একাত্তরের ঘাতক-রাজাকার পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বঘোষিত রাজা ত্রিদিব রায় ২০০৩ সালে একটি বই প্রকাশ করে। বইয়ের নাম "দি ডিপার্টেড মেলোডি" -[The Departed Melody, Memoirs, PPA Publications]। অনলাইনে অর্ডার করেছিলাম। গতকালই হাতে পেয়ে পড়া শুরু করেছি।
বইয়ের বিভিন্ন অংশ থেকে অল্প-বিস্তর উঁকি-ঝুঁকি দিতেই এক পৃষ্ঠায় দেখা গেলো এই ঘাতক আরেক ভয়ানক ঘাতক ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বেশ প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। তাকে "টাইগার" বলে অভিহিত করছে।
ফজলুল কাদের চৌধুরী কে, তা নিশ্চই সকলেই জানেন। একাত্তরের নৃশংস ঘাতক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা। "রতনে রতনে চিনে, শুয়োর চিনবে ঘেচু"। সুতরাং ত্রিদিব ফকা'র প্রশংসা করবে এতে অবাক হবার কিছু নেই।
আইয়ুবের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দেয়া হয় এবং কৃত্রিম জলবিদ্যুত উতপন্নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরফলে প্রচুর সেখানের প্রচুর ফসলী জমি পানির নীচে তলিয়ে যায়, পাহাড়ের সাধারণ মানুষেরা উদ্বাস্তু হয়ে ওঠেন। চিরকালের জন্য গরীব, দুঃখী পাহাড়ী জনতার দীর্ঘঃশ্বাস লেগে থাকে সেই এলাকায়।
আইয়ুবের এত বড় অন্যায়ের ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে আঈয়ুবের প্রতি, পাকিস্তানের প্রতি একটা ঘৃণা জন্মানোর কথা ছিলো রাজাকার ত্রিদিবের। কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে ত্রিদিব শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী মিলিটারীর পক্ষই অবলম্বন করে। এদিকে আরো লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে এই ঘটনারও আগে ত্রিদিবের বাপ-দাদারা ভারতের সাথে থাকতে চেয়েছিলো ১৯৪৭ এর পার্টিশনের সময়।
দুটো ঘটনা একটি আরেকটার সাথে কন্ট্রাডিক্টরী।
আমি পাহাড় নিয়ে যতই পড়ছি ঠিক ততই স্পস্ট হচ্ছে এই অঞ্চলের কষ্টগুলো। আমি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি পাহাড়ের এই ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর সামন্ত প্রভুরা মনে প্রাণে সব সময় ক্ষমতার আশে পাশে থাকতে চাইতো।
প্রশ্ন জাগে, কেন চাইতো?
চাইবার একটা বড় কারন হচ্ছে এই অঞ্চলের সামন্ত প্রভুরা তাদের বাপ-দাদাদের কাছ থেকে যে তালুক পেয়েছে এটিকে গভীর ভাবে ধরে রাখতে চাইতো। তাদের দাপট, ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক যে নেটোয়ার্ক তারা তৈরী করেছিলো দুঃশাসন আর মানুষের উপর অত্যাচার করে, এটি কোনোভাবে ভেঙ্গে যাক সেটি প্রভুরা কোনোদিনি চায়নি।
রাজাকার ত্রিদিব মনে করেছিলো মুক্তিযুদ্ধে বাঙ্গালীরা বিনাশ হয়ে যাবে ফলে এই বিনাশের পরবর্তী পাকিস্তান ত্রিদিবের জন্য আরো ক্ষমতাময় হবে, আরো বেশী প্রফিটেবল হবে। দরিদ্র পাহাড়ী জনতার উপর চাবুক মারা তথা তাদের চুষে চুষে নিঃশেষ করে দেবার পথ আরো অনেক বেশী সুগম হবে।
