Saturday 12 March 2016

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গুরুত্বের বিকৃতি বিরোধী আইনঃ কেন চাই?

সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র ভাবে দাবী উঠেছে “জেনোসাইড ডিনায়াল আইন” এই শিরোনামে বাংলাদেশে আইন প্রণয়নের। মূল আলোচনায় যাবার আগে প্রথমেই এই আইন প্রণয়ন করবার দাবী আর সেটি যে শিরোনামে জন সাধারণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সেটির সাথে আমি বিনীত ভাবে দ্বিমত পোষন করি। 

জেনোসাইড শব্দটি বর্তমানে ইংরেজী লক্ষাধিক শব্দের একটি শব্দ হিসেবে বিবেচিত হলেও এটির ধারনা বলা যেতে পারে সাম্প্রতিক। ১৯৪৪ সালের আগে এই শব্দটির-ই ব্যবহার ছিলোনা। পোলিশ আইনজীবি রাফায়েল লেমকিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ হত্যাকান্ড আর নৃশংস তান্ডব দেখে এই সম্পূর্ণ হত্যাকান্ডকে “জেনোসাইড” শব্দের মাধ্যমে নাম করন করেন। গ্রীক এবং ল্যাটিন এই দুইটি ভাষার ভিন্ন ভিন্ন শব্দ নিয়ে জেনোসাইড এখন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বোধগম্য শব্দ। একটি সুনির্দিষ্ট জাতি, গোষ্ঠী, আদর্শের মানুষদের হত্যাকরার ঘটনাকেই এই একটি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। লেমকিনের নিজের ভাষায়, 

“a coordinated strategy to destroy a group of people, a process that could be accomplished through total annihilation as well as strategies that eliminate key elements of the group's basic existence, including language, culture, and economic infrastructure.”

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের বাংলাদেশীয় দোসরদের মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছিলো ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সুনির্দিষ্ট ঘটনায় ইতিহাস বিকৃতির ধরন কিছু ক্ষেত্রে গণহত্যাকে অস্বীকার করে এগোয় না বরং এই গনহত্যাতে নিহত শহীদদের সংখ্যা কিংবা এই মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত নানাবিধ বিষয়াদিকে মিথ্যে তথ্যে জড়িয়ে দিয়ে এটিকে বাজারজাত করা হয়। সুতরাং সরাসরি জেনোসাইডকে অস্বীকার না করে আনে-বানে এটিকে লঘু করা ও অন্যান্য ঐতিহাসিক সত্য ঘটনাকে বিতর্কিত করবার প্রয়াস এখানে লক্ষ্যননীয়। আর সে কারনেই “জেনোসাইড ডিনায়াল আইন” শিরোনামে আইন প্রণীত হলে এটির বোধগমত্যা একটি সুনির্দিষ্ট ফ্রেমে আটকে যায়, অর্থ্যাৎ মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যাকে অস্বীকার করলে কেবলমাত্র সেটিকে অপরাধ বিবেচনা করে আইন প্রণয়ন, শিরোনাম দেখে কিন্তু সেটিই মনে হতে পারে। 

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে আবর্তিত করে যেসব কুতর্ক ও অপঃপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে বা হয়েছে সেসবের সামগ্রিক এলাকাটা অত্যন্ত দীর্ঘ। সুতরাং শুধু গণহত্যাকে অস্বীকারকরণ আইন-ই নয় বরং সামগ্রিক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত যে কোনো ইতিহাস ও তার গুরুত্বকে খর্ব করে বিকৃত করে বলবার যে কোনো বক্তব্য, লেখা, প্রচার কিংবা ইঙ্গিতকে অপরাধ বিবেচনা করে এমন একটি শিরোনামে আইন প্রণয়ন করা উচিৎ যেটি এই অপরাধীদের এই পুরো অপরাধের এলাকাটিকে সম্পূর্ণভাবে কাভার করতে পারে। সে কারনেই আমি এই লেখার শিরোনাম দিয়েছি “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গুরুত্ব বিকৃতি বিরোধী আইন”

কেন এখন এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের কথা উঠেছেঃ

গত সাড়ে চার দশক ধরে স্বাধীনতা বিরোধীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তাঁর নানাবিধ ইতিহাসকে যেভাবে বিকৃত করেছে কিংবা করছে সেটির নানাবিধ ডাইমেনশন আছে এবং নানাবিধ উপায়ে এই বিকৃতিটিকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের নানা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। 

আমরা সবাই প্রমাণিত সত্য হিসেবে জানি যে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের বাংলাদেশীয় সহযোগী যেমন রাজাকার, আলবদর, আল শামস ইত্যাদি বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন ৩০ লক্ষ কিংবা তারও বেশী মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় উল্লেখিত এইসব অপরাধীদের মাধ্যমে নির্যাতিত হয়েছেন ৪ লক্ষ কিংবা তারও বেশী নারী ও শিশু, বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন প্রায় এক কোটি মানুষ। 

