Sunday 20 March 2016

একাত্তরের ঘাতকদের বিচারে মুসলিম আইডেনটিটির অপঃব্যবহার- পর্ব-১

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী নানাবিধ বাহিনী। খুন করে ৩০ লক্ষ কিংবা তারও অধিক সাধারণ বাংলাদেশীকে এবং লাঞ্ছিত ও নির্যাতন করে প্রায় ৪ লক্ষ কিংবা তারো বেশী নারী ও শিশুকে। পাকিস্তানী বাহিনীর যে হত্যাযজ্ঞের ব্যাপকতা ও পুরো ছক, সেই সমগ্র ছকের আওতায় সে সময় বাংলাদেশেরই কিছু রাজনৈতিক দল, ব্যাক্তি, গোষ্ঠী এই বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে সে সময় এই গণহত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সহযোগিতা করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যদি প্রধান সহযোগী হিসেবে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নাম বলা যায় তবে বলা যেতে পারে জামায়াতে ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলামী, পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)এর কথা। 

মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে এই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা, কর্মী, সমর্থক ও শুভাকাংখীরা মিলে এই বাংলাদেশেই মুক্তিযুদ্ধের সময় গড়ে তোলে নানা প্রকারের বেসামরিক, আধা সামরিক, ডেথস্কোয়াড সহ আরো নানাবিধ বাহিনী। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে এই সমন্বিত দলীয় বিভিন্ন পর্যায়ের একাত্নীকরণের উদ্দেশ্য ছিলো একটাই আর সেটি হচ্ছে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ বাংলাদেশীদের হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে এই বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্ব বজায় রাখা।

একটা বিশেষ লক্ষ্যনীয় ব্যাপার এই ক্ষেত্রে মনে রাখা খুব প্রয়োজনীয় যে মুক্তিযুদ্ধকালীন কিংবা তারও আগে এই পুরো পাকিস্তান রাষ্ট্র উৎপত্তি পূর্বক যে রাজনৈতিক, আদর্শিক কিংবা চিন্তার নানাবিধ প্যাটার্ন আমরা লক্ষ্য করেছিলাম সেখানে ধর্ম একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে উঠে এসেছে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে উপরে উল্লেখিত সহযোগী নানাবিধ রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু বার বার পাকিস্তানের সাথে এই সহযোগীতার যুক্তি হিসেবে “ইসলাম রক্ষা” নামের টার্মটি ব্যবহার করেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যদি আমরা এই দলগুলোর নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যাক্তিদের ভাষন, বক্তৃতা, সভা-সেমিনারের স্লোগানগুলো খুব সন্তর্পণে পর্যবেক্ষন করি তবে সেখানে সারমর্ম হিসেবে যে কথা উল্লেখ করা যায় সেটি হচ্ছে “ভারতের তাঁবেদারীর হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা”, “হিন্দু রাষ্ট্র ভারতের প্রভাব থেকে এই অঞ্চলকে রক্ষা”, “দেশকে হিন্দু-রাষ্ট্র হওয়া থেকে বাঁচানো”, “মুসলমানদের অধিকার রক্ষা” ইত্যাদির জন্যই মূলত তারা পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে একসাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। 

লেখার এই পর্যায়ে ঠিক এমনই আরেকটি হত্যাযজ্ঞের উদাহরন দেয়া উচিৎ যেই হত্যাযজ্ঞের সময় “অযুহাত” বা “কারন” হিসেব উল্লেখিত হয়েছিলো “আমেরিকান প্রভাবের” কথা, “পশ্চিমা সংস্কৃতির” কথা। এই হত্যাযজ্ঞটি হয়েছিলো কম্বোডিয়ায়। সময়কাল ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন কম্বোডিয়ার সরকারী বাহিনীকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে খেমাররুজ গেরিলারা প্রবেশ করে কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে। খেমাররুজ নামের এই গেরিলা বাহিনী দীর্ঘসময় ধরেই কম্বোডিয়া দখল করে এখানে তাদের শাষন কায়েম করবার নানাবিধ প্রচেষ্টা চালায়। দীর্ঘদিনের তাদের এই চেষ্টা মূলত সফল হয় ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে। সেসময় তারা কম্বোডিয়া দখল করে এই দেশটির নাম রাখে ডেমোক্রেটিক কম্পুচিয়া। এই কাহিনীটি এখানে বলবার কারন হচ্ছে বাংলাদেশে সংগঠিত গনহত্যায় পাকিস্তানী আর্মির বাংলাদেশী সহযোগী বাহিনীরা যেমন ইসলাম রক্ষার নাম করে কিংবা বিপন্ন ইসলামকে আরো পোক্ত করবার ধুয়ো তুলেছিলো ঠিক এই খেমাররুজ বাহিনীও কম্বোডিয়াতে বুর্জোয়া ও পশ্চিমা প্রভাবের মুলৎপাটন ঘটাবার ধুয়ো তুলে এক নৃশংস গণহত্যা চালায়। 

সুতরাং এটা বলা চলে যে মূলত রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে রাষ্ট্রকে নিজের ইচ্ছে মত চালাবার ইচ্ছেতেই এই গনহত্যাকারীরা নিজেদের সুবিধামত নামকরণ করে। দেশ ভেদে শুধু অযুহাতের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় কিন্তু অত্যাচারিতদের মূল ইচ্ছে ও কন্ঠ একই থাকে। এই জনপদে যেমন “ইসলাম রক্ষা”র কথা তুলে হত্যাকান্ডগুলো হালাল করবার চেষ্টা করা হয়েছিলো ঠিক কম্বোডিয়াতে “আমেরিকান সংস্কৃতি” কিংবা “পাতি-বুর্জোয়া” দের থেকে দেশকে বাঁচাবার কথা বলেছিলো খেমাররুজের খুনে গেরিলারা।

যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের পুরো মাত্রা, তার নানাবিধ আঙ্গিক, ঘটনা, ব্যাক্তির ভূমিকা, অবস্থান কিংবা বক্তব্য এসব প্রতিটি বিষয় পুংখানোপুঙ্খ আকারে বিস্তারিত বিশ্লেষন করা যায় তবে খুব সহজেই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীরা আসলে মোটেও “ইসলাম রক্ষা” করবার জন্য এই শতাব্দীর সবচাইতে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞটিতে মেতে ওঠেনি বরংচ ক্ষমতা, অর্থ প্রাপ্তি ও নিজস্ব রাজনৈতিক আবহকে একটা চিরস্থায়ী আকারে রূপ দেবার জন্যই ছিলো এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। 

কিন্তু এখানে প্রথমেই এটি বিশ্লেষন করা জরুরী যে এই পাকিস্তানী আর্মির সহযোগী বাহিনীর এমন ইচ্ছে কি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষেরা ধারন করতেন কিনা কিংবা সে সময়ে এই ভূখন্ডের মানুষ আসলে তাঁদের দেশটিকে কিভাবে দেখতে চাইতেন? ঠিক এই পর্যায়ে এসে আজকের বাংলাদেশের শুরুর ইতিহাসটিও সঠিক ভাবে পর্যবেক্ষন করা প্রয়োজন। 

পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কি আসলেই ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারনা থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন কিনা কিংবা যে মূল উদ্দেশ্যে পাকিস্তানহ রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিলো সেটি আসলে সফল হয়েছিলো কিনা। আমাদের আরো দেখা প্রয়োজন যে এই ধারনাটি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে কিভাবে ব্যবহার হয়েছ কিংবা আদৌ হয়েছে কিনা কিংবা সেটির মূল লক্ষ্য আসলে শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলে টিকেছে কিনা এই ঐতিহাসিক অবস্থান কিছুটা আলোচিত হওয়া জরুরী মনে করছি। 

পাকিস্তান রাষ্ট্রের উৎপত্তিঃ বঙ্গ ভঙ্গ এবং দ্বিজাতি তত্ব

১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গকে আলাদা করে প্রশাসনিক কারনে। মূলত এটিই হচ্ছে দৃশ্যত দাখিল করা যুক্তি। কিন্তু এই বঙ্গভঙ্গের গভীরে যদি আস্তে আস্তে খতিয়ে দেখা যায় তবে দেখা যাবে পূর্ব বঙ্গের দীর্ঘদিনের প্রাপ্ত লাঞ্চনা গঞ্জনা বঞ্চনার এক কষ্টের অধ্যায়। যদিও ইংরেজরা এই অঞ্চলের কাঠামোগত ভাবে উন্নতি সাধনের কথা বলেছে এবং এই অংশ ভাগ করে এখানে আলাদা একটা ইনফাস্ট্রাকচার তৈরীর মাধ্যমে এই অঞ্চলের উন্নতির রূপরেখা দেন। কেননা এই বাংলা,বিহার উড়ীষ্যাকে যুক্ত করা এই ১ লাখ ৮৯ হাজার বর্গমাইলের বিশাল অঞ্চল একাই একজন লেঃ গভর্ণরকে সামলাতে হোতো। এই অংশে তখন লোক সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ কোটি ৮৫ লক্ষের মত। 

ভৌগলিক দূরত্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থার নানাবিধ অসুবিধা আর এত বড় একটি অঞ্চলের প্রশাসনিক কাজে গতিশীলতা আনায়ন একটা বড় ইস্যু ছিলো। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলেও এই বিষয়ক প্রস্তাব বা ইঙ্গিত দেখা যায় তারও আগে থেকে। কিন্তু এইসব প্রশাসনিক উন্নতি, অঞ্চল ভাগ করে শাষন ব্যবস্থার গতি এসব ব্যাতিরেকে যদি এই অঞ্চলের মানুষের দিকে তাকাই তাহলে বলতে হয় সে সময় তৎকালীন মুসলমান্দের উপর ভারতীয় হিন্দু সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার আর বঞ্চনার গল্প ছিলো সীমাহীন। ইনফ্যাক্ট এই বঙ্গবভঙ্গ নিয়ে ভারতীয় এলিট, সামন্তবাদীরা ফুঁসে উঠে। তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের যে অবসানের ছায়া এই বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে সূচিত হয় সেটি তারা ভালোভাবেই অনুধাবন করে। 

