Tuesday, 22 March 2016

একাত্তরের ঘাতকদের বিচারে মুসলিম আইডেনটিটির অপঃব্যবহার- পর্ব-৩




(খ) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচার ও সেখানে মুসলিম আইডেনটিটির অপঃ ব্যবহার

এই লেখাটির ১ম পর্ব পড়তে হলে ক্লিক করুন এখানে
এই লেখাটির ২য় পর্ব পড়তে হলে ক্লিক করুন এখানে

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংঘটিত বর্বর গণহত্যার সাথে বাংলাদেশের যে সকল দালাল তথা রাজাকার,আল-বদর, আল-শামস এবং ইন্ডিভিজুয়াল যেসব ব্যাক্তি এই গণহত্যা এবং সেসময়ে এই যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন অপরাধের সাথে যুক্ত ছিলো, তাদের বিচার বাংলাদেশ সরকার একটি নিরপেক্ষ ট্রাইবুনাল এর মাধ্যমে অত্যন্ত সুচারু ও সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি মুক্ত রেখে শুরু করেছে। ২০১০ সালের ২৫ শে মার্চ একটি গেজেট নোটিফিকেশানের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে ট্রাইবুনাল এবং ২৬ শে জুলাই ২০১০ সালে শুরু ট্রাইবুনালের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এই ট্রাইবুনাল যেই আইনে পরিচালিত হচ্ছে, সেই আইনের নাম হচ্ছে- আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন-১৯৭৩। গত ২৫ শে মার্চ ২০১৬ সালে এই ট্রাইবুনালের বয়স গিয়ে দাঁড়ালো ৬ বছর।

এই বিচারটি শুরু হয়েছে ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি হিসেবেই। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে এই রকমের যে একটি বিচার করবার জন্য একটি সরকারকে যেমন নিবেদিত প্রাণ, দক্ষ হতে হয় তার শতকরা ত্রিশ ভাগও এই সরকার দেখাতে পারেনি। 

এই আইন সম্পর্কে কিংবা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সম্পর্কে (সাবেক) আইনপ্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, এক সময়ের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মইনুদ্দিন খান আলমগীর, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, মতিয়া চৌধুরীকে নানান যায়গায় যেসব কথা বার্তা, বিবৃতি দিতে দেখেছি যেগুলো একটা পর্যায়ে বিচারিক ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরী করেছে। এমনকি সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও মতিয়া চৌধুরী ট্রাইবুনাল বিষয়ক নানান বক্তব্যের জন্য ট্রাইবুনালের কাছে ক্ষমাও প্রার্থনা করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্য প্রতিমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হোসেন আপীলেট ডিভিশানের বিচারপতিদের নিয়ে যেই মন্তব্য করেছেন এই বিচার বিষয়ক কিছু ইস্যুওকে কেন্দ্র করে সেটির জন্য দু’জনেরই ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা হয়েছে এবং তাঁদের মন্ত্রীত্ব এখন প্রায় যায় যায় অবস্থায় রয়েছে।

উপরে যে বলেছি দক্ষতার কথা কিংবা নিবেদিত প্রাণের কথা সেটি বলছি এই ট্রাইবুনালকে নিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের ব্যাপক আকারে মিথ্যাচার ও তার প্রেক্ষিতে সেটি ঠেকাতে সরকারের ব্যার্থতার পুরো ব্যাপারটি মাথায় রেখেই। মুক্তিযুদ্ধের পর যেখানে জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ কিংবা বেগম খালেদা জিয়ার আমলে মুক্তিযুদ্ধকালীন দালাল ও রাজাকার রা পুনর্বাসিত হয়েছে ও সেইসাথে মন্ত্রীত্ব পেয়েছে, জাতীয় সংসদে গিয়েছে সেখানে এটা আওয়ামীলীগ সরকারের সহজেই অনুমান করা উচিৎ ছিলো যে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৩৯ বছর পর এই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যথেষ্ঠ সংঘবদ্ধ হয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে প্রকট আকার ধারন করেছে। 

যারা একাত্তরের ঘাতক ছিলো তারাই বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়েছে, শাষন ব্যবস্থায় গিয়েছে। এমন একটা অবস্থায় সরকারের যা যা করনীয় ছিলো তা কি সরকার করেছে? সারা পৃথিবী জুড়ে যত আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন, এই বিষয়ে দক্ষ যত একাডেমিক রয়েছেন, পেশাজীবি রয়েছেন কিংবা পৃথিবীর যেসব দেশে এই সুনির্দিষ্ট আইন বা বিষয় নিয়ে গবেষনা হয় এই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা সেসব প্রতিটি স্থানেই গিয়েছে এবং অর্থের বিনিময়ে লবিস্ট ক্রয় করেছে, তাদের পক্ষে বলবার জন্য অর্থের বিনিয়োগ করেছে।

বৈশ্বিকভাবে পরিচিত যত পি আর ফার্ম রয়েছে সবখানেই এই শক্তিরা অর্থ ঢেলেছে এবং এই পুরো বিচারকে সারা পৃথিবীতে এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে যেখানে সবার কাছে বার্তা পৌঁছেছে যে এই বিচারটি হচ্ছে রাজনৈতিক এক প্রহসনের বিচার এবং এই বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের কিছু ইসিলামী চিন্তাবিদকে হত্যা করা হচ্ছে, এই বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসিলামী প্রসার কমাবার পাঁয়তারা করছে সরকার।

এই উপরে যে প্রোপাগান্ডার কথা বলেছি সেগুলো প্রচার করেছে পৃথিবীর সব খ্যাতনামা পত্রিকা, ম্যাগাজিন কিংবা প্রতিষ্ঠান। যখনই কোনো অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণ হয়েছে কিংবা বিচারে দন্ড কার্যকর হয়েছে ঠিক তখনই বৈশ্বিক সংবাদপত্রগুলো কাভার করেছে “বাংলাদেশে ইসলামী নেতাদের ফাঁসী”, “বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতিবিদের দন্ড কার্যকর” এই ধরনের শিরোনামে।

শুধু বৈশ্বিক মিডিয়াতেই নয়। বাংলাদেশে এইসব স্বাধীনতাবিরোধীদের যেসব পোষ্য মিডিয়া রয়েছে কিংবা সামাজিক মাধ্যমে তাদের যে বেতনভুক্ত কর্মচারী রয়েছে সেখানেও বার বার প্রচার করা হয়েছে যে এই বিচার প্রক্রিয়া মূলত কিছু ইসলামী চিন্তাবিদদের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র, এটা রাজনৈতিক বিচার কিংবা এটি ইসলামকে ধ্বংস করবার এক বিচার।

এই পর্যায়ে এসে এই ধরনের বক্তব্যের কিছু উদাহরণ দেয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। 

৩০ শে সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে দৈনিক সংগ্রামের এক সংবাদের মাধ্যমে জানা যায় যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইসলামী ছাত্রশিবির জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে স্থানীয় একটি মিলনায়তনে এক প্রতিবাদ সভায় বলেন- 

“সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন নির্মূলের ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু জনগণ তা মেনে নেবে না। কারণ জনগণ জানে যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার একটি সাজানো নাটক। প্রহসনের এই বিচার জনগণ রুখে দিবে। তিনি জামায়াত-শিবিরের বন্দি নেতৃবৃন্দের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান”

সংগ্রামের ওই একই রিপোর্ট থেকে বগুড়াতে ইসিলামী ছাত্র শিবির এর আরেকটি সভাতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বগুড়া শহর সভাপতি নূরুল ইসলাম আকন্দ বলেছেন, 

“বর্তমান সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জামায়াত ও শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে ইসলামী আন্দোলনকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে কিন্তু এ দেশের ছাত্র সমাজ সরকারের সকল জুলুম ও নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং জনগণের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে একত্রে ছাত্র গণ-আন্দোলন গড়ে তুলবে। বতিনি অবিলম্বে নেতৃবৃন্দকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানান”

[সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম অনলাইন ভার্সন। তারিখ ৩০/০৯/২০১০। সংবাদের শিরোনামঃ “সরকার যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন নির্মূলের ষড়যন্ত্র করছে”]

দৈনিক সংগ্রামের ১৪-ই নভেম্বর ২০১৫ তারিখের আরেকটি সংবাদ থেকে জানা যায় যে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরীর নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল হালিম বলেছেন-

“সরকার দেশ থেকে ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধ নির্মূলের অংশ হিসাবে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে অন্যায়ভাবে হত্যার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। কিন্তু জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে, আল্লাহর বিধান ও শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে দুনিয়াতে কোন শক্তিই টিকে থাকতে পারেনি, বর্তমান সরকারও পারবে না। তিনি সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ কারাবন্দী সকল নেতাকর্মীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন”

“মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, আল্লাহর সাহায্যের উপযুক্ত হওয়াই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আবশ্যিক কাজ। আল্লাহর রহমত ও সাহায্যের কাছে ইসলাম বিরোধী শক্তির সকল চক্রান্ত নস্যাৎ হয়ে যাবে। সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে কারাবন্দী ও নেতাকর্মীদের উপর নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাচ্ছে। কিন্তু এসব করে ইসলামী আন্দোলনকে কোনভাবেই দমানো যাবে না বরং সকল জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে জামায়াত কর্মীগণ নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় দেশকে শান্তি ও কল্যাণের পথে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর”

[সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম অনলাইন ভার্সন। তারিখঃ ১৪/১১/২০১৫। সংবাদের শিরোনামঃ “ইসলাম নির্মূলের অংশ হিসেবেই জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যার ষড়যন্ত্র”]

ইসলামিক নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট নেট নামে একটি অনলাইন পত্রিকার ৩শরা ডিসেম্বর ২০১০২ তারিখে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল বাংলাদেশে অভিযুক্ত আসামীদের পক্ষে তুরষ্কে সে দেশের একটি রাজনৈতিক দল সা’দত পার্টি এই আসামীদের পক্ষে একটি সমাবেশ করে। খবরে বলা হয়-

“বিচারের নামে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র বাতিল ও তাদের মুক্তির দাবিতে রোববার বিকেলে তুরস্কের ঐতিহাসিক বসফরাস প্রণালীর তীরবর্তী কাদিকয় স্কোয়ারে লক্ষাধিক লোকের বিক্ষোভ করেছে বৃহৎ রাজনৈতিক দল সাদাত পার্টি। জামায়াত নেতাদের অবিলম্বে মুক্তি না দিলে সারা দুনিয়াব্যাপী আন্দোলনের ডাক দিয়ে মুসলিম বিশ্ব থেকে বাংলাদেশকে এক ঘরে করে ফেলা হবে বলেও হুঁশিয়ার করেন বক্তারা। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন সাদাত পার্টির প্রধান প্রফেসর ড. মোস্তফা কামালাক। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের চলমান নির্যাতন যুগে যুগে মুসলমানদের ওপর চালানো নির্যাতনের ধারাবাহিকতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের ওপর সুনামী বয়ে যাচ্ছে। এমনকি সাধারণ জনগণ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আদালতের কাছে বিচার প্রার্থনা করেও কোনো সমাধান পাচ্ছে না তারা। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের এ নির্যাতন ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করা হবে। তিনি শেখ হাসিনাকে ইহুদীদের পাতানো ফাদে পা না দিয়ে অবিলম্বে জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন”

“মিসরের ক্ষমতাসীন দল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রধান ড. মোহাম্মাদ বদিই বলেন, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় সব কটি নির্বাচনেই দলটি অংশ নিয়েছে এবং জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রণালয়ে প্রতিনিধিত্ব করে সফল ভূমিকা রেখেছে। তা সত্ত্বেও জামায়াত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় দু’হাজার মামলা দেয়া হয়েছে। গোলাম আযম ও মাওলানা সাঈদীসহ আওয়ামী লীগ সরকার যাদেরকেই গ্রেফতার করেছে তারা অধিকাংশ মানবতাবিরোধী অপরাধে নয় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার। বর্তমান সময়ে দুনিয়ার কোথাও এ নির্যাতনের নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে মানুষ হত্যার রাজনীতির খেলা খেলছে সরকার। যার পরিণাম আগেও ভাল হয়নি। ভবিষ্যতেও ভাল হবে না”
ওই একই খবরে স্পেনের একটি সভার খবরও বলা হয়। এই অংশে বলা হয় যে-
যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে আটক সকল ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও বিরোধী রাজনীতিবিদদের মুক্তি, বিচারের নামে প্রহসন বন্ধের দাবি ও দেশব্যাপী চলমান আন্দোলনের সরকারি নির্যাতনের প্রতিবাদে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে সেভ বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা এ কথা বলেন। বক্তরা বলেন, আল্লামা সাঈদীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে বলেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে সাঈদীকে যারা ধ্বংস করে দিতে চান তাদের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের কাছে গোপন নয়। তারা মাওলানা সাঈদীর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে তাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই এ হীন অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বক্তারা মাওলানা সাঈদীকে বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত ও মর্দে মুজাহিদ উল্লেখ করে বলেন, মাওলানা সাঈদী যুদ্ধাপরাধী কিনা সেটা তার জন্মস্থান পিরোজপুরের জনগণ জানে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর তার মতো জনপ্রিয় ইসলামী ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ শুধু ভিত্তিহীন নয়, ইতিহাসের নিকৃষ্টতম মিথ্যাচার। যারা এই অভিযোগ তুলেছে তাদের মূল টার্গেট মাওলানা সাঈদীর অভাবনীয় জনপ্রিয়তা”

[সূত্রঃ ইসলামিক নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট নেট। সংবাদের তারিখঃ ০৩/১২/২০১২, সংবাদের শিরোনামঃ তুরস্ক ও স্পেনে বিক্ষোভ সমাবেশ: যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে রাজনীতির খেলা খেলছে সরকার]

উপরের এমন বক্তব্যের উদাহরণ আসলে শত শত। গত ৬ টি বছর বিচার চলাকালীন সময়ে এমন অসংখ্য বক্তব্য, প্রেস রিলিজ কিংবা সভায় আলোচিত হওয়া বক্তব্য আমাদের সামনে এসেছে। এসব সব যদি একটা একটা করে এখানে দিতে যাই তবে হয়ত এই বইয়ের কলেবর আশংকা জনক আকারে বেড়ে যাবে যেটি এই বইটির উদ্দেশ্য নয় একেবারেই। উপরে যে বক্তব্যগুলো আমরা পেয়েছি এটি মূলত এই ট্রাইবুনালে অভিযুক্তদের পক্ষের কিংবা খোদ অভিযুক্তদের বক্তব্যের সারমর্ম। কথা একটাই যে- “এই অভিযুক্ত ব্যাক্তিরা একদম নিষ্পাপ। একাত্তর সালে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে তারা কোনো রকমের সমর্থন দেয়নি এবং সে সময়ে কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক অপরাধের সাথেও তারা সম্পৃক্ত নয়। এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যে বিচার হচ্ছে এটি স্মপূর্ণ প্রহসন ও ইসলাম ও ইসলামী আন্দলোনকে ধংসের পাঁয়তারা” 