উপরে যে চার দশকের কথা বলেছি হিসেব করলে দেখা যাবে যে এটি’র শুরু মূলত হয়েছে বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংস হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন নিহত শহীদের সংখ্যাকে কমিয়ে দেখিয়ে পুরো সে সময়ে সংগঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অপরাধকে শুধু লঘু করিয়ে দেখাই নয় বরং মুক্তিযুদ্ধের সাথে অতি নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে কখনো সম্পূর্ণ মুছে ফেলা কিংবা কখনো মিথ্যের আবরন দিয়ে ঢেকে ফেলার চেষ্টার মাধ্যমেই এই প্রোপাগান্ডার ধারাবাহিকতার সূচনা যেটি আজো বাংলাদেশে চলছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধকে সিভিল ওয়ার বলে অভিহিত করা, বঙ্গবন্ধুর প্রথম স্বাধীনতার ঘোষনাকে মুছে দিয়ে জিয়াউর রহমান নামে একজন সেনাবাহিনীর অখ্যাত কর্মচারীকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া, বঙ্গবন্ধুকে প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে অস্বীকার, বঙ্গবন্ধুকে অস্মমানিতকরন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে নিয়ে নোংরা সমালোচনা ও সেটিকে বাদ দেবার পাঁয়তারা, একুশে ফেব্রুয়ারীর শহীদ স্বরনের দিনটিকে ও শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবার প্রক্রিয়াটিকে ধর্মের সাথে মিশিয়ে এটিকে বিদাত হিসেবে ঘোষনা, রাজাকার-আলবদর-আল শামসের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পর্যায়ে নীতিনির্ধারক হিসেবে নিয়োগ তথা তাদের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করিয়ে দেয়া এগুলো ছিলো গত কয়েক দশকের আলোচ্য প্রোপাগান্ডামূলক চর্চার কিছু উদাহরন।

এছাড়াও নানাবিধ বক্তব্যকে প্রোপাগান্ডার উপাদান হিসেবে বিবেচনা করলে এমন নানাবিধ অপঃকর্মের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। একাত্তরের নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত গনহত্যাকারী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ২০০৭ সালের নির্বাচন কমিশনারের সাথে বৈঠক পরবর্তী সাংবাদিকদের একটি প্রশ্নে বলেছিলো যে বাংলাদেশে কখনই কোনো স্বাধীনতাবিরোধী ছিলোনা এবং এখনো (২০০৭ সালে) স্বাধীনতাবিরোধী বাংলাদেশে নেই, আরেক মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী আব্দুল কাদের মোল্লা (কসাই কাদের)আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তার বিচার চলাকালীন সময়েই এজলাসে দাঁড়িয়ে দাম্ভিক কন্ঠে বলেছিলো মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে নারী ও টাকার লোভে এবং তাদের বাড় বেড়ে গেছে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পেরেছে বলেই, সাকা চৌধুরী তার বিচার চলাকালীন সময়েও অসংখ্যবার মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের সেটেলড ইতিহাস, তার নানাবিধ পথ পরিক্রমা নিয়ে তীব্র তীর্যক মন্তব্য করেছিলো।

সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লক্ষ কিংবা তারও বেশী শহীদের সংখ্যা নিয়ে একটি অনুষ্ঠানে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন খোদ বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার আগে মুক্তিযুদ্ধের এই শহীদের সংখ্যা নিয়ে জামাতী ইসলাম কিংবা তাদের দোসররা নানা সময়ে এবং নানাভাবে এই শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং একটি সম্পূর্ণ সেটেলড বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তুলেছে। খালেদা জিয়ার এমন বিকৃত মন্তব্যের ঠিক কয়েকদিন পর শহীদ বুদ্ধিজীবি ও তাঁদের পরিবার-পরিজন নিয়েও অত্যন্ত আপত্তিকর ও নোংরাভাষায় প্রশ্ন তুলেছে বেগম খালেদা জিয়ারই একজন উপদেষ্টা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।

এখানে একটি কথা খুবই অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশে এই মূহুর্তে পরিচালিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার প্রক্রিয়া এবং এতে করে যে দেশপ্রেমী আলোড়ন বাংলাদেশীদের মনে আরো সুতীব্র ভাবে জেগে উঠেছে মূলত সেটিই আসলে এই ধরনের একটি আইনকে প্রণীত করবার দাবীকে জোরালো করেছে।