যদিও এই অঞ্চলের মুসলমান এলিটদের মধ্যে এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরী হয় এই ঘটনায় কিন্তু দিনের শেষে এই অঞ্চলের মুসলমানরা একটা ব্যাপার বুঝতে সমর্থ হয় যে অবিভক্ত বাংলা মুখে হারমোনাইজেশন কিংবা সাম্যের কথা বল্লেও বাস্তবী ছিলো এটি হিন্দু আধিপত্যবাদের এক বড় অধ্যায়। মুসলমানরা মূলত তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক মুক্তির জন্য আলাদা ক্ষমতায়নের, আলাদা জাতি গোষ্ঠীর বোধটুকু এই সময়ে আরো তীব্র ভাবে পেতে থাকে।

যদি ইতিহাসকে ভালো করে পর্যালোচনা করা যায় তবে এটি কিন্তু বলাই যায় যে জাতিগত ভিত্তিতে সম্প্রদায় বলুন কিংবা ধর্মের ভিত্তিতে সম্প্রদায়-ই বলুন এই অঞ্চলে ক্ষুদ সম্প্রদায়গুলোর আসলে উচ্চকিত হয়ে বলবার স্থান ছিলোনা। কলকাতার জোতদার, হিন্দু জমিদার বা এলিটেরা এই অঞ্চলের মুসলমান বাঙালীকে মনে করত নিম্ন শ্রেণীর মানুষ হিসেবেই। তারা মুসলমানদের মনে করত অপবিত্র, স্লেচ্ছ। সে সময়ে আমাদের সামাজিক আর জীবন যাপনের যে কষ্টের অভিজ্ঞতা সেটি ছিলো একটা আত্ন নিয়ন্ত্রিত সত্বার বিকাশের বা চাইবার চালিকা শক্তি। সাম্প্রদায়িক প্রভাব এবং সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের একটা প্রকটতা এই অঞ্চলকে ছুঁয়ে গেছে তীব্র ভাবেই।

বঙ্গভঙ্গের বিস্তারিত ইতিহাস রচনা করা মোটেও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরংচ ঐতিহাসিক কিছু সুনির্দিষ্ট ঘটনা কিভাবে একটা পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের আগের ২৪ টি বছর বাংলাদেশ অঞ্চলকে প্রভাবিত করেছে বা সেটি থেকে উৎসারিত হয়ে অসাম্প্রদায়িক চিন্তার বিকাশ কি করে হয়েছে এই অঞ্চলে এবং স্বায়ত্ব শাষনের ফলেই এই চেতনার বাস্তবায়নের একটা স্বপ্ন যে প্রোথিত হয়েছে তা দেখানোই আসলে আমার মূল উদ্দেশ্য।

১৯১১ সালে তীব্র রাজনৈতিক চাপে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও এই অঞ্চলের মুসলমানরা ঐতিহাসিকভাবেই মূলত আরো বেশী সক্রিয় হয়, চিন্তাশীল হয়, ধাবমান হয় ধর্মীয় জাতিসত্ত্বার উপর ভিত্তি করে নিজেদের স্বাতন্ত্র, ঐতিহ্য আর অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার। রাজনৈতিক একটি শক্ত অবস্থান তৈরীতে গঠিত হয় মুসলিম লীগ।মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন, লক্ষ্ণৌ প্যাক্ট, ১৯২৭ সালে সাইমন কমিশন রিপোর্টে ভারতের জন্য একটি সংবিধানের প্রস্তাব এইসব নানাবিধ ঘটনা এই সময়ে ঘটে। ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস ও তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রদেশ গুলোতে জাতীয় সংগীত হিসেবে “বন্দে মাতরম” গানটি চালু করে। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে এই গানটি বংকিমের আনন্দমঠ উপন্যাস থেকে চয়নকৃত যেখানে স্পস্টত মুসলিম বিদ্বেষী ভাবধারা রয়েছে এবং মুসলমানদের ধর্মীয় মূল বিশ্বাসের স্থান থেকে এই জাতীয় শব্দের সংগীতকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মেনে নেয়া অসম্ভব ছিলো। এমন ঘটনায় মুসলিমরা নিজেদের আরো বেশী সাম্প্রদায়িক আক্রমনের শিকার মনে করতে থাকে এবং প্রভাবশালী হিন্দু আধিপত্যবাদের সাম্প্রদায়িক চিন্তার ও প্রকাশের ধারা আরো বেশী প্রকট হয়ে দেখা দেয়।

কিন্তু যে কথা আগেও বলেছি এখনো আবার বলছি যে এই সময়ে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এই অঞ্চলের মুসলমানদের ছুঁয়েছে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক নানাভাবে সেটির অভিজ্ঞতা কিন্তু প্রবল। এইসব বঞ্চনার শিকার হয়ে এই অঞ্চলের মানুষ যে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এবং যে মুক্তির পথ খুঁজেছে সেটির কালক্রমিক পরবর্তী অভিজ্ঞতা মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি গড়তে কিভাবে সহায়ক হয়েছে তা-ই আসলে দেখানো আমার উদ্দেশ্য। 

এর মধ্যে ব্রিটিশদের “ভূখন্ডগত জাতীয়তাবাদ” তত্বেরও ঘোর বিরোধীতা করে এখানকার মুসলিম সমাজ এবং সেই সাথে এই তাত্বিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে যে গণতন্ত্র সূচনার চেষ্টা করে ইংরেজ সুচতুর শাষকেরা সেটিও ভালোভাবে নেয়নি এই অঞ্চলের মুসলমানেরা।

একটা প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে যে এই অঞ্চলে কি বিভেদ শুধু মুসলিম আর হিন্দু জাতি সত্তার ভেতরেই দানা বেঁধেছে নাকি ধর্মকে কেন্দ্র করে এই দুইটি জাতিসত্ত্বার বাইরে অন্যান্য প্রান্তিক জাতি [হতে পারে ধর্মের ভিত্তিতে] বা অন্যান্য নানাবিধ সম্প্রদায়কে-ই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শিকার হতে হয়েছে।

উপরের এই প্রশ্নের বা চিন্তার সূত্র ধরে বলা চলে যে অন্যান্য নানাবিধ সম্প্রদায় বা জাতিও এই হিন্দু এলিট বা সামন্ত প্রভাবিত রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদের শিকার হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে। সেটার প্যাটার্ন ও আঙ্গিক কেমন ছিলো সেটি বিশ্লেষন করব না এখানে কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের দমক যে ঐ আধিপত্যবাদীদের বাইরে ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আর সম্প্রদায়ের উপর লেগেছিলো এইটুকু ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য।

বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলেও মুসলমানদের পৃথক জাতিসত্বার বিকাশের প্রয়োজনীয়তার ধারনাটি কখনো মুছে যায়নি। আর দীর্ঘ পরিক্রমায় ১৯৪৭ এর দেশভাগ শুধু একটা আনুষ্ঠানিকতাই কেবল। ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমায় নতুন কিছুই নয়। 

দ্বিজাতি তত্ব ছিলো ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মূল ভিত্তি। ১৯৩০ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর মুসলিম লীগের অধিবেশনে প্রদত্ত আল্লামা ইকবালের সভাপতির ভাষনকে দ্বিজাতি তত্বের প্রথম সূচনা হিসবে বিবেচিত করা হয়। ১৯৩৩ সালে লন্ডনে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে আল্লামা ইকবাল জহওরলাল নেহেরুর এক বিবৃতির ব্যাপারে রিজয়েন্ডার দেন এবং সেখানে উল্লেখ করেন-

In conclusion, I must put a straight question to Pundit Jawaharlal, how is India's problem to be solved if the majority community will neither concede the minimum safeguards necessary for the protection of a minority of 80 million people, nor accept the award of a third party; but continue to talk of a kind of nationalism which works out only to its own benefit? This position can admit of only two alternatives. Either the Indian majority community will have to accept for itself the permanent position of an agent of British imperialism in the East, or the country will have to be redistributed on a basis of religious, historical and cultural affinities so as to do away with the question of electorates and the communal problem in its present form.

এই বিরূপ চিন্তাধারা আর দর্শনের পরেও দীর্ঘদিনের একত্রে এই জোরাজুরির সহাবস্থানের ফলে এটি প্রমাণিত যে মুসলিম আর হিন্দু সমাজ দুইটি আলাদা ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা জাতি। ধর্মভিত্তিক পার্থক্য যদি বাদও দেই তারপরে পার্থক্য থেকে যায় অন্যান্য অংশতেও। কি তাদের ঐতিহ্য, কি তার খাদ্যাভাষ, সংস্কৃতি, চিন্তা বা আদর্শের।

এই সমস্যার গভীর ইতিহাস পর্যবেক্ষন করবার জন্য কিন্তু হিন্দু আর মুসলমানের ভেতর যে বৈরিতা এবং সংঘাত সেটির সাল-সাকিন, শানে নযূল গুলোও অনুধাবন করা জরুরী।যদিও সাল বা সময় দিয়ে কবে থেকে শুরু হয়েছে এটির ক্ষেত্রে জাজমেন্টাল হওয়াটা সম্ভব না তথাপিও হাজার বছরের ইতিহাস এই ক্ষেত্রে দেখা উচিৎ।অষ্টম শতাব্দীর ভারতবর্ষে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বের যুগ থেকে হিন্দু এবং মুসলমানেরা নানাবিধ যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো। সেটা কতটা ধর্মভিত্তিক আর কতটা ক্ষমতার বিস্তার লাভের আকাংখাতে লড়াই সেটির নানাবিধ ন্যারেটিভ রয়েছে। কিন্তু অনেকগুলো কারনের ভেতরে ধর্ম যে একটা প্রধান উপজীব্য সেটি বলা বাহুল্য। ৭১২ খৃষ্টাব্দে সিন্ধুর রাজা দাহিরের সাথে মুহম্মদ বিন কাসিমের যে যুদ্ধ হয় সেটির রেশ হাজার বছর ধরেই চলেছিলো।তারপর মহারাজা জয়পালের সঙ্গে গজনীর সুলতান মাহমুদ,পৃথ্বিরাজের সঙ্গে শিহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘোরি, রানা প্রতাপ সিং এর সাথে সম্রাট বাবর এবং শিবাজীর সঙ্গে সম্রাট আওরঙ্গজেবের যুদ্ধের ইতিহাস বুঝতে পারাটা জরুরী।এই কারনেই জরুরী যে এই হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের দ্বন্দ বুঝবার জন্য এই সঙ্ঘাত গুলো্র ঐতিহাসিক সুত্রগুলো বা কারন গুলোর উপলব্ধি জরুরী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

