Monday 1 June 2015

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালঃ হতাশা কেবল গভীর হয়

প্রারম্ভিক বক্তব্যঃ এ লেখাটা যখন লিখব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তারপর থেকেই আমি ঠান্ডা মাথায় কয়েকবার ভেবেছি এই লেখাটা কি সঠিক হচ্ছে কিনা। কেননা লেখাটা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নিয়ে এবং লেখাটার আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে প্রচন্ড হতাশা্র গল্প। এই ট্রাইবুনাল নিয়ে এই পর্যন্ত যতবার লিখেছি যে কোনো মাধ্যমেই কিংবা যেখানে যেখানেই বলেছি প্রতিটি স্থানেই চেষ্টা করেছি এই ট্রাইবুনাল নিয়ে আশার কথা বলতে। বেছে বেছে সব সময়ই ট্রাইবুনালের পজিটিভ দিকগুলোকে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি।

বার বার মনে করেছি যেসব পাঠক/পাঠিকারা ব্লগ পড়েন এবং এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নিয়ে ভাবেন তাদের কাছে ট্রাইবুনালের শক্তিশালী দিকগুলো, পজিটিভ দিকগুলো কিংবা এই ট্রাইবুনালের বিরুদ্ধে আসা সকল প্রোপাগান্ডার উত্তর গুলো পৌঁছে দিতে পারলে ক্ষুদ্র ভাবে হলেও ট্রাইবুনালের পক্ষে একটি আস্থার জায়গা তৈরী হবে। ট্রাইবুনালের বিরুদ্ধে থাকা শক্তিগুলো এত বেশী শক্তিশালী ছিলো যেখানে আসলে এদের বিরুদ্ধে একাডেমিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সকল ভাবেই পাল্টা যুদ্ধের একটা ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিলো। আর সে প্রস্তুতি ও পরবর্তী যুদ্ধ আমরা অনেকে মিলেই করেছি একসাথে। যদিও এখন সে ঐক্য আর আগের মত নেই, একজন আরেক জনের পেছনে লেগে রয়েছেন সুনিপুন ভাবেই, নিজেদের ভেতরের অন্তঃর্দ্বন্দ, প্রকাশ্য ভাবে একজন স্বাধীনতার পক্ষের এক্টিভিস্ট আরেকজনের বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্য দিচ্ছেন,সংঘাত সব কিছু মিলিয়ে ভেতরের অবস্থা ভয়াবহ।

এর সাথে আবার যুক্ত হয়েছে আওয়ামীলীগ সরকারের অন্য এক চেহারা দেখাবার মহড়া। যদিও এই বিচারটি শুরু হয়েছে ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি হিসেবেই। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে এই রকমের একটি বিচার করবার জন্য একটি সরকারকে যেমন নিবেদিত প্রাণ, দক্ষ হতে হয় তার শতকরা ত্রিশ ভাগও এই সরকার দেখাতে পারেনি। সরকারী পর্যায়ে, মূলত এই বিচারের আইনী দিক থেকে যারা জড়িত ছিলেন তাদের অধিকাংশই এই আইন ঠিকমতো পড়ে দেখেছেন বলে আমার ব্যাক্তিগত ভাবে মনে হয়নি। এই আইন সম্পর্কে কিংবা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সম্পর্কে সামান্যতম ধারনা না থাকার পরেও [আমার তীব্র ধারনা] তৎকালীন আইনপ্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, এক সময়ের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মইনুদ্দিন খান আলমগীর, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, মতিয়া চৌধুরীকে নানান যায়গায় ফালতু যত্তসব কথা বার্তা, বিবৃতি দিতে দেখেছি যেগুলো একটা পর্যায়ে বিচারিক ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরী করেছে। এমনকি সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও মতিয়া চৌধুরী ট্রাইবুনাল বিষয়ক নানান বক্তব্যের জন্য ট্রাইবুনালের কাছে ক্ষমাও প্রার্থনা করেছেন।


এই বিচারের প্রধান প্রতিপক্ষ জামাতে ইসলামীর অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি নানান শ্রেণীগত যেসব কূট দক্ষতা রয়েছে সেসব জানবার পরেও সরকারী পর্যায় থেকে পাল্টা শিল্ড হিসেবে কখনোই এই ট্রাইবুনালকে ডিফেন্ড করবার কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি, বিশ্ব মহলে এই বিচার নিয়ে যেসব অপঃপ্রচার হয়েছে সেসবের বিরুদ্ধে সরকারী ভাবেও কোনো রকমের প্রতিরোধ গড়ে উঠেনি বা আমরা গড়ে উঠতে দেখিনি। এই বিচারের ব্যাপারে সঠিক তথ্য প্রদান, বিচারের বিরুদ্ধে আসা অপঃপ্রচারের ব্যাপারে যৌক্তিক বিবৃতি প্রদান কিংবা এই বিচারের আপডেট নিয়ে বলবার জন্য একটি ইনফরমেশন সেল কিংবা একটি সংস্থার প্রয়জনীয়তা ছিলো ব্যাপক। গত ৪ বছরে সেটি গড়ে উঠা দূরের কথা এই বিচার বিষয়ক একটি পূর্নাঙ্গ ওয়েব সাইট নির্মিত হয়নি সঠিক সময়ে। তিন বছর পরে এই ট্রাইবুনাল নিয়ে যে ওয়েব সাইট তৈরী হয়েছে সেটি নিয়ে কথা বলে আর লজ্জা পেতে চাইনা। এই বিচার নিয়ে একটা ওয়েব সাইট তৈরী করা হবে এই প্রত্যাশা ছিলো এই তথ্য প্রযুক্তির সময়ে একটা অতি সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু এই অতি সাধারণ ব্যাপারটিও সরকার করতে ব্যার্থ হওয়ায় এই সুযোগে ডেভিড বার্গম্যান নামে এক অপরিচিত ব্যাক্তির একটি ওয়েব সাইট, যেই ওয়েব সাইটে এই ট্রাইবুনাল নিয়ে নানান ধরনের তীর্যক কথা, মন্তব্য ইত্যাদি পড়ে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছেন। এই সাইটের লেখাগুলো কখনো কখনো এতই আপত্তিকর ছিলো যে, এই কারনে ডেভিডকে দুইবার আদালত অবমাননার অভিযোগে আদালতে যেতে হয়েছে। বর্তমানে আদালত অবমাননা নিয়ে তার একটি বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ রয়েছে যেটি বর্তমানে বিচারাধীন।


বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংঘটিত বর্বর গণহত্যার সাথে বাংলাদেশের যে সকল দালাল তথা রাজাকার-আলবদর-আলশামস এবং ইন্ডিভিজুয়াল যেসব ব্যাক্তি এই গণহত্যা এবং সেসময়ে এই যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন অপরাধের সাথে যুক্ত ছিলো, তাদের বিচার বাংলাদেশ সরকার একটি নিরপেক্ষ ট্রাইবুনাল এর মাধ্যমে অত্যন্ত সুচারু ও সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি মুক্ত রেখে শুরু করেছে। ২০১০ সালের ২৫ শে মার্চ একটি গেজেট নোটিফিকেশানের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে ট্রাইবুনাল এবং ২৬ শে জুলাই ২০১০ সালে শুরু ট্রাইবুনালের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এই ট্রাইবুনাল যেই আইনে পরিচালিত হবে, সেই আইনের নাম হচ্ছে- আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন-১৯৭৩। গত ২৫ শে মার্চ ২০১৪ সালে এই ট্রাইবুনালের বয়স গিয়ে দাঁড়ালো ৪ বছর। এই চার বছরে ট্রাইবুনাল থেকে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসেব করলে সেটা নিয়ে হয়ত উভয় দিকেই দুটো লিস্ট বানিয়ে ফেলা সম্ভব। এমন হাই ভোল্টেজ একটি বিচার ব্যাবস্থায় সমালোচনা, প্রশংসা, প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তির হিসেব নিকেশ থাকবে তা বলা বাহুল্য মাত্র। ইনফ্যাক্ট আমি আগেই আমার অনেক লেখাতেই বলেছি পৃথিবীর এই জাতীয় কোনো ট্রাইবুনালই আসলে কোনো ধরনের সমালোচনার বাইরে ছিলোনা কখনোই। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে চলমান এই ট্রাইবুনাল যেভাবে চলছে কিংবা এর ভেতরকার যে ভয়াবহ অবস্থা, সেটি অত্যন্ত শংকার, অত্যন্ত দুঃশ্চিন্তার।


এখন কেন বলছি এসবঃ

প্রশ্ন আসতেই পারে যে পূর্বে যে আস্থাহীনতার কথা স্বরণ করে কখনোই এই ট্রাইবুনাল নিয়ে হতাশার কথা বলিনি, নেতিবাচক বক্তব্য দেইনি তবে আজ কেন তেমন বক্তব্য দিচ্ছি বা এভাবে লিখছি। আসলে আজকের এ লেখা যে আমার লিখতে খুব ভালো লাগছে বা আমি এই লেখায় অত্যন্ত পুলকিত বোধ করছি, তা নয়। আমি এই মুহুর্তে আসলে মনে করছি আমাদের ট্রাইবুনালের অনেক ব্যাপার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের একটা স্বচ্ছ ধারনা থাকা খুব বেশী প্রয়োজন। আর এভাবে ভেতরে ভেতরে ঘুনে দ্ধরে পঁচে যেতে থাকা একটি অংশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে আশার প্রলেপ দিয়ে যেতে থাকা আসলে এক ধরনের অপরাধ। যদিও আগে আমি নিজেই নানান ধরনের ডিস্ক্রিপেন্সি দেখে নিজের মনে বিশ্বাস করতাম যে এগুলো সাময়িক। এসব ব্যাপার নিয়ে বলবার কিছু নেই। কিন্তু সেসব এড়িয়ে যাওয়া বিষয়াদি যখন ধীরে ধীরে ঘা থেকে গ্যাংরিনের পর্যায়ে পৌঁছে যেতে শুরু করেছে তখন আসলে এসব নিয়ে উচ্চকিত হওয়াটা খুব জরুরী বলেই মনে করছি আমি। এতে যদি সধারণ মানুষ সত্যটা জানতে পারে এবং এই কাতার থেকেই সরকারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করতে পারে তবে সেটিই হবে এই মুহূর্তে সবচাইতে বড় বেশী কার্যকর। 


হতাশার নানান মাত্রা ও কারন 

[ক] আইনমন্ত্রী আনিসুল হকঃ

আপনারা হয়ত সবাই জানেন যে এই ট্রাইবুনালটির মূলত যখন শুরু হয় তখন বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। যদিও আমি বলব না যে শফিক আহমেদের পরিচালনায় এই ট্রাইবুনাল অভূতপূর্ব কার্য সমাধা করেছে তথাপিও তিনি যতটুকু করেছেন সেটি এখনকার সাথে তুলনা করলে অনেক বেশী। ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এই পুরো প্রক্রিয়ার সাথে কিংবা এই বিচারের দাবীর সাথে আজকে থেকে নয়, বরং বলা যেতে পারে কয়েক দশক ধরে অবিচ্ছিন্ন ভাবে জড়িত। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যখন একাত্তরের ঘাতক গোলাম আজমের বিচার চেয়ে সারা দেশের সাধারণ জনতাকে একই কাতারে এনে একতাবদ্ধ ভাবে গণ আদালত বানিয়ে বিচার করবার যুদ্ধ করছিলেন সেসময়ে যেই ১০১ জন নিয়ে ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে গণ তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিলো সেই সদস্যদের ভেতর ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ছিলেন একজন সৈনিক। এটি ছাড়াও সেসময়কার রাজাকার বিরোধী আন্দলোন, ঘাতক গোলাম আজমের নাগরিকত্ব বাতিলের আন্দলোন সহ মুক্তিযুদ্ধের সকল আন্দলোনেই ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ছিলেন একজন প্রধানতম সৈনিক। সুতরাং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে তিনি জড়িয়ে আছেন, আইনমন্ত্রী হিসেবে ভূমিকা রাখছেন এসব বিষয়গুলো আমাদের বেশ আশান্বিত করেছিলো।


