এক দুপুরে। আমার মনে আছে সেদিন লন্ডনে ছিলো ঝাঁ ঝাঁ দুপর। পাবের মধ্যে অসংখ্য ভীড়, রাস্তায় রাস্তায় সুখের র‍্যালি, ভালবাসাবাসি, প্রেম ট্রেমের মত ব্যাপার স্যাপারগুলো সেদিন বেশ জমে উঠেছিলো লন্ডনে। শুধু ঘুমিয়ে পড়েছিলো তাওহীদ। ভালোবেসে যন্ত্রণা আর সহ্য হয়নি আমার বোকা বন্ধুটির। তাই ঘুম হয়ে চলে গিয়েছিলো ও। নিজেকেই নিজে হত্যা করেছিলো পরম আগ্রহে।

তাওহীদের মৃত্যুর পর সেই মেয়েটি চলে গেলো অস্ট্রেলিয়ায়। আমার বন্ধু ঘুম হয়ে ওকে মুক্তি দিয়েছে হয়ত কিংবা ওর মুক্তির জন্যই তাওহীদ ঘুম হয়েছে। এভাবেও বলা যায়। যেমন ইচ্ছে তেমন বলা যায়। মেয়েটি হয়ত ভালো আছে, সুখে আছে। আমিও চাই ভালো থাকুক। মঙল হোক তার। এমন তীব্র ভালোবাসার পিন্ড, যার জন্য ঘুমিয়ে পড়ে বোকা প্রেমিক; সে ভালো না থাকলে আসলে ঠিক হয় না।

তিন

উপরের এই ছবির আরো একজন, শাহীন। কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়েছিলো। সেও চলে গেলো কাল। শাহীন বলতে গেলে সারাটা জীবনই বাবা মাকে ছাড়া থেকেছে। স্কুলে পড়বার সময় রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের হোস্টেলে আর স্কুল কলেজের গন্ডি পার হয়ে মেলবোর্নে। সেখানীই বাকী সব উচ্চতর পড়ালেখা শাহীনের। বাবা-মা থাকতেন কুয়েতে। শাহীন জীবনটা পার করে দিলো বিদেশ বিভূঁইয়ে। জীবনটা নিয়েও চলে গেলো অচেনা দেশে। শাহীন আমাকে এই লেখা লেখাচ্ছে, অথচ শাহীনের কথা আর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছেনা আমার। কোনো ব্যখ্যা নেই, কারনও জানিনা আমি।

চার

আমার ঘর থেকে ঠিক ২০ ফুট পরেই ম্যানর পার্কের সবচাইতে দীর্ঘ গ্রেভইয়ার্ড। লন্ডন যখন ক্লান্তিকর শীত হয়ে কিংবা স্নো পড়ে চুপসে থাকে তখন গ্রেভ ইয়ার্ডের এপিটাফগুলোকে আমার বিষাদগ্রস্থ মনে হয়। এখানে যখন গ্রীষ্ম এসে পড়ে, ঝক ঝকে হলুদ দুপর যখন ম্যানর পার্কের সকাল সন্ধ্যাকে ঝাঁঝরা করে ফেলে, ঠিক তখন কোনো এক অদ্ভুত কারনে এপিটাফগুলোর চাইতে আমার নিজেকেই বেশী বিষাদগ্রস্থ মনে হয়। কেন মনে হয়, জানিনা। আমি প্রায়ই দীর্ঘক্ষণ জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকি। প্রতিদিনই কারো না কারো কফিন আসছে,। আত্নীয়-স্বজন, বন্ধুরা ঘিরে ধরে রেখেছে একটি কফিন, কেউ না কেউ ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে বিষাদগ্রস্থ এপিটাফের দিকে। পুরো ব্যাপারটির ভেতরে কোথায় যেন একটা তীব্র ভীতি রয়েছে। আমি যতবার এই গ্রেভ ইয়ার্ডের দিকে তাকাই, ততবার এই ভীতিটি আমাকে গ্রাস করে। কিন্তু তারপরেও আমি তাকিয়ে থাকি।

আচ্ছা শাহীনের কবর কোথায় হবে? মেলবোর্নে? কুয়েতে? ঢাকায়? শাহীনের কবরের পাশে কি লেখা থাকবে? "আসসালামুয়ালাইকুম ইয়া হালাল কবুর। মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম শাহীন। মৃত্যু ২১শে মার্চ ২০১৪"

পাঁচ

কেমন হয় যদি কোনো এক বিষন্ন দুপরে শাহীনের কবরে গিয়ে শাহীনকে ডেকে তুলি? সাথে করে নিয়ে গেলাম তাওহীদকে। কেমন হয় শাহীনের কাঁধে হাত রেখে একটা বিকেল গল্প করে করে পার করে দিলে? ধরা যাক আমাদের অর্থহীন জীবন-যাপনের গল্প করলাম, সুখ আর বিষাদের গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। কেমন হয় যদি চিৎকার দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে আমার নতুন চাচীকে ডেকে তুলি? আমার ফুপা, আমার নানু, দাদু কিংবা আরো যারা আশ্চর্য ঘুম হয়ে  শুয়ে আছেন দীর্ঘ আর চিরক্লান্ত বিছানায়?

কেমন হয় যদি এই বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে জাগিয়ে তুলি সবাইকে? এই পৃথিবীকে বিদীর্ণ করে যদি বলে উঠি আশ্চর্য ঘুম তুমি জেগে ওঠো, তুমি জেগে ওঠো, তুমি জেগে ওঠো, তুমি জেগে ওঠো...













No comments:

Post a Comment