ঠিক একই অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তানের জামায়াত, সে দেশের রাজনৈতিক নেতারা। একাত্তরের ঘাতক কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়ে যাবার পর খোদ পাকিস্তানের সংসদে শোক প্রস্তাব গ্রহন করা হয় একজন খুনীর জন্য। শুধু তাই নয় পাকিস্তানের একাধিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই বিচার ও দন্ডের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের সরকারকে হুমকিও প্রদান করেছে। পাকিস্তানের জামাতী ইসলাম তো রীতিমত বাংলাদেশে আক্রমণ করবার জন্য পাকিস্তান সরকারকে আহবানও করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে থেকে বার্তা আসে-

“Islamabad, November 22, 2015 (PPI-OT): We have noted with deep concern and anguish the unfortunate executions of the Bangladesh National Party Leader, Mr. Salauddin Quadir Chowdhury and Mr Ali Ahsan Mojaheed. Pakistan is deeply disturbed at this development”

পাকিস্তানের এই শোক প্রকাশ শুধু কাদের মোল্লার ক্ষেত্রেই থেমে থাকেনি বরং এই ট্রাইবুনাল থেকে যতটি রায় হয়েছে, যতটি দন্ড কার্যকর হয়েছে তার প্রত্যেকটিতেই পাকিস্তান তার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা তাদের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে কোন রকমের রাখ-ঢাক না করে। পাকিস্তান জামায়াত বার বার বলেছে যে যাদের বিচার আজ বাংলাদেশ করছে এরা সবাই হচ্ছে ইসলামী আন্দলোনের নেতা এবং পাকিস্তানকে বাঁচাতে চাইবার জন্যই আজকে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে।

শুধু যে বাংলাদেশে কিংবা পাকিস্তানে এইসব অভিযুক্তের পক্ষে এই ধরনের “ইসলামের শক্তিদের শেষ করে দিচ্ছে” জাতীয় রব উঠেছে তা নয় বরং পৃথিবীর অনেক বড় বড় মিডিয়াতেও কিন্তু এদের দন্ড কার্যকর কিংবা রায়ের সংবাদ দিতে গিয়ে বার বার কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করছে যেটির মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে “ইসলামী চিন্তাবিদ” “ইসলামিস্ট রাজনীতিবিদ” ইত্যাদি। বৈশ্বিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কাজ করে বলে আমি মনে করি। 

প্রথমত, এই বৈশ্বিক মিডিয়ার অধিকাংশ এই স্বাধীনতা বিরোধীদের লবিং এর আওতার মধ্যে এসেছে অনেক আগেই। এই অংশের লেখার শুরুতেই তা বলেছি। হয়ত ব্যাপারটা শুনতে খানিকটা অদ্ভুত মনে হতে পারে এমন ভেবে যে তাই বলে সারা পৃথিবীর মিডিয়াকে কিনে নিয়েছে এই অভিযুক্তদের দল কিংবা তাদের ফাইনান্সার রা? আসলে ব্যাপারটি এমন নয়। 

আগেই বলেছি এইসব অভিযুক্তদের অর্থ যোগানদাতা, তাদের স্টেকহোল্ডাররা পৃথিবী বিখ্যাত লবিস্ট ফার্মগুলোকে নিয়োগ করেছে এই বিচারের ব্যাপারে নেতিবাচক তথ্য ছড়াবার জন্য। যেমন অনেকেই জানেন যে অভিযুক্ত মীর কাশেমের ছেলে বিচার শুরুর আগেই তার বাবার জন্য আমেরিকার একটি লবিইস্ট ফার্ম “ক্যাসিডি এন্ড এসোসিয়েটস” কে নিয়োগ দেয় তার বাবার হয়ে বাংলাদেশের এই ট্রাইবুনালের বিরুদ্ধে ও তার বাবার বিচারের বিরুদ্ধে লবিং করবার জন্য। 

এই লবিস্ট ফার্মগুলো কিভাবে কাজ করে সেগুলো যদি আমরা একটু গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাই যে এই ফার্মগুলোর সত্বাধিকারী কিংবা পরিচালনা পর্ষদের প্রধান কিংবা শেয়ারহোল্ডার রা মূলত সকলেই নাম করা সাবেক রাজনীতিবিদ। যার মধ্যে সিনেট সদস্য রয়েছে, মন্ত্রী রয়েছে, আমলা রয়েছে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা রয়েছে।

এটা কোনো ছোটো খাটো ব্যবসা নয়। এই ধরনের লবিস্ট ফার্মগুলোর মূল কাজই হচ্ছে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন মিডিয়া গ্রুপ গুলোর সাথে যোগাযোগ রাখা, অর্থের বিনিময়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে অনুষ্ঠানের জন্য সময় বরাদ্দ নেয়া, পত্রিকাগুলোতে নিবন্ধ, প্রবন্ধ, আর্টিকেলের জন্য স্থান নেয়া ইত্যাদি। এসব প্রত্যেকটি-ই প্রচুর অর্থের ফলে সম্ভবপর হয় এবং যেই অর্থের ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতা বিরোধীদের কোনো ঘাটতি নেই।

দ্বিতীয়ত, উপরে বলা আরেকটি ব্যাপার রয়েছে যেটিকে আসলে পশ্চিমের দীর্ঘদিনের বৈশ্বিক পলিসির অংশ। নামের সাথে ইসলাম আছে এবং সেই দলটি কোনো মন্দ কাজে শাস্তি পাচ্ছে এই পুরো ব্যাপারটি সারা পৃথিবীতে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে প্রচারের ভেতর একটা সুক্ষ্ণ রাজনৈতিক গন্ধ আছে। একজন মুসলিম নাগরিক ধর্ষন করেছে, হত্যা করেছে এই ব্যাপারটিতে খুন বা হত্যা যেখানে প্রধান হয়ে দেখা দেবার কথা সেখানে পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে পুরো ব্যাপারটি হচ্ছে “একজন মুসলিম” এই হত্যা বা ধর্ষন করেছে। 

এই ধরনের প্রচারণা আসলে অনেকটা ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের এক ধরনের প্রমাণ দেবার মত ঘটনা পশ্চিমের মিডিয়ার কাছে। সুতরাং এই অভিযুক্তদের অধিকাংশ-ই যেহেতু জামাতী ইসলামের সদস্য বা নেতা সুতরাং পশ্চিম তার নিজস্ব স্ট্র্যাটেজিতে এই ধরনের সংবাদ প্রচারণা পদ্ধতি বেছে নেবে তাতে খুব বেশী অবাক হবারও কিছু নেই। এই ট্রাইবুনালে জাতীয় পার্টির একজনের ফাঁসীর আদেশ হয়েছে, আওয়ামীলীগের সাবেক এক কর্মীর ফাঁসী হয়েছে।

এইসব ফাঁসীর খবরে বৈশ্বিক মিডিয়া কিন্তু এমনভাবে বলছে না যে “জাতীয় পার্টির আদর্শে অনুপ্রাণিত একজনের ফাঁসী” কিংবা “আওয়ামীলীগ সমর্থিত ও সে আদর্শে বিশ্বাসী ব্যাক্তির ফাঁসী”। এইসব টার্মগুলোর মধ্যে যেটিতে দর্শক চাহিদা, পাঠক চাহিদা রয়েছে কিংবা যেটির প্রচারে ওই ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের একটা প্রলেপ রেখে যাওয়া যায় পশ্চিমের মিডিয়া সেটিই আগ্রহ ভরে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে।

এগুলো ছাড়াও প্রশ্ন আসতে পারে যে আসলেই কি এইসব অভিযুক্তরা নিজেদেরকে ইসলামের পক্ষের কিংবা সুনির্দিষ্টভাবে ইসলামী ঘরানার একজন হিসেবে নিজেদের পরিচিত করতে পেরেছে? যদি বলি সাধারণ জনতার কাতার থেকে উত্তরটি কি হতে পারে, তবে বাস্তব উত্তর হচ্ছে, “হ্যাঁ পেরেছে”।

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দালাল আইনে বিচারের পুরো অংশটি ছিলো মূলত ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। এরপর সে বিচার আর হয়নি বরং ১৯৭৫ এর ৩১ শে ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল হয়ে যাবার পর এই বিচার আসলে বাস্তবিক অর্থে শেষই হয়ে যায়। ৭৫ পরবর্তী পট পরিবর্তনের ফলে আমাদের এই বাংলাদেশে এই স্বাধীনতাবিরোধীরা নানাভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেটি অর্থনৈতিক ভাবেও সত্য এবং রাজনৈতিকভাবেও সত্য।

আমরা সচেতন যারা আছি তারা হয়ত জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী কিংবা মুসলিম লীগের রাজনীতি সম্পর্কে জানি বলেই বলি যে এগুলো হচ্ছে রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকতে ইসলামকে ব্যবহার। কিন্তু ১৭ কোটির এই বাংলাদেশে বাস্তব চিত্র আসলে অন্য রকম। একটু প্রান্তিক কিংবা শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে মানুষ জামাতে ইসলামী বা এই জাতীয় ধর্মীয় ফ্লেভার আছে দলকেই মূলত ইসলামের দল বলে মনে করে। 

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদশের বাস্তবতা হচ্ছে ভোটের আগে গ্রামের অনেকেই বিশ্বাস করে জামাতকে ভোট দিলে বেহেশতের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। ধর্ম নিয়ে সচেতন হলে হয়ত এ ব্যপারটি হতোনা এই দেশে কিন্তু ধর্ম সচেতনতার পরিবর্তে এই জাতি হয়ে গেছে ধর্মভীরু আর নিজেকে ধর্মভীরু মুসলমান বলতেও এই অঞ্চলের মুসলমানরা নিজেকে গর্বিত মনে করে। 

সুতরাং এই ধর্মভীরু জাতি একটা পর্যায়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সকল চিন্তাকে ছাপিয়ে চিন্তা করবে মৃত্যুর পর কি করে বেহেশত বা অপার শান্তির জীবন খুঁজে পাওয়া যায়। আর এই মনের ভেতরের এই ইচ্ছেই আসলে বাংলাদেশের অনেক মানুষকে এমন স্টেরিওটাইপড রাজনৈতিক চিন্তা করতে শেখায় আর ফলশ্রুতিতে একটি রাজনৈতিক দলের নামের সাথে ইসলাম থাকলেই সেই রাজনৈতিক দল হয়ে উঠে ইসলামের কান্ডারী।েইভাবেই সাধারণ মানুষ ভাবতে শুরু করে।

২৮ শে ফেব্রুয়ারী ২০১৩ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ এ অভিযুক্ত দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে ফাঁসীর দন্ড দেবার ফলে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যে তান্ডব হয়েছে সেটি তো এত দ্রুত ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। সে সময় সবচাইতে ভয়াবহ যে ব্যাপারটি ঘটেছে সেটি হচ্ছে কিছু গ্রামাঞ্চলের মানুষ বলা শুরু করলো যে তারা চাঁদের গায়ে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ছবি দেখতে পেয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে নাকি সাঈদী হাসছে। ধর্মীয়ভাবে কতটা নির্বোধের মত চিন্তা করলে এই ধরনের আজগুবি রটনা একটি দেশে রটতে পারে তা বলা বাহুল্য মাত্র।

মুসলিম আইডেন্টিটি ব্যতিরেকে বাইরের রাজনীতি ও সেটি থেকে প্রাপ্ত সুবিধা

কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই বাংলাদেশে শুধু এই ইসলামিক আইডেন্টিটি বা পরিচয়-ই কি এইসব অভিযুক্তদের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে কাজ করেছে নাকি অপরাধ থেকে মুক্ত হতে রাজনৈতিক আরো নানা সমীকরনও এইসব ঘাতকদের রক্ষাকবচ হিসেবে সামনে এসে গেছে? 

যদিও এই ইসলামিক আবরণকে গায়ে চাপিয়ে একটা বড় ফায়দা এই অভিযুক্তরা নিয়েছে কিন্তু তথাপিও কিছু বাস্তবিক রাজনৈতিক প্রাপ্ত সুবিধা, যেটিকে অনেকটা “মুফতে পাওয়া” বলে অভিহিত করলেও অত্যুক্তি হয় না সেগুলোও এই ক্ষেত্রে আলোচিত হওয়া জরুরী। আমাদের এটাও খতিয়ে দেখা জরুরী যে কেন এই অভিযুক্তদের প্রতি সামান্য হলেও এই বাংলাদেশে সমর্থন রয়েছে? এই সমর্থন কি পুরোপুরি মুসলিম আইডেনটিটি ব্যবহার করে জনতার কাছ থেকে কোনো করুনা কিংবা এই সুনির্দিষ্ট পরিচয়ের ফলে জনতার পক্ষ থেকে “বিপ্লব” হিসেবে পাওয়া? তৎকালীন সময়ে দালাল আইনে চলয়াম বিচার বন্ধের ক্ষেত্রে কি এই ইসলামিক আইডেনটিটির সাথে সাথে অন্য কোনো নিয়ামক কাজ করেছে? তাই এই প্রশ্নগুলোর প্রেক্ষিতে তার জবাব খোঁজা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই আমি মনে করি।

এটি নিয়ে আলোচনা করবার পরই আমরা আসলে দেখব যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দাঁড়িয়ে এইসব অভিযুক্তরা তাদের বিচারের ব্যাপারে কি বলেছে আর মাননীয় আদালত-ই বা কি পর্যবেক্ষন দিয়েছেন।

আমি আমার পূর্বের অনেক লেখাতেই ১৯৭২ সালে যখন সর্ব প্রথম দালাল আইনে রাজাকার-আলবদরদের বিচার হয়েছিলো সে বিচারের নানা প্রাসঙ্গিক কথন আপনাদের সামনে হাজির করেছিলাম। সে সময়কার বিচারটা ছিলো এমন একটা সময় যখন মুক্তিযুদ্ধের দগদগে স্মৃতি আর ভয়াবহতার কথা শরীরে আরো তাজা হয়ে লেগে ছিলো। তার মানে এই নয় যে এখন আর সেটি তাজা নয়, কিন্তু সময়ের ক্রম বিবেচনা করলেও সে সময়কার স্মৃতি অনেক বেশী কাছাকাছি ও নৃশংসতাকে আরো বেশী স্পস্ট করে তোলে।

মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পর পর এই দালাল আইনে বিচারের সময় জামাতী ইসলামী, নেজামী পার্টি, মুসলিম লীগ সহ যে যে দলের মধ্য থেকে রাজাকার, আলবদর তথা ঘাতকেরা মূলত উঠে এসেছিলো সেসব দল কিংবা দলের সদস্যরা তখন কেউ ছিলো পালিয়ে কিংবা কেউবা বিচারের জন্য অপেক্ষমান হয়ে জেলে আটক ছিলো। মূলত সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীদের মধ্যে অধিকাংশ বাংলাদেশী এই বিচারের পক্ষে ছিলো এবং এটাই সে সময় স্বাভাবিক ছিলো। স্বাভাবিকের থেকে সবচাইতে বড় ব্যাপার ছিলো যে কোনো অপরাধ রাষ্ট্রের ভূ-খন্ডে হলে এটা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের উপরেই গিয়ে বর্তায় সে অপরাধের ন্যায্য বিচার করবার জন্য।