বিচার শুরু হবার প্রাক্কালে যে ব্যাক্তিটির ভূমিকা আমাদের আশ্চার্যান্বিত করেছিলো সেই ব্যাক্তিটি আইনজীবি আনিসুল হক। বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত আইনবিদ হিসেবেই যিনি সুপরিচিত। কেবল আইনজীবি নন বরং তাঁকে নিঃসন্দেহে একজন স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ হিসেবেই বলা যায়। আনিসুল হকের পিতা সর্বজন শ্রদ্ধেয় এডভোকেট সিরাজুল হক ছিলেন বাংলাদেশের প্রবাদ প্রতিম একজন আইনজীবি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাদী পক্ষের কৌঁসুলী যদিও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে আনিসুল হক এ মামলার দেখাশোনা করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে এডভোকেট আনিসুল হক এই ট্রাইবুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বরাবর বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এই কথার সমর্থনে বলা যায় যে, ২০১২ সালে জামাতে ইসলামী এই ট্রাইবুনাল নিয়ে অনলাইনে একটি প্রোপাগান্ডামূলক ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে। সেই ডকুমেন্টারিতে দেখা যায় আনিসুল হক এই ট্রাইবুনালে আসামীদের গ্রেফতার করবার প্রক্রিয়া নিয়ে তার ক্ষোভের কথা বলছেন এবং এও বলছেন যে এই গ্রেফতার সঠিক হয়নি। একজন স্বাধীনতার পক্ষের আইনজীবি যখন স্বাধীনতার বিপক্ষের একটি প্রোপাগান্ডামূলক ও উষ্কানিমূলক ডকুমেন্টারিতে বক্তব্য দেন তখন সেটা নৈতিক ভাবে মেনে নেয়া কষ্টের। সেটির উপর তিনি আবার বক্তব্যের পাশা পাশি এই ট্রাইবুনাল নিয়ে যে সমালোচনা করেছেন সেটি আইনগত ভাবে ভুল।


এর মধ্যে আইনী জগতে একটি গুজব ভেসে বেড়াতে থাকে যে এডভোকেট আনিসুল হক এই ট্রাইবুনালের প্রধান প্রসিকিউটর হতে চেয়েছিলেন এবং সেটি হতে না পেরেই তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হন। যদিও আনিসুল হক এই গুজবের বিপক্ষে বলেন যে তিনি এই ট্রাইবুনালের সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত হতে চান নি কেননা তাঁর মা এই ট্রাইবুনালের সাথে সম্পৃক্ত হতে নিষেধ করেছিলেন। একজন প্রতিথযশা আইনজীবি এমন মাতৃভক্ত কিংবা প্রফেশনাল জগতে মা’র কথাকে বেদবাক্য মনে করে সামনে চলেন ব্যাপারটি অত্যন্ত ইউনিক বলেই আমার মনে হয়েছে এবং এই ব্যাপারে আসলে কোনো ধরনের মন্তব্য করা থেকেও বিরত রইলাম। কিন্তু মুশকিল হয়েছে আসলে বর্তমান প্রেক্ষিতে। যেই ট্রাইবুনালের ব্যাপারে সম্পৃক্ত হতে আনিসুল সাহেবের মা’র এই নিষেধাজ্ঞা সেই ট্রাইবুনালের ব্যাপারে তিনি একজন কনসার্ণ্ড মন্ত্রী, এই ব্যাপারটি এখন আনিসুল সাহেব কিভাবে দেখেন এটি অবশ্যই কৌতূহলের।


আমার উপরের লেখাগুলোর সংক্ষিপ্ত সারমর্ম করলে যে ব্যাপারটি দাঁড়ায় সেটি হচ্ছে আনিসুল হক নিজেই এই বিচারের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করে এখন নিজেই এই ট্রাইবুনাল দেখভাল করছেন। শুধু এই ব্যাপারটিতেই যদি আমি ফোকাস করি তবে এটাই আসলে আনিসুল হকের ব্যাপারে অনাস্থা জানাবার একটা তীব্র কারন হতে পারে।


[খ] বিচারের গতি, শামুক তুমি আরো ধীরে চলোঃ






কাদের মোল্লার ফাঁসি আর ৫-ই জানুয়ারীতে নির্বাচন শেষে আওয়ামীলীগের মাধ্যমে গঠিত সরকার এ দুইটির মধ্যে কোথায় যেন একটা যোগসূত্র রয়েছে। এই বছরের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে। সবখানেই একটা প্রচন্ড গা ছাড়া ভাব। সেই গা ছাড়া ভাবের একটা উদাহরন দেয়া যেতে পারে নিজামীর মামলার দিকে তাকালেই। নিজামীর মামলার সকল যুক্তি-তর্ক সম্পন্ন শেষে রায় দেয়া হবে এই মর্মে অপেক্ষমান রাখা হয় গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে। সেই অপেক্ষমান বিচার আজ পর্যন্ত অপেক্ষমান-ই রয়ে গেছে। ভয়াবহ ব্যাপারটি ছিলো ট্রাইবুনাল-১ প্রায় কয়েকমাস ছিলো চেয়ারম্যান বিহীন কেননা গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩ তে প্রথম ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির অবসরে যান। সুতরাং ট্রাইবুনাল নিজামীর মামলাসহ অনেক মামলা-ই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি বিচারপতি সংকটে। শেষ পর্যন্ত ৫৩ দিন এই চেয়ারম্যানের পদ শুন্য থাকবার পর সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এনায়েতুর রহিমকে ট্রাইবুনাল-১ এর বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এখন প্রশ্ন গিয়ে দাঁড়ায় এই ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া কি সরকারের পক্ষে এতই কঠিন ছিলো যে যার জন্য ৫৩ টি দিন খামাখাই অপেক্ষা করতে হোলো। তাও এই নিয়োগ হয়েছে ক্রমাগতভাবে পত্র-পত্রিকায় এই বিষয়ে লেখালেখি, সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সাধারন জনতার প্রচন্ড চাপের কারনে। সেটি না হলে হয়ত আজও ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে গড়িমসি করতেই থাকত সরকার। এই ট্রাইবুনালের ধীরগতি নিয়ে কালের কন্ঠে গত বছর একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। আহমেদ দীপু ও আশরাফুল আলমের সেই রিপোর্টের যে অংশগুলো আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেগুলো আমি পাঠকদের জন্য হুবুহু তুলে দিচ্ছি-




বিচারপ্রক্রিয়ার এই ধীরগতির জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অনেকটা দায়ী বলে অভিযোগ উঠেছে। তদন্তে গাফিলতি, আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র যথাযথ না হওয়া, নির্ধারিত সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারা, মামলার সাক্ষী হাজির করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মতো ঘটনাগুলোর কারণেই এসব অভিযোগ উঠছে। আর ওই সব ঘটনার কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা পর্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। জানা গেছে, একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনাল প্রথমে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়, সেগুলো সুবিন্যস্ত ও শ্রেণীভুক্ত ছিল না, ছিল অগোছাল। একটি ঘটনার সঙ্গে অন্য ঘটনা মিলিয়ে ফেলা হয়েছিল। তারিখ ঠিক ছিল না। তাই সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ উল্লেখ করে নতুনভাবে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন আদালত।


আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগপত্রেও একই ধরনের সমস্যা ছিল। সেগুলোও সংশোধনের জন্য ট্রাইব্যুনাল ফেরত পাঠিয়েছে। আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগপত্রে নিহতদের নামের তালিকা দেওয়া হয়নি। সাক্ষীর নামও দেওয়া হয়নি। একটি হত্যাকাণ্ডে কাদের মোল্লার উপস্থিতির কথা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হলেও তদন্ত প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন কি না। আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিলের দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল গত ১২ জানুয়ারি। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ সেদিন তা জমা দিতে পারেনি। পরে ১৫ জানুয়ারি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ছয়বার সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমবার গত বছরের ২০ নভেম্বর। এর পর থেকে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি, ১৮ জানুয়ারি, ২৪ জানুয়ারি, ৭ ফেব্রুয়ারি ও ১৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে ৭ ফেব্রুয়ারি সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হলে এদিন ট্রাইব্যুনাল তদন্ত কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা করেন। মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, তার মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ তোলা হয়নি। এমনকি এই অপরাধের জন্য তাঁকে সরাসরি অভিযুক্তও করা হয়নি। নিজামীকে বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি অভিযুক্ত না করায় ট্রাইব্যুনাল বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।


ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপক্ষ বারবার সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার থমকে আছে। জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানিও পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। গোলাম আযম, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে উত্থাপন করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগেও ভুলত্রুটি থাকায় ফেরত দিতে হয়েছে ট্রাইব্যুনালকে। এসব কারণে তদন্ত শেষ করার পরও দীর্ঘদিন ধরে চিহ্নিত এসব আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন সম্পন্ন হয়নি। এই বিচারকাজ চলাকালে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের ভূমিকায় ট্রাইব্যুনালকে বারবার অসন্তুষ্ট হতে দেখা গেছে। এমনকি মামলার সঠিক তদন্ত হচ্ছে না বলেও বিচারকদের বলতে শোনা গেছে।


একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, বিলম্বের জন্য গাফিলতির চেয়ে অনভিজ্ঞতাই প্রধান কারণ। সংশ্লিষ্টদের অনভিজ্ঞতার কারণেই বিচারকাজ চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তাই সময় নষ্ট হচ্ছে। এতে লাভবান হচ্ছে অপরাধীরা। তিনি আরো বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা বা প্রসিকিউশনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের গাফিলতি বা অনভিজ্ঞতার চেয়ে আবার সরকারের নীতিনির্ধারকদের সীমাবদ্ধতা দায়ী অনেক বেশি। অপরাধীদের বিচারে সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু এই বিচার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, সে সম্পর্কে সরকারের ধারণা স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এটা। তাই এটা একটা বিশাল যজ্ঞ বলা যায়। এ জন্য গবেষণা প্রয়োজন। আমরা প্রথম থেকেই গবেষণার বিষয়ে বলে আসছি, কিন্তু সরকার সেদিকে নজর দিচ্ছে না। এর পরিণতি এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। সাত-আটজন অপরাধীর বিচার করার জন্য কমপক্ষে ২৫ জন আইনজীবী প্রয়োজন। সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৩ জন। তাঁদের সবাই আবার অফিস করেন না। এর পাশাপাশি আইনজীবীদের নিরাপত্তা নেই, সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না। সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য নিরাপত্তা আইন করার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা তৈরি করা হয়নি, যে কারণে সাক্ষীরা ভয় পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারকে সংশ্লিষ্ট সবার ষোল আনা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।’



উপরের এইসব ঘটনাগুলোকে আসলে এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা নিজে মনে মনে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে আশান্বিত হবার কিছু নেই। অত্যন্ত অপ্রতুল আইনজীবি যাদের মধ্যে অনেকেই এই ধরনের বিচার চালিয়ে নিতে অদক্ষ, অপ্রতুল তদন্ত দলের সদস্য, যথাযথ লজিস্টিক, নিরাপত্তা, সুযোগ সুবিধার অভাব, সরকারের সমন্বয়হীনতা, সরকারের গা-ছাড়া মোনোভাব এসব সব কিছুই এখন এই পুরো বিচার প্রক্রিয়াকে শামুকের চেয়েও ধীর গতির করে ফেলেছে। প্রথমত যেই ব্যাক্তি এই ট্রাইবুনালের বিপক্ষে গিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে বেড়িয়েছেন সেই ব্যাক্তিকেই দেয়া হয়েছে আইনমন্ত্রীর পদ, আবার সেই ব্যাক্তিই ট্রাইবুনালের পেছনে প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এর পরে এই বিষয়ে আর কিছু বলার থাকেনা হয়ত।


[গ] ট্রাইবুনালের আইনজীবি, প্রধান প্রসিকিউটর, ভিন্ন দলে গোত্রীভুক্ত আর সেই পুরোনো নোংরা রাজনীতিঃ

এই ট্রাইবুনাল শুরুর প্রাক্কালে ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন যথাক্রমে এডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু(প্রধান প্রসিকিউটর), রানা দাশ গুপ্ত, সৈয়দ রেজাউর রহমান, সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, মোহাম্মদ আলী, মুখলেসুর রাহমান বাদল, আবদুর রহমান হাওলাদার, আলতাফ উদ্দিন আহমেদ, এ কে এম সাইফুল ইসলাম, শাহিদুর রহমান, মোহাম্মদ সুলতান আহমেদ, নুরজাহান মুক্তা, ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী প্রমুখ। যদিও পরবর্তীতে এই আইনজীবিদের মধ্যে অনেকেই সংরক্ষিত মহিলা আসনে এম পি হন বা অন্য কোনোভাবে এই ট্রাইবুনালের সাথে আর সম্পৃক্ত থাকেননি, সুতরাং অনেক নতুন আইনজীবিরা এই প্রসিকিউটর প্যানেলে যুক্ত হন।


