Monday 21 March 2016

একাত্তরের ঘাতকদের বিচারে মুসলিম আইডেনটিটির অপঃব্যবহার- পর্ব-২

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দুই সময়ের বিচার পর্ব এবং সেখানে মুসলিম আইডেনটিটির ব্যবহার


এই লেখাটির ১ম পর্ব পড়তে হলে ক্লিক করুন এখানে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একদিকে যেমন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের অনুসারীদের বক্তব্য ও চিন্তা করবার ভিন্নতা রয়েছে তেমনি সেটির সূত্র ধরে ঐতিহাসিক বিষয়াদির গুরুত্বও অনস্বীকার্য। এই অঞ্চলে ধর্মকে কতটা গুরুত্বপূর্ন করে দেখা হয়, এটার রাজনৈতিক অবস্থান, মেরুকরন ও রাজনৈতিক তারতম্যের কারনে ধর্মের অবস্থান ও জনতার ভাবনা প্রতিটি বিষয়-ই আসলে আলোচিত হওয়া একান্ত জরুরী। উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে হয়ত একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে অখন্ড পাকিস্তানে ধর্ম ব্যাপারটি সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। গুরুত্বপূর্ণ থাকলেও ধর্মের প্রতি আনুগত্য, মানবার প্যাটার্ন, ধর্ম পালন করবার রীতির মধ্যে ফারাক ছিলো দুই খন্ডের পাকিস্তান ভেদে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান ঘোষনা দিয়ে হয়েছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র আর পূর্ব পাকিস্তান মানে বাংলাদেশ হয়েছে অসাম্প্রদায়িক মোনোভাবাপন্ন একটি রাষ্ট্র যেই রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির একটি নীতি-ই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। 

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মকে সমীহ ও ধর্মকে যথাযথ পবিত্রতার মাধ্যমে পালন করলেও অধিকাংশ মানুষ ধর্ম নিয়ে কখনোই বাড়াবাড়ি করেনি কখনো। আর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ যুদ্ধ করেছে সকল ধর্মের মানুষ একত্রিত হয়েই। উল্লেখিত সেই সহযোগী বাহিনী, ব্যাক্তি ও তাদের অনুসারীরা ছাড়া আর কেউই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ধর্মকে কখনোই এই যুদ্ধের প্রধান বিষয় বলে মনে করেনি কিংবা কখনোই মনে করেনি এই যুদ্ধ ভারতের চাল বা ছল, এমনকি এই যুদ্ধে বাংলাদেশ আলাদ রাষ্ট্র হলে ইসলাম বিপন্ন হবে কিংবা পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে ইসলাম শেষ হয়ে যাবে এমন কথাও সাধারণ মানুষ চিন্তা করেনি।

এই যুদ্ধ যে ছিলো নিজের অস্তিত্ব আর অধিকারের লড়াই, এই যুদ্ধ যে ছিলো বাংলাদেশীদের স্বকীয়তার লড়াই, এই যুদ্ধ যে ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই সেটি জানত এই অঞ্চলের সকল বাংলাদেশী। ধর্মের সাথে এই যুদ্ধের আসলে কোনো সম্পর্কই ছিলোনা এবং ধর্মের সাথে এই স্বাধীনতার যুদ্ধকে মিলিয়ে ফেলে যারা নৃশংস গনহত্যায় অংশ নিয়েছে তারা মূলত ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের কার্য হাসিল করতে চেয়েছে মাত্র। তারা সব সময় ধর্মকে উপজীব্য করে গণতান্ত্রিক শাষন ব্যবস্থা অতিক্রম করে সামরিক শাষকেদের আজ্ঞাবহ থেকে শুধু এই অঞ্চলের ক্ষমতা পেতেই ছিলো পরম ভাবে আগ্রহী। 

এই দলগুলো সব সময় জানতো যে গনতান্ত্রিক শাষন ব্যাবস্থায় তারা এই অন্তত এই অঞ্চলে কখনোই ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আর এই অংশের প্রায় শতকরা ৯৫ জন মুসলমান হবার পরেও এইসব ইসলাম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে কখনোই সাধারণ জনতা সমর্থন করেনি কেননা বাংলাদেশ অংশে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির প্রতি অধিকাংশ জনতার একটা অনীহা ছিলো দীর্ঘদিন ধরেই। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নৃশংস আক্রমণ এবং তাদের হিংস্রতার ফলশ্রুতিতে এই সহযোগী বাহিনীরা শুরু থেকেই ভেবে এসেছে যে এই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান নিশ্চিত ভাবে জয়ী হবে এবং যুদ্ধ শেষে ক্ষমতার মূল মালিকানায় তারাই থাকবে। কিন্তু এরা কখনোই চিন্তা করতে পারেনি যে তাদের মাঝপথে রেখে পাকিস্তানী বাহিনী আত্নসমর্পণ করবে এবং পালিয়ে যাবে। 

সুতরাং যখন পাকিস্তানী বাহিনী যুদ্ধের ৯ মাসের সময় বাংলাদেশের কাছে আত্নসমর্পণ করলো তখন সবচাইতে বড় বিপদে পরে গেলো এই পাকিস্তানী আর্মির এই বাংলাদেশীয় দালালেরা। 