সমস্যার মূলে আমার কাছে শুধু ধর্মই যে একমাত্র বিবেচ্য তা একেবারেই নয়। ধর্মের পার্থক্য, সেটি থেকে উৎসারিত আঞ্চলিক রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ, তার ফলে বঞ্চনা, আর তার থেকে আলাদা জাতি সত্বার ধারনা কিংবা প্রয়োজনীয়তার কথা যতই বলা হোক এর মূল অনেক বেশী বিস্তৃত ছিলো বলেই ইতিহাস আসলে সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু প্রাথমিকভাবে ধর্মকে আর তার পার্থক্যের এবং এটিকে ভিত্তি করে বঞ্চনা টা ছিলো দৃশ্যত স্পস্ট। সুতরাং এই দৃশ্যমান সমস্যা আর তার থেকে উদ্ভব হওয়া সমস্যাগুলোর পরিত্রান যে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা জাতি রাষ্ট্র গঠনে পূর্বক পাওয়া সম্ভব সেটি ঐ চিন্তার চালিকা শক্তি ছিলো এটা বলা বাহুল্যই মাত্র। যুগ বিবেচনায় তৎকালীন মুসলিম নেতা কিংবা সাধারন জনতার বিচার্য বিষয় ছিলো ধর্মের ভিত্তিতেই আলাদা জাতি সত্ত্বা বিকাশের স্বপ্ন। এটার বীজ ঐতিহাসিকভাবে রোপন করা ছিলো।

ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় ছাড়াও কি এই ভারতবর্ষে অন্যান্য অনান্য নানা ভিতের ও দর্শনের উপর স্থাপিত সম্প্রদায় বিরাজ করত না? অবশ্যই করত।নানাবিধ প্রান্তিক পেশাজীবি সম্প্রদায়, মূল ধর্মের বাইরের ধর্মের আরো সম্প্রদায় এমনকি খোদ হিন্দু ধর্মের মধ্যেও নানাবিধ কাস্ট প্রথার উপর ভিত্তি করে সম্প্রদায় এসব সবার মধ্যেই কিন্তু টানাপোড়েন ছিলো, নিজস্ব চিন্তা আর চেতনা বিকাশের তীব্র আকাংখাও ছিলো।কিন্তু এইসব সকল সম্প্রদায়ের উপর জেঁকে বসা বঞ্চনা, নির্যাতন, অভাব, অনটনগুলোর অব্যাক্ত ক্ষোভগুলোও কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্পে জর্জরিত একটি পুরো মহাদেশের চারিদিকেই তখন নতুন স্বপ্নের তীব্র আশা বিরাজ করছিলো।

১৯৪৭ এর দেশ ভাগ তাই অবশ্যম্ভাবী-ই ছিলো।এই দেশ ভাগ প্রশ্নেও হিন্দু কট্টর রাজনীতিবিদেরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও স্থানান্তরের কথা বলে, অধিকাংশ এলিটেরা ক্ষমতা খর্বের পরণতি চিন্তায় এর তীব্র বিরোধীতা করে। ১৯৪০ সালে লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলে-

It is extremely difficult to appreciate why our Hindu friends fail to understand the real nature of Islam and Hinduism. They are not religions in the strict sense of the word, but are, in fact, different and distinct social orders, and it is a dream that the Hindus and Muslims can ever evolve a common nationality, and this misconception of one Indian nation has troubles and will lead India to destruction if we fail to revise our notions in time. The Hindus and Muslims belong to two different religious philosophies, social customs, and litterateurs. They neither intermarry nor interline together and, indeed, they belong to two different civilizations which are based mainly on conflicting ideas and conceptions. Their aspect on life and of life is different. It is quite clear that Hindus and Musolmans derive their inspiration from different sources of history. They have different epics, different heroes, and different episodes. Very often the hero of one is a foe of the other and, likewise, their victories and defeats overlap. To yoke together two such nations under a single state, one as a numerical minority and the other as a majority, must lead to growing discontent and final destruction of any fabric that may be so built for the government of such a state.

১৯৪৪ সালে আবার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলে-

We maintain and hold that Muslims and Hindus are two major nations by any definition or test of a nation. We are a nation of hundred million and what is more, we are a nation with our own distinctive culture and civilization, language and literature, art and architecture, names and nomenclature, sense of values and proportions, legal laws and moral codes, customs and calendar, history and tradition, and aptitude and ambitions. In short, we have our own outlook on life and of life.

আগেই বলেছি যে ইতিহাসের এসব সব অধ্যায় বিস্তারিত লেখা এই লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। সে কারনেই ঐতিহাসিক উল্লেখিত এই পটভূমিতে আমি বিস্তারিত লিখছি না শুধু ঐতিহাসিক মূল ঘটনাগুলোর একটা ফ্রেম দাঁড় করবার চেষ্টা করা ছাড়া।সুতরাং উপরের আলোচনা আসলে এই লেখার বিষয় বস্তুর সাপেক্ষে সামনে এসেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পেছনে যেসব ঐতিহাসিক পটভূমিগুলো রয়েছে এবং যেসব দর্শন গুলোর ভিত্তিতে স্বাধিকারের, মুক্তির প্রশ্ন এসেছে সেগুলো আলোচনা না করলে এই লেখাটির পরবর্তী অধ্যায়গুলো বুঝতে পারা যাবে না। 

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এই তত্বের ব্যর্থতাঃ

প্রশ্ন এসেই যায় দেশভাগের পর মুসলমানরা আলাদা যে জাতিসত্বার বিকাশ চেয়েছিলো সেটি কতটুকু উত্তীর্ণ হয়েছে? পূর্ব পাকিস্তান মানে আমাদের আজকের বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তান মানে আজকের পাকিস্তান যে মূলত ধর্মের ভিত্তিতে একটি স্বতন্ত্র জাতি গঠিত করে আগের বঞ্চনা আর আধিপত্যবাদের নির্মূল চেয়েছে সেটি কি কার্যকরী ছিলো?

প্রশ্নটির সহজ উত্তর হচ্ছে, না সেটা কার্যকর হয়নি। কার্যকর তো হয়-ই নি বরং দ্বি জাতি তত্ব যে আসলে একটা ভুল তত্ব সেটি বার বার প্রমাণিত হয়েছে। দেশভাগের পর হয়ত হিন্দু আধিপত্যবাদের ও তাদের এলিট, সামন্তদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকা গেছে কিন্তু এই আধিপত্যবাদ আবারো নতুন এই পাকিস্তানে আবারও ফিরে এসেছে আরো তীব্র হয়ে। 

সাতচল্লিশ এর দেশভাগের মূল দর্শন ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠিত হলেও এখানে সাম্প্রদায়িক ভাবনার ভয়াবহ আধিপত্য ছিলো শুরু থেকেই। সাম্প্রদায়িকতার নানান রূপের সাথেই বরংচ বাংলাদেশ পরিচিত হয়েছে নানান ফরম্যাটে।যে সমাজে সাম্যবাদ অনুপস্থিত, সকলের কথা বলবার অধিকার, মতামত দেবার, টলারেন্স প্রবণতা শূন্যের কোঠায় সেখানে ধর্ম ভিত্তিক জাতি গঠন আসলে আধিপত্যবাদের নতুন মোড়ককেই উদ্ভোধন করে।

আগেই বলেছি শুধু কি ধর্মীয় ভিত্ততে সম্প্রদায় গঠিত হয়, শুধু কি জাতীয়তার ভিত্তিতে সম্প্রদায় গঠিত হয়? উত্তর হচ্ছে না। তা নয়। সম্প্রদায় গঠিত হ্তে পারে একই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে আরো উপ-দর্শনের ফলশ্রুতিতে, সম্প্রদায় গঠিত হতে পারে চিন্তার ঐক্যের ফলে, সম্প্রদায় হতে পারে পেশার ঐক্যে, আঞ্চলিকতার ঐক্যে। সুতরাং সম্প্রদায় যতই গঠিত হোক কিংবা যতই ধর্ম ভিত্তিক পার্থক্য থাকুক না কেন যদি এই হাজারো সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা কিংবা সাম্যের ভিত্তিতে বা পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধের যায়গাটা শক্তিশালী একটি ভিত্তিতে পরিণত না হয় তবে আলাদা জাতি গঠন-ই সমাধান নয়।

হায়দার আকবর আলী খান রনো’র ভাষায়,

পাকিস্তানের দাবি ছিল আসলে অবাঙালি উঠতি বুর্জোয়া ও জমিদার শ্রেণির দাবি। শ্রেণিগতভাবে মুসলিম লীগ তাদেরই দল। ভারতের মুসলমান উঠতি বুর্জোয়ারা (যারা আবার অবাঙালি) চেয়েছিল অধিকতর শক্তিশালী ভারতীয় অমুসলমান বুর্জোয়াদের প্রভাবমুক্ত এলাকা, যেখানে থাকবে তাদের একচ্ছত্র শোষণ ও লুণ্ঠনের অধিকার। কিন্তু বাঙালি উঠতি মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষ ভেবেছিল অন্য কিছু। মুসলমান কৃষক প্রজা চেয়েছিল, হিন্দু জমিদারদের কাছ থেকে মুক্তি। আর মুসলমান বাঙালি মধ্যবিত্ত ভেবেছিল চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি লাভ করতে পারবে। সেই সময় চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে হিন্দুরা অগ্রসর ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ফলে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের কিছুটা উন্নতি হলেও তারা এক নতুন ধরনের ঔপনিবেশিক শোষণের শিকার হলো। তাই পাকিস্তানের মোহ দ্রুতই কেটেছিল। এবার তারা নিজেদের জাতি হিসেবে ভাবতে শিখল। বাঙালি জাতি, যারা বাংলা ভাষায় কথা বলে। এখানে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ সুতরাং দেশভাগের পর ধর্মের উপর ভিত্তি করে একটিও একক জাতির একক দেশ গঠিত হলেও সেখানে ছিলো সাম্প্রদায়িকতার বীজ, সেখানে ছিলো আধিপত্যবাদের, ক্ষমতার একচ্ছত্র নোংরামো। মুসলমানরা আগে যেখানে অপবিত্র ধ্যান হয়েছে, স্লেচ্ছ নির্নীত হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের দারা সেখানে এই পাকিস্তানে এক অংশের মুসলমান আরেক অংশের মুসলমানকে “হিন্দু প্রভাবিত মুসলমান” মনে করেছে, বাঙালীকে অগ্রাহ্য করেছে সমাজের সব ক্ষেত্রে নানান অবহেলায়। 

ভাষা আন্দোলোন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের হেজিমোনিক আচরণঃ