আন্তর্জাতিক আদালতের বিভিন্ন রায় নিয়ে একজন বৃটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যান তার নিজস্ব ব্লগে যে আদালত অবমাননামূলক লেখা লিখেছে তার একটি বড় অংশ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত ৩০ লক্ষ শহীদ হবার কথাটি আদালত কেন বলেছে সেটিকে উপজীব্য করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ৩০ লক্ষ শহীদের বিষয়কে সম্পূর্ণভাবে সেটেলড হিসেবে ধরেই তাঁদের রায়ের পরবর্তী বক্তব্য রেখেছেন আর এই সুনির্দিষ্ট স্থানে এসেই ডেভিড বার্গম্যান অত্যন্ত অন্যায্য, অগ্রহনমুলক এবং আদালতকে নির্দেশমূলক পন্থায় তার ব্লগে এই বিষয়ে লিখেছে। ফলাফল স্বরূপ ডেভিড বার্গম্যাঙ্কে আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তি পেতে হয়েছে। ডেভিড বার্গম্যানের বিরুদ্ধে মামলা ও তারও আগে তার লেখার বিভিন্ন কন্টেন্টের বিরুদ্ধে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন কনসার্নড ব্যাক্তিরা আর সে সময় থেকেই বাংলাদেশে এই ধরনের কর্মকান্ডকে বা বক্তব্যকে অপরাধ বিবেচনা করে আইন প্রনয়নের দাবী ক্রমাগতভাবে উঠতে থাকে।


বিশ্বব্যাপী এই সংক্রান্ত আইন ও তার পেছনের কারনঃ

বাংলাদেশে যেভাবে, যে প্রক্রিয়ায় ও যে উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত শহীদের সংখ্যাকে লঘু করে বলে যে মিথ্যে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয় সেটির মূল যে আদর্শিক অবস্থান সেটি কিন্তু পৃথিবীতে বিরল নয়। উপরে যে আদর্শিক অবস্থান-এর কথা বলেছি সেটি আসলে মন্দার্থে আদর্শিক অবস্থান। নৃশংসতার পুরো ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও ব্যাক্তি স্বার্থে কিংবা যে কোন উদ্দেশ্যে খর্ব করে দেখানো কিংবা লঘু করে ফুটিয়ে তোলার চর্চা আসলে ইউরোপে দীর্ঘদিন ধরেই দেখা গেছে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ ইহুদী ধর্মালম্বীকে হত্যার মাধ্যমে নিঃশেষ করবার যে চেষ্টা করা হয়েছিলো সেটিকে ব্যাক্তি বিশেষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় অবস্থান থেকেও অস্বীকার করবার প্রবণতা দেখা গেছে বহুবার।

এন্টি ডিফেমেশন লীগ কর্তৃক প্রকাশিত “Holocaust Denial in the Middle East: The Latest Anti-Israel Propaganda Theme” শীর্ষক শিরোনামে নিবন্ধে বলা হয়-

Early forms of Holocaust denial took shape in the late 1940s in the writings of Maurice Bardeche, French fascist; American historian Harry Elmer Barnes, and a French concentration camp survivor, Paul Rassinier. Their ideas over time helped inspire a sizeable literature and a small industry that persist on the fringes of Western culture, especially among neo-Nazis, conspiracy theorists and extreme anti-Semites. The deniers’ central idea — that Nazis never attempted to annihilate European Jewry often takes the form of elaborate, pseudo-scholarly arguments, all founded, ultimately, on notions of a vast international Jewish conspiracy, on belief in a universal Jewish hatred of non- Jews, and on Jewish “rapaciousness.” To make their claims credible, Holocaust deniers are forced to reject enormous volumes of Historical evidence from World War II. Records from the period, including thousands of pages of evidence used immediately after the war in the Nuremberg trials, are dismissed as forged by a secret committee; survivors are rejected as greedy charlatans; American GI’s who saw the death apparatus in the camps are told that they were duped by the American military itself, which was also complicit in the conspiracy. As for a motive (for why would Jews claim Holocaust Denial in the Middle East that millions of their brethren were killed in WWII?): deniers claim that the Jews wanted to defraud the West of billions of dollars in reparations and other payments; to “purchase” world support for the creation of the state of Israel; to demoralize “Aryans” and the West so that the Jews could more easily take over the world.