ধর্মের কথা বলে ৩০ লক্ষ কিংবা তারও অধিক মানুষকে খুন, ৪ লক্ষ কিংবা তারও অধিক নারী ও শিশু নির্যাতন, ১ কোটি কিংবা তারও অধিক মানুষকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করাসহ আরা নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধের পক্ষে আর কোন যুক্তি-ই এদের কাছে অবশিষ্ট ছিলোনা।

কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে এই অপরাধীরা যখন আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়ালো তখন তারা সেই আগের মতোই ইসলাম ধর্মকে ঠিক তাদের সামনে এনেন্ডহালের মত হাজির করলো। তারা হত্যা করেছে যেই ইসলামের নামে ঠিক হত্যা থেকে বাঁচতে আবারো সেই ইসলাম ধর্মকে বেচতে শুরু করে দিলো।

“পাকিস্তান আল্লাহর ঘর তাকে বাঁচাতেই পাকিস্তানীদের সাথে হাত মিলিয়েছিলাম”, “ইসলাম ধর্মকে বাঁচাতে এই যুদ্ধে পাকিস্তানীদের সাথে ছিলাম”, “আমরা আল্লাহর প্রেরিত রাসূলের ধর্ম ও তাঁকে বাঁচাতে পাকিস্তানীদের সাথে হাত মিলিয়েছিলাম”, এই ছিলো এই সব খুনীদের বক্তব্য। 

আলোচ্য এই অধ্যায়ের ক্ষেত্রে আমরা যদি দুইটি ভাগ আলাদা আলাদা পর্যালোচনা করি তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পর বিচারিক ক্ষেত্রে দুইটি সময় এবং দুইটি আলাদা আলাদা আইনে আমরা পাকিস্তানী সহযোগী বাহিনীদের বিচার পরিলক্ষন করি। 

(ক) দালাল আইনে বিচার, সময়কাল ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ এবং 

(খ) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন-১৯৭৩ এর মাধ্যমে ট্রাইবুনাল গঠন করে বিচার। সময়কাল ২০১০ থেকে বর্তমানেও চলছে।

(ক) ১৯৭২ এর দালাল আইনে বিচার ও সেখানে মুসলিম আইডেনটিটির ব্যবহার

মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পরপর কথা সাহিত্যিক জহির রায়হান বুদ্ধিজীবি হত্যা কমিশন করবার জন্য একটি কর্মসূচী হাতে নেন। সেটির দাবী জীবন্ত থাকতে থাকতেই বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালেই দালাল আইন-১৯৭২ এর মাধ্যমে একাত্তর সালে যেসব ব্যাক্তি (১) পাকিস্তানী বাহিনীকে বাংলাদেশে বেয়াইনী দখল টিকিয়ে রাখবার জন্য সমর্থন করেছিলো (২) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে কোনো চুক্তি কিংবা কোনো ধরনের বস্তুগত সাহায্য কিংবা সহোযোগিতা করেছিলো (৩) গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছিলো (৪) মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার বিরুদ্ধে কিংবা মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলো (৫) পাক বাহিনীর পক্ষে কোনো বিবৃতি প্রদান, প্রচারণা, পাক বাহিনীর কোনো প্রতিনিধি দলের সদস্য হওয়া, কমিটির সদস্য হওয়া, তাদের আয়োজিত নির্বাচনে অংশ নেয়া ইত্যাদি কাজে অংশ নিয়েছিলো, বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছিলো। 

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দালালীর জন্য ১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আটক হয় - ৩৭ হাজার ৪ শত ৯১ জন। ট্রাইবুনাল গঠিত হয়- ৭৩ টি ( সারা বাংলাদেশে ) ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত উক্ত ট্রাইবুনাল গুলোতে দায়ের করা মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয় মোট ২ হাজার ৮ শত ৪৮ টি মামলা ।দোষী প্রমাণিত হয় - মোট ৭৫২ জন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়ঃ প্রায় ২০ জনেরও বেশী। মামলায় খালাশ পায় - ২ হাজার ৯৬ জন । আইনগত ব্যাবস্থায় দ্রুততা আনার জন্য সে সময় ৭৩ টি ট্রাইবুনালের ব্যাবস্থা করা হলেও প্রতিদিন ৩-৪ টির বেশী মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব হয়নি এবং মাসে যার পরিমাণ ছিলো ১৩০ টির মত মামলা।

এই আটক ব্যাক্তিদের মধ্যে সমাজের নানা পেশা, অবস্থান কিংবা অর্থনৈতিক ঘরানার আসামী ছিলো। আর এই আসামীদের মধ্যে নিজেদের অপরাধ লুকোবার একটা সহজ পন্থা তৈরী হয়েছিলো আর সেটি হচ্ছে মূলত পাকিস্তানী আর্মিদের সহযোগিতা তারা করেছে শুধু ইসলামকে রক্কা করতেই। পাকিস্তান অখন্ড থাকলে ভারতের মত “হিন্দু” দেশ আর কিছু করত পারবে না ফলে মুসলমানের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এই ছিলো এইসব ধর্মীয় বেত্তাদের যুক্তি।