এই অবহেলা, আধিপত্যবাদ, বঞ্চনার প্রেক্ষিত রচনার পথে একটা বড় ঘটনা হচ্ছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।দেশভাগের মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই বাঙালীর নিজস্ব মাতৃভাষা যেটি তার সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উপকরন সেটিকে তীব্র লাঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানী শাষকদের কাছ থেকে।

বাংলা ভাষা হচ্ছে হিন্দুদের ভাষা এই ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের মূল উপজীব্য। উর্দূ, যেটি ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রধান ভাষা ছিলো সেটিকে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো এই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলে। বাঙালীর মুসমানিত্বের প্রশ্নে নয়, বরং একই ভাষাভাষী এই রকম একটা সম্প্রদায়ও যদি বিবেচনা করি তবে তার উপর পশ্চিম পাকিস্তানের এই অমার্জনীয় আঘাত কিন্তু শুরুতেই দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তি কিংবা পাকিস্তানের কবর রচনা করে দিয়েছিলো। 

যে ২৪ টি বছর আমরা পশ্চিমের সাথে ছিলাম সেটি ছিলো আসলে অনেকটা জোর করেই থাকা। আগেই বলেছি ৫২’র ভাষা আন্দোলন খুব স্পস্ট করে দেখিয়ে দিয়েছিলো বিদায়ের রাস্তা। চাপিয়ে দেবার ইচ্ছে ব্যাক্তই নয় বরং জিন্নাহ এই বিষয়কে উপজীব্য করে তার ক্ষেদের অনলে হত্যা করেছিলো সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিক সহ নাম না জানা আরো অনেককেই। বাংলাদেশ ভাষার জন্ত, নিজের সংস্কৃতি রক্ষায় রক্ত দিয়ে জানান দিয়েই জানিয়ে দিয়েছিলো ভবিষ্যতের বার্তা।

এই বিষয়েও হায়দার আকবর খান রনোর ভাষ্য আমার দৃষ্টিতে জরুরী,

ভাষা আন্দোলন তাই পাকিস্তানি ভাবধারাকেই আঘাত করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে চলে আসা মুসলিম জাতীয়তাবাদ, যার প্রধান প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ালেন জিন্নাহ সাহেব, সেটাকেই কার্যত অস্বীকার করে ভাষা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যদিও তখনো পর্যন্ত সরাসরি পাকিস্তানবিরোধী কোনো বক্তব্য আসেনি। প্রতিটি দেশের জাতীয়তাবাদের নিজস্ব কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম উপাদান হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। পাকিস্তানি ভাবধারার মুসলিম জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই তদানীন্তন পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান নতুন করে তার জাতীয় সত্তাকে খুঁজে পেয়েছিল।

ঐ একই লেখাতে তিনি বলেন-

একুশের চেতনার মধ্যে অবশ্য এই বহুমাত্রিক দিক ছিল না। কিন্তু যেটা ছিল তা হলো পাকিস্তানি চেতনার ঠিক বিপরীতটি। এটা ভাবতে অবাক লাগে যে ১৯৪৭ সালে যারা পাকিস্তানের জন্য সোচ্চারে স্লোগান দিয়েছিল, তাদেরই সন্তানরা মাত্র ২৪ বছর পর সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং ক্রমেই সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষা বিকাশ লাভ করেছিল এই ২৪ বছরে; যার সূচনা হয়েছিল ভাষা আন্দোলন থেকেই। এটাও ভাবতে অবাক লাগে যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই পাকিস্তানি চেতনা এভাবে হারিয়ে গেল কিভাবে? পাকিস্তানি চেতনা বলতে কী বুঝি? পাকিস্তান আন্দোলনের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তো পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেই দিয়ে গেছেন। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা নয়, ধর্মীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক জাতীয়তা। বাঙালি যে একটি স্বতন্ত্র জাতি তার অস্বীকৃতি ছিল পাকিস্তানি ভাবধারার মধ্যে। বাঙালি ভাষা হিন্দুদের ভাষা- এমন কথা শোনা গিয়েছিল। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সরাসরি তুচ্ছ করার ঘটনাও আমরা দেখেছি। ঘরে উর্দুতে কথা বলাকে মুসলিম উচ্চবিত্তের সমাজে আভিজাত্যের লক্ষণ বলে মনে করা হতো। তথাকথিত অভিজাত মুসলমানরা ঘরে উর্দুতে কথা বলতেন। একুশের আন্দোলন এই ধারাটির পতন ঘটিয়েছিল। জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি বলতে গর্ববোধ করতে শুরু করি। আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা, যা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরও ভাষা, তাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার জন্য দাবি জানাই। জনগণের মানসিকতা ও চেতনার ক্ষেত্রে এই যে বিরাট পরিবর্তন, একুশের আন্দোলনের সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় তাৎপর্যপূর্ণ দিক।

[সূত্রঃ অসাম্প্রদায়িকতা ও একুশের চেতনা, হায়দার আকবর খান রনো]

ব্যর্থতার আলোকে বাংলাদেশ অঞ্চলে লব্ধ অভিজ্ঞতাঃ

১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পরবর্তী সময়ে খুব সুক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মননশীলতা, প্রগতিশীলতা কিংবা সুস্থ চিন্তার একটা বিশাল ফারাক। শিল্প, সংস্কৃতি কিংবা সাহিত্য চর্চার দিক থেকেও এই ফারাক খুব সুস্পস্ট ছিলো। উপরে এই সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনোর বক্তব্য তাই খুব তাৎপর্যপূর্ণ বলেই আমার মনে হয়েছে। 

ধর্মভিত্তিক মুসলমান জাতি সত্তায় শুধু নাম হিসেবেই পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান ছিলো মুসলমান। কিন্তু এই ধর্মের চর্চা, নানাবিধ সংস্কৃতিক চর্চা, ঐতিহ্যের দিক থেকে, চিন্তা, চেতনা কিংবা মননশীলতার ফারাক বিবেচনায় ছিলো যোজন যোজন দূরত্ব। ভাষার উপর পাকিস্তানীদের প্রথম আঘাতেই যেটা স্পস্ট হয়েছিলো যে “হারমোনাইজেশন থিওরী” পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা নিতে অপারগ বরংচ ভাষার উপর হেজিমোনিক অস্ত্রকে ক্ষমতার স্থায়ী সূত্র বলেই তারা মনে করেছিলো।

পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মৌলিক পার্থক্য যা ছিলো সেটি আমার পর্যবেক্ষনে বরাবরই মনে হয়েছে চিন্তা আর দর্শনে। আমাদের এই অঞ্চল, মানে পূর্ব পাকিস্তানের চিন্তা আর চেতনার বিকাশ পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় ছিলো অধিকতর অগ্রগামী। অগ্রগামী বলছি পূর্বের ফিলোসোফিকাল যে দৃষ্টি ভঙ্গি আছে সেটা ছিলো মানবিক এবং অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে এখানে অতিক্রম করবার বাসনাও ছিলো প্রকট। সেটা কিভাবে তা হয়ত সামনে কিছুটা আলোচনা করব। কিন্তু এই যে বলেছি অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা সেটি বলছি প্রাক ১৯০৫ থেকে ৪৭ এর আগ পর্যন্ত যে নানাবিধ বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের অভিজ্ঞতা কিংবা রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের একটা বিস্তার এই আমাদের এইদিকের জনপদকে ঘিরে তীব্র হয়েছিলো সে কথা মাথায় রেখে।

আগেই বলেছি দেশভাগের পর যে স্বপ্ন পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ দেখেছিলো বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনতা সেটি ছিলো অতীতের নানাবিধ ঘটনাক্রমের ফলে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার আলোকে।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলোন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাষন বিরোধী আন্দোলোন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলোন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলোন, ১৯৬৯ সালের গন অভ্যুত্থান ও ১১ দফা এগুলো আমাদের এই অঞ্চলকে জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে, একটি একক সত্ত্বায় যেমন একত্রিত করেছে তেমনি এসব আন্দলনের ফলে অসাম্প্রদায়িক চেতনারও বিকাশ ঘটেছে সেই পূর্ব অভিজ্ঞতার ফলাফল হিসেবে।

আবার একই সাথে বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জাতিসত্বাদের দীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাসও এখানে উল্লেখযোগ্য। চাকমা বিদ্রোহ,সাঁওতাল বিদ্রোহ, হাতি খেদা বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ, হদি আন্দোলণ, টংক আন্দোলোন এসব নানাবিধ চড়াই উৎরাই পার হয়েও এই সুনির্দিষ্ট এলাকার অধিবাসীরাও যোগ দেন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টিতে। সক্রিয় হন মুক্তিযুদ্ধে।

দুইটি ধর্মের একসাথে থাকবার সময়ও যে বঞ্চনার শিকার এই জনপদের মানুষেরা প্রত্যক্ষ করেছে এবং সেটির সমাপ্তি প্রকল্পে দেশ ভাগের সারকথা যখন ব্যার্থতায় পর্যবসিত হোলো তখন উপলব্ধিটুকু আমাদের যা হয়েছে তা হচ্ছে সাম্যের, সংহতির এবং পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধের যায়গা থেকে সহবস্থান। ধর্মীয় বিশ্বাসের আলোকে গঠিত পাকিস্তানের এই ভীষন ব্যার্থতা এই অঞ্চলের মানুষদের মানসিকতায় এটি সুনিশ্চিতভাবে নির্ধারিত করে দিলো যে অসাম্প্রদায়িক চেতনাই আসলে পারে মুক্তি দিতে। উপলব্ধির যায়গা থেকে বাঙালী এই দর্শনকেই বরং তাদের চেতনায় ঠাঁই দিয়েছে। এটা এমন একটা দর্শন যেটা আসলে আরোপিত নয় বরং অতীতের ব্যার্থতাগুলোর ফলে এক ধরনের বাস্তব অভিজ্ঞতা।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা যে আসলে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ছিলো সেটি মূলত নানাভাবে আমাদের সামনে আসছিলো ঐতিহাসিক ঘটনাকে আরো গভীরভাবে বিবেচনা করেই আর সেগুলোতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের সু-স্পস্ট ঘোষনা রয়েছে। সে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর পর্যায়ক্রম বলা যেতে পারে এমন-

১/ ৬ দফা, ১১ দফায়।

২/ মুজিবনগর সরকারের ঘোষণা।

৩/ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র, দাবিনামা, কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত লিফলেট, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পত্রিকা বা প্রকাশনা।