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরাজিত নাৎসি বাহিনীর এপলোজিস্ট যারা বেঁচে বর্তে সমগ্র ইউরোপ-আমেরিকা-ফার ইস্ট এশিয়ার নানাবিধ অঞ্চলে রয়েছেন তারা নানাবিধ কারনে এই বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন হত্যাকান্ডকে অস্বীকার করে নানাবিধ লেখা কিংবা বক্তব্য দিয়েছে। অপঃকর্ম করে সেটিকে লঘু করে দেখানো অপরাধীদের সাধারণ প্রবৃত্তি। অপরাধীরা তাদের অপরাধকে লুকাতে চাইবে এবং সেটিকে যথার্থ হিসেবে রূপ দিয়ে নিজের অপঃকর্মকে হালাল করবার অপঃপ্রয়াস চালাবে এটিই হয়ত অপরাধীর চিরায়ত সাইকোলজিকাল অবস্থান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই নির্মম ভয়াবহতার হাজার হাজার প্রমাণ সকলের চোখের সামনে থাকলেও সুনির্দিষ্ট ব্যাক্তিরা সেটিকে অস্বীকার করবেই। উপরে উল্লেখিত নিবন্ধে মধ্যপ্রাচের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের এই বিষয়ক অবস্থানকেও তুলে ধরা হয়েছে। দেখা যায় মূলত ইসরাইলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যরে বিভিন্ন দেশের দীর্ঘদিনের বৈরিতা কিংবা রাজনৈতিক তিক্ত সম্পর্কের জের ধরে এবং গুরুত্বপূর্ণভাবে বলা চলে যে ধর্মীয় অবস্থানের দিক থেকে বিবেচনা পূর্বকও এই গণহত্যাকে অস্বীকার করবার একটা চলিত ধারা তৈরী হয়ে গেছে।

একটা পর্যায় যখন এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডকে অস্বীকার করবার ও তাকে “কিছুই হয়নি” বলে খারিজ করে দেবার মত অবস্থা আরো পাকাপোক্ত হওয়া শুরু করলো ইউরোপ কিন্তু সেটিকে শক্ত হাতে দমন করেছে আইন প্রণয়ন আর সেটিকে প্রয়োগের মাধ্যমেই। Australia,Austria, Belgium,Bosnia and Herzegovina, Czech Republic,France, Germany, Israel, Liechtenstein, Lithuania, Luxembourg, Netherlands, Poland, Portugal, Romania, Spain, Switzerland-এ হলোকাস্ট কে অস্বীকার করবার প্রেক্ষিতে কঠিন আইন রয়েছে।

Gyorgy Nagy
সুনির্দিষ্টভাবে একটি ঘটনার কথা এই ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে- Gyorgy Nagy নামের এক ব্যাক্তির কথা। ন্যাগি ছিলো পেশায় কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রকৌশলী। ২০১১ সালের ২৩শে অক্টোবরে হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদাপেস্টের একটি রাজনৈতিক র‍্যালির মধ্যে ন্যাগি'র হাতে ধরা ছিলো একটি প্ল্যাকার্ড। যেখানে খুব স্পস্ট করে সে লিখে রেখেছিলো যে "হলোকাস্ট নামের কিছু হয়নি"। 

সাথে সাথেই পুলিশ ন্যাগিকে গ্রেফতার করে সেই র‍্যালি থেকে। এখানে উল্লেখ্য যে হাঙ্গেরী সরকার ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসেই হলোকাস্ট [The Holocaust was the mass murder of six million Jews and millions of other people leading up to, and during, World War II] অস্বীকার করবার বিরুদ্ধে একটি আইন প্রনয়ন করে। এখানে এই আইনের নাম হচ্ছে “Law Against Support and Dissemination of Movements Oppressing Human Rights and Freedoms (2001)”


এই আইনের মাধ্যমে আদালত ন্যাগিকে ১৮ মাসের সাসপেন্ডেড জেইল সেন্টেন্স প্রদান করেন [নোটঃ A suspended sentence is a legal term for a judge's delaying of a defendant's serving of a sentence after they have been found guilty, in order to allow the defendant to perform a period of probation]

তদুপোরি আদালত নির্দেশ দেয় যে ন্যাগিকে হাঙ্গেরির হলোকাস্ট মেমোরিয়াল জাদুঘর যেটি বুদাপেস্ট-এ অবস্থিত, পোল্যান্ডের Auschwitz death camp কিংবা ইসরাইলে অবস্থিত the Yad Vashem memorial এই তিনটার একটিকে বেছে নিয়ে এবং সেগুলো তাকে পরিদর্শন করাবার পর এই বিষয়ে ন্যাগিকে তার অনুভূতি লিখতে হবে যে এই সব স্থান দেখবার পর সে হলোকাস্ট সম্পর্কে কি ভাবছে।