এইসব তথাকথিত ইসলামী বেত্তাদের এইভাবে একা ফেলে রেখে যে পাকিস্তানী বাহিনী পালিয়ে বাঁচলো সে সময়ে এই সহযোগী বাহিনীদের মানসিক অবস্থা আসলে কেমন ছিলো সে সময়? এই তাদের একা করে রেখে পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক কতটা অসহায় করে দিয়েছিলো এই দেশীয় সেসব রাজাকার ও আল-বদরদের? এই পুরো ব্যাপারটি জানতে আসলে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এইসব দালালদের আত্নকথা কিংবা তাদের কিছু লেখা পড়ে আঁচ করা সম্ভব হয়।

একাত্তরের ঘাতক, দালাল আইনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামী এ বি এম খালেক মজুমদারের লিখিত আত্নকথা জাতীয় বই “শেকল পরার দিনগুলি” বইটির ১৬ পৃষ্ঠার তৃতীয় প্যারায় খালেক পাকিস্থানী বাহিনীর এই অকষ্মাৎ পলায়নের প্রেক্ষিতে লেখে- 

“কিন্তু হায়!! সব ধারনা্র মূল ছিন্ন করে সবাইকে বিষ্মিত করে দিয়ে যখন ১৬-ই ডিসেম্বর তাঁদের আত্ন গ্লানি শোনা গেলো তখন সকলেই বিষ্ময় বিমুড়। সেদিনই ভোরে সিটি আমীর গোলাম সরওয়ার আমাকে ত্বরা করে ডেকে পাঠালেন সিটি জামায়াত অফিসে। বাসা থেকে তড়ি ঘড়ি করে ছুটে এলাম। তখোনো আমি সব খবর জানিনা। ওখানে গিয়ে বৃত্তান্ত শুনে হতাশায় ছেয়ে গেলো মন। শিউরে উঠলো প্রতিটি লোমকূপ”

আবার পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষের বিখ্যাত দালাল, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংরেজীর প্রফেসর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন তার রচিত “একাত্তরের স্মৃতি” বইয়ে এই বিষয়ে বার বার নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছে, বার বার আনে-বানে পাকিস্তানী বাহিনী কেন তাদের এভাবে এতিম করে ফেলে রেখে গেলো কিংবা এখন এই বাংলাদেশের কি হবে এসব নিয়ে নানাবিধ বক্তব্য পাই। 

সাজ্জাদের উল্লেখিত বইয়ের ১৪৭ নাম্বার পাতায় সাজ্জাদ তার প্রভুদের নিশ্চিত পরাজয়ের গ্লানি ঢেকে রাখতে পারেনি। “১৪-ই ডিসেম্বর” শিরোনামের এই অংশে সে বুঝাতে চাইলো যে এই জয়ে গৌরবের কিছু নেই কেননা মুক্তিবাহীনি ভারতীয় আর্মির সহযোগিতায় আসলে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করেছে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্য মিলে যে মিত্র বাহিনী তৈরী হয়েছিলো এটি সাজ্জাদের ভাষায় ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া।

এই বইয়ের ১৪৮ নাম্বার পৃষ্ঠায়। এই অংশে ওই একই শিরোনামের অধীনে সাজ্জাদ হোসাইন বলেন যে ১৬-ই ডিসেম্বর তার এলাকাতে নাকি কোনো আনন্দ উৎসব হয়নি বিজয়ের পরে। একই সাথে তিনি এই তথ্যও দিতে ভোলেন নি যে আত্নসমর্পণের পর নিয়াজী নাকি কেঁদে দিয়েছিলো এই বাংলার জন্য।

সাজ্জাদ হোসাইন আগা গোড়াই ছিলেন একজন সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী ঘরানার ব্যাক্তি। দীর্ঘ নয় মাস ধরে পাকিস্তানী বাহিনী যে নির্মম হত্যাকান্ড চালিয়েছে এবং সাজ্জাদ যেই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিলো (ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হত্যাকান্ডে) সেটি সাজ্জাদের কাছে এক ধরনের ধর্মকে রক্ষা করবার যুদ্ধ ছিলো। তার লেখা উল্লেখিত বইটিতে এটির দেখা মেলে প্রতিটি পৃষ্ঠাতেই অথচ শুধু স্বাধীনতা পাবার জন্য মুক্তিবাহিনীর যে কোনো কর্মকান্ডের প্রতিই বিষেদাগার আর তার প্রতিটি পাতাতেই রয়েছে মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি কার্যক্রমকে হয় “নির্মমতা বা নিষ্ঠুরতা” হিসেবে দেখানো না হয় সেটি “ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র” হিসেবে দেখানো।

মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকার সাজ্জাদ হোসাইনকে বিক্ষুব্ধ জনতা যখন উত্তম মধ্যম দিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যায় এবং বেঁচে যাওয়া সাজ্জাদ জ্ঞান ফিরে পেয়ে কি বলছেন সেটি তার বইয়ের বয়ানেই চলুন দেখি। সেখানে সে লিখেছে যে সে সধারণ জনতাকে বলছে-

“আমি আবার লোকজনকে বললাম, আমাকে একটু রিকশায় তুলে বায়তুল মোকাররম মসজিদে দিয়ে আসতে "

(সূত্রঃ একাত্তরের স্মৃতি, লেখকঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, পৃষ্ঠাঃ ১৫৫, ২য় প্যারা)