লক্ষ্য করে দেখবেন আমি উপরে একটি শব্দ ব্যবহার করেছি। শব্দটা হচ্ছে “অধিকাংশ” । আমি বলেছি অধিকাংশ বাংলাদেশী-ই এই বিচারের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ শব্দটা ব্যবহার করবার ফলে যে ব্যাপারটি প্রশ্ন হয়ে আপনার সামনে দাঁড়াবে এইভাবে যে, তাহলে কি এই অধিক-অংশের বিপরীতে যে কম অংশ থেকে গেলো তারা এই বিচার সমর্থন করেনি? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। করেনি। ১৯৭২ সালে দালাল আইনে বিচার শুরু হলেও এই সময় বাংলাদেশের একটা অংশ, সেটি সংখ্যায় কম হলেও বিচারকে সমর্থন করেনি।

আপনার মাথাতে প্রশ্ন এখন আসবেই কিংবা আপনি হয়ত খুব বিষ্মিত হবেন এবং বলবেন কেন সমর্থন করেনি? আপনার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে এখন আমাকে দর্শনের পথে যেতে হবে। কিন্তু দর্শনের পথে না গিয়েও একেবারে সাধারণ একজন নাগরিকের চোখেও এটির উত্তর দেয়া যেতে পারে। 

মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে আগে যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিলো তৎকালীন পাকিস্তানে, সে নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরংকুশ ভাবে দুই পাকিস্তানের মধ্যে জয়ী হলেও এই বাংলাদেশ ভু-খন্ডে কিন্তু দুইটা নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামীলীগ জিততে পারেনি। আবার যেগুলোতে জিতেছে সেই নির্বাচনী আসনে আওয়ামীলীগ যে প্রত্যেকটা ভোট পেয়ে জয় লাভ করেছে, তাও নয়। প্রতিটি সিটেই আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে ভোট ছিলো। আবার এগুলোর সাথে সাথে সে সময়ে জামাত, নেজামে পার্টি, মুসলিম লীগ, পিডিবি সহ নানাবিধ রাজনৈতিক দলের কিছুটা হলেও কর্মী বা সমর্থক ছিলো যারা সে সময়ে আওয়ামীলীগের পক্ষে ছিলোনা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই আওয়ামীলীগের পক্ষে না থাকলেই কি একাত্তরের ওই নৃশংস হত্যাকান্ডকে সবাই সমর্থন করেছে? এই কথার উত্তরও হচ্ছে, না, ব্যাপারটা সে রকমও নয়। কিন্তু উপরে উল্লেখিত ওই রাজনৈতিক দলের মূলত সবাই এবং সেই ভোট না দেয়া অংশের একটা বৃহৎ অংশ সেই হত্যাকান্ডের পক্ষে ছিলো। এদের মধ্যে কেউ সরাসরি কিংবা পরোক্ষ ভাবে জড়িত ছিলো এবং বাকীরা সমর্থন করলেও প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে একাত্তরের হত্যাকান্ডে হয়ত জড়িত ছিলোনা।

এখন ১৯৭২ সালে যখন দালাল আইনে বিচার শুরু হোলো তখন প্রাক মুক্তিযুদ্ধকালীন সেইসব বিরোধী ব্যাক্তিরা ও তাদের পরিবার এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার-আলবদর ও তাদের পরিবার তো বাংলাদেশেই অবস্থান করছিলো। তাহলে এই লেখার এই পর্যন্ত এসে একটা রেখা টানা গেলো যে, পোস্ট মুক্তিযুদ্ধের পরেও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী একটা শক্তি, সেটা সংখ্যায় নগন্য হলেও বাংলাদেশে ছিলো। সুতরাং বিচার যখন সেই ১৯৭২ সালেই শুরু হলো তখন এই নগন্য অংশটাই কিন্তু মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। 

যে কোনো অপরাধী-ই তার অপরাধকে তার নিজের পক্ষ থেকে সঠিক মনে করে। একজন খুনী খুন করবার পর তার যুক্তি থাকতে পারে যে তার সে সময় মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো কিংবা অমুক কারনে সে খুন করেছে, তমুক কারনে করেছে। খুনী তার ডিফেন্স দিতে গিয়ে নানা ধরনের যুক্তি হাজির করবে, এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক। কিন্তু নৈর্ব্যত্তিক চোখে একজন রিজেনেবল মানুষ কিভাবে এই অপরাধকে সূচিত করবে এটাই আসলে শেষ পর্যন্ত বিবেচ্য। আজকের প্রসঙ্গ যদিও সেটি নয় কিন্তু এটাও সত্য যে এই অপরাধীরা তাদের পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছে সেটা কিন্তু সেই অপরাধীদের পরিবারও সমর্থন দিয়েছে যার ফলে এই হত্যার পক্ষে একটা সমর্থন কিন্তু লক্ষ্য করে দেখেন দাঁড়িয়ে গেলো আর সেটি অল্প করে হলেও।

ঠিক মুক্তিযুদ্ধের পর পর এই দালাল আইনে বিচারের সময়েও যে প্রারম্ভিকভাবে এক লক্ষ লোকের মত ধরা হোলো তারা কিন্তু বাংলাদেশেরই সন্তান। এই দেশেই জন্ম। এখন লক্ষ্য করে দেখেন যে, যেই এক লক্ষ লোককে গ্রেফতার করা হোলো সেই এক লক্ষ লোকের প্রতিজনের পক্ষে নুন্যতম যদি দুইটা করে পরিবারে সদস্যও থাকে তাহলে এই অপরাধীদের পক্ষে সাফাই দেবার জন্য কতজন দাঁড়িয়ে যায়? সংখ্যাটি দাঁড়ায় দুই লক্ষ। আমি তো কম করে ধরেছি, সত্যকার হিসেব আসলে সংখ্যাটি আরো বেশী হতে পারে। এবার এই দুই লক্ষের বাইরে আরো কিছু আছে যারা একাত্তরে রাজাকারদের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে কিন্তু অপরাধের সাথে যুক্ত ছিলোনা। এই অংশের সংখ্যা কেমন? যদি ধরি আরো এক লক্ষ তাহলে সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় তিন লক্ষে।

একটা দেশের একটা ন্যায্য বিচার চলাকালীন সময়ে যদি ৩ লক্ষ লোক তাদের রাজনৈতিক কারনে ও পারিবারিক কারনে অন্যায্যভাবে একটা বিচারের বিরোধীতা করে কিংবা অষন্তোষ প্রকাশ করে তবে সেটি কিন্তু আপনার নজরে আসবেই। সুতরাং এই প্রেক্ষিতে একটা যুক্তি দাঁর করানো গেলো। 

এইবার আমি আসি এই যে সমর্থকের কথা বলেছি উপরে সেটির বাইরেও দেশের সে সময়কার কিছু বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদ তাদের ভূমিকা কি ছিলো। সে সময়ে খান এ সবুর, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চোউধুরী, শাহ আজিজ, এম এ মালিক সহ আরো অনেক ব্যাক্তির বিচার চলছিলো। প্রাক মুক্তিযুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের দুইটি বছর আগেও কিন্তু এক সময়ের এই ডাকসাইটে রাজনীতিবিদেরা বাংলাদেশের ভূখন্ডে রাজনীতি করেছে, তাদের একটা সমর্থক গোষ্ঠী ছিলো সুতরাং এদেরও একটা সমর্থক কিন্তু এই বিচারের বিরুদ্ধে ছিলো। যারা সেই তখনই ধোঁয়া উঠিয়েছিলো যে বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার জন্য এই খান এ সবুর, মালেক, ফকাদের বিচার করছে।

দালাল আইনে গ্রেফতার হওয়া অনেকেই যেমন একেবারেই অশিক্ষিত, নিম্নবিত্ত কিংবা পয়সার লোভে রাজাকার হয়েছিলো ঠিক একই দিকে গ্রেফতার হওয়া অসংখ্য ব্যাক্তিরা ছিলো সমাজের বেশ প্রভাবশালী মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের প্রতিনিধি। যেমন বড় বড় শিল্পপতি, মন্ত্রী, সরকারী আমলা, বিশ্ব বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক, ব্যাবসায়ী, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের চাকুরীজীবি, প্রভাবশালী স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদ ইত্যাদি। দেখা গেলো এদের একটা বড় অংশের পলিটিকাল কানেকশান, অর্থ কড়ির ব্যাপ্তি সুবিশাল। এই ধৃত প্রভাবশালী একটা অংশ একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক ভাবে লবিং করবার ক্ষমতা রাখত, ঠিক তেমনি খোদ আওয়ামীলীগ সরকারের একটা তীব্র ডান পন্থী অংশের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখত।

আরেকটা ব্যাপারও এখানে খুব উল্লখ্য যে, ৭২ পূর্ব রাজনীতিবিদের অনেকেই তীব্র পাকিস্তানপন্থী থাকলেও এদের সাথে পাকিস্থান বিরোধী রাজনীতিবিদদের একটা সখ্যতা কিংবা পলিটিকালি কার্টেসি মেইন্টেন করবার একটা প্রবণতা ছিলো। রাজনীতির ময়দানে এদের একটা ভূমিকা ছিলো। প্রাক মুক্তিযুদ্ধ অবস্থায় এইসব রাজনীতিবিদ দেশীয় বিভিন্ন দাবি দাওয়ার সংগ্রামে এক সাথেই রাজপথে ছিলো। যেমন খান এ সবুর খান কিংবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ভালো সম্পর্ক ছিলো মুক্তিযুদ্ধের আগের রাজনৈতিক অবস্থায়। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই যখন তারা মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষনা করলো তখন এইসব রাজনীতিবিদদের ভাগ্য মূলত পুরোপুরিই ঘুরে গেলো। তথাপিও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় তারা যখন গ্রেফতার হোলো তখন দেখা গেলো বঙ্গবন্ধু সরকারের ভেতর ডানপন্থী যে এলায়েন্স ছিলো এরা বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে লবিং করা শুরু করলো কুখ্যাত রাজাকার-আলবদরদের ছেড়ে দেবার তদবির করে। এই অংশটাই দেখা গেলো বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পেছনে অন্যতম বড় ষড়যন্ত্রকারী। 

খন্দকার মোশতাকের মত এমন অনেক আওয়ামীলীগ নেতা সে সময় বঙ্গবন্ধু সরকারের ভেতর উদার বামপন্থী অংশকে কোনঠাসা করে ফেলেছিলো। সেটির চিত্র আমরা বুঝতে পারি যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে পরে করা হয় অর্থ মন্ত্রী, তাঁর সম্পর্কে নানাবিধ কথা বলে বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করা হয়, বঙ্গবন্ধুর কাছে বিরাগভাজন করা হয় তাজ উদ্দিন আহমেদ এবং তাঁর চিন্তার অনুসারী নেতাদের।

আমার উপরের এই সব কথারই প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নৃশংস ভাবে হত্যা করবার পরবর্তী প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনলে। সে সময় আওয়ামীলীগের বড় বড় নেতারা বিশ্বাস ঘাতকতা করে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রী সভায় ঢুকে পড়ে এবং ধীরে ধীরে এই প্ররিক্রমায় দালাল আইনে আসামীদের বিচারের প্রক্রিয়া অস্তমিত হতে থাকে। যেমন আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন-১৯৭৩ তৈরীতে যিনি মূল ভূমিকা রেখেছিলেন, তৎকালীন আইনমন্ত্রী মোনোরঞ্জন ধর, ফনীভূষন মজুমদার সহ অনেকেই তখন মোশতাক মন্ত্রী সভায় শপথ নেন। সুতরাং সে সময়ে প্রভাবশালী আসামী, আওয়ামীলীগের ভেতর ষড়যন্ত্রকারী ডানপন্থী অংশ এই দালাল আইনে বিচারকে সুষ্ঠু ভাবে হতে না দেবার পেছনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। তা বলাই বাহুল্য মাত্র।

সেই সময়ে মাওলানা ভাসানীর ন্যাপের অনেকেই দালাল আইনে কারাগারে আটক ছিলো। মাওলানা ভাসানী তো রীতিমত বিচার বন্ধ করার জন্য আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডঃ আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন “স্বাধীনতাত্তোর দালালদের বিচার প্রক্রিয়াঃ একটি পর্যালোচনা” শীর্ষক তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধে লিখেন – “যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনে আওয়ামীলীগ সরকারের দূর্বলতার সুযোগে পাকিস্থান আমলই ভালো ছিলো এই প্রচার চালানো হয় এবং এ পর্যায়ে “মুসলিম বাংলা আন্দোলন” নামে একটি আন্দোলন বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশ-বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হয় । ধর্ম ভিত্তিক দলগুলো পিকিংপন্থী দলগুলোর সঙ্গে একত্রিত হয়ে দালালদের মুক্তির দাবী তোলে।

১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে নির্বাচনের প্রাক্কালে দালাল ও স্বাধীনতা বিরোধীদের সমর্থন পেতে ন্যাপ (ভাসানী) এবং আতাউর রহমানের জাতীয় লীগসহ আওয়ামী বিরোধী পিকিংপন্থী জোট নির্বাচনের আগেই দালালদের মুক্তি দাবী করে । এ সময় মাওলানা ভাসানী হুমকি দেন যে, ১৯৭২ সালের ৩১ শে ডিসেম্বরের মধ্যে দালাল আইন বাতিল না করলে তিনি দূর্বার আন্দলোন গড়ে তুলবেন”। শুধু এখানেই ভাষানী ক্ষান্ত হননি, একের পর এক তিনি কর্মসূচি দিয়ে গিয়েছিলেন এই বিচার বন্ধ করবার জন্য। এই বিচারকে তিনি অভিহিত করেছিলেন প্রহসন হিসেবে। উল্লেখ্য যে এই দালাল আইনে তখন ভাষানীর দলের অনেক নেতা কর্মী মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা অপকর্মে আটক ছিলো।

আবার সে সময়ে আইন শৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা কি ছিলো সেগুলো নিয়েও আমাদের একটু কথা বলা দরকার। দালাল আইনের বিচারের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা ছিলো পুলিশের। একজন পুলিশ অফিসারের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে একটি মামলায় আসামীর জামিন হওয়া কিংবা না হওয়া থেকে শুরু করে মামলার একটা বড় অংশ নির্ভর করত পুলিশের ওপরেই। 

সাধারণত দালাল আইনে আটকদের ৬ মাসের ভেতর জামিন দেবার ব্যাবস্থা ছিলো না কিন্তু এই ব্যাবস্থার মধ্যেও যদি পজিটিভ পুলিশ রিপোর্ট আনা যেতো তাহলে সেটির উপর ভিত্তি করেও জামিনের ব্যাবস্থা ছিলো। সুতরাং এই সময়ে একজন পুলিশ অফিসার যদি তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অসৎ ভাবে আসামী থেকে ঘুষ খেয়ে মিথ্যে তথ্য দেয় কিংবা আসামীর পক্ষে কাজ করে সেক্ষেত্রে আইন অসহায় হয়ে পড়ে। 