শুধু যে ন্যাগির শাস্তি-ই নয়। ইউরোপের এই বিষয়ক যে শক্ত অবস্থান রয়েছে সেটির প্রায়োগিক ইতিহাসের দিকে যদি লক্ষ্য রাখি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে গণহত্যাকে অস্বীকার করবার কারনে এমন অসংখ্য ব্যাক্তির বিভিন্ন মেয়াদে কিংবা বিভিন্ন প্রক্রিয়াতে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছিলো। ১৯৮৭ এবং ১৯৯৯ সালে যথাক্রমে জিন মেরী ও লী পেন কে ফ্রান্স ও জার্মানী ১৮৩,০০০ এবং ৬,০০০ ইউরো অর্থদন্ডে দন্ডিত করেছিলো দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের গণহত্যাকে অস্বীকার করবার দায়ে, রজার গারাউর্ডিকে ফ্রান্স ১৯৮৭ সালে প্রায় ৩৭,৫০০ ইউরো জরিমানা করেছিলো, ১৯৯৮ সালে সুইজারল্যান্ড জার্গেন গ্রাফকে ১৫ মাসের জেল, ১৯৯৮ সালে জিন প্লান্টিন না্মের এক ব্যাক্তিকে ফ্রান্স ৬ মাসের কারাদন্ড দিয়েছিলেন, অস্ট্রিয়া ২০০৬ সালে ডেভিড আরভিং নামে এক ব্যাক্তিকে ৩ বছরের কারাদন্ড দেয় এবং ১৩ মাস কারাবাসের পর তাকে তার নিজের দেশে ডিপোর্ট করে দেয়, এইতো ২০১৫ সালের নভেম্বরেই উরসুলা হ্যাভারবেককে জার্মান আদালত ১০ মাসের কারাদন্ড প্রদান করে জেনোসাইড অস্বীকার করবার দায়ে। ৮৭ বছর বয়স্ক উরসুলা দাবী করেছিলেন যে অসুইজে যে কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছিলো সেটি একটা লেইবার ক্যাম্প ছাড়া আর অন্য কিছু ছিলোনা। তারমানে অসুইজের কারাগারে ভয়াবহ হত্যাকান্ডের নৃশংসতা অস্বীকার করবার পরে একজন ৮৭ বছরের ব্যাক্তিকেও জার্মানী কোনোভাবেই ছাড় দেয়নি। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৫ সালের ফেব্রিয়ারীতে ভিন্সেন্ট রেইনোয়ার্ড নামের এক ব্যাক্তিকে ফ্রান্স আদালত ২ বছরের কারাদন্ড প্রদান করেন হলোকাস্টকে অস্বীকার করবার দায়ে। 

শুধু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দেশেই যে এমন আইন রয়েছে তাও কিন্তু নয়। অস্ট্রেলিয়াতে যদিও জেনোসাইড ডিনায়াল নিয়ে সরাসরি আইন নেই তথাপিও "hate speech" এবং "racial vilification" অপরাধের অধীনে গণহত্যাকে অস্বীকার করবার অপরাধের বিচার হয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক Gerald Fredrick Töben এর মামলা এই বিষয়ে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি উদাহরণ। টোবেন যদিও দাবী করেছেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের গনহত্যাকে অস্বীকার করবার উপায় নেই কিন্তু তার লেখাতে এই গণহত্যাকে মিথ্যে বলে বলা হয়েছিলো। এটি ছাড়াও জাতি সত্ত্বা হিসেবে ইহুদিদের তীব্র ভাষায় সমালোচনাো করেছিলেন টোবেন এবং এই জাতীয় দুইটি অপরাধের জন্য তিনি জার্মানী ও অস্ট্রেলিয়া এই দুই দেশেই সাজা ভোগ করেন। ঠিক একই রকম আইন রয়েছে আর্মেনিয়ান গণহত্যাকে অস্বীকার করবার ক্ষেত্রেও।

এই সুনিদির্ষ্ট বিষয়ে নানা দেশে প্রণীত আইনের কিছু উদাহরন এখানে দেয়া যেতে পারে। যেমন অস্ট্রিয়া প্রণয়ন করেছে- National Socialism Prohibition (1947, amendments of 1992)আইন। যে আইনের একটি অংশে বলা রয়েছে - 

3g. He who operates in a manner characterized other than that in 3a – 3f will be punished (revitalising of the NSDAP or identification with), with imprisonment from one to up to ten years, and in cases of particularly dangerous suspects or activity, be punished with up to twenty years' imprisonment. 3h. As an amendment to 3 g. whoever denies, grossly plays down, approves or tries to excuse the National Socialist genocide or other National Socialist crimes against humanity in a print publication, in broadcast or other media.

আবার বেলজিয়ামের এই বিষয়ক আইনে বলা রয়েছে যে- Negationism Law (1995, amendments of 1999)

Article 1 Whoever, in the circumstances given in article 444 of the Penal Code denies, grossly minimises, attempts to justify, or approves the genocide committed by the German National Socialist Regime during the Second World War shall be punished by a prison sentence of eight days to one year, and by a fine of twenty six francs to five thousand francs. For the application of the previous paragraph, the term genocide is meant in the sense of article 2 of the International Treaty of 9 December 1948 on preventing and combating genocide. In the event of repetitions, the guilty party may in addition have his civic rights suspended in accordance with article 33 of the Penal Code.