৪/ মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য, সাক্ষাৎকার, লেখা।

উল্লেখিত ভিন্ন ভিন্ন দলিলগুলোর এক একটি আলাদা স্বকীয়তা, আলাদা বৈশিষ্ট্য কিংবা আলাদা মেরিট রয়েছে। ৬ দফার যেই মেজাজ বা যে প্রেক্ষাপট ১১ দফার প্রেক্ষাপট তার অত্যন্ত সমসাময়িক হলেও এর কলেবর আরো বিস্তারিত। ১১ দফা ৬ দফাকে গ্রহন করেছে উপরন্তু আরো সুনির্দিষ্ট করে রাষ্ট্রের ফিজিকাল কাঠামোকে প্রকাশ করে। খুঁজলে এখানেও সাম্য, সমান অধিকারের বক্তব্য পাওয়া যায়। কিন্তু কথা সেটা নয় এই অংশে। কথা হচ্ছে ৬ দফা, ১১ দফা, স্বাধীনতার ঘোষনা, আওয়ামীলীগের মেনিফেস্টো এগুলো প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা নিজস্ব স্বকীয়তা আছে। একটি পুরো বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় এসব দলিল, দাবী উত্থাপিত হলেও প্রত্যেকটির উপ-প্রেক্ষাপট রয়েছে। আলাদা সময়ের সাথে সাথে দাবীগুলোর আলোচনা বিশ্লেষিত হতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তি, এর বিকাশ মূলত ঐতিহাসিক ঘটনার বিশ্লেষনের ফলাফল হিসেবে সামনে আসবে এমনটাই যৌক্তিক। আর এই বিশ্লেষনের জন্য এই অঞ্চলের মানুষদের চরিত্র, তার সংস্কৃতি, তার অভিজ্ঞতা, এডপ্টেশনের ক্ষমতা, ইতিহাসের পাঠ এগুলো জরুরী।

আমাদের এই অঞ্চলে একটা বাস্তব অভিজ্ঞতায় পূর্ণ চিন্তার বিকাশের যে কথা উপরে বলেছি সেটা কিন্তু একটা কল্পিত রাষ্ট্র বা ইউটোপিয়ার সূচনা করে। এই কল্পিত রাজ্যের চিন্তার বিকাশ ঘটবার পেছনে যে ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে সেটি ব্যাক্তিকে ডিটারমাইন্ড করে ঐ অভিজ্ঞতার আলোকে রাষ্ট্রের জন্য ফিজিকাল সংবিধি প্রণয়ণে কিংবা দাবী উত্থাপনে। এইসব দাবী ম্যাটারিয়াল প্রকরনে আদৃত থাকলেও সেটির পেছনে থাকে সেসব ইন্ট্যাঞ্জিবল প্রকরন। ৬ দফা বা মূলত স্বায়ত্ব শাষনের দাবী। যদিও এখানে অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা নানা বিষয়ে দাবী উল্লেখিত হয়েছে। 

৬ দফা হচ্ছে একটি আকাংখিত রাষ্ট্রের ফিজিকাল কাঠামোর একটা প্রকাশমাত্র। এই প্রকাশের অন্তরালে যে স্পিরিট কিংবা যে দর্শন চালিকা শক্তি হিসেব কাজ করেছে সেটিকে অনুধাবন করতে পারলেই যে ব্যাপারটি আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে তা হচ্ছে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির ধর্ম ভিত্তিক পটভূমি যে আসলে পুরোপুরি অসাড় সেটি। অর্থনৈতিক অন্যায় আর অবিচারের প্রেক্ষাপটে তার ফিজিকাল একটা রূপ হচ্ছে ৬ দফা আর ১১ দফা। ঠিক একই ভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে বিকাশমান ধারা পূর্ব বাংলায় বজায় রয়েছে এবং যে চেতনাটি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত সেটির স্থায়ী একটা রূপ কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাষনের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হয়। আর ৬ দফার প্রথম দুইটি দফা স্বায়ত্বশাষন ইচ্ছেকে প্রকাশ করে।

সুতরাং অসাম্প্রদায়িক চেতনার ইচ্ছেটুকু ঐতিহাসিক এই জাতীয় দলিলগুলোতে মৌনভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেটি বলা বাহুল্য মাত্র। প্রশ্নটা আমি উপরেও করেছি এবং এখন আবারও করি যে অসাম্প্রদায়িক একটা সমাজ ব্যবস্থা যে স্বায়ত্বশাষন কিংবা স্বাধীনতার আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং সে উপলব্ধি যে বাংলাদেশীরা পাকিস্তান গঠনের পর দীর্ঘ ২৪ বছর ধরেই করে এসেছে সেটি একজন বাংলাদেশীর চোখ এড়ায় কি করে? 

আবার ১১ দফার উল্লেখিত দফাগুলো ভালো করে বিচার বিশ্লেষন করলে এটির উত্থাপনের প্রেক্ষাপট পরিষ্কার হবে। ৬ দফা আর ১১ দফা সম সাময়িক হলেও এবং ৬ দফার মূল ইচ্ছে ১১ দফায় সন্নিবেশিত হলেও ১১ দফা আরো অনেক বেশী বিস্তারিত আকারে এবং নতুন কিছু দাবী দাওয়াকে তুলে ধরার মাধ্যমেই উপস্থাপন করা হয়েছিলো।

এই ১১ দফায় যেমন একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক, গণতান্ত্রিক, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিকল্পের দাবী ছিলো ঠিক একই ভাবে কৃষক সম্প্রদায় কিংবা পেশাজীবি সম্প্রদায়ের অধিকারকেও সুনির্দিষ্টভাবে বলবৎকরবারও সুস্পস্ট ইঙ্গিত ছিলো যা আমরা দেখি ১১ দফার ছয় এবং সাত দফার বক্তব্যে। সরল বক্তব্যে এটিকেও বলা যায় যে ১১ দফাও একটি দেশের শাষন্তান্ত্রিক কাঠামো কেমন হবে তার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন হবে সেটি এই জাতীয় ম্যাটারিয়াল দাবী দাওয়ার ভেতর থাকেনা। থাকলে সেটি হয় অনুনয়।

অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বাংলাদশের চরিত্র হিসেবে থাকবার যে প্রবণতা এটা কোনো একক সিদ্ধান্ত নয়। এটা সম্মলিত মানুষের যৌথ চিন্তা। এই চিন্তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিংবা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে পরিস্ফুটিত হবার একমাত্র পথ ছিলো শায়ত্বশাষনের মাধ্যমে আত্ননিয়ন্ত্রনের অধিকার আদায়ের পরবর্তী পথ পরিক্রমায়। 

১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ ৬-দফা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য অবশ্য এই আলোচনার ক্ষেত্রে জরুরী। যেখানে তিনি বলেন-

আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবীরূপে ৬-দফা কর্মসূচী দেশব্যাপী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করিবার পরিবর্তে কায়েমি স্বার্থবাদীদের দালালেরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছে। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও নায্য দাবী যখনই উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈচৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী, পূর্ব পাক জনগণের মুক্তি-সনদ একুশদফা দাবিযুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবী, ছাত্র-তরুণদের সহজ ও স্বল্পব্যয়ে শিক্ষা লাভের দাবী, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবী ইত্যাদি সকল প্রকার দাবীর মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালেরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।

৭০ এর নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধুর যে বেতার ভাষনটি রয়েছে সেটি এখানে খানিকতা উল্লেখ করা যাকস। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষনের কিছু অংশ :

আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য লেবেল সর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসুলে করিম (স.) এর ইসলাম। যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বরাবর যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চণার পৃষ্টপোষকতা করে এসেছেন, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদেরই বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলমান সে দেশে ইসলাম বিরোধী আইন পাশের সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারেন কেবল তারাই ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফায়স্তা করে তোলার কাজে।

আবার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর রেসকোর্সে ভাষণ দিতে গিয়ে ওই একই স্পিরিট তিনি বজায় রাখেন। তিনি বলেন-

সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম এবং ভারত তৃতীয়। বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো বিশেষ ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

১৯৭২ সালের ৭ জুন, রেসকোর্স ময়দানে ও ১২ ই অক্টোবর গন পরিষদে এক ভাষনে বঙ্গবন্ধু যথাক্রমে বলেন-

বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল বদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।

“আমাদের আদর্শ পরিষ্কার। এই পরিষ্কার আদর্শের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এই আদর্শের ভিত্তিতে এই দেশ চলছে। জাতীয়তাবাদ-বাঙালী জাতীয়তাবাদ, এই বাঙালী জাতীয়তাবাদ চলবে বাংলাদেশে। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার আকাশ-বাতাস, বাঙালীর রক্ত দিয়ে গড়া বাংলার জাতীয়তাবাদ। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, জনসাধারণের ভোটের অধিকারকে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রে, যেখানে শোষনহীন সমাজ থাকবে। শোষক শ্রেণী আর কোনোদিন মানুষকে শোষণ করতে পারবে না। সমাজতন্ত্র না হলে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ ৫৪ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে বাঁচতে পারবে না। সেজন্যই অর্থনীতি হবে সমাজতান্ত্রিক, আর হবে ধর্ম নিরপেক্ষতা। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে, মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে না, বাংলার মানুষ এটা চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ তাকে প্রত্যাঘাত করবে। এ বিশ্বাস আমি করি”

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে ভাষণ :

জনাব স্পিকার সাহেব, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাঁধা দেওয়া ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাঁধাদান করতে পারবে না। খ্রীস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাঁধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অত্যন্ত পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি, সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করছি। যদি কেউ বলে গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলবো সাড়ে সাতকোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তাহলে তা করতে হবে।

১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ভাষণ :

আর একটা জিনিস। রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে , যারা সাম্প্রদায়িক, তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে, সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন, তিনি রাব্বুল আলামিন, রাব্বুল মুসলেমিন নন। হিন্দু হোক, খৃষ্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক, সমস্ত মানুষ তার কাছে সমান। সেজন্যই এক মুখে সোস্যালিজম ও প্রগতির কথা আরেকমুখে সাম্প্রদায়িকতা চলতে পারে না। সমাজতন্ত্র, প্রগতি আর সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না।

এই ভাষনটি রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক ভাবনা কি করে নির্বাচনী বক্তব্যে স্থান পেয়েছে, দেখিয়েছি কি করে তা রাষ্ট্রের চরিত্র হিসেবে অন্যতম ভিত্তি হয়ে থাকবে সেটির স্পস্ট নিদর্শন। সুতরাং আলোচনার এই স্থানে আর নতুন করে সেগুলোকে আবার বলবার প্রয়োজন দেখিনা। 