এই বিষয়ে একটা তথ্য দেই- ২০ শে জুলাই ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার একটি খবরের দিকে নজর দেয়া যাক। এই সংবাদের শিরোনাম ছিলো এমন – “পুলিশ রিপোর্ট এর ফাঁক দিয়ে দালালরা বেরিয়ে আসছে”। এই রিপোর্টটির মূল বক্তব্য দাঁড়ায় এমন যে ১৯৭২ সালে দালাল আইনে বিচার চলাকালীন সময়ে কিছু অসৎ পুলিশ অফিসারের ব্যাপারে তীব্র প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এদের অনেকেই দালালদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলো, কেউ কেউ ব্যাক্তিগত পরিচয়ের সূত্র ধরে সুযোগ নিচ্ছিলো এবং এই অসৎ পুলিশ অফিসারদের মধ্যে বেশীরভাগ অর্থের বিনিময়ে দালালদের পুলিশ রিপোর্টে এমন ফাঁক ফোকর রেখে দিত এবং সেক্ষেত্রে মামলা দূর্বল হয়ে পড়ত। ১৯৭২ সালে দালাল আইনে খোদ ঢাকা থেকেই ১০০০ জনের মত গ্রেফতার করা হলেও শেষ পর্যন্ত পুলিশ রিপোর্ট দেয় মাত্র ১৯ জনের।

অনেকের ক্ষেত্রে রিপোর্ট দিলেও সেই রিপোর্টটি দিত এমন ভাবে যাতে করে পরে গিয়ে দেখা যায় যে অপরাধটি অত্যন্ত মাইনর কিংবা অপরাধের ধরন সুনির্দিষ্ট নয়। স্বাভাবিক ভাবেই দেখা যেতো এই রিপোর্টের উপর ভর করে আসামী জামিন পেয়ে যাচ্ছে কিংবা তার মামলা আসলে খারিজ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যেতো পুলিশ বলছে যে আসামীর অপরাধ সুনির্দিষ্ট নয়। স্বাভাবিক ভাবেই খালাশ পেয়ে যেতো আসামী। বন্ধ হয়ে যেতো তার মামলা।

উদাহরন হিসেবে ঢাকা জেলার কুখ্যাত দালাল, ফকিরাপুলের ফিরোজের কথাই ধরা যাক। পাক বাহিনীকে সাহায্য সহযোগিতা করবার অভিযোগে ফিরোজকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে তার জামিনের আবেদন করা হলে বিচারক ফিরোজের পুলিশ রিপোর্ট এবং ফাইল চেয়ে পাঠান। দেখা যায়, পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী ফিরোজের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। সুতরাং জামিন পেয়ে যায় সে। কিন্তু পরের দিন-ই যখন পত্র-পত্রিকাতে তাকে নিয়ে, তার অপরাধ নিয়ে তুমুল ভাবে লেখালিখি হয় তখন পুলিশ আবার তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। 

একটি সময়ে যখন বিচারক আবার ফিরোজের ফাইলটি চেয়ে পাঠায় তখন দেখা গেলো ফিরোজের বিরুদ্ধে দেয়া পুলিশের রিপোর্টটিই নেই আর। জামিন পুন;র্বিবেচনার কথা উঠবার সাথে সাথেই রিপোর্ট গায়েব হয়ে গেছে। এটা শুধু একটা উদাহরন দিলাম। ১৯৭২ সালের যেই সময়ে সারা দেশ থেকে এভাবে দালালদের গ্রেফতার করা হচ্ছিলো তখন এমন অনেক অসৎ পুলিশ অফিসার এমন ভূমিকা রেখেছিলো এই পুরো ব্যাপারটিতে। [সূত্রঃ একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার, প্রথম প্রকাশ ১৯৯০, লেখকঃ মোশতাক হোসেন]

এই ছাড়াও কিছু বুদ্ধিজীবি যেমন নির্মল সেন, আবুল মনসুর আহমদ এই দালাল আইনের বিরোধীতা করেছিলেন দেশকে বিভক্তিতে ঠেলে দেয়া হচ্ছে এই কথাটা বলে। সে সময়ে তারা এই নিয়ে একের পর এক পত্রিকায় কলাম লিখতে থাকেন আর বিচার বন্ধে চাপ দিতে থাকেন। আবুল মনসুর তার লেখা বই আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর গ্রন্থেও এই বিচার নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন। ১৯৭২ আইনে দালাল আইনে দালালদের বিচারের সরাসরি বিরোধিতা করে এই বিচারের পক্ষে তিনি যে ছিলেন না সেটা স্পস্ট ভাবেই প্রকাশ করেছেন। এই প্রেক্ষিতে আমি রেফার করছি আবুল মনসুর আহমদের “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” বইটির ৬০৭ নাম্বার পৃষ্ঠা। যে অংশের শিরোনাম হচ্ছে “চাঁদে কলংক”। এই অংশটি যদি আমরা পাঠ করি তবে জানতে পারব যে আবুল মনসুর আহমদ খুবই স্পস্ট ভাবে এই মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের বিপক্ষে ছিলেন। ইনফ্যাক্ট এই আইন করে বিচার করাকে তিনি অভিহিত করেছিলেন সর্বগ্রাসী ও মারাত্নক হিসেবে। দালাল আইনে বিচারটাই যেখানে তিনি চান নি সেখানে তিনি আবার এই আইনের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন “দালাল আইনে ফাঁক ছিলো অপঃপ্রয়োগের” 

মুক্তিযুদ্ধের পরের ঠিক মাত্র কয়েক মাসের মাথাতেই যদি এই ক্ষুদ্র একটা অংশ সেই সময়েই বিচারের এই রকমের নানাবিধ বিরোধিতা করতে পারে তাহলে প্রায় ৩৯ বছর পরে (১৯৭২ এর পর ২০১০ সালে বিচার শুরু হয়েছে বিবেচনায়) তো সেই বিরোধিতা আরো প্রকট হবেই। কেননা এই ৪ দশকে এইসব বিরোধীতাকারীরা তাদের রাজনৈতিক দলকে সু-সংহত করেছে, তাদের ছেলে মেয়েদের বাংলাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থানে, চাকুরীতে তথা প্রতিটি স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের একটা বড় সমর্থক গোষ্ঠী আস্তে আস্তে গড়ে তুলেছে, বাংলাদেশের মূল রাজনীতিতে ধর্মের নাম দিয়ে কিছু মানুষের কাছে চলে এসেছে, তরুন আর যুবকদের ভুল শিখিয়েছে। তাদের বুঝিয়েছে যে একাত্তরের ভূমিকা ছিলো কেবল মুসলিম বিশ্বকে কিংবা ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্য। অন্য কিছু নয়। 

আবার এই এতসব কিছুর পর গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বি এন পি। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োজনে বাংলাদেশের একটা বড় রাজনৈতিক দল এই রাজাকার-আলবদরদের পরিপূর্ণভাবে সহায়তা করেছে ঠিক যেভাবে করেছিলো ৭৫ পরবর্তী সময়ে জিয়া এবং তার পরে এরশাদ।এইভাবে একটা বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থনে আর পশ্রয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই বিচারের বিরোধীর সংখ্যা বাড়বেই। ১৯৭২ সালে যদি অমন অবস্থা হতে পারে তাহলে ২০১৫ সালে তো সেটা চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়বেই। এই সময়ে কি এই ঘাতকেরা বসে ছিলো? তারা তো নিজেদের অপকর্মকে লুকোবার জন্য ধর্ম, রাজনীতি, অর্থের একটা বর্ম তাদের আশে পাশে তৈরী করে রেখেছিলোই।

উপরে যা কিছু বর্ণনা করেছি তার প্রতিটি বিষয়ে একটা প্রভাব পড়বেই তাদেরই গড়া নতুন প্রজন্মের প্রতি। এরা শুরু থেকেই জেনে এসেছে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই লোকগুলো ঘাতক নয়, এরা অপরাধ করেনি। ফেসবুকের এই প্রজন্মে এই “কিছু অংশ” কিংবা একটা “বড় অংশ” বই পড়েনা, ইতিহাসের প্রতি তাদের আগ্রহ নেই বললেই নেই। 

এখন এই দায় কার সেটি নিরূপন আমি করব না, সেটি করতে গেলে অনেক বড় আরো একটি লেখা লিখতে হবে। কিন্তু এটা বলা অনস্বীকার্য যে এই বিভ্রান্ত প্রজন্মটি এখন শাহবাগের মত একটি ন্যায্য আন্দলোনকে ঘৃণা করছে বাপ দাদাদের যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে, শহীদ জননীর গণ আন্দলোনকে তারা ঘৃণা করে, তারা আমাদের এই বিচারের দাবীকে অস্বীকার আর বাতিল বলে মনে করে। তারা এই পুরো ব্যাপারটাকেই রাজনৈতিক প্রহসন মনে করে কিংবা মনে করে এই বিচার হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে নির্মূল করবার জন্য।

এই প্রহসন কিংবা “ইসলামকে ধ্বংস করবার জন্য” এই জাতীয় চিন্তার অনুরণ তারা অনুধাবন করবার প্রয়াস পেয়ছে এই বিচার নিয়ে পশ্চিমাদের একটা বড় প্রোপাগান্ডার কবলে পড়ে যেটা উপরে আগে বলে এসেছি। উপরে বলেছি এই অভিযুক্তরা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। সুতরাং ১০ কোটি বা ৫০ কোটি টাকা খরচ করে দু’জন কিংবা দশজন লবিস্ট কিনে ফেল আসলে এদের জন্য ডাল আর ভাতের ব্যাপার। 

এইসব লবিং মূলত অনেকটা গোয়েবলসীয় প্রচারের মতন। একটা মিথ্যাকে আপনি ৫০ বার বিভিন্ন ভাবে প্রচার করেন, দেখবেন আপনার মাথায় সেই মিথ্যেটাই সত্য হয়ে বাসা বাঁধবে। সুতরাং কেন এই তরুন অংশটি এই বিচারের বিপক্ষে গেলো বা এই বিচারের বিরুদ্ধে বলছে সেগুলো একটার সাথে আরেকটা খুবই স্পস্ট আকারে সম্পর্কিত।

সাঈদীকে যখন আদালতে তার নিজের বক্তব্য দেবার সুযোগ দেয়া হোলো তখন সুযোগ পেয়েই সাঈদী কিন্তু সারাটা বক্তব্য জুড়ে তার ধর্মীয় ট্রাম্প কার্ডটিই খেলেছে। এই বলয়ের মধ্য থেকেই সাঈদী কিংবা তার দল কৌশল সাজিয়েছে, ছক কষেছে। আর বাংলাদশের রাজনীতিতে সেই মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে প্রচারিত হয়েছে যে আওয়ামীলীগ হচ্ছে ভারত ঘেষা রাজনৈতিক দল। খোদ বেগম খালেদা জিয়া মন্তব্য করেছিলেন যে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে মসজিদে উলু ধনি শোনা যাবে। 

সহজ কথা হচ্ছে বাংলাদশের একটা বড় অংশ আজও মনে করে যে আওয়ামীলীগের হাতে ইসলাম ধর্মের খুব একটা প্রসার হয়না। এগুলো ভাব্বার পেছনে নানাবিধ রাজনৈতিক কারনও রয়েছে। রয়েছে নানাবিধ রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার খেলা। 

সুতরাং আওয়ামীলীগ আমলে এই বিচারকে কেন্দ্র করে “ইসলাম গেলো” “ইসলাম গেলো” মাতমটি সাধারণ জনতার জন্য একদ ধরনের কার্যকরী ব্যবস্থা-ই বটে।

সাঈদী আদালতে দাঁড়িয়ে তার ভাষনে বলে-

“বিশ্ববাসী জানে এই মামলাটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, আমি সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। আমার বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল মিথ্যা একদিন দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হবে। আল্লাহ যেন আমাকে ঈমানের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তৌফিক দেন। ধৈর্য্যরে সঙ্গে জালিমের জুলুমের মোকাবেলা করতে পারি এজন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। আমি কুরআনের ময়দানে ফিরে আসতে চাই। কুরআনের খেদমত করতে চাই। আল্লাহ যেন সে তৌফিক আমাকে দেন। মাননীয় বিচারপতি, সেদিন আপনি প্রথম হজ্ব করে এসেছেন। আপনার মাথায় টুপি ছিল। তখনও আপনার চেহারা থেকে হজ্জের নূরানী আভা মলিন হয়নি। সেদিন আমাকে এখানে আনার পর একজন সম্মানিত প্রসিকিউটর আমার নাম বারবার বিকৃত করে বলছিলেন। আমি আশা করেছিলাম আমার নাম বিকৃত না করার জন্য আপনি প্রসিকিউটরকে নির্দেশ দিবেন। কিন্তু আপনি সেটা করেননি। বরং আপনিও আদেশ দেয়ার সময় প্রসিকিউটরের সুরে সুর মিলিয়ে একই বিকৃত নাম বলেছেন। আমার সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, পার্লামেন্ট কোথাও কি এ রকম বিকৃত নামের উল্লেখ আছে, যে নাম প্রসিকিউটর উল্লেখ করেছেন। আমি সেদিনই বুঝেছিলাম যে, আমি মারাত্মক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। সূরা হুজুরাতের ১১ নং আয়াতে নামের বিষয়ে বলা আছে, চকোন মানুষকে বিকৃত নামে ডেকো না। তিনি বলেন, মাননীয় বিচারপতি, আপনি একদিন এখানে বলেছিলেন, আল্লাহ আমাকে একটি বিরাট দায়িত্ব দিয়েছেন। আসলেই তাই। বিচারপতির দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মহান। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস রয়েছে। যেখানে বলা হচ্ছে, আল্লাহর আরশের ছায়ায় সাত শ্রেণীর মানুষ আশ্রয় পাবে। তার মধ্যে ন্যায় বিচারকরা প্রথমেই রয়েছেন। আপনার (ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান) কাছে সেই ন্যায় বিচারই আশা করি। একজন বিচারপতির জবাবদিহিতা থাকে আল্লাহ তায়ালা এবং নিজ বিবেকের কাছে। এর বাইরে তৃতীয় কোনো স্থানে জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতা থাকলে ন্যায় বিচার করা যায় না। বরং সেটা জুলুম হয়ে যায়। আর জুলুমের পরিণতি জাহান্নাম।যারা এই অভিযোগনামা রচনা করেছে, যারা মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছে, যারা বাদী হয়েছে তাদের মনে আল্লাহর ভয় ছিল না, হাশরের ময়দানে রাসূলের (সা.) শাফায়াতের আশা ছিল না। তাদের পক্ষে এ কারণেই এ ধরনের চরম মিথ্যাচার সম্ভব হয়েছে। আমাকে জনসম্মুখে হেনস্থা করা, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা ইব্রাহীমের ৪৬ ও ৪৭ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ওরা ভীষণ ষড়যন্ত্র করেছিল, কিন্তু তা আগেই আল্লাহর কাছে লিপিবদ্ধ ছিল। আর ওদের সেই ষড়যন্ত্র এমন ছিল যে, তা বাস্তবায়িত হলে পর্বতসমূহ টলে পড়তো। সুতরাং এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা ভঙ্গ করবেন। বরং আল্লাহই বিজয়ী এবং চরম প্রতিশোধ গ্রহণকারী।একটি মিথ্যা রচনার ভিত্তিতে বিচার নামক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। এমন মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে আমার প্রতি বিনা অপরাধে আক্রোশমূলকভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত অবিচার করা হলে আল্লাহর আরশ কাঁপবে। আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে যারা এমন মিথ্যা প্রতিবেদন রচনা করেছে তাদের ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসবে। আমি সেই লানত দেখার অপেক্ষায় থাকবো।”

