Monday 25 May 2015

মৃত্যু উপত্যাকার নুরুজ্জামানেরা ও বেগম জিয়া

এক
প্রথমেই যে বর্ণনা দেব সেটির সময়কাল ফেব্রুয়ারী ১, ২০১৫। বর্ণনার মূল চরিত্র নুরুজ্জামান কবে কোথায় জন্মেছেন সেটা আমাদের জানা নেই। নুরুজ্জামানের বেড়ে ওঠা কোথায় সেটিও আমরা জানিনা। আমরা জানি ঘটনার ঠিক মাঝপথ থেকে। যেখানে একজন দর্শক হিসেবে আমরা জানতে পারলাম নুরুজ্জামান ব্যবসার কাজে চট্রগ্রাম যাবেন। নুরুজ্জামানের দশম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে মাইশা তাসনিম বায়না ধরেছেন বাবার সাথে তিনিও চট্রগ্রাম যাবেন। চট্রগ্রামের কাছেই তো কক্সবাজার। সুতরাং বাবা যখন চট্রগ্রামে যাবেনই তখন কক্সবাজারটাও এ যাত্রা ঘুরে দেখবার একটা সুযোগ থাকে। বাবাকে এই কথা বলতেই তিনি মেয়ের এই বায়না ফেলেন নি। মেয়ের বায়না মেটাতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন তাহলে পরিবারের সবাইকে নিয়েই এই যাত্রা কক্সবাজার দেখে আসা যাক। সুতরাং তিনি সাথে নিলেন প্রিয় কন্যা, পূত্র আর স্ত্রী মিতা মাহফুজাকে কক্সবাজারে স্ত্রী, পূত্র আর মেয়েকে নিয়ে ঘুরেছেন নুরুজ্জামান। জীবনের আনন্দের সময়গুলো পার করেছেন পুরো পরিবারকে নিয়ে


এইসব উষ্ণ স্মৃতি সাথে করে নুরুজ্জামান ঢাকায় ফিরছিলেন আইকন পরিবহনের একটি বাসে। নুরুজ্জামান প্রিয় কন্যাকে পাশে নিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। কুমিল্লার কাছাকাছি ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের জগমোহনপুর এলাকায় রাত তিনটার দিকে একটি “গণতান্ত্রিক” পেট্রোলবোমা এসে পড়ে আইকন পরিবহনের সেই বাসে। নুরুজ্জামানের স্ত্রী ও পূত্র আগুন লাগবার পর বাস থেকে লাফিয়ে পড়েন। বেঁচে যান তাঁরা। নুরুজ্জামান আর তাঁর কন্যা মাইশা জীবনের শেষ ঘুম থেকে আর উঠতে পারেন নি কিংবা হয়ত উঠেছেন কিন্তু এই জ্বলজ্বলে হলুদ আগুনের থেকে আর তাঁরা দু’জন ফিরে আসেন নি।

এই লেখাটির ঠিক এই সুনির্দিষ্ট পর্যায়ে আমরা বলব আরো একজন নুরুজ্জামানের কথা। এই বর্ণনার সময়কাল ৬-জানুয়ারী ২০১৪। আমাদের এই অংশের বলা বর্ণনার নুরুজ্জামানের ক্ষেত্রেও আমাদের জানা নেই তিনি কবে কোথায় জন্মেছেন কিংবা কোথায় বেড়ে উঠেছেন। আমরা জানি নুরুজ্জামানের ছিলো স্ত্রী রত্না, দুই বছরের মেয়ে সাহা ও চার বছরের পূত্র সাহেল। নুরুজ্জামান পেশায় ট্রাক চালক। তাঁর আরো চার ভাই রয়েছেন। সব ভাই মিলে একটি ট্রাক কিনেছেন আর সেই ট্রাক নিয়েই নুরুজ্জামান গরু বোঝাই ট্রাক চালিয়ে যাচ্ছিলেন নরসিংদী। গাজীপুরের মৌচাকে আসতেই সন্ধ্যা ৭টার দিকে এই ট্রাকের দিকে সেই একই “গণতান্ত্রিক” পেট্রোল বোমা ছুটে আসে। আগুনের বিভৎস হলকা নুরুজ্জামানকে সাথে করে নিয়ে চলে যায় ঠিক তার একদিন পরের খুব সকালে।