৭০ এর নির্বাচনের প্রাক্কালে সামরিক শাষক ইয়াহিয়া খান শাষনতন্ত্রের মূলনীতিতে কি কি থাকতে হবে এবং সেই প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলো কোন কি গাইডলাইন মেনে চলবে সেটির একটি নীতি ঘোষনা করেন। উল্লেখ করবার ব্যাপার হচ্ছে যে সেই মূলনীতিগুলোতে আইয়ুব খান ধর্ম ইস্যুটিকে বাধ্যতামূলকভাবে সামনে রেখে একটি রূপরেখা প্রদান করেন। একটু দেখা প্রয়োজন যে কি ছিলো সেই রূপরেখায়-

১) শাষনতন্ত্রে ইসলামী আদর্শকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে

২) ফেডারেল ইউনিয়ন হবে ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র হতে হবে

৩) গণতন্ত্র ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্ত বয়ষ্কদের ভোটাধিকার থাকতে হবে

৪) ফেডারেল শাষনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতা ভাগাভাগি হবে

৫) অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে

যদিও সে সময়কার ছাত্র-জনতা এমন বেঁধে দেওয়া ও সুনির্দিষ্ট করে মূলনীতির ঘোষনার তীব্র প্রতিবাদ জানায় তথাপিও বঙ্গবন্ধু বিচক্ষন রাজনীতিবিদের মত তাঁর লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হন। তিনি জানতেন যে সামরিক শাষনের সমাপ্তি এখন সবচাইতে জরুরী এবং গনতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসলেই তার মাধ্যমে পরবর্তীতে তিনি এইসব বেঁধে দেয়া কাঠামোর মধ্যে আবির্ভূত চরিত্র রাষ্ট্র থেকে সরিয়ে নিতে পারবেন এবং একই সাথে জনতার ইচ্ছে অনুযায়ী রাষ্ট্রের চরিত্রকে তিনি নির্ধারন করতে পারবেন। 

প্রাক মুক্তিযুদ্ধে পর্বে সামরিক শাষকদের এই রাষ্ট্র গঠনের বেঁধে দেয়া চরিত্র আর বাস্তবিক অর্থে জনতার চিন্তা তখন স্বাভাবিক ভাবেই দুইটি মেরুর দিকে অবস্থান করছিলো। ধর্মের ভিত্তিতে ও সে চিন্তায় একটি রাষ্ট্রের পুরো গঠন প্রণালী-ই যে মূলত ব্যার্থ তখন এই জনপদের মানুষেরা সেটি কার্যত অনুভব করতে পেরেছিলো। ২৩ বছরের পাকিস্তানী সামরিক শাষকদের ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের শাষনে পূর্ব পাকিস্তান এতটাই ভঙ্গুর অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলো যেখানে ধর্ম হয়েছিলো এক নগন্য প্রকরনের নাম। 

ধর্মের চিন্তা ক্রমশই এই অংশের জনতা সীমাবদ্ধ রেখেছে পরলৌকিক নিজস্ব চিন্তাতে ও উপাসনালয়ে। এটির প্রভাব যে রাজনীতিতে কিংবা নিজের প্রাপ্ত অধিকারের ক্ষেত্রে একেবারেই শূন্য এবং এই ধারনার মূল উপাদানগুলোই যে আসলে অকার্যকর তা বাংলাদেশীরা অনুধাবন করেছিলেন পাকিস্তান গঠিত হবার ২৪ বছর ধরে। মূলত ধর্ম যে এই পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাষক আর তাদের পোষ্য রাজনীতিবিদদের একটি কূট চাল ও ক্ষমতাকে ধরে রাখবার কৌশল সেটিও ধীরে ধীরে প্রকাশ্য হয়ে উঠেছিলো।

কিন্তু এখানে এটিও বলে রাখা ভালো যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানেই নয় বরং এই পূর্ব পাকিস্তানেও কিছু রাজনৈতিক দল ও ব্যাক্তি ছিলো এই সামরিক শাষকদের তল্পিবাহী যারা সব সময় পূর্ব পাকিস্তানের এই সামগ্রিক ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার বিরোধী ছিলো। এই জন্য তারা মূলত দায়ী করত আওয়ামীলীগ কে এবং তারা এও মনে করত যে আওয়ামীলীগ হচ্ছে ভারতের হাতের এক রাজনৈতিক গুটি যারা পাকিস্তানুকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে বদ্ধ পরিকর। লেখার শুরুতেই যে আমি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ করেছিলাম পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে এই দলগুলো এবং কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ। এরাই ছিলো মূলত পূর্বাঞ্চলের এই চাওয়ার সবচাইতে বড় বিরোধিতাকারী।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ধর্মের ব্যবহার

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সাথে তাদের এই আঞ্চলিক সহযোগী বাহিনীর সদস্য ও স্বতন্ত্র কিছু রাজনৈতিক ব্যাক্তিরা হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। তাদের এই হত্যাযজ্ঞের পুরো সময়টা জুড়েই ঢাল ও কারন হিসেবে সামনে ছিলো ইসলাম ধর্ম। “পূর্ব পাকিস্তান ইসলাম থেকে হিন্দু হয়ে যাবে”, “এই যুদ্ধ হিন্দুস্থানের চাল”, “পূর্ব পাকিস্তানকে হিন্দুত্বের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে” এইসব নানাবিধ স্লোগান ছিলো এই রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিদের মূল উপজীব্য। ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সালের মধ্য রাত থেকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালায় ঢাকা সহ সারা দেশে তার পর পরই এই সহযোগী বাহিনীরা। 

এই সময়ে এই সহযোগী বাহিনীর মধ্য থেকে যে ব্যাক্তিটি মূলত সব বাহিনী ও ব্যাক্তির মূল গুরু হয়ে ওঠে তার নাম গোলাম আজম। যদিও সে কখন, কোন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজে শিক্ষকতা করেছে এমন কোনো প্রমাণ কখনই পাওয়া যায়নি তথাপিও সে নামের আগে বরাবরই অধ্যাপক উপাধিটি ব্যবহার করে গেছে। 

এক গোপন প্রতিবেদনে [যার নাম্বার হচ্ছে ৫৪৯ (১৫৯) পল/এস (আই)] উল্লেখ ছিলো যে, আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, ‘হিন্দুরা মুসলমানদের শত্র“। তারা সবসময় পাকিস্তানকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে।’ 

ওই সম্মেলনে গোলাম আযম প্রতি গ্রামে শান্তি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ আখ্যা দিয়ে তাদের নির্মূল করারও নির্দেশ দেন তিনি। গোলাম আযম বলেন, খুব শিগগিরই রাজাকার, মুজাহিদ ও পুলিশ মিলে দুষ্কৃতকারীদের মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়েই গোলাম আযম ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সরলমনা মুসলমানদের খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেন হিন্দু সম্প্রদায় ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। জুলাই মাসে রাজশাহীতে শান্তি কমিটি আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে গোলাম আযম বলেন, ‘যাদের নিজেদের শক্তি নেই, তারা হিন্দুস্তানের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে স্বাধীন হতে চায়।’ 

তিনি ঘোষণা করেন যে, ‘হিন্দুরা মুসলমানের বন্ধু–এরূপ প্রমাণ করার মত কোন দলিল নেই।’ ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্যদানরত অবস্থায় গোলাম আযমের ছবিসহ সংবাদটি ছাপা হয় একাত্তরের ১৯ জুলাই দৈনিক সংগ্রাম-এ।

[সূত্রঃ এই দেশ, আজাদুর রহমান চন্দন। ১২ ই নভেম্বর ২০১২, প্রবন্ধ শিরোনাম “৭১-এ গণহত্যায় গোলাম আযমের ভূমিকা ছিল মাস্টার মাইন্ডের”]

এইসব ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই সহযোগী বাহিনীর নানা রকমের সম্মেলন, সভা, বক্তৃতা, সেমিনার, আলোচনায় বার বার ইসলাম ধর্ম ও তার নানাবিধ প্রথার এক সংমিশ্রণে এই হত্যাকান্ডকে সমর্থন ও সঠিক হিসেবে প্রমাণ করবার সকল রকমের পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাই। তারিখ ও সূত্র ধরে ধরে যদি কিছু সভা, সেমিনার কিংবা সমাবেশের কথা উল্লেখ করি তাহলে বলতে হয়-

১। পাকিস্তান রক্ষার জন্য গোলাম আযমের মোনাজাত – দৈনিক সংগ্রাম -এপ্রিল ১৩, ১৯৭১

২। ভারত মুসলমানদের হিন্দু বানাতে চাচ্ছে তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে গুজব ছড়াচ্ছে – মৌলবী ফরিদ আহমেদ – – দৈনিক সংগ্রাম -এপ্রিল ১৬, ১৯৭১

৩। ‘যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী আলবদর সেখানেই’ এই স্লোগান নিয়ে কুখ্যাত বদর বাহিনী গঠিত হয় ২২ এপ্রিল, ১৯৭১ -দৈনিক পাকিস্তান, পূর্বদেশ -এপ্রিল ২২/২৩, ১৯৭১

৪। আল্লাহু আকবরের জায়গায় জয় বাংলা দখল করে নিয়েছে – দৈনিক সংগ্রাম ১২ মে, ১৯৭১

৫। যে কোন মূল্যে ভারতের চক্রান্ত নস্যাৎ করব -মওলানা আশরাফ আলী – দৈনিক আজাদ, ১৯ মে, ১৯৭১

৬। অতি সম্প্রতি আমাদের দেশের একদল লোক হিন্দুদের সাথে যোগ দিয়েছে – পাকিস্তানের দুশমনদের নিশ্চিহ্ন করার আহ্বান – মওলানা সিদ্দিক আহমেদ – দৈনিক আজাদ, ২৪ মে, ১৯৭১

৭। সরকারী প্রেসনোটে পহেলা বৈশাখ নববর্ষের ছুটি বাতিল, ২৪০টি রাস্তার নামকরন হিন্দু থেকে মুসলিম করন, ৬৯টি বই নিষিদ্ধ– হিন্দুরা মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলোপের কাজ করেছে – এই সংবাদে দৈনিক 

৮। জয় বাংলা স্লোগানে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ বাতাস কলুষিত হয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষদের ধর্ম বিরোধী অত্যাচার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে রাজাকারদের ক্ষূদ্র অস্ত্র দিয়ে গুলী চালানোর ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে – দৈনিক সংগ্রাম – ১-৫ জুলাই, ১৯৭১