[সূত্রঃ নতুন বার্তা ডট কম, প্রকাশের তারিখঃ ২১/০৯/২০১৪, সংবাদের শিরোনামঃ রায়ে সন্তুষ্ট নন সাঈদী]

পুরো ভাষন জুড়েই সাঈদী নিজের অপরাধের কথা বলতে গিয়ে ইসলাম ধর্মকে সামনে নিয়ে এসেছে। একটা অপরাধ হবার সাথে সাথে বিচার না হলে যা হয় বাংলাদেশে মূলত তাই হয়েছে। অপরাধী নিজেকে প্রস্তুত করা ও প্রতিষ্ঠিত করবার শক্তি পায়। বাংলাদেশের পলিটিকাল স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী এই অভিযুক্তরা খেলেছে ধর্মীয় খেলা। মুক্তিযুদ্ধের পরে এইসব ঘাতকেরা প্রত্যেকেই রাতারাতি ধর্মের বেত্তা হয়ে উঠেছে, হয়ে গেছে ধর্মীয় চিন্তাবিদ। যে সাঈদী মুক্তিযুদ্ধের আগে ছিলো একটি মুদির দোকানের দোকানী সেই সাঈদী মুক্তিযুদ্ধের ৩৯ বছর পর বিচার শুরুর প্রাক্কালে হয়ে গেছে “মোফাসসিরে কোরান” আর নামের আগে বসিয়েছে “আল্লামা? অথচ আদালতই তার রায়ে বলেছে- 

On perusal of the papers submitted by the accused with the form filled up in the 9th Parliament Election of 2008, it is found that a part of his name “Abu Nayeem Mohammad” is cut off from his name and new names such as ‘Alamma’ and Sayeedi have been added with his name. In the same form he wrote his name “Allama Delowar Hossain Sayeedi and Signed it. It is alleged by the prosecution that after passing Alim Examination he did not receive any higher degree nor he obtained doctorate degree in any subject of Islam religion and as such he is not legally entitled to use the title ‘Allama’ or Maulana with his name. During the War of Liberation in 1971 the accused was a grocery shopkeeper, he used to sell oil, salt, onion and pepper at parerhat Bazar and as such his economic condition was not good. He could speak Urdu well as, he obtained ‘Alim’ from Madrasha. He welcomed the Pakistani Army at parerhat Bazar and formed local peace committee and subsequently as a member of Rajakar Bahini actively participated in the atrocities committed by Pakistani Army and Rajaker Bahini targeting civilians, Hindu Community and pro-liberation people. By adopting illegal means became a rich man and now he is the owner of huge properties including multistoried buildings in Dhaka and Khulna.



[সূত্রঃ প্রধান রাষ্ট্রীয় কৌঁশুলী বনাম দেলোয়ার হোসেন সাঈদী মামলার ট্রাইবুনালের রায়, প্যারাঃ ১৫]

আদালত সু-স্পস্ট ভাবে তার এই “আল্লামা” উপাধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং এটি যে প্রাপ্ত নথির ভিত্তিতে একটি ভুয়া উপাধি সেটি আদালতই তার রায়ে বলেছেন। সাঈদী তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের ক্ষেত্রে যে মুসলিম পরিচয়কে বার বার সামনে তুলে ধরেছিলো সে প্রেক্ষিতে আদালত খুব শক্ত একটা অবস্থানে দাঁড়ায় এবং খুব স্পস্ট ও শক্তিশালী বক্তব্য আমরা আদালত থেকে পাই। 

আদালত তাঁর রায়ের ২৪৪ নাম্বার প্যারায় বলেন (ট্রাইবুনালের রায়)

244. We should keep in mind an important aspect of the case that we are not holding the trial of an Ex-M.P. or Nayb-e-Amir of Jamat-e-Islam named Allama Delowar Hossain Sayeedi, a renouned Oazin who is popularly known as an Islamic orator through out the country for his gift of the gab. Now let us go back to 40/41 years while the struggle for Liberation War started in 1971. From the evidence on record we have found that accused Delowar Hossain Sayeedi had a very low profile having no significant social or political status in the society. He was simply a grocery shop keeper who used to sell oil, salt, onion, pepper etc. at Parerhat Bazar. His financial condition was not good. This trial is being held against that Delowar Hossain Sayeedi for the commission of crimes against Huminity alleged to have been committed by him about 41 years back at Parerhat area while he was a Potential Razakar as well as member of local Peace Committee.


এই বক্তব্যেই আসলে সাঈদী ও তার রাজনৈতিক দলের এতদিনের সকল ইসলামী ঢাল কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায়। যে সাঈদী মুক্তিযুদ্ধের পর পর “ইসলামী বক্তা” হয়েছে সেই সাঈদীর বিচার আদালতে করা হয়নি। বিচার করা হয়েছে ৭১ এর সাঈদীকে। যেই সাঈদী পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে একাত্ন হয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহন করেছিলো।

সাঈদীর মত এমন ধর্মীয় কার্ড ব্যবহার করেছে জামায়াতে ইসলামীর অভিযুক্ত সবাই। শতকার ৯৫ ভাগ মুসলমান যে দেশে সেই দেশ কিছু ইসলামী চিন্তাবিদ ও ইসলাম রক্ষাকারীদের শেষ করে দিচ্ছে বলে যে আহাজারি তার পুরো ব্যাপারটি অত্যন্ত করুনা মিশ্রিত হাস্যকর। 

যিনি এসব ধুয়ো তুলছেন তিনি যে আর উপায় অন্তর না দেখে বাংলাদেশীদের একেবারে দূর্বল ও আবেগের যায়গাতে নিয়ে খেলছেন সেটি বোধগম্য না হবার কিছু নেই। যখনই নিজের অপঃকর্ম ঢাকবার প্রয়জন হয়েছে তখনই ইসলামী পরিচয়ে ইত্যন্ত সুনিপুনভাবে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবের বিষয়টি হচ্ছে, আদালতের কাছে এর একটিও ধোপে টেকেনি।

ফাঁসীর দন্ডপ্রাপ্ত আসামী কাদের মোল্লাও একইভাবে নিজের পরিচয় হিসেবে সব সময়ই ইসলামী চিন্তাবিদ কিংবা ইসলাম রক্ষাকারী হিসেবে নিজেকে বার বার পরিচয় দিয়েছে। কখনো সেটি সরাসরি কখনো সেটি পরোক্ষভাবে। কাদের মোল্লার ফাঁসীর দন্ড যখন প্রায় কার্যকর হবার মুহূর্তে ঠিক তখনই সর্বশেষের একটি পূর্ব তৈরী করা খেলা খেলেছে এই কাদের মোল্লা। মিডিয়াতে সে পাঠিয়েছে তার “শেষ চিঠি” নামের একটি লেখা যদিও এটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে এটি আদৌ কাদেরের নিজের লেখা চিঠি নাকি তারই রাজনৈতিক দল জামাতের আরেকটি ধূর্ত চাল।

কাদেরের শেষ চিঠিটির কিছু অংশ এখানে দেয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। চিঠিটি আমি নিয়েছি আমারদেশ অনলাইন সংস্করণ থেকে। তারিখঃ ১৭ ডিসেম্বর ২০১৩।

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। প্রিয়তমা জীবন সাথী পেয়ারী,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আজ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর খুব সম্ভব আগামী রাত বা আগামীকাল জেলগেটে আদেশ পৌঁছানোর পরই ফাঁসির সেলে আমাকে নিয়ে যেতে পারে। এটাই নিয়ম। সরকারের সম্ভবত শেষ সময়। তাই শেষ সময়ে তারা এই জঘন্য কাজটি দ্রুত করে ফেলার উদ্যোগ নিতে পারে। আমার মনে হচ্ছে তারা রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করবে না। যদি করেও তাহলে তাদের রায়ের কোনো পরিবর্তন হওয়ার দুনিয়ার দৃষ্টিতে কোনো সম্ভাবনা নেই। মহান আল্লাহ যদি নিজেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন, তাহলে ভিন্ন কথা। অথচ আল্লাহর চিরন্তন নিয়মানুযায়ী সব সময় এমনটা করেন না। অনেক নবীকেও তো অন্যায়ভাবে কাফেররা হত্যা করেছে। রাসুলে করিম (সা.)-এর সাহাবায়ে কেরাম এমনকি মহিলা সাহাবীকেও অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। আল্লাহ অবশ্য ঐ সমস্ত শাহাদাতের বিনিময়ে সত্য বা ইসলামকে বিজয়ী করার কাজে ব্যবহার করেছেন। আমার ব্যাপারে আল্লাহ কী করবেন তা তো জানার উপায় নেই।
গতকাল ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এসে আওয়ামী লীগকে শুধু সাহসই দেন নাই, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে চাপও দিয়েছেন। এবং সতর্ক করার জন্য জামায়াত-শিবিরের ক্ষমতায় আসার ভয়ও দেখিয়েছেন। এতে বোঝা যায় যে জামায়াত এবং শিবিরভীতি এবং বিদ্বেষ ভারতের প্রতি রক্তকণায় কিভাবে সঞ্চারিত। আমি তো গোড়া থেকেই বলে আসছি, আমাদের বিরুদ্ধে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে এটার সবটা ছকই ভারতের অঙ্কন করা। আওয়ামী লীগ চাইলে এখান থেকে পেছাতে পারবে না। কারণ তারা ভারতের কাছে আত্মসমর্পণের বিনিময়েই এবার ক্ষমতা পেয়েছে।জাতি ও পৃথিবীর ন্যায়পন্থী মানুষ অবশ্যই জানবে এবং আমার মৃত্যু এই জালেম সরকারের পতনের কারণ হয়ে ইসলামী আন্দোলন অনেক দূর এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।কালই সুরা আত-তাওবার ১৭ থেকে ২৪ আয়াত আবার পড়লাম। ১৯নং আয়াতে পবিত্র কাবাঘরের খেদমত এবং হাজীদের পানি পান করানোর চাইতে মাল ও জান দিয়ে জেহাদকারীদের মর্যাদা অনেক বেশি বলা হয়েছে। অর্থাত্ স্বাভাবিক মৃত্যুর চাইতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর দেয়া ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা অর্থাত্ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জেহাদে মৃত্যুবরণকারীদের আল্লাহর কাছে অতি উচ্চ মর্যাদার কথা আল্লাহ স্বয়ং উল্লেখ করেছেন। 
আল্লাহ নিজেই যদি আমাকে জান্নাতের মর্যাদার আসনে বসাতে চান তাহলে আমার এমন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। কারণ, জালেমের হাতে অন্যায়ভাবে মৃত্যু তো জান্নাতের কনফার্ম টিকেট। এবার আল্লাহ যদি তার সিদ্ধান্ত আমার এবং ইসলামের অগ্রগতির সাথে সাথে জালেমের পতনের জন্য কার্যকর করেন, তাহলে ক্ষতি কি? শহীদের মর্যাদার কথা বলতে গিয়ে রাসুলে করিম (সা.) বারবার জীবিত হয়ে বারবার শহীদ হওয়ার কামনা ব্যক্ত করেছেন। যারা শহীদ হবেন, জান্নাতে গিয়ে তারাও আবার জীবন এবং শাহাদাত কামনা করবেন। আল্লাহর কথা সত্য, মুহাম্মাদ (সা.)-এর কথা সত্য। এ ব্যাপারে সন্দেহ করলে ঈমান থাকে না। ইনশাআল্লাহ, জান্নাতের সিঁড়িতে দেখা হবে।
তোমাদেরই প্রিয়
আবদুল কাদের মোল্লা
৫ ডিসেম্বর ২০১৩”

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণিত হয়ে ফাঁসীর দন্ডপ্রাপ্ত একজন আসামী এমনভাবে চিঠি লিখেছে যেন ইসলামের এক বড় কান্ডারীকে জোর করে অপরাধী বানিয়ে ফাঁসী দেয়া হয়েছে। আদালতে সঠিক আইন, সমান অধিকার, সুযোগ সুবিধা সব কিছুই দেয়া হয়েছিলো কাদের মোল্লাকে। কিন্তু সব কিছুর পরেও কাদের মোল্লা দোষী প্রমাণিত হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করবার পর সেটি আবার রিভিউ-ও হয়েছে। তারপরেও কাদের দোষী প্রমাণিত হয়েছে। 

সব কিছুতে পরাজয়ের পর যখন দেখা গেলো এই মুসলিম পরিচয় তার কৃত অপরাধ থেকে বাঁচাতে পারছেনা ঠিক তখনই কাদের আর তার দল খেলেছে আবেগের খেলা। স্ত্রীকে লেখা একটি ব্যক্তিগত চিঠি কি করে মিডিয়াতে আসলো কিংবা কেনইবা সেটি প্রকাশ্যে আসবে সেটি এখনো বোধগম্য নয়। চিঠিটি লেখা হয়েছে ৫ তারিখ, ফাঁসী হয়েছে ১২ তারিখ আর মিডিয়াতে এসেছে ১৭ তারিখ।

পুরো ব্যাপারটি-ই যে একটা সাজানো খেলা তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকেনা যদি আমরা প্রতিটি ঘটনাকে আলাদা আলাদা বিশ্লেষন করি। এই খেলাটা কাদের মোল্লার জন্য যতটা না জরুরী ছিলো তার চাইতে বেশী জরুরী ছিলো কাদেরের দল জামায়াতে ইসলামীর। কাদেরের কৃতকর্মে সে তার বিচার পেয়েছে কিন্তু জামায়াত যেহেতু তার রাজনীতি অব্যাহত রাখতে চায় সেজন্য তাদের রাজনৈতিক ইমেজ ঠিক রাখবার জন্য হলেও কাদেরের মাধ্যমে এই মুসলিম পরিচয় তুলে ধরা-ই মুখ্য হয়ে উঠেছে।

উপরের পুরো আলোচনায় একটা ব্যাপার কিন্তু আরো বেশী আলোচিত হওয়া আরো বেশী জরুরী যে ব্যাক্তি মুসলিম আইডেনটিটির এই পরিচয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থেই। এই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কিংবা পূর্বে আলোচনা করা দালাল আইনে বিচারের সময় ব্যাক্তির মুসলিম পরিচয়ের পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে পরবর্তী রাজনৈতিক সুবিধা, টিকে থাকা কিংবা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবার এক ধরনের নন-জুডিশিয়াল স্ট্র্যাটেজি।