এই ঘটনা দুইটির সময়ের পার্থক্য এক বছর। দু’জন নুরুজ্জামানকেই বিনা অপরাধে খুন করা হয়েছে এই তাঁদেরই বাংলাদেশে। গত ৫-ই জানুয়ারী ২০১৪ থেকে আজ ৪ ই ফেব্রুয়ারী ২০১৫ পর্যন্ত এমন প্রায় অসংখ্য মানুষের আলাদা আলাদা গল্প রয়েছে এইভাবে খুন হবার। আর খুন হয়েই এসব ঘটনাগুলো মূলতঃ শেষ হয়ে যায়নাকাগজে কলমে মৃত নয় কিন্তু আত্নিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিকভাবে ভেঙ্গেচুরে খান খান করে দিয়ে যায় নুরুজ্জামানদের পুরো পরিবার। বিধবা স্ত্রী তাঁদের অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক সন্তানদের নিয়ে এই বাংলাদেশে তাঁদের জীবন শুরু করেন। আজকে যারা এই লেখা পড়ছেন আর ইচ্ছে করছেনা তাঁদের জন্য কাব্যিক ভাবে নতুন করে এই মৃত্যু পরবর্তী বুকভাঙ্গা উপখ্যানের বর্ণনা করতে।
বাংলাদেশের প্রতিটি ধূলি কনা আর বাস্তবতার গলি ঘুপচি আপনাদের চেনা। দয়া করে কল্পনা করে নিন আমাদের দুই ঘটনার দুই বিধবা স্ত্রী মিতা মাহাফুজা আর রত্না এবং তাঁদের বেঁচে থাকা বাকি সন্তান সন্তদিদের কথা। যদি সেই ঘটনাগুলো অনুধাবন করে আপনি আঘাতপ্রাপ্ত হন, আপনি কষ্টের নীলে ভেসে যান প্রবল বিষাদে ও যন্ত্রণায় তবে উপযাচক হয়ে আমি আগেই ক্ষমা চাই।

দুই
সারা বাংলাদেশটাকে এখন পরিণত করা হচ্ছে একটা জলজ্যান্ত মৃত্যু উপত্যাকায়। এই চেষ্টা করবার যাত্রায় বেগম জিয়া ও তাঁরসাথে থাকা বাকি ১৯টি দলের কর্তা ব্যাক্তিরা বেগম জিয়ার সাথে হাত মিলিয়েছেন। বেগম জিয়া আর তার প্রিয় স্বাধীনতাবিরোধীদের কর্মীদের ছুঁড়ে দেয়া এই সম্মিলিত এবং সর্ব সম্মতিক্রমে অন্তঃর্দলীয় অনুমতি প্রাপ্ত এই ধরনের পেট্রোলবোমাকে নির্দ্বিধায় “গণতান্ত্রিক” বলা যেতে পারে। আমাদের দু’টি বর্ণনার দু’জন নুরুজ্জামান সেক্ষেত্রে “গণতান্ত্রিক অস্ত্রের আঘাতে গণতান্ত্রিক সরকার পুনোরোদ্ধার যুদ্ধে (!!) নিহত”, এমন বললে সেটি হয়ত বেগম জিয়া এবং তাঁর সভাসদ দের কাছে মোটেই অতিরঞ্জিত কোনো স্টেটমেন্ট হয়ে উঠবে না।

বেগম জিয়া বলছেন তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনোরোদ্ধারে নেমেছেন। জাতীয় নির্বাচনের সময় তিনি নির্বাচনে আসেন নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে সংলাপের জন্য দাওয়াত দিয়েছিলেন গণভবনে। সুযোগ ছিলো সরাসরি সংলাপের এমনকি মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে সুস্পস্ট প্রস্তাব ছিলো নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে সে বিষয়েওবেগম জিয়ার পছন্দমত উপদেষ্টা নির্বাচনের ব্ল্যাংক চেক দেয়া ছিলো সে প্রস্তাবে। তিনি সেই দাওয়াত শুধু প্রত্যাখ্যান-ই করেন নি বরং প্রধানমন্ত্রীর সাথে যে অভব্য আচরণ করেছেন সেটি বোধকরি সারা বাংলাদেশের মানুষই শুনেছেন এবং জেনেছেন। যেদিন দাওয়াত দেয়া হয়েছিলো সেই দিনটি ছিলো রবিবার এবং পরদিন সোমবার থেকে ছিলো হরতাল। বেগম জিয়াকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি চুড়ান্ত ঐক্যমত্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত হরতাল চালিয়ে যাবেন বলেও সেই টেলিফোন সংলাপে বলেছিলেন। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে অপহরনের পর মুক্তিপণ চাইবার ও সেটি না মানলে খুন করে ফেলবার যে পদ্ধতিটুকু রয়েছে সেটির চিহ্ন জ্বলজ্বলে ভাবে বিদ্যমান।