মজার ব্যাপার হচ্ছে একজন ব্যাক্তি যাকে বিক্ষুব্ধ জনতা দালালির অভিযোগে গণধোলাই দিয়ে রাস্তায় ফেলে রেখে গেছে এবং আধমরা অবস্থায় সে লোক হাসপাতালে নেবার অনুরোধ না করে যেতে চাইছে বায়তুল মোকাররম মসজিদে। এর থেকে মিথ্যে ও হাস্যকর বয়ান কি হতে পারে, আমার জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘদিন পর একাত্তরের স্মৃতি লিখতে গিয়ে এই রাজাকার লিখিত বইয়েও চরম মিথ্যাচার করেছে ইসলামকে উপজীব্য করে। উদ্দেশ্য সহজেই বুঝতে পারা যায় যে সাধারণ মানুষ যাতে এই বইটা পড়ে সাজ্জাদের সম্পর্কে ভেবে বলুক “আহারে এই লোকটা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ঘরের কথাই মনে করছে কিংবা ইসলামের কথাই ভাবছে”

কত সহজেই শুধু মাত্র ধর্মকে পুঁজি করে এই জাতীয় মিথ্যাচারগুলো করা সম্ভব হয়ে ওঠে। সাজ্জাদের এই বইটি প্রথবার প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৩ সালে। ততদিনে বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদীর দল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, জেনারেল জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া মিলে রাজাকার আর আলবদরদের এই বাংলাদেশে রাজনীতি করবার সুযোগ করে দিয়েছে সুতরাং ১৯৯৩ সালে এসে ঝোঁপ বুঝে কোপ মারবার মত নিজের স্মৃতির সাথেই সাজ্জাদ প্রতারণা করেছে এইভাবে নানাবিধ মিথ্যে তথ্য দিয়ে।

এই বইয়ের “শহীদের বন্যা” অধ্যায়েও সাজ্জাদ বার বার ইসলামকে টেনে এনেছে। এই অধ্যায়ের শুরুতেই সাজ্জাদ জানায় যে মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের নাকি “শহীদ” বলাটা অন্যায়। শুধু মাত্র ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ করে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের মৃত্যু হলেই তাঁদের শহীদ বলা যাবে।

শুধু শহীদ বলতে পারা কিংবা না পারার জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দিয়েই সাজ্জাদ ক্ষান্ত থাকেনি বরংচ মুক্তিযুদ্ধের পর নাকি ইসলামের নাম ও নিশানা মুছে ফেলবার চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুর শাষনামলে এমন অভিযোগে ভরপুর এই অধ্যায়। রাস্তা-ঘাট থেকে নাকি ইসলামী ব্যাক্তিদের কিংবা ভাবধারার ব্যাক্তিদের নাম উঠিয়ে অ-ইসলামী ব্যাক্তিদের নামে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এই ধরনের ইতিহাসের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করায় সাজ্জাদ। উদাহরন দিতে গিয়ে এই একই অধ্যায়ের তৃতীয় প্যারায় সাজ্জাদ উল্লেখ করে যে কবি আল্লামা ইকবালের নামের হল পরিবর্তন করে রাখা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, জিন্নাহর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সূর্য সেন হল, ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের নাম পরিবর্তন করে রাখা হোলো কবি নজরুল ইসলাম কলেজ, কায়েদে আজম কলেজের নাম পরিবর্তন করে রাখা হোলো শহীদ সোহরোওয়ার্দী কলেজ। সাজ্জাদের মতে এসব সবকিছুই হচ্ছে ইসলামের নাম মুছে দেবার পাঁয়তারা। 

সাজ্জাদ হোসাইন ১৯৭২ সালের দালাল আইনে আটক হয় এবং জেলে প্রবেশ করে। মজাত ব্যাপার হচ্ছে এই জেলের জীবন নিয়ে তার বইয়ে যে অধ্যায়টুকু সে লিখেছে সেখানে প্রতি শব্দে ও প্যারাতে সে প্রাণপণভাবে পাঠকদের এটাই বুঝাবার চেষ্টা করেছে যে এই জেলে সে বন্দী হয়েছে ইসলামের পক্ষে থাকবার কারনে, এই জেলে নামাজের সু-ব্যবস্থা নেই, তার মত ইসলাম “মনষ্ক” ব্যাক্তিদের কোনো সম্মান নেই। এই অধ্যায়ে এসে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সাজ্জাদ বার বার তার নামাজ পড়া, অজু করা এসবের বিবরণ দিচ্ছে এবং সে সময় জেলে তারই মতন আর যারা দালাল আটক ছিলো তারা কেউ কেউ গভীর রাতে কোরান শরীফ পড়তো, আজান দিতো, নামাজ পড়তো, সূরা পড়ত। 

ইসলাম নিয়ে চিন্তা করত, বই লিখত এই ধরনের বর্ণনা দিয়েছে। অসম্ভব এক ধুর্ততার সাথে এই দালাল আইনে আটক ব্যাক্তিটি সাধারণ পাঠকের মনে একটি ব্যাপারই ঢুকাতে চাইছিলো যে দালাল আইনে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো, যাদের বিচার চলছিলো বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে তারা প্রত্যেকেই আসলে এখানে গ্রেফতার হয়েছে ইসলামের প্রতি অনুগত ছিলো বলেই। পুরো বইটিতে সাজ্জাদ শুধু একটি মূল বিষয়কেই ফোকাস করে সামনে এগিয়েছে আর সেটি হচ্ছে পাকিস্তানের সাথে থাকাটা ছিলো ইসলামকে সঠিকভাবে সেবা করার সামিল এবং তার মত কিছু ব্যাক্তিরা পাকিস্তানী আর্মির হত্যাযজ্ঞের সাথে যোগ দিয়ে ইসলামকেই সেবা করেছে আর অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মানে বাংলাদেশ একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে আত্ন প্রকাশ করেছে, অন্য কিছু নয়।