আদালতে একজন মানুষ অপরাধী নাকি অপরাধী নয় সেটি প্রমাণিত হয় প্রমাণ, নথি-পত্র কিংবা সাক্ষীর মাধ্যমে। কিন্তু সেই পুরো প্রক্রিয়ায় একজন ব্যার্থ মানুষ সব সময়ই তার দন্ডের আগে তার অপরাধকে যথার্থ করবার জন্য কখনো ব্যবহার করে তার অবস্থানের, ওই অবস্থানে ব্যাক্তির অসহায়ত্বের, ব্যাক্তির ধর্মীয় পরিচয়, আদর্শিক পরিচয় ইত্যাদি নিয়ামক গুলোকে।

বিচারিক ব্যর্থতার বাইরে এসে এই ধরনের আবেগী পাব্লিক স্টান্ট জাতীয় কৌশলগুলো মূলত করা হয় ব্যাক্তির অপরাধের মাত্রাকে “মানুষের চোখে” নমনীয় করবার জন্য। যেমন হাতে নাতে খুন করা প্রমাণিত হবার পরেও খুনী ব্যাক্তি শেষ মুহুর্তে এসে তার সেই খুনের যথার্থতা দিতে চায় ভিকটিম সম্পর্কে নানাবিধ অপঃপ্রচার করে কিংবা তার উপর আক্রমন হয়েছে আর সে ফলশ্রুতিতেই হত্যা করেছে এই ধরনের ডিফেন্স দিয়ে। ধর্ষন করবার পরেও একজন ধর্ষক নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চায় নানাবিধ যুক্তি তুলে ধরে। গনহত্যা করে এসেও ব্যাক্তি নিজেকে বাঁচাতে চায় রাজনৈতিক অবস্থার কথা বলে কিংবা অধীনস্থ কর্মচারী ছিলো, এই জাতীয় অপঃযুক্তি তুলে ধরে।

কাদের মোল্লা কিংবা সাঈদীর ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খুন, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি প্রতিটি অপরাধের অভিযোগের ক্ষেত্রে এরা প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের বর্তমান অবস্থা সকলের সামনে তুলে ধরে বলেছে যে তাদের মত এমন নামাজী, পরহেজগার কিংবা আল্লাহর রাস্তায় আসা ব্যক্তি কি এই ধুরনের অপরাধ করতে পারে কিনা। কিন্তু এই ব্যাপড়তি আসলে এখানে বিবেচ্য, যেটা আমরা বার বার বলছি যে এই ধরনের অপরাধ গুলো ঘটেছে ১৯৭১ সালে। আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে। সুতরাং ৪৫ বছর আগের সেই ব্যাক্তির অবস্থা ও কর্মকান্ড এখানে বিবেচ্য। ঐ অপরাধের পর ব্যাক্তি কতবার হজ্ব করে হাজী হয়েছেন সেটি নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে না কিংবা বিচারও হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এইভাবে কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ, গোলাম আজম, আব্দুস সোবাহান, এ টি এম আজহারুল রা নিজেদের মুসলিম পরিচয় বার বার তুলে ধরে এই বিচার সম্পর্কে জনতার দৃষ্টিকে অন্য দিকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে, আবেগকে অন্যদিকে ধাবিত করে এই বিচারিক প্রক্রিয়াকে অসাড় প্রমাণ করবার প্রাণ পণ চেষ্টা করেছে।

একাত্তরের আরেক ঘাতক জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা আবদুস সোবাহান তার নাম, লেবাস, কর্মকান্ড সব কিছু দিয়েই আদালত ও আদালতের বাইরে প্রমাণ করতে চেয়েছে যে সে আসলে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের সাথে অংশ নিয়েছে ইসলামকে রক্ষার জন্য। আদালত আব্দুস সোবাহানের মামলায় রায় দিতে গিয়ে বলেন-

578. Accused Moulana Abdus Sobhan was the acting Ameer of Pabna district JEI, an Islamist political party. That is to say he was in leading position of JEI in 1971 and his position speaks that he had to work with the Islamic spirit and philosophy. But did he do it? 

No, rather dumping the holy spirit of Islam he opted to become a man of extreme notoriety around the locality of Pabna as he consciously and actively aided, abetted, assisted and substantially facilitated the Pakistani occupation army in committing the horrific atrocious acts constituting the offence of murder, large scale killing, massive destruction. Accused’s role thus impels the conclusion that JEI to which the accused Sobhan belonged was a ‘criminal organisation’. 

579. The holy religion Islam encourages to practice the value of faith, integrity, self-discipline, self-restraint, loving-kindness and it also encourages and teaches human beings to refrain from sinful acts and live life in moderation. But we have found it proved that the accused Moulana Abdus Sobhan knowingly participated and encouraged and induced the principal perpetrators in committing the horrendous sinful acts. Accused's attitude and role that he had in 1971 did not go with the philosophy and spirit of true Islam. In disguise of spirit of Islamic leadership accused Moulana Abdus Sobhan remained culpably closer to the Pakistani occupation army, Razakar force which were engaged to wipe out the pro-liberation Bengali civilians, in furtherance of policy and plan

এখানে লক্ষ্যনীয় হচ্ছে যে খোদ আদালত এই অভিযুক্তের ইসলামী ফিলোসোফী, তার ইসলামী লেবাস ও শিক্ষাকে গ্রহন করেছে এবং গ্রহন করে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়েছে যে এই ইসিলামী চিন্তাধারার ব্যাক্তি হয়ে কি করে এত বড় অন্যায় সে করতে পারে? লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে সোবাহানের আদালতে ব্যবহার করা তার ইসলামী পরিচয় এখানে উলটো তার দিকে বুমেরাং এর মত ফিরে আসছে। সোবাহানের ক্ষেত্রে আদালতের এই পর্যবেক্ষণ তাই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ব্যখ্যার দাবী রাখে। আদালত স্পস্ট আকারে বলছে যে ইসলামী চিন্তাধারার ব্যাক্তি হয়েও যে এরা যা করেছে তা ইসলাম রক্ষা তো নয়ই বরং সেটি ইসলামকে কিংবা ইসলামের মূল বক্তব্যকে নস্যাৎ করবার-ই সামিল।

একাত্তরের কুখ্যাত ঘাতক মতিউর রহমান নিজামীর ক্ষেত্রে আদালতের পর্যবেক্ষণ গুলো এই পর্যায়ে এসে আরো অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আদালত নিজামীর ট্রাইবুনালে প্রদত্ত রায়ের ক্ষেত্রে বলে-

315. It is very much relevant to mention here that accused Motiur Rahman Nizami wrote an article under the caption “বদর দিবসঃ পাকিস্তান ও আলবদর” [Badr Dibosh: Pakistan O Al-Badr] which was published in Dainik Sangram dated 14.11.1971 [Ext. 2/22]. The relevant portion of the said article is quoted- “হিন্দু বাহিনীর সংখ্যা শক্তি আমাদের তুলনায় পাঁচ গুন বেশি। ..........দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানের কিছু মুনাফিক তাদের পক্ষ অবলম্বন করে ভেতর থেকে আমাদের দুর্বল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে............শুধু পাকিস্তান রক্ষার আত্মরক্ষামূলক প্রচেষ্টা চালিয়েই এ পাকিস্তান কে রক্ষা করা যাবে না । বদরের যুদ্ধ থেকে অনেক কিছুই আমাদের শিখবার আছে.......... আজকের কাফেরদের পর্যুদস্ত করতে হলে আমাদেরও ............ আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, পাকসেনার সহযোগিতায় এদেশের ইসলাম প্রিয় তরুণ ছাত্র সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আল-বদর বাহিনী গঠন করেছে ............বদর যোদ্ধাদের সেই সব গুণাবলির কথা আমরা আলোচনা করেছি, আল বদরের তরুণ মর্দে মুজাহিদ দের মধ্যে ইনশাল্লাহ সেই সব গুণাবলী আমরা দেখতে পাব............আমাদের বিশ্বাস সেদিন যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করবে। আর সেদিনই পূরণ হবে বিশ্ব মুসলমানের অন্তরের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা”

উপরের প্যারাতে এসে আদালত নিজামীর একটি নিবন্ধ যেটি সে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দৈনিক সংগ্রামে লিখেছিলো সেটিকে উদ্বৃত করে। এই লেখাটির ক্ষেত্রে বলতে গিয়ে পরবর্তী প্যারাতে আদালত বলেন যে-

316. Accused Motiur Rahman Nizami has stated in the said article that the number and power of Hindu Bahini were five times higher than that of Pakistani Bahini. But unfortunately, some betrayers of Pakistan having taken the side of India were involved in the conspiracy to make Pakistan weak and as such, the ideology and existence of Pakistan would have been protected after having foiled their conspiracy. The accused has further stated in the article that a promise would have been made to protect the existence of Pakistan after having defeated the Hindu Bahini and prostrated India and, the religious strength, which brought the victory to the Muslims in the Badr war, would be gathered. In collaboration with Pakistan Army, Islam loving young students of the country had formed Al-Badr Bahini keeping the memory of Badr War in their minds. The accused has also stated in his said article that the day is not so far away when the young members of Al-Badr Bahini along with Pakistani army would hoist the victory flag of Islam in the whole world after having defeated the Hindu Bahini and destroyed the existence of Hindustan [India]. It appears that during the Liberation War, 1971 accused Motiur Rahman Nizami wrote said article on the eve of Badr Day directing the members of Al-Badr Bahini to exterminate so-called betrayers of Pakistan i.e. freedom-fighters and unarmed civilians who wanted liberation of Bangladesh. If the accused would not have been in a superior or commanding position over the members of Al-Badr Bahini during the Liberation War, 1971, he would not have directed them to exterminate the so-called betrayers of Pakistan. So, the article written by the accused himself also supports that the accused was the commander of Al-Badr Bahini during the Liberation War, 1971.

নিজামীর রায়ের ২৪ তম অধ্যায়ে এসে আদালত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। জামায়েত ইসলামী কিভাবে ধর্মকে অপঃব্যবহার করে রাজনীতি করেছে সেটির সম্পর্কেই আদালত বিস্তারিত বর্ণনা করেন। আদালত বলেন-

XXIV. Misuse of religion in politics by Jamaat-e-Islami during the War of Liberation of Bangladesh in 1971 

328. It is undisputed that Jamaat-e-Islami was founded in 1941 in this subcontinent by Maulana Abul Ala Maududi. Jamaat-e-Islami is a political party having cadre based structures in its formation. In August, 1947 the partition of British India took place and Pakistan came into being as a soverign state based on two nation theory under auspices of the Muslim League. On being inspired by thoughts and writings of Maulana Abul Ala Maududi, a group of students formed the Islami Jamaat-e-Talaba (Islami Chhatra Sangha) in December 1947 as a student wing of Jamaat-e-Islami. 
329. Though Maulana Maududi opposed the very creation of Pakistan in 1947, but while it came into being on the basis of two nation theory, the leaders of Jamaat-e-Islami gradually made intimacy with the Muslim League leaders claiming themselves as vanguard of Islamic revoluation. Pakistan has been created as the homeland of only Muslims, this dogma inborned in the minds of Muslim League leaders and some of them became communal in their feelings, thoughts and actions. Virtually, communal feeling is the byproduct of two nation theory upon which Pakistan was founded in 1947 as an independent country. 
330. It is needless to mention that it was one of the objects of Jamaat-e- Islami to capture the state power of Pakistan in the name of Islam. Jamaat-e- Islami gradually established a close tie with Muslim League leaders and ultimately borrowed communal feeling, the by-product of two nation theory from the leaders of Muslim League. Thus, both Jamaat-e-Islami and Muslim League used to legitimate political and social functions giving islamic terms in strenthening their common communal attitude for the purpose of making Pakistan as the only homeland for Muslims.
332. Referring to verse- 26 of surah 'Hajj' she has submitted that Allah depicts kaabah [place of worship] as only house of Allah in the Holy Quran but the accused knowing the true meaning of the verse, purposely treated Pakistan as the house of Allah in a meeting attended by the members of Islami Chhatra Sangha with intent to infuse wrong conception about the house of Allah in the minds of the members of Islami Chhatra Sangha so that they can blindly counter the 'miscreants' [freedom fighters] and proliberation Bangalees treating them as enemies of Islam. 
333. Similarly, Professor Ghulam Azam, the then Ameer of Jamaat-e-Islami delivered a direct and public speech on 17.07.1971 addessing a gathering of peace committee at Rajshahi to the effect that Hindus are always enemies of Muslims and there is no evidence to show that Hindus are friends of Muslims. The above hateful speech made by him manifestly demonestrates that he expressed hatred and communal feeling towards Hindu community with intent to create hostility between the Hindu and Muslims. Followers and disciples of Professor Ghulam Azam on being inspired by such inciting speech, they made the people of Hindu community living in Bangladesh, a target for attack, subsequently it happened in a henious manner across the country in 1971. 
334. Infact, the history of Sultani regime and Mughal Empire of this subcontinent is the best evidence to show that the people belonging to the Hindu and Muslims have been living together peacefully by maintaining a friendly and harmonious relations to each other for about one thousand years last.
335. Professor Ghulam Azam the chief of Jamaat-e-Islami made an open speech reported in the Daily Sangram dated 26.9.1971 claiming that "Pakistan Jamaat-e-Islami considers Islam and Pakistan are one and indivisible. Pakistan is the house of Islam of the world. Therefore, Jamaat supporters do not consider to live in the world if Pakistan does not exist". 
[Ref:- Ghulam Azam Case:- Ext. No. 22]
336. The above proposition that Pakistan and Islam are one and indivisible is completely a fallacy, virtually Pakistan is the name of a soverign state created on two-nation theory.
337. On the other hand, Islam is the most sophisticated religion of the Muslims in the world which is derived from the Holy Al-Quran and Hadith and that was preached by the greatest prophet Hazrat Muhammad [S.M.]. A country like Pakistan in no way can be a part of Islam. It is an attempt to impure Islam, the holy religion of the Muslims of the world.
338. It is undisputed that about 1400 years ago, our great prophet Hazrat Muhammad [S.M.] made a contract between Muslim and Non-Muslims living in Medina and established a non-communal nation. That contract is known as 'Medina Charter', probably it is the first written constitution in the world.
339. The famous Mawlana Akram Kha of this sub-continent has cited the philosophy of the 'Medina Charter' in his book named "Mostafa Charit" under the caption "Modinai Shadharon 
‘মদিনা সনদে বলা হয়েছে, পরস্পর বিপরীত চিন্তা, রুচি ও ধর্মভাবসম্পন্ন ইহুদি, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের দেশের সাধারণ স্বার্থ রক্ষা ও মঙ্গল বিধানের জন্য একই কর্মকেন্দ্রে সমবেত করতে হবে। তাদের একটি রাজনৈতিক জাতি বা কওমে পরিণত করতে হবে। তাদের শেখাতে হবে যে এক দেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়গুলো নিজেদের ধর্মগত স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ রক্ষা করেও দেশের সেবায় একত্রে সমবেত হতে পারে এবং এমন হওয়াই কর্তব্য।’ ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘মদিনা সনদ অনুসারে রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ সমাজেরই একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী রয়েছে, যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মের মূল বাণীর অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মভীরু মুসলমানদের বড় অংশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।’
340. The 'Medina Charter' has guaranteed to the equality before law, freedom of religion and profession among the different classes of people for establishing a non-communal nation and to work together irrespective of caste, creed and religion. According to Medina Charter, there is no room for utilising religion in the field of politics. It is noticed that only a group of communal people in our society try to misuse religion by misinterpreting its true meaning with intent to misguide bulk of the Allah-fearing Muslims for protecting their self interests. 