এখানে এটিও উল্লেখযোগ্য যে এই জাতীয় আইন যখনই কোন দেশ তাদের নিজেদের দেশে স্থায়ী ভাবে প্রণয়ন করবার জন্য চেষ্টা করা হয়েছিলো তখন সেটির বিপক্ষেও কিন্তু বড় বড় জ্ঞানবিদ তাদের নিজের বক্তব্য দিয়েছেন। এই বক্তব্যের মধ্যে যে উল্লেখযোগ্য অংশটি বার বার উঠে এসেছে সেটি হচ্ছে বলবার ও চিন্তার স্বাধীনতার ব্যপারটি। খোদ ইউরোপিয়ান কনভেনশন অফ হিউম্যান রাইটসের আর্টিকেলের সাথেও যে এই ধরনের আইন সাংঘর্ষিক সে কথাও এইসব জ্ঞানবিদেরা উল্লেখ করে আইনের বিরুদ্ধচারণ করেছেন। নোয়াম চমস্কি, ক্রিস্টোফার হিচেন্স, রওল হিলবার্গ, রিচার্ড যে ইভান্সের মত ব্যাক্তিরা তীব্র ভাবে তাদের দেশে এই ধরনের আইনের বিরুদ্ধে তীব্র মতামত রেখেছেন।

এই তীব্র মতামতের বিরুদ্ধে যে ব্যাপারটি প্রতিবারই ওই সুনির্দিষ্ট দেশে দাঁড়িয়েছে সেটি হোলো সাধারণ জনতার মতামত এবং পলিসি যারা নির্ধারণ করেন সেসব নীতি নির্ধারকদের ইচ্ছে। নীতি নির্ধারকেরা বার বার ই এই ব্যাপারটিতে ইতিহাসের প্রতি সুবিচার, ইহুদিদের প্রতি অত্যাচার হবে কিংবা আরো বেশী হতে পারে তথা এই অস্বীকারের মধ্য দিয়ে যে ভায়োলেন্সের পথ সুগম হচ্ছে ও আরো গণহত্যাকে যথার্থ করে তুলছে এমন যুক্তি দেন। সাধারণ জনতাও বার বার জেনোসাইড প্রত্যাখানকারীদের ও তাদের এপোলোজিস্টদের স্বতস্ফূর্তভাবে প্রত্যাখান করেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব সভ্যতার ইতিহাসে যত বর্বরতম হত্যাকান্ড হয়েছে তাদের একটি প্রতীক। হিটলারের নাৎসী বাহিনী লক্ষ লক্ষ ইহুদিদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এই পুরো ঘটনা শুধুমাত্র রাজনৈতিক আবরণে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি মানব সভ্যতার জন্য অন্যতম করুন ট্র্যাজেডি। এই সময়কালীন অপরাধের ক্ষেত্রী এমন একটি জুরিস্প্রুডেন্সও দাঁড়িয়ে যায় যে এই সময়ে সংগঠিত নানাবিধ অপরাধ আসলে শুধুমাত্র ওই সুনির্দিষ্ট দেশ কিংবা মানুষের বিরুদ্ধে নয় বরং এই অপরাধ সারা মানবসভ্যতা কিংবা মানবতার বিরুদ্ধেই। এইরকম একটা আইনী ধারনা কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আরো গভীরভাবে প্রসারিত হয় যার ফলে নেদারল্যান্ডের হেগে আজকে আমরা আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত দেখতে পাই কিংবা নুরেমবার্গ আদালতের মতন করে বাংলাদেশেও সেই ১৯৭৩ সালেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রণয়ন করা হয়। সুতরাং এটি বুঝতে পারা খুব বেশী কষ্টের নয় যে এই ধরনের অপরাধ কিংবা সেটি যাতে আর কখনোই ঘটতে না পারে কিংবা কেউ এই ধরনের অপরাধকে কখনই বাক স্বাধীনতার নামে যথার্থকরন প্রক্রিয়াতে না নিয়ে যেতে পারে সে চিন্তাতেই সারা বিশ্ব এই হলোকাস্ট অস্বীকারকরণ কে অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে। এই ধরনের কঠোর আইন শুধু কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে হলোকাস্টকে অস্বীকার করবার জন্য প্রণীত হয়েছে এমন মেসেজই দেয়না বরং এটিও জানান দিয়ে যায় যে যে কোনো ধরনের গণহত্যাকে অস্বীকার করবার ফলাফল কি হতে পারে।