তাঁর এবং তাঁর সাথে থাকা বাকি জোটভুক্ত দলের মনে হয়েছে এই ধরনের ব্যাবস্থায় ক্ষমতা পাবার আশা ক্ষীণ সুতরাং দেশের নানান পরিবহনে তাঁর কর্মীদের লেলিয়ে দিয়ে পেট্রোল বোমা মেরে একদা যে জনতার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি সেই জনতাকে আগুনে পুড়িয়ে মারাটা বেগম জিয়ার জন্য হয়ে উঠেছে অত্যধিক রিজেনেবল। বেগম জিয়া নির্বাচনে না যাবার ফলে পাননি ক্ষমতাসুতরাং নুরুজ্জামানরা ঘুরে বেড়াবে বাসে, ট্রাকে, রিকশায়? অবশ্যই এ হতে পারেনা। তিনি হারিয়েছেন ক্ষমতার লাল ভেলভেটের মসনদ, সচিবালয়, ক্যাবিনেট, হাজার হাজার কোটি টাকার কাঁচা বাণিজ্য, হাওয়া ভবন কিংবা অনাগত আদম ভবন। সুতরাং বোমা তো খেতেই হবে। অনাগত আদম ভবন হারাবার ক্ষোভে আগুনে পুড়বে জীবন্ত আদম, এটাই এখন স্বাভাবিক নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনতাই যেখানে ক্ষমতার উৎস আর সেই জনতাই যেখানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে রয়েছেন সুতরাং বোমা মেরে কয়লা বানাতে হবে এই জনতাকেই।

এটা এখন স্পস্ট যে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দলের খোলশ গায়ে লাগিয়ে ও গনতন্ত্রের বুলি কপচিয়ে যে খুনে আন্দোলনে নেমেছেন সেখানে তিনি ছুরি ধরেছেন সাধারণ জনতার চিবুকে। হিসেবটা খানিকটা সরল ও বর্বর। সাংবিধানিক ভাবে একটা বৈধ সরকারকে উৎখাত করবার জন্য জিম্মি হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে পুরো বাংলাদেশের সাধারণ জনতাকে। ভেবেই নেয়া হয়েছে যে, দেশ যেহেতু শেখ হাসিনার সরকারই চালাচ্ছে সুতরাং দেশের জনতার দায় সরকারের। আর জনতার দায় যেহেতু সরকারের সুতরাং নিরাপত্তাহীনতার যে কোনো কারনেই জনতা প্রশ্নবিদ্ধ করবে সরকারকেই। সরল অংকের প্রথাগত নিয়মে এই জনতার নিরাপত্তাকে নিঃশেষ করে দিতে পারলেই সমাজে তৈরী হবে অষন্তোষ এবং একটা পর্যায়ে সাধারন জনতা ফুঁসে উঠবে এবং চাপ দিবে সেই সরকারকেই, গাল দিবে সেই সরকারকেই, আস্থা হারাবে এই সরকারের কাছ থেকেই। আর এগুলো যদি সফলতার শীর্ষমুখ দেখেই ফেলে তবে আর যায় কোথায়? এরপর নির্বাচন। জিম্মি যেহেতু আমাদের মত জনতাকেই করা হয়েছে আর বেগম জিয়া যেহেতু ছু্রি ধরেছেন আমাদেরই বুকে সেহেতু একজন আম জনতার কাতার থেকে আমি সেই জনতার হয়েই প্রশ্ন তুলতে চাই কিছু বিষয়ে।

প্রথমত আমার জানা দরকার যে, আমাদের এই বাংলাদেশের জন্মের শুরুতে যেই জামাতে ইসলামী এই দেশের স্বাধীনতা চায়নি, বাংলাদেশের অস্তিত্ব তৈরী হোক এমনটা চায়নি এবং যেই দল তাদের এই না চাওয়া থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে পুরো দেশজুড়ে অবর্ণনীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সেই দলের চাওয়া কিংবা পাওয়ার সহযোগী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত বেগম জিয়ার সাথে কেন কোনো ধরনের সংলাপে যেতে হবে সরকারকে?