৯। জামাত সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেকের আহ্বান- গ্রামে গ্রামে রক্ষীদল গঠন করুন – দৈনিক পাকিস্তান ৩রা জুলাই ১৯৭১

১০। জনগণ এখন স্বেচ্ছায় রাজাকার ট্রেনিং নিচ্ছে – জামাত নেতা আব্দুল খালেক – দৈনিক সংগ্রাম ৯ জুলাই, ১৯৭১

১১। সেনাবাহিনী কুখ্যাত শহীদ মিনারটি ধ্বংস করে মসজিদ গড়েছে – দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদকীয় ১৬ জুলাই, ১৯৭১

১২। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে –ফজলুল কাদের চৌধুরী,দৈনিক পাকিস্তান ১৮ জুলাই, ১৯৭১

১৩। পাক সেনারা আমাদের ভাই, তারা জেহাদী চেতনায় উজ্জীবিত – মতিউর রহমান নিজামী – দৈনিক সংগ্রাম ৩রা আগস্ট, ১৯৭১

১৪। পাকিস্তান টিকলেই এদেশের মুসলমানরা টিকবে, দুনিয়ার কোন শক্তিই পাকিস্তানকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। গ্রামে গন্জের প্রতিটি এলাকা থেকে শত্রুর চিন্হ মুছে ফেলার আহ্বান – নিজামী -দৈনিক সংগ্রাম ৫ই আগস্ট, ১৯৭১

১৫। তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকরা ইসলাম, পাকিস্তান ও মুসলমানদের দুশমন – গোলাম আযম – দৈনিক সংগ্রাম ১২ই আগস্ট, ১৯৭১

১৬। পাকিস্তানকে যারা বিচ্ছিন্ন করতে চায়- তারা ইসলামকেই উৎখাত করতে চায় – নিজামী

১৭। হিন্দু ভারতের নিরপেক্ষ আদর্শের প্রচারক আওয়ামী লীগ – দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদকীয় ৩০ আগস্ট, ১৯৭১

১৮। ছাত্রসংঘ কর্মীরা পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি জায়গা রক্ষা করবে – মতিউর রহমান নিজামী, যশোহরে ছাত্রনেতা মতিউর রহমান নিজামীর মন্তব্য : পাতা ১, পাতা ২ – দৈনিক সংগ্রাম – ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

১৯। জামাতে ইসলামী ইসলাম ও পাকিস্তান কে এক ও অভিন্ন মনে করে- গোলাম আজম (দৈনিক সংগ্রাম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)

২০। পবিত্র ভূমি পাকিস্তান আল্লাহর ঘর, আল্লাহর এই পূত পবিত্র ঘরে আঘাত হেনেছে খোদাদ্রোহী কাপুরুষের দল।" - মতিউর রহমান নিজামী (দৈনিক সংগ্রাম ১৬ ই নবেম্বর ১৯৭১) 

২১। পাকিস্তান হাসিলের লক্ষ্য বাস্তবায়িত না হওয়ায় বর্তমান সংকটের কারণ – আব্বাস আলী খান -দৈনিক সংগ্রাম – ২০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

২২। যশোহরের রাজাকার সদর দফতরে মতিউর রহামন নিজামী : পাতা ১, পাতা ২

নিউইয়র্কে এ.টি. সাদী – বাংলাদেশ আন্দোলন ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র -দৈনিক পাকিস্তান ২৭শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

২৩। আব্বাস আলী খান, আখতার উদ্দীন আহমদ, ওবায়দুল্লাহ মজুমদার ও গোলাম আজম বলেন

স্বাধীন বাংলা জিগিরের উদ্দেশ্য মুসলমানদের হিন্দু বানানো – দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদকীয়, ১০ অক্টোবর, ১৯৭১

২৪। তথাকথিত মুক্তিবাহীনির শতকরা ৯০ জন হিন্দু – দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদকীয়, ১৩ অক্টোবর, ১৯৭১

হয় শহীদ নয় গাজী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও আব্দুল খালেক, দৈনিক সংগ্রাম ১০ নভেম্বর, ১৯৭১

২৫। ভারত আক্রমণ করলে কোলকাতা ও দিল্লীতে নামাজ পড়বো – আব্বাস আলী খান– দৈনিক সংগ্রাম ১০ নভেম্বর, ১৯৭১

মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর শপথ পাঠ করবার সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের হাতে থাকত মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ কোরান শরীফ। এই গ্রন্থ হাতে নিয়েই কিন্তু এই বাহিনী নির্মমভাবে আল্লাহর সৃষ্টি “আশরাফুল মাখলুকাত” হত্যার জন্য পণ করেছিলো। একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ্য যে শান্তিকমিটি গঠিত হয় মূলত ১০ ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে। 

এই সময়ে বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য (এদের ভাষ্যমতে)১৪০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয় যার নাম দেয়া হয় “শান্তি কমিটি”। এইদিনের সভাতেও শান্তিবাহিনীর নেতাদের মূল বক্তব্য ছিলো বাংলাদেশকে হিন্দুস্থান হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেবার জন্য, ইসলামকে রক্ষার জন্যই মূলত তাদের এই কমিটি গঠন। 

পর ১২ এপ্রিল ১৯৭১ সালে যোহরের নামাযের ঠিক পর পর এই বাহিনীর পক্ষে ও সমর্থনে বায়তুল মোকাররম থেকে প্রথম মিছিল বের হয় গোলাম আজমের নেতৃত্বে। এসময় মতিউর রহমান নিজামী ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে মিছিলে যোগদান করে। নিজামীর নেতৃত্বে তৎকালীন ছাত্রসংঘের কর্মীরা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান ও পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার বৃহৎ ছবি মিছিলে নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। এইদিন মিছিলে প্রচুর লোকের সমাগম হয়েছে এটি দেখাবার জন্য তারা বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারীদেরও মিছিলে নিয়ে আসে। সেদিন মিছিলের শ্লোগান ছিল: ‘পাকিস্তানের উৎস কি- লা ইলাহা ইল্লাহ, কায়েদে আযম জিন্দাবাদ, আল্লাহ তায়ালা মেহেরবান ধ্বংস করবে হিন্দুস্তান, ব্রাহ্মণ্যবাদ সাম্রাজ্যবাদ মুর্দাবাদ, ওয়াতনকে গাদ্দারোসে হুঁশিয়ার’ ইত্যাদি। 

মিছিলটি শেষ হলে গোলাম আজম ও নিজামীরা পাকিস্তান রক্ষার জন্য লম্বা মোনাজাত করে। মোনাজাত পরিচালনা করে গোলাম আজম। পরদিন গোলাম আজমের এই মোনাজাতের খবরটি জামাতের মুখপাত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পরিবেশন করতে যেয়ে লেখে- ‘গোলাম আযম পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সত্যিকারের মুসলিম সৈনিক হিসাবে দেশ রক্ষার যোগ্যতা অর্জনের জন্য আল্লাহর দর্গাতে দোয়া করেন। সত্যিকারের মুসলমান ও পাকিস্তানী হিসেবে বেঁচে থাকার ও পাকিস্তানকে চিরদিন ইসলামের আবাসভূমি হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি সর্বশক্তিমানের নিকট দোয়া করেন।’

আবার উপরে উল্লেখিত আল-বদর বাহিনী সম্পর্কে যে বক্তব্য এই বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী দিয়েছিলো সেটি এখানে উল্লেখ করা জরুরী। ১৪-ই নভেম্বর ১৯৭১ সালে নিজামী তাদের মুখপত্র পত্রিকায় একটি কলাম লেখে। কলামের শিরোনাম ছিলো-‘বদর দিবস: পাকিস্তান ও আল-বদর’। যেখানে নিজামী লেখে-

“বিগত দু’বছর থেকে পাকিস্তানের একটি তরুণ কাফেলার ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের ছাত্র প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘ এই ঐতিহাসিক বদর দিবস পালনের সূচনা করেছে। সারা পাকিস্তানে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে এই দিবস উদযাপিত হওয়ার পেছনে এই তরুণ কাফেলার অবদান সবচেয়ে বেশি। হিন্দুবাহিনীর সংখ্যা শক্তি আমাদের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। তাছাড়া আধুনিক সমরাস্ত্রেও তারা পাকিস্তানের চেয়ে অধিক সুসজ্জিত। দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানের কিছু মুনাফিক তাদের পক্ষ অবলম্বন করে ভেতর থেকে আমাদেরকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তাদের মোকাবেলা করেই তাদের সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করেই পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে; শুধু পাকিস্তান রক্ষার আত্মরক্ষামূলক প্রচেষ্টা চালিয়েই এ পাকিস্তানকে রক্ষা করা যাবে না। বদরের যুদ্ধ থেকে অনেক কিছুই আমাদের শিখবার আছে। এই যুদ্ধের সৈনিকরা কেউ পেশাদার বা বেতনভুক্ত সৈনিক ছিলেন না। মুসলমানরা সবাই ছিলেন সৈনিক, তারা সবাই ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ, ঈমানের তাগিদেই তারা লড়তে প্রস্তুত হয়েছিলেন বিরাট শক্তির মোকাবেলায়। বৈষয়িক কোনো স্বার্থ ছিল না তাদের সামনে। মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী এই ছিল তাদের বিশ্বাসের অঙ্গ। ঈমানের পরীক্ষায় তারা ছিলেন উত্তীর্ণ। সংখ্যার চেয়ে গুণের প্রাধান্য ছিল সেখানে লক্ষণীয়। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহের লেশ মাত্র ছিল না তাদের মাঝে। একমাত্র আল্লাহর সাহায্য ছিল তাদের সম্বল। আর আল্লাহর সন্তোষ ছিল তাদের কাম্য। আজকের কাফেরদের পযুর্দস্ত করতে হলে আমাদের মধ্যেও অনুরূপ গুণাবলীর সমাবেশ অবশ্যই ঘটাতে হবে। আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাকীস্তানী সেনার সহযোগিতায় এদেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদরযুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আল-বাদর বাহিনী গঠন করেছে। বদরযুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিনশত তের। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে তারাও তিনশত তের জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বদর যোদ্ধাদের যেসব গুণাবলীর কথা আমরা আলোচনা করেছি, আল-বাদরের তরুণ মর্দে মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাআল্লাহ সেসব গুণাবলী আমরা দেখতে পাবো। পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে গঠিত আল-বাদরের যুবকেরা এবারের ‘বদর দিবসে’ নতুন করে শপথ নিয়েছে, তাদের তেজোদ্দীপ্ত কর্মীদের তৎপরতার ফলেই ‘বদর দিবসের’ কর্মসূচি দেশবাসী তথা দুনিয়ার মুসলমানদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। ইনশাআল্লাহ বদরযুদ্ধের বাস্তব স্মৃতিও তারা তুলে ধরতে সক্ষম হবে। আমাদের বিশ্বাস, সেদিন আর খুব দূরে নয়, যেদিন আল-বাদরের তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দস্থানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে’।