এই একই ধরনের ভাবধারা প্রকাশের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা যায় দালাল আইনে সাজা প্রাপ্ত আরেক রাজাকার এবি এম খালেক মজুমদারের লিখিত বই “শেকল পরা দিনগুলি”। এ বি এম খালেক মজুমদার মুক্তিযুদ্ধের পর পর গ্রেফতার হয় মুজিব বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। বুদ্ধিজীবি শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরন ও হত্যা করবার অভিযোগে খালেক রাজাকারকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরবর্তীতে তাকে সাত বছরের কারাদন্ডও দেয়া হয়। 

একটু দেখা দরকার যে রাজাকার খালেক তার বিচারপর্বে কিভাবে নিজের অপরাধকে অস্বীকার করে বার বার ইসলাম ধর্মকে ঢালের মত সামনে নিয়ে এসেছে। বইটির শুরুতেই দেখা যাচ্ছে খালেক মজুমদার বইটি উৎসর্গ পত্রে লিখেছে “ইসলামী আন্দলোনের নিবেদিত প্রাণ মুজাহিদ-ভাই বোনদের উদ্দেশ্যে”। এই উৎসর্গ পত্রের এমন বাক্য গঠন ও শব্দের উদ্দেশ্যে বুঝতে পারাটা খুব কঠিন কিছু নয়। মূলতঃ বইয়ের শুরুতেই একটি অবহ তৈরী করে ফেলা নিজের মূল আইডেনটিটি লুকিয়ে। একজন অপরাধী যিনি মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস ধরে পাকিস্তানী নির্মম হত্যাযজ্ঞের পক্ষে সায় দিয়ে ও জড়িত থেকে সেই হত্যাযজ্ঞকে লুকিয়ে রেখে পুরো ব্যাপারটিকে জায়েজ করতে চায় “ইসলাম ধর্মের সেবা” করেছে এই তত্ব দিয়ে, স্বাভাবিকভাবেই এটি বোধগম্য হয় যে ইসলাম ধর্মটিকে দাবার গুটির মত সামনে দিয়ে সেই গুটির আড়ালে নিজের অপঃকর্মকে জাস্টিফাই করবার অপঃউদ্দেশ্যেই সেটি করা হচ্ছে।

খালেকের বইয়ের ১৩ নাম্বার পৃষ্ঠা্র দ্বিতীয় প্যারায় উল্লেখ রয়েছে তাকে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা যখন আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো সেই মুহূর্তের বর্ণনা। এই জিজ্ঞাসাবাদকে খালেক তার বইয়ে উল্লেখ করেছে “নির্যাতনের প্রস্তুতি” হিসেবে। নিজেকে একজন নির্যাতিত হিসেবে উল্লেখ করে সাথে সাথেই খালেক পাঠকদের মধ্যে এক ধরনের ধর্ম ভিত্তিক প্রতিক্রিয়ার উদ্দেশ্যে নিজেকে কিছু সাহাবীদের সাথে তুলনা করে ফেললো। এই পর্যায়ে এসে খালেক নিজেকে সাহাবী হযরত ইমাম আহম্মদ বিনতে বিন হাম্বল, হাসানুল বান্না সাইয়েদ কুতুবের সাথে নিজেকে তুলনা করে এবং বুঝাবার চেষ্টা করে যে উল্লেখিত তিনজন সাহাবী যেমন তাঁদের উপর নানাবিধ অত্যাচারের সময় আপোষহীন ও বীরত্বপূর্ণ আচরণ করেছে ঠিক তেমনি সেও তেমন বীরত্বপূর্ণ আচরণ করবে। 

দুটো সম্পূর্ণ আলাদা প্রেক্ষিতের দুটো ঘটনাকে চট করে একত্রিত করে খালেক ঠিক এই যায়গায় পাঠকের মনে এমন একটি আবহ তৈরী করবার চেষ্টা করলো যেখানে একজন সাধারণ পাঠকের মনে হতে পারে যে খালেকের মত একজন নিরাপরাধ ব্যাক্তিকে খুব সম্ভবত নির্যাতন করা হচ্ছে ইসলাম ধর্মটি পালন করবার জন্য।

খালেক ভুল করেও কোথাও বলেনি যে মুক্তিযুদ্ধের ৯ টি মাস পাকিস্তানী আর্মিরা যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে এবং সেই হত্যাযজ্ঞে যে খালেকের মত এমন রাজাকাররা ইন্ধন দিয়েছে। খালেক তার এই সুনির্দিষ্ট অংশে এটিও উহ্য রেখেছে যে ও এইসব হত্যাকান্ডে খালেক অংশ নিয়েছে এবং তার ফলশ্রুতিতেই আজকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এসব উল্লেখ করা ছাড়াই খালেক নিজেকে এমন ভাবে এখানে সাধারণ পাঠকের সামনে উপ্সথাপন করছে যেখানে মনে হতে পারে খালে ইসলাম রক্ষা করতে গিয়েছিলো এবং সে কারনেই তাকে ধরে বেঁধে রাখা হয়েছে।