341. There is no denying that accused Motiur Rahman Nizami was the then leader of Islami Chhatra Sangha who had education in Islamic religion. He is the writer of several Islamic books out of which the defence has submitted a book titled "রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ম বনাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি " in which he depicted true islamic attitude towards non -Muslims under the caption ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা of which the relevant portion of his ideological belief is quoted below:-


‘আল্লাহ সব মানুষের স্রষ্টা। এর পরেও কেউ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে কি আনবে না—এই ব্যাপারে তিনি স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং ঈমান আনার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ ও জবরদস্তিকে নিষেধ করেছেন।’
342. The above idological belief of the accused as manifested in hiswritings is squarely in consonance with the directives of Medina Charter as discussed above. 


343. But while we go back to fateful 1971, the year of Liberation War, we find quite opposite picture in the deeds and thoughts of the accused and his associates including Professor Ghulam Azam, the then Ameer of Jamaat-e- Islami. 


344. It is gathered from facts of common knowledge as well as exhibited documents filed by both the sides that Pakistan occupation forces and their collaborators did never utter the word 'Muktijodda' or freedom fighter, they always referred them as miscreants, rebels, separatists, anti-state elements


343. But while we go back to fateful 1971, the year of Liberation War, we find quite opposite picture in the deeds and thoughts of the accused and his associates including Professor Ghulam Azam, the then Ameer of Jamaat-e-Islami.


344. It is gathered from facts of common knowledge as well as exhibited documents filed by both the sides that Pakistan occupation forces and their collaborators did never utter the word 'Muktijodda' or freedom fighter, they always referred them as miscreants, rebels, separatists, anti-state elements, intruders of India etc. in order to give massage to the world that no War of Liberation was going on in Bangladesh in 1971.


345. On perusal of speeches of accused Motiur Rahman Nizami, published
in the Daily Sangram on different dates in 1971 marked as Ext. nos. 2(5), 2(10), 2(15), 2(16), 2(17), 2(22) and Police Abstract Reports, it is evident that during the War of Liberation accused Motiur Rahman Nizami, his religious and political Guru (leader) Professor Ghulam Azam and other leaders of Jamaat-e-Islami used to deliver speeches in public to their followers using religion in their party politics giving wrong interpretation of Islam with intent to inspire young generation to counter freedom fighters and pro-liberation Bangalees treating them as enemies of Islam.


346. The following citations namely, "Pakistan is the house of Allah," "Hindus are always enemies of Muslims" and " Islam and Pakistan are one and indivisible", may appear to be not so dangerous in its plain meaining . But, we are to evaluate those speeches considering the prevailing circumstances and the Liberation War context under which those speeches were made to whom and for what purpose.


347. It is gathered from the facts of common knowledge that the accused and his associates made a lot of speeches addressing their subordinates to resist the independence of Bangladesh. The meaning of such speeches is to be determined in the context of 1971. 


Context is the principal consideration for finding out real meaning of such speeches.


(a) All most all the Bangalees irrespective of caste and religion, living in the then East Pakistan, whole heartedly supported the War of Liberation of Bangladesh;


(b) the accused as the, president of Islami Chhatra Sangha made speeches in public to the members of ICS encouraging, instigating , and persuading them to counter 'miscreant's' [freedom fighters] branding them as enemies of Islam;


(c) Leaders of Jamaat-e-Islami and its notorious student wing Islami Chhatra Sangha including accused Motiur Rahman Nizami used to make speeches in public branding freedom fighters and pro-liberation people as miscreants and Indian agents as a result members of Rajakar and Al-Badr Bahini firmly believed that freedom fighters and pro-liberation people were not Muslims enough. 


348. In the context of on going the Liberation War the following wrong massages namely "Pakistan is the house of Allah", "Hindus are always enemies of Muslims", and " Islam and Pakistan are one and indivisible" were infused in the minds of young members of Rajakar and Al-Badr Bahini as gospel of truth and on being inspired by those propaganda in the name of Islamic ideology, they committed more atrocities vigorously in collaboration with Pakistan occupation forces. The citations quoted above are the classic instances of misuse of Islam in politics in the name of protecting Pakistan.


349. It is found from the facts of common knowledge that ' Islam' teaches us to be non-communal and pure in thoughts, words and deeds but during the War of Liberation, the leaders of Jamaat-e-Islami tought its followers to be communal in thought, words and deeds and also treating non-jamaat-e-Islamis as bad Muslims and the freedom-fighters as miscreants.



আদালত নিজামীর এই রায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন একটি অধ্যায় সংযুক্ত করে এই উপরের পর্যবেক্ষন দেয়াতে অনেকগুলো বিষয় পরিষ্কার হয় এবং এটিও স্পস্ট হয় যে ধর্মকে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের মাত্রা ঠিক কোন পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। 

নিজামীর বিভিন্ন সময়ের ধর্মীয় বক্তব্যও যে পবিত্র কোরান শরীফের আয়াতগুলোর বিরুদ্ধচারন করে সেটিও এই অংশে দেখানো হয়েছে। দৈনিক সংগ্রামে লিখিত এক নিবন্ধে নিজামী পাকিস্তানকে আল্লাহর ঘর হিসেবে দাবী করেছে যেটির সূত্র সহ বিবরন উপরে দেয়া হয়েছে এর মধ্যেই। কিন্তু আদালত কোরান শরীফের সূরা হাজ্বের ২৬ নাম্বার আয়াত দিয়েই দেখিয়েছেন যে কাবা হচ্ছে আল্লাহর ঘর। কিন্তু নিজামী পাকিস্তানকে আল্লাহর ঘরের সাথে তুলনা করেছেন।

আদালত তার পর্যবেক্ষনে এটি-ই বলেছেন যে ধর্মকে এইভাবে ভুল-ভাল ব্যখ্যা করতঃ নিজামী কিংবা তৎকালীন এইসব নেতারা সব সময় চেয়েছে ধর্মকে উপজীব্য করে তাদের দলে থাকা তরুনদের সব সময় স্বাধীনতার পক্ষে থাকা মানুষদের ঘৃণার পাত্র বানাতে। ধর্মকেই পবিত্র জ্ঞান করে এইসব তরুনেরা তখন তাদের এইসব ধর্মীয়গুরুদের কথাই একমাত্র পালনীয় বলে মনে করত এবং এই ধারনাই তাঁদের মগজে গেঁথে গিয়েছিলো যে যারা পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছে বা চাচ্ছে তারাই হচ্ছে ইসলামের শত্রু কেননা তারা আল্লাহর ঘর ভাঙছে।

প্রখ্যাত ইসিলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আকরাম খাঁর গ্রন্থ “মোস্তফা চরিত” থেকেও আদালত কিছু বক্তব্য কোট করেন। সেখানে আদালত মদীনা সনদে যে অসাম্প্রদায়িক চিন্তার প্রতিফলন হয়েছে সেটি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন। এটি যে ইসলামের শিক্ষা সেদিকেই গুরুত্ব দেন আদালত। 

আদালত কিন্তু স্পস্টত নিজামীর ইসলামী শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরিচয় যেটি সে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো সেগুলোর সবই গ্রহন করে নিয়েছে। এই গ্রহন করে নেবার পরেই আদালত নিজামীর কর্ম ও সেটির সাথে ইসলামী চিন্তার কন্ট্রাডিক্টরী অবস্থানকে কোরান, হাদীস কিংবা বড় বড় আলেমদের বক্তব্যদের মাধ্যমেই দেখিয়েছেন।

আদালত নিজামীর ব্যাপারেই তার সর্বশেষ মতামতটি জানায় এভাবে-

368. Thus, we are constrained to hold that Motiur Rahman Nizami being educated in Islamic education had consciously and also deliberately misused the name of the Almighty Allah and the holy religion 'Islam' in 1971 during the Liberation War of Bangladesh in order to ruin and root out the 'Bangalee Nation.'

আদালতের এই রায় পড়ে একটি ব্যাপার স্পস্ট যে আদালত এই মুসলিম পরিচয় ব্যবহারকারীদের তাদের আদর্শিক অবস্থানের যায়গা থেকেই পর্যবেক্ষন দিচ্ছেন। আদালত একদিকে যেমন নিজামীর বক্তব্যকে ক্রিটিকালী বিশ্লেষন করেছেন ঠিক তেমনি সেই বক্তব্যের যে মূল উপাদান এই অপরাধীরা টুলস হিসেবে ব্যবহার করেছে সেই পবিত্র কোরান শরীফ থেকেই উদ্বৃতি কোট করে অভিযুক্তদের অপরাধের মাত্রা নির্ণয় করেছেন। 

অভিযুক্তদের নিজেদের বক্তব্যই একটি আরেকটির সাথে সাঙ্ঘর্ষিক ও বিরুদ্ধচারণ করে। আদালতে ব্যবহার করা মুসলিম আইডেনটিটি শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হিসেবেই বার বার এইসব অভিযুক্তদের দিকে ফেরত আসছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ঠিক একইভাবে জামাতের সাবেক আমীর গোলাম আজমের ব্যাপারেও তাঁদের পর্যবেক্ষন দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলমান পরিচয়ের ও সেটির অপঃব্যবহারের সবচাইতে বড় উদাহরন হিসেবে গোলাম আজমকেই সবার আগে স্থান দেয়া যায়। উপরে যাদের কথা আলোচিত হয়েছে কিংবা আলোচনার বাইরেও যারা এই মুসলিম পরিচয় আদালতে বিচার কার্যের সময় বার বার সামনে নিয়ে এসেছে তাদের মধ্যমনি হচ্ছে গোলাম আজম। 

গোলাম আজমের মামলায় আদালত ২৬২ নাম্বার প্যারায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন পত্রিকায় প্রকাশিত গোলাম আজমের কিছু বক্তব্য প্রকাশ করে যেখানে গোলাম আজম বলছে- 

“কোনো ভালো মুসলমানই তথাকথিত বাংলাদেশের সমর্থক-ই হতে পারে না”

গোলাম আজমের আইনজীবিরা গোলাম আজমের পক্ষে বলতে গিয়ে যা বলেন সেটির দেয়া আছে এই রায়ের ৩৯ নাম্বার প্যারায়। যেখানে বলা হচ্ছে-

All the accused’s actions, statements, speeches and meetings with the Pakistani rulers during 1971 were made only to protect soliditary of Pakistan and to implement its ideology among the people. He did nothing against the War of Liberation of Bangladesh. He is innocent.



সেই একই কথা। পাকিস্তানী আদর্শ টিকিয়ে রাখার জন্য ছিলো সংগ্রাম, পাকিস্তান আদর্শের পক্ষে থাকলেই সেই ব্যক্তি ভালো মুসলমান এই ছিলো গোলাম আজমের মূলমন্ত্র। 

আর তার এইসব শত শত বক্তব্য আদালতের রায়ে উঠে এসেছে যেখানে পরিষ্কারভাবে গোলাম আজম পাকিস্তানী বাহিনীকে উৎসাহ দিচ্ছে হত্যাকান্ডের ব্যাপারে, তার অধীনস্থ বিভিন্ন বাহিনীকে পরিষ্কার ভাবে নির্দেশনা দিচ্ছে খুন করবার জন্য, পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে একত্রিত হয়ে হত্যার মিশনে নামার জন্য।মূলত মওদুদীর আদর্শে অনুপ্রাণিত গোলাম আজমের অধীনেই ছিলো পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সকল সহযোগী বাহিনী। 

ইসলামের যে লেবাস একাত্তরের সময় গায়ে চড়িয়েছিলো পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যাকান্ডকে জায়েজ করবার জন্য ঠিক একই লেবাস গায়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে উপস্থিত হয়েছিলো গোলাম আজম। বার বার নিজের মুসলমানিত্বের পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসে বিচারের পুরোটা সময় আদালতকে যুক্তি দেবার চেষ্টা করেছিলো গোলাম আজম তার আইনজীবিরা। 

একাত্তরের আরেক ঘাতক আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদও তার ফাঁসীর আগ মূহুর্তে যথারীতি নিত্য নৈমত্তিক নাটকটি উপস্থাপন করেন। ফাঁসীর আগে শেষ চিঠি শেষ কথা। কাদের মোল্লার মত মুজাহিদ চিঠি রেখে না গেলেও মুজাহিদের ছেলে জেল গেট থেকে ফিরে তার বাবা শেষ মুহুর্তে কি বলেছে, কি খেয়েছে এসব লিখে মিডিয়াতে প্রকাশ করে। যেখানে সে মুজাহিদের কথা কোট করে লেখে-

“আমার শাহাদাৎ এই দেশে ইসলামী আন্দোলনকে সহস্রগুন বেগবান করবে এবং এর মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে ইনশাল্লাহ।”

একাত্তরের একজন ঘাতক দেশের প্রচলিত আদালতে সন্দেহ ছাড়া খুনী প্রমাণিত হবার পর শেষ যে অস্ত্রটা বরাবরই খেলেছে সেটি হচ্ছে তাদের মুসলিম পরিচয়টি সামনে তুলে ধরা। আমি আগেও এই কথাটি উপরে অনেকবার উল্লেখ করেছি মুজাহিদের প্রসঙ্গে আবারো করতে হোলো।

একাত্তর সালে মুসলমান পরিচয় দিয়ে এত লক্ষ লক্ষ ব্যাক্তির খুনের সাথে জড়িত থেকে, পুরো মুসলিম সমাজকে কলংকিত করবার পরেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই ইসলামের নাম করে নিজের অন্যায়কে চাপা দিয়ে যাবার এই যে প্রচেষ্টা এটি আসলে একমাত্র ঠান্ডা মাথার কোন খুনীর পক্ষেই কেবল সম্ভব।

৯৫ ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামী আলেমের বা চিন্তাবিদের কি এতই অভাব পড়েছে যে একজন খুনী ও গনহত্যাকারীকে ইসলামের সেবক বলে মনে করে নিতে হবে? যেই ব্যাক্তির ব্যাপারে গত ৪৫ বছর ধরে সারা বাংলাদেশ অভিযোগ করে এসেছে, যেই লোকটির বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগনামা সেই লোকটিই এই বাংলাদেশে ইসলামের নাম নিয়ে এই দীর্ঘদিন রাজনীতি করে গেছে। এই লজ্জা আসলে পুরো বাংলাদেশের। আজকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দাঁড়িয়ে এই অভিযুক্ত ও দন্ডিতরা প্রতিটি পদে পদে ইসলামকে, মুসলমান সম্প্রদায়কে যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছে সেগুলোই আসলে প্রকৃত অর্থে ধর্ম অবমাননা।