দ্বিতীয়ত আমার জানা দরকার, যদি তথাকথিত সব দলের অংশ গ্রহণের পুঁথিগত মানে দাঁড়ায় গণতন্ত্র আর সেটা যদি হয় বেগম জিয়ার ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে তবে সাধারন জনতা হিসেবে আমাদেরও স্পস্ট জানবার অধিকার রয়েছে ২০১০ সালের ২৫ শে মার্চ থেকে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার চলছে সেটির বিষয়ে। বেগম জিয়া গত ছয় বছরে তাঁর ভাষনে একাধিকবার এইসব ঘাতকদের রাজবন্দী বলে উল্লেখ করে বিভিন্ন সমাবেশে তাঁদের মুক্তি দাবী করেছেন। আইন আর আদালতের সমস্ত নর্মস, সঙ্গাকে উপেক্ষা করে তিনি সেসব সভা আর সমাবেশেই সরাসরি এইসব ঘাতকদের দায়মুক্তি দিয়েছেন।

অতএব এটা আমার অবশ্যই জানা দরকার যে আমি কেন বেগম খালেদা জিয়াকে সরকারের প্রধান হিসেবে দেখতে চাইব যিনি এই ঘাতকদের মুখপাত্র হিসেবে আর আইন আদালতের তোয়াক্কা না করে তাদের মুক্তি দিতে চান? আমার বাবা-মা, আত্নীয়-স্বজন তথা যে ৩০ লক্ষ মানুষ খুন হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি কেন সেটির সুষ্ঠু বিচারচলাকালীন সময়ে এমন একজন ব্যাক্তির আবদারে মাথা নোয়াবো যিনি এই বিচার বন্ধ করবার জন্য সরাসরি আহবান করেছেন? আমি কেন এই মানুষগুলোর কাছে মাথা নোয়াবো যেখানে আমি নিশ্চিত তারা এই বিচার নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধ পরিকর? মুক্তিপণ হিসেবে যেহেতু আমাদের মত সাধারণ জনতাকেই ধরা হয়েছে সেহেতু এই খুন হয়ে যাবার আশংকা থাকবার পরেও এগুলো জানা আমার অধিকার।

বাংলাদেশের জনগন ২০০৮ সালের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সরকারকে নিরংকুশ ম্যান্ডেট দিয়েছিলেন মূলত একাত্তরের এই ঘাতকদের বিচার হবে এমন সংকল্পে। সারা বাংলাদেশের মানুষ একত্রিত হয়েছে এই বিচারের দাবীতে। ২০০৮ সালের পরের পাঁচ বছর ধরে এই বিচার চলেছে এবং এখনও চলছে। যে খালেদা জিয়ার বি এন পি’র সাথে জোটভুক্ত জামাতী ইসলামী এই বিচার প্রক্রিয়াকে ভন্ডুল করবার জন্য পাশে রয়েছে আমাদের ম্যান্ডেট পাওয়া সরকার কেন তবে বেগম জিয়ার সাথে সংলাপে যাবেন আর সরকার কোনো ধরনের সংলাপে গেলেই বা আমরা কেন মেনে নেব?

তিন
যে তথাকথিত গণতন্ত্রের দাবীতে বেগম জিয়া বাংলাদেশের মানুষকে এভাবে পুড়িয়ে মারবার মত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সে তথাকথিত গণতন্ত্র তিনি এভাবে খুনের রাজত্ব কায়েম করে উদ্ধার করতে পারবেন কিনা আমাদের জানা নেই। তিন তিনবারের একজন প্রধানমন্ত্রী যেখানে ফোন করে নিজে হামলা ও নাশকতার নির্দেশ দেন [ সাম্প্রতিক সময়ে বেগম জিয়ার প্রকাশিত টেলিফোন কনভার্সেশন দ্রষ্টব্য] সেখানে এই বাংলাদেশ নিয়ে আমি কোন স্বপ্ন দেখব? গত ৬ টি বছর বিরোধী রাজনৈতিক দলে থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়া আর তার ১৯ দলের নেতাকর্মীরা বিরোধী রাজনৈতিক দলের কোন দায়িত্ব পালন করেছেন? তারা দেশের মানুষের জন্য কি করেছেন? তারা কি একটা কার্যকর শিক্ষানীতির প্রস্তাব দিতে পেরেছেন? তারা কি পেরেছেন আমাদের রাষ্ট্রনীতি উন্নয়নকল্পে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে? তারা কি পেরেছেন যে ক্ষমতায় গেলে তাদের কৃষিনীতি ও এই বিষয়ে তাদের পরিকল্পনা কি হবে সেটির কোনো প্রস্তাব দিতে? তারা কি পেরেছেনে আমাদের অর্থনীতি, সমাজনীতি, পরারাষ্ট্র নীতি, অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়নের প্রস্তাব দিতে? তারা কি সরকারের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কখনো? কখনো কি আদৌ তারা বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তা করেছেন?