মজার ব্যাপার হচ্ছে এই আইনজীবি নিয়োগেও নানাবিধ দলীয়, সাংগঠনিক অদৃশ্য কোটা বলবৎ ছিলো, সুপারিশ ছিলো রিগার্ডলেস আইনজীবি হিসেবে কে কতটা দক্ষ। দক্ষতার প্রশ্নের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিলো কোন প্রসিকিউটর কোন মন্ত্রীর কতটা নিকটের কিংবা কোন সংগঠনের সাথে সরকারের আইনমন্ত্রীর কতটা যোগাযোগ রয়েছে। যদিও কিছু কিছু নিয়োগ সত্যকার অর্থেই ট্রাইবুনালকে কয়েক ধাপ সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে সন্দেহ ছাড়া। যেমন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ কিংবা তাপস কে বাউলের নিয়োগ। আমার জানা মতে এই দুইজন ব্যাক্তি আন্তর্জাতিক অপরাধের আইন বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ ব্যাক্তি এবং এই ট্রাইবুনালের শুরু থেকেই তাঁদের থাকাটাই বরং প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু সেসব না হয়ে শোনা গিয়েছিলো আইনজীবি নিয়োগে অদৃশ্য কোটা সিস্টেমের কথা। যেমন আমরা শুনেছিলাম আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম কোটা, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাহারা খাতুন কোটা, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের নিজস্ব বিবেচনার আইনজীবিরা। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল কিংবা সাহারা খাতুনের কোটায় আশা আইনজীবিরা বরাবরই ছিলেন অদক্ষ। কয়েকটি সুত্র থেকে এও জানা যায় যে এই ট্রাইবুনালের দু’এক জন আইনজীবি ট্রাইবুনালের মামলা লড়তে থাকা অবস্থাতেই প্রাডো জীপ কিনেছেন, ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন।


এইসব অভিযোগের মাত্রা এই পর্যন্ত থাকলে হোতোই। কিন্তু ক্রমাগত ভাবে এইসব কোটায় আশা আইনজীবিরা এই প্রসিকিউশনে থাকা সত্যকার অর্থে দক্ষ আইনজীবিদের ক্রমাগতভাবে গ্রাম্য রাজনীতির নোংরা চালে কর্নারড করে দিতে থাকে। জেয়াদ আল মালুম, গোলাম আরিফ টিপু, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, এডভোকেট তারেকসহ অনেক আইনজীবিকেই আসলে এইসব রাজনীতির স্বীকার হতে হয়েছে এবং যার ফলশ্রুতি অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের দক্ষতা নানান ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অদক্ষ আইনজীবিদের পাল্লায় পড়ে এক্টি গুরুত্বপূর্ন মামলার কি ভয়াবহ দশা হতে পারে সেটি এক সাঈদীর মামলার দিকে তাকালেই বিজ্ঞ ব্যাক্তিরা হয়ত অনুমান করতে পারবেন। এর বেশী কিছু এই মুহুর্তে আমি আর বলতে চাইনা।


প্রসিকিউটরদের নিজের মধ্যে এমন ক্রমাগত যুদ্ধাংদেহী অবস্থায় শেষ পর্যন্ত হায়দার আলীর মত আইনজীবি প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পেলেন এর থেকে দুঃখের আর কি হতে পারে? গোলাম আরিফ টিপুর মত এমন দক্ষ আইনজীবিকে আজকে সিঙ্গাপুর যেতে হবে চিকিৎসার জন্য এমন রাজনীতির মধ্যে পড়ে যেতে হয়। এই বিষয়ে দৈনিক সমকাল একটি রিপোর্ট প্রকাশ ওয়াকিল আহমেদ হিরনের লেখা যা সকল পাঠক/পাঠিকাদের জন্য নীচে তুলে দিচ্ছি-




[ঘ] কিছু আইনজীবির অদক্ষতাঃ আমরা বিষ্ময়ে তাকিয়ে রইঃ

এই আমিই ট্রাইবুনালের আইনজীবিদের পক্ষে আজ থেকে দেড় বছর আগেই দৈনিক কালের কন্ঠে লিখেছিলাম স্তুতি। আজ আমাকেই এই ট্রাইবুনালের কিছু প্রসিকিউটরদের দক্ষতা নিয়েই লিখতে হচ্ছে। এটা আমার জন্য অত্যন্ত বেদনা দায়ক। এটা সত্য যে ট্রাইবুনালের অনেক আইনজীবিই এই ট্রাইবুনালের বিভিন্ন মামলাতে অত্যন্ত দক্ষতা দেখিয়েছেন, আইনী যুদ্ধে তারা জয়ে হয়েই ফিরেছেন। কিন্তু ওই যে বলেছি নানান কোটায় আসা আইনজীবিদের সমারোহও হয়েছে এই ট্রাইবুনালে, তাদের অনেকেই এমন খেল দেখিয়েছেন এই ট্রাইবুনালের ক্ষেত্রে যে বিষ্মিত না হয়েই আর পারাই যায়নি। প্রথম আলোর একটা রিপোর্ট থেকেই-


একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ পর পর দুই দিন রাষ্ট্রপক্ষ (প্রসিকিউশন) ‘অনভিপ্রেত’ ঘটনার জন্ম দিল। গত বুধবার রাষ্ট্রপক্ষের এক কৌঁসুলির ‘অস্বাভাবিক’ আরজিতে বিস্মিত হয়েছিলেন তাঁর সহকর্মীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো কৌঁসুলি উপস্থিতই ছিলেন না। গতকাল বেলা পৌনে ১১টায় ট্রাইব্যুনাল-১-এর কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যতালিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের বিষয়ে শুনানি। এইচআরডব্লিউর পক্ষে আইনজীবী আনিসুল হাসান, আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এজলাসে উপস্থিত। কিন্তু ছিলেন না রাষ্ট্রপক্ষের কোনো কৌঁসুলি। এ অবস্থায় আইনজীবী আনিসুল হাসান আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করার আবেদন জানান। ট্রাইব্যুনাল ৬ মার্চ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল মুলতবি আবেদনের একটি অনুলিপি রাষ্ট্রপক্ষকে সরবরাহের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেয়াদ-আল-মালুম দাবি করেন, ‘এইচআরডব্লিউর শুনানির এই তারিখ পূর্বনির্ধারিত নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আর যেহেতু এটা ছিল আদালত অবমাননার অভিযোগে বিবাদীপক্ষের জবাব দেওয়ার বিষয়। নিয়মিত মামলার বিচারের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেনি, তাই এটা কোনো সমস্যা নয়।’ তবে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কার্যালয় সূত্র জানায়, শুনানির তারিখ পূর্বনির্ধারিত ছিল। তাৎক্ষণিকভাবে কখনো দিনের কার্যতালিকা তৈরি হয় না। এর আগে বুধবার সকালে নবনিযুক্ত বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে প্রথম দিনের মতো ট্রাইব্যুনাল-১-এর কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যতালিকায় ছিল জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মামলা। গত ১৩ নভেম্বর এই মামলাটির কার্যক্রম শেষ হয়। মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ [সিএভি- case awaiting verdict (CAV)] ছিল।