পাহাড়ের এই রাজা-গজারা সব সময় চায় পাহাড়ী সাধারন জনতারা ৫০০ বছর পিছিয়ে থাকুক। এরা চায় মধ্যযুগের সকল নিয়ম কানুন নিয়ে এরা আমৃত্যু বেঁচে থাকুক। আজ থেকে ৫০ বছর আগে মানুষ যেখানে চলে গেছে চাঁদে, যেখানে এখন কৃত্রিম মানুষ তৈরী হচ্ছে সেখানে সামন্ত প্রভুরা ঐতিহ্যের কথা বলে, কৃষ্টি ও কালচারের কথা বলে সাধারন পাহাড়ী জনতাকে আটকে রাখছে ক্ষেতের মধ্যে, নালার মধ্যে।
পাহাড়ের এলিট কিংবা তাদের থেকে একটু নিম্ন মাঝারিরা উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যায়। তারা লিঁয়াজো করে সরকারের সাথে, বিভিন্ন এন জি ও'র সাথে। তারা লাভ করে সর্ব শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, তারা পায় সবচাইতে সেরা চিকিৎসা। এরা পায় সকল অনুদান, সাহায্য, এরাই এই অঞ্চলে ক্ষমতার আঁধার হয়ে একটা আবর্ত হয়ে ঘুরছে বহুকাল।
কিন্তু আমার যে মারমা বোনটি মনস্থির করেছে পাহাড়ে জুম চাষ করে কাটিয়ে দেবে তাঁর শৈশব, কৈশোর, কিংবা যে চাকমা ভাইটি তাঁর শৈশব থেকেই রাজার দাসে পরিণত হয়েছে বা করা হয়েছে তাঁরা কেন জীবনের সকল সুযোগ ও সুবিধা পাবেন না। তারা কেন তথাকথিত এই রাজাকার কিংবা তার পূত্র পৌত্রাদির দাসে পরিণত হবে। ব্যারিস্টার শুধু দেবাশীষ কেন হবে? কেন এই রাজাকার পূত্র তত্বাবধায়কের উপদেষ্টা হবে? কেন একজন দরিদ্র মুরঙ হবেন না, একজন দরিদ্র মারমা হবেন না।
এই যে সামন্ত প্রভুরা একটা দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে থেকে পুরো বাংলাদেশের সাথে পাহাড়ের একটা দূরত্ব তৈরী করে দিয়েছে সেটির দেয়াল সজোরে আঘাত দিয়ে ভেঙ্গে দিতে হবে।
আমি কোনোভাবেই বলছিনা পাহাড়ের ঐতিহ্য, আদর্শ এসব পরিবর্তন করতে। কিন্তু আমি বলছি পাহাড়ের প্রতিটি নাগরিক যেন আধুনিক জীবনের সকল সুযোগ ও সুবিধা পান সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সেখানের জীবন নষ্ট করে আমরা বিদ্যুৎ পাই, কিন্তু পাহাড়ের সব মানুষ কি বিদ্যুৎ পেয়েছেন? এর উত্তর দেবে কে?
আমি জানতে পেরেছি সেখানে একটা মহাবিদ্যালয় করতে গেলে সন্তু লারমার দলের কিংবা অন্যান্য বাকি দল থেকে বাঁধা আসে। সেখানে একটা হাসপাতাল করতে গেলে বাঁধা আসে, ইউনিভার্সিটি করতে গেলে বাঁধা আসে, সেখানে ক্লিনিক করতে গেলে বাঁধা আসে।
কাদের থেকে বাঁধা আসে? উত্তর হচ্ছে এইসব আঞ্চলিক সন্ত্রাসী আর সামন্ত প্রভুদের কাছ থেকে বাঁধা আসে।
কেন আসে?
কারন পাহাড়ের সাধারন জনতারা যদি শিক্ষিত হয়ে ওঠেন, যদি তাঁরা ফুল আর পল্লবে ভ'রে ওঠেন, যদি তাঁরা মেধাবী হয়ে ওঠেন তাহলে এই রাজা-গজাদের সিংহাসন আর রইবে না সেখানে। এই পাহাড়ের জনতারা এই রাজাকার পূত্র দেবাশীষের কলার ধরে থাপড়াবে এতদিন তাদের পেছনে ফেলে রাখার জন্য, এতদিন তাদের দাসে পরিণত করে রাখবার জন্য।
আমি এমন এক পাহাড় চাই, আমি এমন এক পাহাড়ের জনতা চাই যেখানে এই সমতলের সাথে থাকবে না কোনো বাঁধা আর দেয়াল। আমার ভাই বলে আমি জড়িয়ে ধরতে চাই দীপক চাকমা কে, সুবিনয় মারমা কে, সুনয়ন তঞ্চঙ্গ্যাকে। আমি তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে চাই। বলতে চাই সমতলেও আমার দুঃখের কথা।
আমি চাই পাহাড় আর সমতল প্রেম হোক, আমি চাই পাহাড়ের ঘরে আসুক সমতল আর সমতলের ঘরে যাক পাহাড়।
আমি এইসব সামন্ত প্রভুদের ভেঙ্গে চুরে চুরমার করে দিতে চাই।
No comments:
Post a Comment