খালেকের পুরো বইটিতে প্রতি প্যারায় কিংবা লাইন কিংবা শদে ইসলাম ধর্মকে তার নিজের স্বার্থে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যখন যেখানে নিজের অপরাধকে যথার্থকরণের প্রয়োজন পড়েছে ব্যাস চট করে খালেক ধর্মের একটা গুটি এনে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।

মুক্তিযুদ্ধের বিষয়কে যদি আমরা খালেকের মত ইসলামের আদলে দেখি তাহলেও তো এতবড় জোচ্চুরি করা এখানে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক উপায়ে আওয়ামীলীগ ৭০ এর নির্বাচনে জয় লাভ করে। জয় লাভ করবার পরেও পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আওয়ামীলীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি বরং একটা পর্যায়ে ২৫ শে মার্চের কালো রাত্রে পাকিস্তানী বাহিনী রাতের আঁধারে অতর্কিতে হামলা চালায় বাংলাদেশীদের ওপর। ইসলামিক দৃষ্টিতেও যদি আমি দেখতে চাই তবে বলতে হয় যে এটি মজলুমের উপর অন্যায় হামলা। 

মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র গ্রন্থ কোরান শরীফে ঘোষণা করেছেন যে, 'নির্দিষ্ট কোনো জাতির বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে তাদের প্রতি অবিচার করতে উদ্বুদ্ধ না করে। তোমরা নির্বিশেষে সবার প্রতি সুবিচার করো। কারণ এটাই তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী। (জেনে রেখো) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজের খবর রাখেন। (সুরা আল-মায়িদা, আয়াত-৮)। উপরের এই আয়াত থেকে সহজেই অনুমেয় যে মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ের পাকিস্তানী ও তার সহযোগী বাহিনীর যে অত্যাচার এই নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের উপর হয়েছিলো সেটি ছিলো মজলুমের উপর অবিচার এবং সেটি ইসলামের দৃষ্টিতেও অপরাধ।

খালেক তার বইতে এই পুরো ব্যাপারটি-ই আসলে এড়িয়ে গেছে সন্তর্পণে। এই বইটি আসলে এক ধরনের এজেন্ডা ভিত্তিক বই। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দালাল আইনে বিচার এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে শাস্তির পুরো বিধানটা এমনভাবে অবৈধ ও অনৈতিক হিসেবে দেখানো হচ্ছে যেটি দেখলেই মনে হতে পারে যে বাংলাদেশ সরকার নিরাপরাধ কিছু ব্যাক্তিকে অকারণে বিচারের আওতায় এনেছে। খালেকের বইয়ের আসলে একটি দুটি অধ্যায় নয়। পুরো বইটি জুড়েই চটুল ভাবে নিজেকে “ইসলামের সেবক” হিসেবে এমন ভাবে জাহির করা হয়েছে যে একজন একেবারে সাধারণ মানুষও এই ভন্ডামীটুকু খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে এটি হচ্ছে নিজের দালালির ইতিহাসকে ধামচাপা দেবার একটা নোংরা কৌশল। আর এই কৌশল করতে গিয়ে যেই ধারনাটিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে সেটি হচ্ছে ধর্মের বিশ্বাস। ইসলাম ধর্মকে নানা ভাবে, নানা কায়দায় সামনে নিয়ে এসে নিজের অপঃকর্মগুলোকে ধর্মের ছায়াতে আচ্ছাদিত করে দিয়েছে সুনিপুন ভাবে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে জন্মানো নতুন প্রজন্মের কেউ যদি এই বইটি পড়লে মনে হতে পারে যে একজন ইসলামের বড় পাহারাদারের উপর এত বড় খড়গ নেম৪এ এসেছে, তার প্রতি অন্যায় হয়েছে।

খালেকের পুরো বইটিতে নানাবিধ অধ্যায় ও তার শিরোনাম দিয়ে সাজানো। এক একটি অধ্যায়ে সেই শিরোনামের বিষয় ধরে ধরে আগানো। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রতিটি অধ্যায়ে খালেক প্রাসঙ্গিক না হলেও তার ধর্ম চর্চার বিষয়টি না এনে তার প্রতি দয়া ও দাখিণ্য যেন পাঠকের মনে পুরো বইটি পড়বার সময় ও পরেও জারি থাকে সেটি সে নিশ্চিত করতে চেয়েছে। যেমন কারাগারের অধ্যায়ে সে মূলত বেশী বর্ননা করেছে কি করে ওজু করলো, নামাজ পড়বার জন্য জায়নামাজে বসলো, কিভাবে আজান হোলো এইসব আলোচনা। এত বড় এক ইসলামের সৈনিক হিসেবে নিজেকে বার বার পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছে অথচ বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭৩ সালের ৩০ শে নভেম্বর সাধারণ ক্ষমতা ঘোষনা করলেন এই খালেক কিন্তু সেই ক্ষমা ঘোষনার প্রেক্ষিতে সরকারের অনুকম্পা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো যেটির প্রমাণ আমরা পাই এই বইয়ের ১৫ নাম্বার পৃষ্ঠায়। আল্লাহির সৈনিক আল্লাহর কাছে অনুকম্পা না চেয়ে দুনিয়াবি অনুকম্পার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এই পুরো ব্যাপারটি খালেকের মুখ থেকে চট করে তার ইসলামের মুখোশটা টেনে খুলে ফেলে।