রায়ের জন্য দিন ধার্য করতে রাষ্ট্রপক্ষের স্বাভাবিক আরজির বদলে কৌঁসুলি মোহাম্মদ আলী মামলাটিতে নতুন করে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য তারিখ নির্ধারণের আরজি জানান। এতে এজলাসে উপস্থিত রাষ্ট্রপক্ষের অন্য কয়েকজন কৌঁসুলি বিস্ময় প্রকাশ করেন। এক কৌঁসুলি তাঁর এক সহকর্মীকে ফিসফিস করে বলেন, এটা কী হচ্ছে? তিনি তো আসামিপক্ষের আইনজীবীর মতো কাজ করছেন! যেহেতু রাষ্ট্রপক্ষই নতুন করে যুক্তি উপস্থাপনের আরজি জানিয়েছে, ফলে আসামিপক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলামকে আর কিছুই করতে হয়নি। তিনি শুধু বলেন, যুক্তি উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুতি নিতে তাঁদের এক সপ্তাহ সময় প্রয়োজন। ট্রাইব্যুনাল নতুন করে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য ১০ মার্চ দিন ধার্য করেন। এ ঘটনার পর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাষ্ট্রপক্ষের একাধিক কৌঁসুলি প্রথম আলোকে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির যে বিধান রয়েছে, মোহাম্মদ আলীর আরজি সেই বিধানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। এটা অনভিপ্রেতও। ক্ষুব্ধ এক কৌঁসুলি বলেন, ‘মোহাম্মদ আলী রাষ্ট্রপক্ষের, না আসামিপক্ষের আইনজীবী, তা বোঝা গেল না।’


মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সেদিন বলতে চেয়েছি, ট্রাইব্যুনাল আইনে পুনঃশুনানির কোনো বিধান নেই। কিন্তু যেহেতু ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদে বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম সদ্য যোগদান করেছেন এবং তিনি এই মামলার সমাপনী যুক্তিতর্ক শোনেননি, এ জন্য তিনি চাইলে আবার যুক্তি শুনতে পারেন। আমি এসব কথা ইংরেজিতে বলেছি বলে হয়তো কেউ বোঝেনি, নয়তো বুঝেও আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ইচ্ছা করে ভুল ব্যাখ্যা করছে।’



[ছবি সূত্রঃ ই-প্রথম আলো]

এই ঘটনা ছাড়াও, এর আগে আদালতে গোলাম আজম, নিজামী, মুজাহিদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগপত্র সঠিক ভাবে না লেখা, সাক্ষী সঠিক সময়ে হাজির করতে না পারা, অভিযোগ দাখিলের ক্ষেত্রে চরম উদাসীনতা ইত্যাদি। এই বিষয়ে বর্তমান একজন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ তাঁর নিয়োগের আগে বলেছিলেন-


বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের কৌশলগত অদক্ষতার মূল কারণটি হল, কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি হিসেবে আনা হয়েছে (Individual Criminal Responsibility)। এটি আনা হয়েছে ১৯৭৩ সালের আইনের ৪ (১) ধারা অনুযায়ী (সংক্ষিপ্ত রায়ের ৯০, ১০৫ এবং ১০৬ অনুচ্ছেদসমূহ দ্রষ্টব্য)।আমার মতে, কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা নিরুপণের ক্ষেত্রে যে বিষয় বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে তা হল নেতা হিসেবে কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা (Superior Responsibility)। কাদের মোল্লা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল ইউনিটের ‘ইসলামী ছাত্র সংঘের’ তৎকালীন সভাপতি (সংক্ষিপ্ত রায়ের অনুচ্ছেদ ১২ দ্রষ্টব্য)। ‘ইসলামী ছাত্র সংঘের’ একটি ইউনিটের নেতা, যার অধীনে বা নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে ‘ইসলামী ছাত্র সংঘের’ নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়িত হত। ইউনিটের অধীনস্তরা তার নির্দেশ মানতে বাধ্য ছিল, কেননা একটি অর্গানাইজড বা সংগঠিত সংঘের সদস্য বা অধীনস্তরা তাদের নেতার নির্দেশ, উপদেশ ও অবস্থান সমর্থন করবে এটাই তো স্বাভাবিক।… অতএব, ১৯৭৩ সালের আইনের ৪(২) ধারা অনুযায়ী কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি হিসেবেই নয়, বরং একটি সংগঠিত বা অর্গানাইজড ইউনিটের নেতা হিসেবেও আনা উচিত ছিল।


সংঘটিত অপরাধসমূহের দায়বদ্ধতা যদি একজন ব্যক্তি হিসেবে তার কম হয়েও থাকে, ইউনিট প্রধান হিসেবে তার অপরাধের দায়বদ্ধতা ছিল অনেক বেশি। তবে বিজ্ঞ প্রসিকিউশন কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র ১৯৭৩ সালের আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী এনেছে। বিজ্ঞ প্রসিকিউশন ৪(২) ধারা অনুযায়ী কাদের মোল্লার উপর অপরাধের দায়বদ্ধতা অর্পণে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে অপরাধের দায়বদ্ধতা ১৯৭৩ সালের আইনে ৪(১) এবং ৪(২) ধারা অনুযায়ী যুগপৎ আনা সম্ভব; এক্ষেত্রে আইনি কোন নিষেধাজ্ঞা নাই।


এ মুহূর্তে প্রসিকিউশনের উচিত শুধুমাত্র আপিলের রায় অথবা আইন সংশোধনের অপেক্ষায় না থেকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে নতুন চার্জ এনে আরও এক বা একাধিক মামলা দায়ের করা। সে ১৯৭১ সালে ‘কসাই মোল্লা’ নামে পরিচিত ছিল। তার কৃত অপরাধের সংখ্যা অগণিত। বর্তমান মামলাটিতে বিজ্ঞ প্রসিকিউশন তার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র ৬টি চার্জ এনেছে। এত কম চার্জ আনার পেছনে সম্ভাব্য কারণগুলো ছিল তদন্তের অপ্রতুলতা; ভয়ভীতির কারণে ভিকটিম, প্রত্যক্ষদর্শী অথবা সাক্ষীদের অসহযোগিতা; তদন্ত এবং প্রসিকিউশন টিমের মাঝে সমন্বয়হীনতা; আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সম্পর্কে প্রসিকিউশন টিমের জ্ঞানের অগভীরতা ইত্যাদি।