এসব সব প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, না, তারা এর কিছুই করেন নি। করার ভেতর তারা কেবল পেরেছেন সেভেন আপ কিংবা কাঁচের বোতলের ভেতর খোলা বাজার থেকে পেট্রোল কিনে সেটি সাধারন আমজনতার দিকে তাদের দলীয় পান্ডাদের দিয়ে ছুঁড়ে মারতে। তারা পেরেছেন লন্ডন থেকে তাদের নেতাকে দিয়ে জাতির জনকের প্রতি বিষবাষ্প ছুঁড়ে দিতে আর ইতিহাসের গায়ে কালিমার পর কালিমা লেপে দিতে। এই বাংলাদেশে নামের রাষ্ট্রে তাদের শুধু চাই ক্ষমতা। ভ্যাম্পায়ার যেমন অনেকদিন রক্তের সাধ না পেলে উন্মাদ হয়ে ওঠে, বেগম জিয়া তেমন উন্মাদ হয়ে উঠেছেন ক্ষমতার জন্য।

লেখার শেষ প্রান্তে এসে আমি আবারও আমাদের এই মৃত্যু উপত্যাকার  নুরুজ্জামানদের কথা বলে শেষ করি। বেগম জিয়ার গণতন্ত্র যাত্রার পেট্রোল বোমাতে যে নুরুজ্জামানদের স্বপ্ন, জীবন, পরিবার এভাবে সিম্পলী কাঠ কয়লার মত অঙ্গার হয়ে গেছে সেই খুনের পরে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর স্বপ্নের গণতন্ত্রকে তথা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারবেন কিনা আমাদের জানা নেই। এই সব সম্ভবের বাংলাদেশে হয়ত সেটি পারবেন। যে দেশে গোলাম আজমদের জানাজায় হাজার হাজার লোক হয় সে দেশে পেট্রোল বোমার হুকুমদাতারা ক্ষমতায় যেতে পারেন। এসব নিয়ে আমি আর ভাবিনা।

আমি কেবল ভাবি হতভাগ্য নুরুজ্জামানদের কথা। হয়ত বেগম জিয়ার সভাসদেরা একদিন নুরুজ্জামানদের নিয়া শোকসভা করবেন। গণতন্ত্র রক্ষা করবার জন্য হয়ত তাদের বানিয়ে দেয়া হবে গনতন্ত্র রক্ষার অগ্রদূত কিংবা প্রতিমূর্তি হিসেবে। হয়ত একদিন নুরুজ্জামানদের পরিবারের বাকি সদস্যদেরও বাধ্যতামূলক ভাবে এইসব সভা কিংবা সিম্পোজিয়ামে হাজির থাকতে হবে। হয়ত একদিন মাথা নীচু করে তাঁরাও বসে থাকবেন সেসব সভাতে ঠিক আজ যেমন নূর হোসেনকে গণতন্ত্রের আইকন বানিয়ে এরশাদও ফুল দিতে জিরো পয়েন্টে যান আর তাদের পরিবারকেও বসে থাকতে হয় বিভিন্ন সভা কিংবা সমাবেশে।

আজকে আমরা যারা গণতান্ত্রিক পেট্রোলবোমা ফাঁকি দিয়ে কোনোভাবে বেঁচে বর্তে আছি এই মৃত্যু উপত্যাকায় মূলত বলা যেতে পারে এই জনপদের অবশিষ্ট নুরুজ্জামান আমরা। মৃত নুরুজ্জামানদের কবর একদিন যেমন গণতন্ত্রের মাজার হিসেবে ব্যবহার হবার অপেক্ষা তাঁদের খুন হবার ঠিক পর থেকেই শুরু হয়েছে ঠিক তেমনি আমাদের মত বেঁচে থাকা নুরুজ্জামানদের পরবর্তী কবর হয়ে উঠবার অপেক্ষারও সূচনা হয়েছে।


ক্ষমতালোভী ভ্যাম্পায়ারদের এই মৃত্যু উপত্যাকায় একজন নুরুজ্জামান পরিচয় হিসেবে আমরা এইভাবে ক্ষমতার উৎস হয়ে বেঁচে ও মরে থাকি। আমাদের নিয়তি এইভাবেই লেখা হয়ে আছে।

No comments:

Post a Comment