বইটির ২১ পৃষ্ঠার তৃতীয় প্যারায় খালেক আবার সেই পুরোনো সুত্র ধরেই নিজের অপরাধের যথার্থকরন প্রক্রিয়ায় ফিরে গেছে। আবার সে বলছে বিশ্ব উম্মাহ ও মুসলমানদের হেফাজতের জন্য তার পাকিস্তানের পক্ষে থাকার কথা। অথচ একজন স্বাভাবিক মানুষের কাছে এটাই আসলে বোধগম্য নয় যে ৩০ লক্ষেরও উপর সাধারণ মানুষ খুন করে কিংবা ৪ লক্ষেরও উপর নারী ও শিশুকে নির্যাতন করে কিভাবে ইসলামী উম্মাহর উন্নতি সাধন করা যায়। ইসলামের কথা বলতে গিয়ে আর ইসলামকে বিক্রি করতে গিয়ে খালেক ইসলামকে মানুষের সামনে নীচু থেকে নীচুতর করে দিচ্ছে।

আগেই বলেছি যে খালেক শহীদ বুদ্ধিজীবি শহীদুল্লাহ কায়সার অপহরন ও হত্যা মামলায় আটক হয়ে বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলো। এই বিচারের নানাবিধ বর্ণনা দেবার সময় কিংবা তার বয়ানেই আমরা জানতে পারি যে বিচারের বিভিন্ন সময়ে সে কি করে “ইসলামী আদর্শের লোক বলেই তার উপর এই অত্যাচার ও নির্যাতন হচ্ছে” এই বক্তব্যটি সবার সামনে তুলে ধরেছিলো। 

আদালতে আনবার সময় খালেকের জাতে পায়ে ডান্ডাবেড়ী পরানো থাকতো, হাতে থাকতে হাত কড়া। লেখার একটা পর্যায়ে এসব নিয়ে তার নানাবিধ ক্ষোভ প্রকাশ পেত। তারমত এমন ইসলামের সেনাকে এইভাবে অপমান করা হচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে খালেক তার কিছু পরের লাইনেই এই ডান্ডাবেড়ী পড়াকে কিংবা হাতে হাতকড়া পরাকে মনে নিচ্ছে নিজেকে প্রবোধ দিতে দিতে। কখনো সে নিজেকেই বুঝিয়ে বলছে যে আল্লাহর পথে যারা থাকবে তাদের এমন কষ্ট সহ্য করতেই হবে, তাদের এমন দুঃখ বেদনা সহ্য করতেই হবে অথচ তার আবার কিছুক্ষন পর এইসব ডান্ডাবেড়ী ও হাতকড়া তার পায়ে কেন এসব প্রশ্ন নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন করে বসে। খালেকের এই বিশ্বাসের দ্রুত ওঠা-নামা আসলে তার নিজের বক্তব্য ও বিশ্বাসকে-ই মূলত হালকা করে তোলে। এটা বুঝতে বাকি থাকেনা যে নিজের ধর্ম বিশ্বাসের উপরই তার কোনো আস্থা নেই, পুরো ব্যাপারটাই ঠুনকো।

খালেক তার বইয়ের ৮৫ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারাতে এসে জানায় যে তার বিরুদ্ধে কতজন সাক্ষী এসেছে, সাক্ষীদের জেরা কতদিন চলেছে ইত্যাদি তথ্য। একটা পর্যায়ে সে জানায় শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরন করা দূরের কথা, তাঁকে নাকি কখনো দেখেই নি। আর ঠিক এই সময় এসেই এই ঘাতক তাদের সেই দলীয় অস্ত্রটি পরিপূর্নভাবে ব্যবহার করে পাঠকের জন্য। সে বলে, 

“তবুও আমাকে ফাঁসাতেই হবে। আমাকে জড়াতেই হবে। আমার অপরাধ শহিদুল্লাহ কায়সারকে অপহরণ করা নয় বরং বিপরীত বিপ্লবী জীবনাদর্শের সাথে শরীক থাকাই আমার অপরাধ। মানুষের দু;খ দূর্দশা লাঘব করার, রুটি রুজির বিহিত ব্যবস্থা করা, নিখিল বিশ্বে ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য যে বিপ্লবী মতাদর্শ দুনিয়াব্যাপী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সাথে জড়িত থাকাই আমার অপরাধ। 

এ অপরাধই আমাকে ফাঁসাবার জন্য তাদের এক সূবর্ণ সুযোগ। এ আন্দলোনের একজন কর্মীকেও নিঃশেষ করতে পারলে তারা অপরিসীম খুশী। এতেই তাদের অনেক লাভ। কারন তারা ভান্ডারী গোষ্ঠী ও নাস্তিক”

কত সহজে কিছু মানুষকে, ব্যাক্তিকে, বিচারালয়ের প্রধানকে নাস্তিক বলে দিলো। শুধু মাত্র নিজের অপরাধটুকু কোনোভাবেই মেনে নেবে না, স্বীকার করবে না, মানতে চাইবে না বলেই অন্যকে “নাস্তিক” কিংবা “কাফের” বলাটা কত সোজা হয়ে যায়। খালেকের উপরের উদ্বৃত করা অংশটি পড়লেই আসলে এই অধ্যায়ের বাকী অংশের বলতে চাওয়া বক্তব্যগুলো অনুধাবন করা যায়। 