[ঙ] তদন্ত দলের অদক্ষতাঃ

উপরের লেখাগুলো যদি আপনারা পড়ে আসেন তাহলে এরই মধ্যে হয়ত দেখেছেন যে মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে তদন্ত দলের নানান ভূমিকা বিভিন্ন মামলায় কতটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি মামলা মূলত শুরু করবার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তদন্ত দলের দক্ষতার প্রশ্ন বিশেষভাবে জড়িত। এই তদন্ত দলকে আজ পর্যন্ত এই ধরনের হাই ভোল্টেজ ট্রাইবুনালে কিংবা আইনী কাঠামোর আওতায় কিভাবে তদন্ত করতে হবে এই জাতীয় প্রশিক্ষণ সরকার থেকে দেয়া হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। ইনফ্যাক্ট দেয়া হয়নি, এটাই চরম সত্য। সরকার তাদের এক বছরের কার্যক্রম প্রচার করতে গিয়ে ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের দৈনিক ডেইলী টাইমসে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে দেশের জনগনের ট্যাক্সের ক্ষাতে দেয়া কয়েক কোটি টাকা খরচ করে অথচ এই সরকার এই ট্রাইবুনালের জন্য দক্ষ আইনজীবি নিয়োগ দিতে পারেনা, তাদের সাধারণ একটি কম্পিউটারও দিতে পারেনা, নিরাপত্তা দিতে পারেনা, তদন্ত দলের প্রশিক্ষন দিতে পারেনা। অথচ আমরা জানি এই ট্রাইবুনালকে কেন্দ্র করে সরকার প্রতি বছর বাজেট করে থাকে। প্রশ আসে, বাজেটের টাকা কোথায় যায়?

তদন্ত দলের অদক্ষতার কারনে অনেকগুলো মামলাকে পুরোপুরি গুবলেট করে ফেলা হয়েছে। তদন্ত দলের মধ্যে যেহেতু প্রসিকিউশনের আইনজীবিদেরও এক্সেস থাকে সুতরাং দায়-দায়িত্ব কোর তদন্ত দল ছাপিয়ে ট্রাইবুনালের প্রসিকিউশনকেও ছুঁয়ে যায়।

একটি মামলার প্রি ট্রায়াল তদন্ত, সেই ঘটনার পুংখানুংখ ম্যাপ, কে কে সাক্ষী হবেন, সাক্ষী নিরাপত্তা, সাক্ষীকে নিরাপদে রাখা, মামলা কিভাবে সাজানো হবে, মামলা কিভাবে এগুবে এসব সব কিছু মূলত প্রাথমিক পুরোপুরি নির্ভর করে তদন্ত দলের উপর। কিন্তু আমাদের আসলে ভাগ্য এতই খারাপ যে এই তদন্ত দলের ব্যাক্তিদের নিয়োগ দিতে গিয়েও সরকার গোলমাল পাকিয়ে ফেলে। প্রাথমিক ভাবে যখন এই ট্রাইবুনালের তদন্ত দল গঠিত করা হয়েছিলো তখন আব্দুল মতিন নামে এক ব্যাক্তিকে প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয় যেই ব্যাক্তি কিনা স্বাধীনতার পূর্বে ইসলামী ছাত্র সংঘ থেকেই নির্বাচন করেছিলেন বরিশাল বি এম কলেজ থেকে, এমনই অভিযোগ ছিলো তার বিরুদ্ধে। অথচ সরকার বেছে বেছে এত কোটি কোটি লোকের মধ্য থেকে এই ব্যাক্তিকেই ট্রাইবুনালের তদন্ত দলে তাকেই নিয়োগ দেয়। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে- মতিন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নির্বাচন করেছেন ইসলামী ছাত্রসংঘের ভিপি পদে। রাজনৈতিক ব্যক্তি, গণমাধ্যমের কর্মী এবং ওই সময়ে ছাত্রসংঘের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

তবে আবদুল মতিন বরাবরই বলেছেন তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা গতকাল আবারও অস্বীকার করে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, তার বাবা ও ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাড়িতে আশ্রয় নিত। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, বরিশাল বিএম কলেজে ওই সময় তিনটি ছাত্র সংগঠন ছিল। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং ক্ষুদ্রাকারে ইসলামী ছাত্রসংঘ। ওই সময় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র নির্বাচনের কোন সুযোগ ছিল না। কারণ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করত না। মতিন সম্পর্কে বলেন, ১৯৬৩ সালে বরিশাল বিএম কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তাকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে ছাত্র সংঘ থেকেই নির্বাচন করেছেন।

ওই সময়ের বরিশাল ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মানবেন্দ্র বটব্যাল জানান, ওই সময়ে কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতেন না। ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়াও ছোটদল হিসেবে ইসলামী ছাত্রসংঘের অস্তিত্ব ছিল। ১৯৬৫-১৯৬৬ সালে বরিশালের বিএম কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রার্থী শাহাদত হোসেন জানান, ওই সময়ে ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া তৃতীয় দল হিসেবে ইসলামী ছাত্রসংঘই সক্রিয় ছিল। আবদুল মতিন ছাত্রলীগ বা ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নির্বাচন করেননি। অন্য কোন দল থেকে নির্বাচন করলে তাকে ছাত্রসংঘ থেকেই নির্বাচন করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমি তখন থেকেই মতিনকে চিনতাম।

বিএম কলেজের ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি এবং কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আলতাফ হোসেন ভুলু জানান, মতিন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার পিতা আইনুদ্দিন হাওলাদার জোতদার ছিলেন। বরিশাল নগরীর কাউনিয়া জেলেবাড়ির পুলের নিকটে তাদের বাড়ি রয়েছে। আইনুদ্দিন হাওলাদারের দুই স্ত্রীর প্রথম স্ত্রীর সন্তান আবদুল মতিন। বেশ কয়েক বছর আগে বরিশালের প্যারোডা রোডে সন্ধ্যার পর তরুণ আইনজীবী বাদশাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে তার আত্মীয়স্বজনরা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ ছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন গ্রেফতারও হয়। তবে সাবেক জজ হিসেবে তার প্রভাবে মুক্ত হয় তার আত্মীয়স্বজন।

এত অভিযোগের পরেও এই আব্দুল মতিনের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। এই ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানা যাবে এখানে-

এই হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের অবস্থা। প্রতিটি সেক্টরে অব্যাবস্থাপনা, দূর্নীতি, বাংলাদেশের চলমান নোংরা রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব এই ট্রাইবুনালে ঢুকিয়ে দিয়ে বার বার এই বিচারের গতিকে স্লথ করেছে, ক্ষতিগ্রস্থ করেছে।