১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যশোরে ছাত্রসংঘের এক সভায় নিজামী বলেন,

“আমাদের প্রত্যেককে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলমান সৈনিক হিসাবে পরিচিতি হওয়া উচিত এবং মজলুমকে আমাদের প্রতি আস্থা রাখার মত ব্যবহার করে তাদের সহযোগীতার মাধ্যমে ঐ সকল ব্যাক্তিকে খতম করতে হবে। যারা সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তান ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে”

[সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১]

শুধু যে উল্লেখিত এসব রাজনৈতিক দল কিংবা নেতাদের বক্তব্য ও বিবৃতিতে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে হত্যাকান্ডের যথার্থতা খোঁজা হয়েছে শুধু তাও নয়। স্বতন্ত্র ব্যাক্তি হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাক্তি এই সময় ইসলামের নাম ব্যবহার করে এই পাকিস্তানী বাহিনীদের হত্যাকান্ডকে সমর্থন করে ও সেটিকে কার্যকর করবার জন্য সহায়তাও করে। এই রকম একজন ব্যাক্তি হচ্ছে বরিশালের শর্ষিনার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ওয়েব সাইটে প্রকাশিত গৌতম চৌধুরীর এই বিষয়ক একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে,

“বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ২৫৬ পৃষ্ঠার ২য় প্যারায় লিখেছেন ৭০ এর নির্বাচনের প্রাক্কালে যে কজন ব্যক্তি বলে বেড়াতেন যে, আমাকে ভোট দিলে ইসলাম বিপন্ন হবে এবং ধর্ম থাকবেনা তাদের মধ্যে শর্ষিনার এই পীর ছিলেন অন্যতম। স্বরুপকাঠীর যুদ্ধকালীন কমান্ডার মোঃ মজিবুর রহমান বলেন, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ আর এই মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধীতা করে পাকিস্তানের সেনা বাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছিলেন এই শাহ আবু জাফর মোঃ ছালেহ। শর্ষিনার মাদ্রাসার আইয়ুব হলে অবস্থান করতে দেয়া হয়েছিল রাজাকার আলবদর বাহিনীর খুনীদের। এখানে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো মুক্তিযোদ্ধা এবং অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষকে। 

মুক্তিযুদ্ধের দুই কিংবদন্তি মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ ও মেজর হায়দার এর ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসান ভূইয়া তার জনযুদ্ধের গনযোদ্ধা বইয়ের ৪২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন স্বরূপকাঠীর শর্ষিনার পীরের বাড়িতে শত্রুর আস্তানা এবং স্থানীয় নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র। এদের সাথে আছে পাকিস্তানী মিলিশিয়া এবং রাজাকার। রাজাকাররা স্থানীয় এবং সেই সুবাদে শত্রুর পথ প্রদর্শক এবং সংবাদদাতা হিসেবেও কাজ করে। 

তিনি লিখেন , শত্রু লঞ্চে ও নৌকায় স্বরুপকাঠী, ইন্দুরহাট সহ অন্যান্য এলাকায় টহল দেয়। এই পশুদের অত্যাচার আর নিষ্ঠুরতা এদেশের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে। ইসলাম রক্ষার নাম করে কি অবিশ্বাস্য পাশবিকতা। মানুষকে এরা নির্দ্বিধায় কাক-শকুনের আহার বানিয়ে ফেলে। এদের কি বিবেচনায় ক্ষমা করা যায়? আকাশের নিচে কোন মানুষের পক্ষে তা অসম্ভব।

এদিকে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর আন্তজার্তিক অপরাধ তদন্ত সংস্থার একটি তদন্ত দল এ,এস,পি মোঃ আব্দুল হান্নান এর নেতৃত্বে স্বরূপকাঠীতে গেলে স্বরূপকাঠীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শর্ষিনার পীর এর স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকান্ডের বিস্তারিত বিবরণ দেন। তারা জানান দরবার শরীফের মধ্যে অবস্থিত মাদ্রাসার পাঁচ শতাধিক ছাত্রকে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরী করা হয় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। 

এই বাহিনী প্রায় পঞ্চাশটি গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর, বাজার ও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকয় লুটপাট করে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণালংকার এবং অন্যান্য মূল্যমান মালামাল নিয়ে আসত। ২৫ নভেম্বর মালেক কমান্ডারের নেতৃত্বে এই পীরের বাড়ি আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা, সেখানে টানা দুইদিন যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা কাজী মতিউর রহমান, আবু জাফর, হারুন-অর- রশিদ সহ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

স্বরূপকাঠী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ১৬ ডিসেম্বর সারা দেশে বাংলাদেশের পতাকা উড়লেও এই দরবার শরীফে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানী পতাকা টানানো ছিল। শর্ষিনার এই পীরকে ২৩ ডিসেম্বর গ্রেফতার করা হয় এবং দালাল আইনের মামলায় ২৬ মাস বরিশাল কারাগারে আটক রাখা হয়। জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি শর্ষিনায় ফিরে আসেন এবং ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের হাত থেকে স্বাধীনতার পদক গ্রহন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি মারা যান”

[সূত্রঃ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ওয়েব সাইট, লেখক গৌতম চৌধুরী, লেখার শিরোনামঃ শর্ষিনার পীর আবু জাফর মোঃ ছালেহকে দেয়া স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের দাবি]

আবার একক ব্যাক্তি হিসেবে চট্রগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী কিংবা তার দুই পুত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিভিন্ন কর্মকান্ড-ও এই লেখায় উল্লেখ করবার প্রয়োজন রয়েছে। ৭০ এর নির্বাচনী প্রচারের প্রাক্কালে ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন-

“জয় বাংলা স্লোগানটি মূলত ভারতের হিন্দুদের থেকে আমদানীকৃত এবং এই স্লোগান দিলে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের লুঙ্গি ছেড়ে দুতি পরতে হবে”

জামাতের আরেক নেতা, যার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রমাণিত হবার কারনে মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত হতে হয় সেই নেতা ১৯৭১ সালের ১৫-ই সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রামে একটি কলাম লেখেন। কলামের শিরোনাম ছিলো “অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রঃ যুক্তি নয়”। এই কলামে মুজাহিদ লেখে- 

‘পৃথিবীর শেষ্ঠতম ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান ও এ দেশের মানুষ আজ অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রু উভয়পক্ষের শিকারে পরিণত হয়েছে। বিলম্ব হলেও বৈষম্যজনিত সমস্যা সমাধানের যখন যাবতীয় পথ উন্মুক্ত হয়ে ওঠে, তখন এ দেশ ও দেশবাসী মুসলমানদের ঘোর শত্রুরা তাদের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করতে এগিয়ে আসে। কেননা তারা বুঝতে পেরেছিল যে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাধাণ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবার যদি আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীভূত করা যায়, তা হলে এ দেশকে ধ্বংসের পরিকল্পনা চিরতরে বানচাল হয়ে যাবে। তাই তারা বিচ্ছিন্নতা ও মুসলিম হত্যা অভিযান চালায় যার ফলে এ পর্যন্ত ‘হিন্দু গুণ্ডা’ ও তাদের এখানকার দালালরা প্রায় দু’ লাখের বেশি মুসলমানকে হত্যা করেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তথাকথিত মুক্তি আন্দোলনের শ্রুতিমধুর কথা শুনে প্রথম দিকে এ দেশের কোনো কোনো মানুষ বিভ্রান্ত হলেও সকলেই এখন বুঝতে পেরেছে যে, এ আন্দোলন মুক্তির নয়, হিন্দুদের গোলাম বানানোর আন্দোলন এবং এখান থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের খতম করে এটাকে স্পেন বানাবার আন্দোলন। মূলত এ কারণেই আজ এ দেশের ঈমানদীপ্ত মুসলমানরা জেগে উঠেছে। তারা আজ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। ওই বেইমান বিশ্বসঘাতক মিরজাফরদের বিরুদ্ধে’।

এই সুনির্দিষ্ট লেখাতেই যে কয়েকটি ব্যাপার খুব সু-স্পস্ট হয়ে ওঠে তা হচ্ছে 

(১) পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণভাবে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ উল্লেখ করে সেই ফ্রেমে অন্যসব ধরনের দাবী দাওয়া, আন্দলোন সংগ্রামকে তুলে ধরে এক ধরনের জিঘাংসামূলক ও প্ররোচনামূলক প্রচার,
(২) পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর নির্মম হত্যাকান্ডের পুরো দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে হিন্দু ধর্মালম্বীদের ওপর
(৩) ইসিলাম বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে এই মুক্তিযুদ্ধের ফলে। 

[তথ্য সূত্রঃ সহুল আহমেদ এর লিখিত প্রবন্ধ, ধর্মের ব্যবহার এবং ১৯৭১:দালালনামা]

উপরের এই বিভিন্ন ব্যাক্তি কিংবা রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্ধৃতি ও কর্মকান্ডগুলো অনুধাবন করবার জন্য চিন্তার গভীরে যাবার প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিক ভাবে পড়লেই বুঝতে পারা যায় যে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের নির্মম সময়টিতে এই সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল শামস, শান্তি বাহিনীর সদস্য সহ জড়িত প্রত্যেকেই ইসলাম ধর্মকে ঢালের মত সামনে তুলে ধরেছেন। ইসলামকে সামনে রেখে নিজেদের অন্যায়কে বার বার যথার্থ করবার চেষ্টা করে গেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা তারা ধর্মকে উপজীব্য করে, ধর্মের ওপর সওয়ার হয়ে মানুষকে ভুল শিখিয়েছে এবং ধর্মের নামে মিথ্যে বলে তাদের হত্যাকান্ডের পথে আসবার জন্য উৎসাহ দিয়ে গেছে এবং পরবর্তীতে তারা এই অন্যায়কে বৈধতা দেবার জন্যও ধর্মকে তাদের নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করেছে।


No comments:

Post a Comment