কেন বাংলাদেশেও এমন একটি আইন দরকার

উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা হয়ত পাঠকের কাছে স্পস্ট যে গনহত্যাকে অস্বীকার করবার প্রেক্ষিতে ইউরোপসহ সারা বিশ্ব কতটা কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সাথেই মিশে রয়েছে। ৩০ লক্ষ কিংবা তারও বেশী শহীদ, ৪ লক্ষ কিংবা তারও বেশী মা-বোনদের ত্যাগে আমরা একটি বাংলাদেশ পেয়েছি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা শুধু যে খুন আর নির্যাতন করেছে এবং অপরাধ সেগুলোতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। পুরো একটি দেশকে তারা আক্ষরিক অর্থে তছনছ করে দিয়ে গেছে। কি তার অর্থনীতি, কি তার রাজনীতি কি তার কোটি কোটি মানুষের জীবন। কত স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে, ভেঙ্গে গেছে কত ঘর, অপমান, নির্যাতন, ক্লান্তি, গ্লানি সব কিছু একাকার হয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জাতিসত্বায় অত্যন্ত আবেগের একটি অবস্থানে প্রোথিত রয়েছে।

এমন একটি অবস্থানে এসে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার হত্যাকান্ডের ফলে নিহতের সংখ্যা কমিয়ে বলে এই সময়কার অপরাধকে লঘু করে দেখবার যে “ইন্টেনশন” বা ইচ্ছে সেটির বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন এবং ব্যবস্থা গ্রহন এখন নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের কর্তব্য হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মূলত মোটা দাগে গণ হত্যাকে অস্বীকার হয়ত করা হয়না কিন্তু গণহত্যাকে পরোক্ষভাবে গৌন করবার একটা সুতীব্র প্রচেষ্টা গত কয়েকটি বছরে তীব্র ভাবে এই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিদের কাছ থেকে দেখা দিয়েছে। একটা সময় পাকিস্তানী আর্মির এই দেশীয় দোসর জামাত-শিবির এই জাতীয় প্রোপাগান্ডার কান্ডারী হলেও এখন সেই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধেই তুলে নিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বি এন পি। যে বি এন পির প্রতিষ্ঠাতা একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং ঐতিহাসিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের একটি সেক্টরের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন সেই প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী-ই আজকে মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বলে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন। এর থেকে লজ্জার আর গ্লানির হয়ত আর কিছুই হতে পারে না।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার শুরু হবার পর থেকে বিচার বিষয়ক নানাবিধ প্রোপাগান্ডা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে মূল মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে এটি প্রসারিত হয়েছে এই স্বাধীনতাবিরোধীদের আল্টিমেট টার্গেট হিসেবেই। আর আশংকা জনকভাবে বাংলাদেশের মানুষের সবচাইতে আবেগের এই ইতিহাসের সাথে তথাকথিত ইতিহাস চর্চাকারীদের এমন মিথ্যাচার পুরো দেশটির সেটেলড ইতিহাসকে বিপন্ন করে তুলেছে।

আগামীর প্রজন্ম যদি বাংলাদেশের শুরু, তার রক্তের সংগ্রাম, ইতিহাস, ত্যাগ আর সাহসের গল্পগুলোকে এমন মিথ্যে প্রোপাগান্ডার সাথে মিলিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে তবে বাংলাদেশ যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হয়ে সামনে এগোবার শপথে বলীয়ান ছিলো সেটি সম্পূর্নভাবেই পরাস্ত হয়ে উঠবে। সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্ক রয়েছে এমন ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া নৃশংসতাকে লঘু করবার প্রচেষ্টাকে মূলত মুকুলেই বিনষ্ট করতে হবে। যদিও এই প্রোপাগান্ডার প্রসারকে “মুকল অবস্থায়” বলাটা অনুচিৎ কেননা আমি এই লেখায় আগেই বলেছি এই প্রোপাগান্ডা কিংবা এই মিথ্যাচারের শুরুটা আজকের নয়, তথাপিও এই সময়টা বিশেষ করে বাংলাদেশে যখন একাত্তরের নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধের ও সেখানে জড়িত ঘাতকদের বিচার চলছে এই সময়টাই শ্রেষ্ঠ সময় মুক্তিযুদ্ধ বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থায় যাওয়া। একাত্তরের ঘাতকদের বিচারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে শাহবাগের মত তীব্র আন্দলোনও যেখানে তৈরী হয়েছে, যেখানে এই প্রজন্মের কোটি কোটি তরুন/তরুনী, যুবক/যুবতী একাত্ন হয়েছে এই বিচারের দাবীতে সেখানে সারা বাংলাদেশকে একটি চেতনায় সমন্বিত করা মূলত সময়ের দাবী।

তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে শুধু গণহত্যা অস্বীকার করন আইন নামে কোনো আইন না করে বরংচ এই আইন করবার সময়ের ড্রাফটিং ও তার শিরোনামকে হতে হবে অত্যন্ত সূদূর প্রসারী। একাত্তরের ঘাতক ও তাদের বন্ধুরা ইউরোপের আদলে মূলত গণহত্যাকে অস্বীকার করেনা বরং তাদের মিথ্যাচারের ধাপগুলো আরো বেশী সুবিন্যাস্ত ও ব্যাপক। সে কারনেই আইন প্রণয়নের সময় আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে এর ফ্রেম ওয়ার্ক যেন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি বিষয়কে কাভার করে এবং এমন ভাবে এই আইনের প্রভিশন রাখতে হবে যে আইনের ফাঁক দিয়ে একটি অপরাধ করে মুক্তিযুদ্ধকে আর দ্বিতীয়বারের মত প্রশ্নবিদ্ধ না করতে পারে। স্বাধীনতার ঘোষনা কে দিয়েছেন, ৭-ই মার্চের ভাষনকে বিকৃত করে ব্যখ্যা, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চান নি বলে মিথ্যাচার, প্রথম রাষ্ট্রপতি যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেটি অস্বীকার সহ প্রতিটি বিষয়কে যেন একটি আইন একা ধারন করতে পারে সে বিষয়ে আইনবিদেরা সচেষ্ট হবেন বলেই আমি আশা রাখি।

এই ধরনের একটি আইনে যাতে বার বার হাত দিতে না হয় কিংবা সংশোধন না করতে হয় সে বিষয়টা শুরু থেকেই প্রাথমিক গন্তব্য ধরলে আমরা সবচাইতে বেশী উপকৃত হব। উপরে উল্লেখিত বিষয়ের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক, নির্যাতিত মানুষের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক কিংবা সমালোচনা করাকে কঠোর আইনী শাস্তির প্রভিশন রাখা সাপেক্ষে প্রণীত করাটা জরুরী।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধ শুধু বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে-ই অপরাধ নয় বরং এই সময়ে সংগঠিত অপরাধ “হিউম্যান ডিগনিটি” বলে যে ধারনা রয়েছে সেটির বিরুদ্ধেও অপরাধ। এই নৃশংসতা বা বর্বরতা সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষদের বিরুদ্ধে অপরাধ, এটি সারা বিশ্বের মানুষদের কাছেই আবেগের। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বর্বরতা, খেমার রুজদের বর্বরতা/গণহত্যা, মিলোসোভিচের হত্যাযজ্ঞ, রুয়ান্ডার তুতসীদের উপর হত্যাযজ্ঞ, আর্মেনীয়দের উপর হত্যাযজ্ঞ, শ্রীলংকায় তামিলদের উপর হত্যাযজ্ঞ শুধু সে দেশের ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে সংগঠিত অপরাধ নয়। এইসব অপরাধ পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের বেঁচে থাকবার অধিকারের উপর আক্রমণ কিংবা বিপন্ন করবার সরাসরি হুমকি। সুতরাং এইসব হত্যাকান্ড স্থান কাল পাত্র ছাপিয়ে এখন বৈশ্বিক আবেগের যায়গায় পরিগণিত হয়েছে।

সুতরাং শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে এমন ধারনা থেকেই নয় বরং সমগ্র মানবজাতির আবেগের স্থানকে এইসব ঘাতকেরা দলিত ও মথিত করছে তাদের মিথ্যাচার দিয়ে, এমনটাই মনে করে আইন প্রণয়ন করা হোক। 

ঘাতক যখন তার হত্যাকে যথার্থ করবার প্রক্রিয়াকে বাক স্বাধীনতার অংশ হিসেবে ভেবে অন্যায়কে সত্য ভাষনে পরিণত করতে চায় তখন রাষ্ট্রের দায় বর্তায় এই ধারনাকে ভেঙ্গে কঠোর অবস্থানে যাওয়া। আর সে অবস্থানকে নির্দিষ্ট করেই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গুরুত্ব রোধ করবার অপঃপ্রয়াসের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন এখন শুধু সময়ের দাবী-ই নয় বরং বাংলাদেশের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার জন্য জরুরী। একটি জাতির নব প্রজন্ম যখন সেই দেশের ইতিহাসকে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থতায় বেড়ে ওঠে তখন সেই জাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠতে থাকে অন্ধকারময়।


সে কারনেই দরকার আইন। সে কারনেই দরকার সচেতনতা।


লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছেঃ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিতর্ক মহোৎসবে প্রকাশিত ম্যাগাজিন "পিদিম" এ।



No comments:

Post a Comment