[চ] নিরাপত্তা সংকট, সাক্ষী সংকটঃ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের সার্বিক নিরাপত্তার কথা বল্লে আসলে কেবল হতাশাগ্রস্থ হওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ট্রাইবুনাল-১ এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান জনাব নিজামুল হক নাসিমের সাথে স্কাইপির কনভারসেশন যারা রেকর্ড করে এই বিচারকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছেন, যারা এইসব অপকর্ম করেছেন তাদের বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। বিচারপতিদের নিরাপত্তা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কাদের মোল্লার রায়ের সময় আমরা দেখেছি বিচারপতি সিনহার বাড়ীতে আক্রমণ করা হয়েছে, এর আগে বিচারপতিদের কম্পিউটার থেকে রায় নিয়ে রায়ের আগে প্রকাশ করা হয়েছে, প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের বাড়িতে হামলা হয়েছে অথচ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো যথাযথ উদ্যোগ আমরা লক্ষ্য করিনি। সাক্ষী দেবার কারনে খুন হয়েছেন সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী মোস্তফা হাওলাদার, সাকার বিরুদ্ধে সাক্ষী ওয়াহিদুল হক জুনু, গোলাম আজমের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়া আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাই মেরাজ। সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়া আরেক সাক্ষী আব্দুল হালিম বাবুলের বাড়ীতে হামলা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা এসব ব্যাপারে যথাযথ আইনী পদক্ষেপ কিংবা সরকারী কড়া পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। এভাবে যদি পুরো ট্রাইবুনাল কিংবা সাক্ষীদের হামলা বা খুনের স্বীকার হতে হয় তবে কে আসবে এই ট্রাইবুনালে সাক্ষী দিতে? বিচার তো এভাবেই ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে।






[ছবি সূত্রঃ ই-প্রথম আলো]


২০১১ সালে সাক্ষী সুরক্ষা আইন বানিয়েও কতটা লাভ হয়েছে আমার ব্যাক্তিগত ভাবে জানা নেই। বরং সাঈদীর বিরুদ্ধের সাক্ষী খুন হয়ে যাবার পরেও পুরো ব্যাপারটাকে একটা স্বাভাবিক কর্মকান্ড হিসেবেই যেন নিয়েছে প্রশাসন। নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ। সাঈদীর বিরুদ্ধে আসা আরেক সাক্ষী সুখ রঞ্জন বালিকে খুঁজে পাওয়া না যাবার কারনে জিডি করা হলেও সেই সাক্ষীকে পাওয়া গিয়েছিলো সাঈদীর পক্ষের আইনজীবিদের গাড়িতে। এই ব্যাপারেও আমরা ট্রাইবুনালকে বা সরকারে কোনো পদক্ষেপ নিতেই দেখিনি। সাক্ষীর এসব নিরাপত্তা হীনতার কারনে অনেক সাক্ষী ভয়ে সাক্ষ্য দিতে আসেননি, ট্রাইবুনাল থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন দিনের পর দিন। মামলা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, ট্রাইবুনাল চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

শেষ কথাঃ

এটাই খুব সম্ভবত আমার প্রথম লেখা যেই লেখা লিখে আমি নিজেই দুঃখিত এবং বিষাদ গ্রস্থ। আমি কখনো ভাবিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল শুরু হবার ৪ বছর ২৮ দিনের মাথায় আমাকে এই ট্রাইবুনাল নিয়ে এমন হতাশার কথা লিখতে হবে। আওয়ামীলীগের অনেক নেতা কর্মীদের মুখে শুনেছি যে, এই সরকারের আমলে এইসব ঘাতকদের পক্ষে আর কারাগার থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না কিংবা তারা আর আলোর মুখ দেখবেন না। এই ব্যাপারটিতে সামান্য আনন্দিত হলেও আসলে আমি সত্যকার অর্থে পুরোপুরি আনন্দিত নই।

একাত্তরের ঘাতকদের কারাগারের মধ্যে বছরের পর বছর ফেলে রাখাতে হয়ত নিজস্ব ক্রোধের একটা সংস্থান হয় কিন্তু আদতে যেই অপরাধ তারা এই সমগ্র বাঙালী জাতি তথা মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে করেছে তার জন্য স্পেসিফিকালী বিচার হওয়াটাই আসলে আমার কাছে মূখ্য মনে হয়। যে অপরাধ করবার পরেও তারা সমাজে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বা পেতে চেয়েছে সেই কুট প্রচেষ্টার পুরো সার্কেলটাই মূলত ভেঙে দিতে হবে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ার-ই অবস্থা যদি এমন দৈন্য দশা হয় কিংবা বিচারের প্রধান দায়িত্বেই যদি থাকেন একজন কন্ট্রোভার্সিয়াল ব্যাক্তি, যদি এই বিচারের ইন্টারন্যাল কক্ষ পথগুলো ব্যাক্তি সংঘাত, অদক্ষতা, নিরাপত্তাহীনতা, উদাসীনতায় এভাবে ভেসে যেতে থাকে তবে স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর এই মহান বিচারের মর্মার্থ আসলে বিলীন হয়ে উঠে।

যদি এই বিচারের মূল উদ্দেশ্য সত্যকার অর্থেই হয়ে উঠে রাজনৈতিক কিংবা ব্যাক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করবার কেন্দ্র তবে এটি সিম্পলী এই দেশের সাধারণ জনতা আর ৭১ সালে ৩০ লক্ষ নিহত আর অগণিত নির্যাতিত মানুষের সাথে বেঈমানী বৈ অন্য কিছু নয়। বিচার হতে যদি সময় লাগে বিচারিক কাঠামোর কারনে, বিচারের কন্টেন্ট কিংবা এর ব্যাপ্তিগত বা বৈশিষ্ঠ্যগত কারনে তবে মনে হয়না এই ব্যাপারে কোনো শিক্ষিত ব্যাক্তি বা এই বিচার বোঝেন এমন ব্যাক্তি অভিযোগ করবেন। তবে বিচারিক প্রক্রিয়া ইচ্ছেকৃত ভাবে শ্লথ করে দিয়ে, এর মধ্যে নানান রকমের জটিলতা ঢুকিয়ে দিয়ে, নানান ধরনের অযোগ্য ব্যাক্তিকে ঢুকিয়ে দিয়ে এই বিচারকে দিনে দিনে ক্ষয়িষ্ণু করবার কারনেই মূলত এই ট্রাইবুনাল নিয়ে এত হতাশা আর এত সমালোচনা হচ্ছে।

একজন ব্যাক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের এমন গতিতে, এমন অবস্থায় আমি চরম ভাবে হতাশ। সামনে যে কোনো আলোর দেখা পাব সেই বিশ্বাসটুকুও বিলীন হয়ে উঠছে ক্রমাগত…

No comments:

Post a Comment