ইসলামের কোন শাখাটিকে তারা অপবিত্র করেনি? উহুদ, বদররের মত ধর্মীয় যুদ্ধের নাম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তারা নিরীহ মুসলমানদের মারার জন্য গঠন করেছিলো আল-বদর বাহিনী, আল শামস বাহিনী। অথচ এই জামায়াতে ইসলামী এবপ্নগ এই দলের নেতারাই গত সাড়ে চার দশক ধরে এই বাংলাদেশে ইসলামের নাম করে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে সুবিধা নিয়ে গেছে।

উপসংহার

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের যদি ভিন্ন ভিন্ন শাখা প্রশাখার কথা বলি তবে সেটির আয়তন অনেক দীর্ঘ। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই এত বিশাল বিশাল ডাইমেনশন, আঙ্গিক, দিক, পথে আলোচনা করা যায় যেটির সব হয়ত জীবদ্দশাতে লিখে সম্পন্ন করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এর আগস্ট পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে ২০১০ সালের ২৫ শে মার্চ থেকে ২০১৬ এর আজকের তারিখ পর্যন্ত একাত্তরের ঘাতকদের যে দুইটি দশকে বিচার হয়েছে এটি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক অনেক তাৎপর্য পূর্ণ ঘটনা।

একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পরে এই বিচারটি আজকে এমন একটি অবস্থাতে এসে শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই বিচারিক ক্ষেত্রে এমন সব বিষয় রয়েছে যেগুলোর প্রত্যেকটি নিয়ে আলাদা করে বিশদ আলোচনা সম্ভব এবং আলাদা করে বই লিখে ফেলা সম্ভব। এই দুইটি বিচার পর্বের প্রস্তুতি নিয়ে, বিচারের তদন্ত নিয়ে, বিচারিক ক্ষেত্রের প্রশাসনিক গঠন, সাক্ষী, আইনী যুক্তি, বিচার চলাকালীন সময়ে নানা ঘটনা, বিচারে উপস্থাপিত সাক্ষ্য কিংবা আইনী নানাবিধ বিষয়াদি নিয়ে শুধু আলাদা বই শুধু নয় বরং দীর্ঘ কলেবরে বই প্রকাশ সম্ভব। সেদিক বিবেচনা করে এই মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী ঘাতকদের বিচারিক পর্বে ঘাতকদের মাধ্যমেই তাদের যে ধর্মীয় পরিচয় এবং এটি আদালতে বা সামাজিক ভাবে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেটির ব্যাপ্তি এত এত বিশাল যে এটি নিয়ে আলাদা করে হয়ত আরো দীর্ঘ গবেষনা সম্ভব।

আমি আমার বইয়ে সাধ্যমত এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি দেখাতে চেয়েছি যে ব্যক্তির কৃত অপরাধের পুরো ইসুটিকে ধামাচাপা দেবার জন্য ধর্ম কত সহজ একটা টুল হতে পারে। ধর্ম এমন একটি ধারনা কিংবা বিশ্বাস যেটির নিজস্ব কোনো মুখ নেই, নিজস্ব কোনো আকার নেই যেটি দিয়ে ধর্মের গভীরতা বা আদর্শের সীমানাকে চিহ্নিত করা সম্ভব। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে এমন সীমানা আরো বেশী গভীর।

এরকম একটা অবস্থায় যখন কী ইসলাম ধর্মের বরাত দিয়ে, নাম ব্যবহার করে নিজের অপঃকর্মগুলোকে যথার্থকরণ প্রক্রিয়াতে নেয়া হয় তখন এটির নানাবিধ অভিঘাত থাকে, উদ্দেশ্য থাকে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত এসব সব নিয়ামক নানাভাবে এসব প্রক্রিয়ার কারন হিসেবে সামনে আসতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের এই একাত্তরের ঘাতকদের ক্ষেত্রেও নানাবিধ নিয়ামক কাজ করেছে ঠিক তখনই, যখন তারা তাদের করা অপরাধের পুরো ঘটনাকে লুকিয়ে রেখে ধর্মের নীচে আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে চেয়েছে। এতে করে ধর্ম কতটা কলুষিত হলো কিংবা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিম কতটুকু বেদনায় জর্জরিত হোলো এই ব্যাপারটিতে অপরাধীদের কোনো ভ্রুক্ষেপ-ই ছিলোনা বরং সেসব ছাপিয়ে রাজনৈতিক ও ব্যাক্তি ইমেজের লাভটাই বেশী মূর্ত হয়ে উঠেছিলো তাদের কাছে।

একাত্তরের ঘাতকেরা যে দুইটি ব্যাপার জিয়ে রাখতে চেয়েছে সেটি হচ্ছে সমর্থক পর্যায়ে আস্থার ইমেজ এবং তাদের দন্ড কার্যকরের পর দলীয় কার্যক্রমের যথারীতি চলমান প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা। এই বিচার, অভিযোগ ও পুরো বিচার প্রক্রিয়ায় এদের মুখোশ উন্মোচনে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক ধারনার উপরেই আসলেই সাধারণ জনতার তীব্র বিরাগ এসেছে। ৪৭ পরবর্তী সময়ে ধর্মকে উপজীব্য করে রাষ্ট্রীয় চিন্তার ধারনা, অতঃপর সম্পূর্ণ ব্যার্থতা, মুক্তিযুদ্ধের পর সেকুলার একটা সমাজ ব্যবস্থা প্রতিটি ঘটনা এই জনপদের সধারণ মানুষের মানসিক অবস্থাকে নির্দেশ করে।

৭৫ পরবর্তী কুট রাজনীতিবিদেরা ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির যে অবস্থান গত ৪ দশক ধরে তৈরী করেছে এটি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়বারই উপক্রম হয়েছে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন ও সেখানে বিচার শুরু হবার পর থেকেই। 

ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ধারনার উপর যে তীব্র আঘাত এসেছে এবং এই বর্তমান প্রজন্ম যে ধর্ম ভিত্তিক যে কোন ধরনের রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সেটি ধর্ম বেত্তাদের কাছে আশংকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সে কারনেই ইমেজ রক্ষার্থে সর্বশেষ ধাপ দাঁড়ায় ধর্ম ভিত্তিক আবেগী গল্পের জন্ম দেয়া ও সেটিকে পরিচর্যা করে সুক্ষ্ণভাবে ছড়িয়ে দেয়া। আর সেটি করতে গিয়েই বিচারিক আদালতে বারবার ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

অপরাধ করবার পর ও সেটা সবার সামনে খোলাশা হয়ে যাবার পর অপরাধী নিজেকে কিংবা নিজের রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ রক্ষা করবার জন্য কিভাবে ধর্ম পরিচয়কে অন্যের ঘৃণার নীচে জলাঞ্জলি দিতে পারে সেটির বড় একটি উদাহরন হচ্ছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দুইটি দশকের দুই বিচার পর্বে ঘাতকের যুক্তির অবস্থানে। দুটো সময়েই ঘাতক ইসলামের মিথ্যে ব্যখ্যা করে প্রথমত, তাদের অন্যায় গুলো সংগঠন করেছে এবং পরবর্তীতে এই ইসলামকে রক্ষা করবার জন্যই যে এতসব “অন্যায়” সেটিকে ইসলামের নীচে এনে যথার্থ করতে বার বার অপঃচেষ্টা করেছে।

শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রে এই জাতীয় প্রক্রিয়া ব্যবহার হয় তা কিন্তু নয়। একজন রাজনৈতিক দলের নেতা অপঃকর্ম করে নিজেকে লুকোতে চায় নিজের “দলের স্বার্থে” করেছে এমন ভিত্তিকে সামনে এনে কিংবা কখনোবা “বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দলের বলে আমার উপর এমন আক্রমন” এই জাতীয় অভিযোগকে সামনে এনে।

আবার যিনি ধর্মীয় পরিচয়ধারী লোকও নন কিংবা রাজনীতিবিদিও নন, তিনিও তার কৃত অপরাধ কর্মকে যথার্থ করন করবার প্রয়াস চালান নানাবিধ যুক্তি দিয়েই। অপরাধের ফলে কারো ক্ষতি হয়েছে, প্রাণ নাশ হয়েছে, অন্যের সমস্যার কারন হয়েছে এসব আসলে নিজেকে বাঁচাবার যে প্রক্রিয়া রয়েছে সেই জোরালো ধারার কাছে বেশীরভাগ সময়ই ভেসে যায়।

পুরো ব্যাপারটির হয়ত একটি ফিলোসফিকাল কিংবা মনস্তাত্বিক সংঙ্গা ও কারন রয়েছে। এইসব বিষয়ক গবেষকরা হয়ত ব্যাপারটি সামনে আরো ভেবে দেখবেন। তবে অন্যায় করে সেটি ধর্মীয় আদর্শের নীচ দিয়ে পার করে দিয়ে ইন্ট্যাঞ্জিবল ধর্মকে সামনে আনার মধ্যে এক ধরনের ক্রুদ্ধ নির্মমতা রয়েছে।

যেই স্রষ্ঠার নামে ধর্মকে বিক্রি করে অপরাধী, সেই স্রষ্ঠার সৃষ্টি জীবকে হত্যা করে আবার সেই স্রষ্ঠার নামে ধর্মের ঐ একই ধর্মের নীচে পালাবার মধ্যে এক ধরনের নির্মম রসিকতা রয়েছে খুব সম্ভবত। কখনো কখনো এইসব নির্মম রসিকতা প্রচন্ড করে পীড়া দেয়, কখনোবা ক্রুদ্ধ করে তোলে। 

যে ধর্মকে ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না, দেখা যায়না কেবল অনুভব করা যায়, এমন একটা অবস্থাতে ধর্ম নিয়ে এমন অপঃচেষ্টা হয়ত হবেই। কিন্তু ধর্ম সঠিকভাবে পাঠ করলে জানা যায় যে ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য, সুন্দরের জন্য। আর এতটুকু জানলেই এইসব অপঃচেষ্টাকে মুকুলেই বিনাশ করে দেয়া অসম্ভব কিছু নয়।




এই লেখাটির ১ম পর্ব পড়তে হলে ক্লিক করুন এখানে
এই লেখাটির ২য় পর্ব পড়তে হলে ক্লিক করুন এখানে


-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সহায়ক গ্রন্থ এবং নথি-পত্রঃ

১) বঙ্গবন্ধুর ভাষন, নভেল পাব্লিল্কেশন্স, [মিজানুর রহমান মিজান সম্পাদিত]

২) তাজউদ্দিন আহমেদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, মাওলা ব্রাদার্স, ড মো কামাল হোসেন

৩) তাজউদ্দিন আহমেদের সমাজ ও রাষ্ট্র ভাবনা, নির্বাচিত বক্তৃতা, প্রকাশকঃপ্রতিভাস

৪) অসমাপ্ত আত্নজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড

৫) সরদার ফজলুল করিম, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, কথা প্রকাশ

৬) পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, সৈয়দ মুজতবা আলী, একুশে পাব্লিকেশন্স

৭) শত বর্ষ পরে ফিরে দেখা ইতিহাস, বঙ্গভঙ্গ ও মুসলিম লীগ, ড নূরুল ইসিলাম মঞ্জুর, গতিধারা প্রকাশনী

৮) শতাব্দী পেরিয়ে, হায়দার আকবর খান রনো, তরফদার প্রকাশনী

৯) পলাশী থেকে একাত্তর, শাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স

১০) বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিকথাম রইস উদ্দিন আরিফ, পাঠক সমাবেশ

১১) আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর, আবুল মনসুর আহমদ, খোশরোজ কিতাব মহল

১২) যদ্যপি আমার গুরু, আহমদ ছফা,মাওলা ব্রাদার্স

১৩) লেনিন কেন জরুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নালন্দা প্রকাশনী

১৪) মূলধারা ৭১, মঈদুল হাসান, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড

১৫) আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, হুমায়ুন আজাদ,আগামী প্রকাশনী

১৬) আগরতলা মামলা ও আমার নাবিক জীবন, আব্দুর রঊফ, মীরা প্রকাশন

১৭) গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান

১৮) সমাজ চিন্তা ও সমাজ তাত্বিক মতবাদ, প্রফেসর ড এ এফ ইমাম আলি,নভেল পাব্লিশিং হাউস

১৯) বাংলাদেশের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা, সফিউদ্দিন তালুকদার, কথা প্রকাশ

২০) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ, সরদার ফজলুল করিম, সাহিত্য প্রকাশ

২১) সাম্প্রতিক বিবেচনা, বুদ্ধি বৃত্তির নতুন বিকাশ, আহমদ ছফা, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানী

২২) জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আগামী প্রকাশনী (শেখ হাসিনা ও বেবী মওদুদ সম্পাদিত)

২৩) বঙ্গবন্ধু, ২য় বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শন, আবীর আহাদ, জ্যোৎস্না পাব্লিশার্স

২৪) নির্বাচিত প্রবন্ধ, আহমদ ছফা্‌, মাওলা ব্রাদার্স

২৫) দেশ ভাগ, ফিরে দেখা আহমদ রফিক, অনিন্দ প্রকাশ

২৬) একাত্তরের স্মৃতি, ডক্টর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন

২৭) শিকল পরা দিনগুলো, এ বি এম খালেক মজুমদার, আধুনিক প্রকাশনী

২৮) ট্রাইবুনালের রায়ঃ চীফ প্রসিকিউটর ভার্সেস গোলাম আজম

২৯) ট্রাইবুনাল আপীলেট ডিভিশানের রায়ঃ চীফ প্রসিকিউটর ভার্সেস মুজাহিদ

৩০) ট্রাইবুনাল ও আপীলেট ডিভিশানের রায়ঃ চীফ প্রসিকিউটর ভার্সেস নিজামী

৩১) ট্রাইবুনালের রায়ঃ চীফ প্রসিকিউটর ভার্সেস আব্দুস সোবাহান

৩২) ট্রাইবুনাল ও আপীলেট ডিভিশানের রায়ঃ চীফ প্রসিকিউটর ভার্সেস কাদের মোল্লা

৩৩) ১৯৭২ সালের দৈনিক বাংলা, ১০ ই অক্টোবর।

৩৪) আমার দেশ অনলাইন ভার্সন, ইসিলামিক নিউ টুয়েন্টিফোর ডট কম, দৈনিক সংগ্রাম

৩৫) মতিউর রহমান নিজামী, আলবদর থেকে মন্ত্রী, আলী আকবর টবী, ঢাকা প্রকাশনী

৩৬) একাত্তরের দালালনামা, ইফতেখার আমিন, শব্দ শৈলী

৩৭) যুদ্ধাপরাধীদের বিচারঃ একটি আইনী অনুসন্ধান, মিজানুর রহমান সম্পাদিত

৩৮) পবিত্র কোরান শরীফ, লন্ডন কোরান একাডেমী

৩৯) ঢাকা ল রিপোর্টস

৪০) দৈনিক প্রথম আলো, অনলাইন ভার্সন

৪১) দৈনিক বাংলা, ২০ শে জুলাই, ১৯৭২

৪২) একাত্তরের ঘাতক দালাল, মোশতাক আহমেদ

৪৩) একাত্তরের ঘাতক দালাল যা বলেচজে যা করেছে, সংকলন ও সম্পাদনাঃ নূরল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ



No comments:

Post a Comment