যেই ব্যাক্তিকে অপহরন ও খুন করবার অভিযোগ খালেকের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে তাঁর নাম শহীদুল্লাহ কায়সার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই নাম শুনেই অনুমান করা যায় নামটি মুসলিম নাম। খালেক এই অপহরন বিষয়ক ডিফেন্স দিতে গিয়ে শুরুতেই বলেছে শহীদুল্লাহ কায়সার কে সে জানে না কিংবা শহীদুল্লাহ কায়সারের পরিবারকে সেটিও সে জানে না অথচ কি অবলীলায় তাদের নাস্তিক বানিয়ে দিলো এই বইটিতে।

যারা তার নামে অভিযোগ এনেছে, যারা বিচার করেছে, যিনি আদালতে সেদিন বিচারপতি হিসেবে আসীন ছিলেন সেই হান্নান চৌধুরী কিংবা যেই ব্যাক্তি খালেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন কাস্টডিতে রেখে কিংবা যে পুলিশ খালেককে গ্রেফতার করেছে তাদের নাম-পরিচয় খালেক মজুমদার-ই তার বিয়ে আমাদের পাঠকদের দিয়ে দিচ্ছে। সেখান থেকেই অনুমান করে নেয়া যায় যে এই প্রশাসনের সব কর্মকর্তাই মুসলিম। অথচ খালেকের ধারনা হচ্ছে সেই হচ্ছে একমাত্র মুসলিম আর তার বিরুদ্ধে বিরাট এক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। 

খালেকের বইয়ের এই অংশ গুলোর কথা শুনলে মনে হয় আল্লাহ আরশ থেকে নেমে এসে ইসলাম রক্ষার সব দায়িত্ব খালেককে দিয়ে রেখেছে এবং ইসলাম হচ্ছে এমন একটা ধর্ম যার রক্ষনা বেক্ষন, ভরনপোষন, ভবিষ্যৎ সব কিছু দেখভাল ও বাঁচিয়ে রাখার গুরু দায়িত্ব খালেকের। খালেকের অন্যায়ের জন্য সে আটক হয়েছে কিংবা তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে সে আটক হয়েছে এই কথার পাশে দিয়েও খালেক যায়নি কখনো বরং প্রতি মুহুর্তেই খালেক জানান দিতে ব্যাস্ত ছিল যে সে আসলে কোনো অপরাধের সাথেই জড়িত ছিলোনা মুসলিম বলেই তাকে আসলে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের দেশে খালেকের মত একজন ইসলামী চিন্তাবিদকে ফাঁসানো ছাড়া যেন বাংলাদেশের আর কোনো কাজ নেই।

৪ ই অক্টোবর ১৯৭২ এর দৈনিক বাংলা পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয় যেখানে একাত্তরের দালাল মাওলানা খলিলুর রহমানের পাঁচ বছরের কারাদন্ডের খবর প্রকাশিত হয়। দালাল আইনে মাওলানা খলিল এই সাজা পায়। নোয়াখালীর রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসার এই শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধের সময় ফতোয়া প্রদান করে যে যারা মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবে তারা সকলেই কাফের এবং তারা বেহেশতে যেতে পারবে না। এই একই রাজাকার দালাল আইনের বিচারের সময় “ইসলামের পক্ষেই কাজ করেছে” বলে মামলার জবাননবন্দীতে উল্লেখ করে।

দালাল আইনে বিচার চলাকালীন সময়ে শুধু এই কয়েকটি ঘাতকই নয় এমন শত শত ঘাতক, দালাল, রাজাকার নিজেদের বাঁচাবার জন্য ইসলাম ধর্মকে সামনে এনে অপরাধকে ঢাকবার জন্য বার বার চেষ্টা করে গেছে। যখন তারা নিজদের এই বিপন্ন জীবনকে আর কোনো চলের ফলে বা অপঃকৌশল দিয়ে বাঁচাতে পারেনি তখন তারা কখনো এই বিচার নিয়ে লিখে গেছে বই, প্রবন্ধ কিংবা এমন সব অনুসারী রেখে গেছে যারা তাদের মৃত্যু পরবর্তী সময়েও এত বড় অন্যায়কে জায়েজ করবার জন্য অবিরাম ও অক্লান্ত খেটে গেছে। 

মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পর পর ১৯৭২ সালের বিচার চলাকালীন সময়ে যেখানে পাকিস্তানী সহযোগী বাহিনীর অবস্থা ছিলো সঙ্গীন এবং যেখানে তৎকালীন সময়ে ধর্মের ভিত্তি ধরে রাজনৈতিক দল করাটা ছিলো নিষিদ্ধ সেখানেই ধর্মকে এইভাবে উপজীব্য করে চলছিলো নানাবিধ বিচার বন্ধের ও পাবলিক ইমোশনকে নিজেদের দিকে টেনে নেবার প্রচেষ্টা। 

তাহলে এটি সহজেই অনুমেয় যে জিয়াউর রহমানের শাষন আমলের পর থেকে যখন ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি আবার শুরু করা হোলো সেই অধ্যায় থেকে আজকের বাংলাদেশে যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মুক্তিযুদ্ধকালীন নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার চলছে তখন সেখানে কি অবস্থা হচ্ছে।


এই লেখাটির ১ম পর্ব পড়তে হলে ক্লিক করুন এখানে

No comments:

Post a Comment