Thursday 4 June 2015

চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামনের এক্সট্রাডিশন সম্পর্কিত কিছু আইনী ভাবনা

আপনারা সকলেই জেনে থাকবেন যে একাত্তরের ঘাতক, বুদ্ধিজীবি হত্যাকারীদের অন্যতম দুই ভয়ংকর অপরাধী চৌধুরী মইনুদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামান খানের ফাঁসির দন্ড হয়েছে বাংলাদেশে চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ের মাধ্যমে। কিন্তু হতাশার বিষিয় হচ্ছে তাদের এখনো দেশে ফেরত আনা যায় নি। চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিচার বিষয়ক একটি আলোচনা আমি আমার আগের পোস্টে করেছি কিংবা এই ব্যাপারে হয়ত বিশদ জানাও গেছে কিন্তু এই পুরো বিচার-ই মূলত ব্যার্থতায় পরিণত হবে যদি এই দুই কনভিক্টেড অপরাধীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করা না যায়। বাংলাদেশের রাজনীতি আর তার দীর্ঘ মারপ্যাঁচে স্বাভাবিকভাবেই এই দুই অভিযুক্তের ব্যাপারে আর কোনো পদক্ষেপ স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর্যন্ত না নেয়া হলেও এটা সত্য যে এই দুই অভিযুক্তের ব্যাপারে সাধারণ জনতা কিংবা ভিক্টিম পরিবারের সদস্যরা বরাবরই উচ্চকিত ছিলেন এবং বৃটেন-আমেরিকার মিডিয়াও সব সময় উচ্চকিত ছিলো। এত কষ্ট, ত্যাগ ও সংগ্রামের পর অবশেষে এই অপরাধীর বিচার বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছে। কিন্তু অপূর্ণতা রয়েই গেছে শেষ পর্যন্ত। কেননা এই দুই খুনী এই দেশে নিরাপদে জীবন যাপন করছে এবং এই চলমান ট্রাইবুনালের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ক্রমাগত বিষেদাগার করেই চলেছে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত দেশ কিংবা পশ্চিমা বেশীরভাগ দেশ-ই যে কোনো বিচারে মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে একটি অবস্থানে এসে পৌঁছেছে এবং এই অবস্থানের কারনে চৌধুরী মইনুদ্দিনকে বাংলাদেশে ফেরত নেবার ক্ষেত্রে একটি জটিলতা তৈরী হয়েছে। চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানকে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আইনী একটা অবস্থান এই লেখায় তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বলেই আমার মনে হয়েছে বিধায় এই বিষয়ে কিছু বলবার চেষ্টা করব। প্রথমত যদি যুক্তরাজ্যে বসবাসরত চৌধুরী মইনুদ্দীনের ব্যাপারে আলোচনা করি তবে এটা দেখা আবশ্যক যে ইংল্যান্ডে এক্সট্রাডিশন [ এক্সট্রাডিশন হচ্ছে একটি আইনী ফর্ম বা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি দেশ থেকে আরেকটি দেশে একজন অপরাধীকে স্থানান্তর করা যায় আলোচ্য দেশের সাথে এই বিষয়ক কোনো এক পক্ষীয় বা অনেক দেশের সমন্বিত এই বিষয়ের উপর কোনো চুক্তির উপর ভিত্তি করে। যদিও এই ধরনের চুক্তিতে নানাবিধ শর্ত থাকতে পারে এবং যে দেশটি অপরাধী ব্যাক্তিকে অন্য দেশ থেকে চাইছে সেটির ক্ষেত্রেও নানাবিধ দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতা থাকে।

যুক্তরাজ্যের এক্সট্রাডিশন আইন-২০০৩ এর মাধ্যমে এই বিষয়ক ব্যাপারগুলো ব্যবস্থাপনা করা হয়। এই আইনের দুইটি অংশ আছে মূলত। একটা অংশ পার্ট-১ যে অংশ প্রজোয্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোর ক্ষেত্রে। এবং পার্ট-২ এর অংশের যে দেশগুলোর কথা রয়েছে সেটি মূলত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রজোয্য এবং এই অংশকে সূচিত করা হয়েছে ক্যাটাগোরী-২ নামে সূচিত করে। এই ক্যাটাগোরি-২ আবার দুইভাগে বিভক্ত। একটি অংশের ক্ষেত্রে মূলত দেখাতে হয় যে সে অংশের অনুরোধের প্রেক্ষিতে “প্রাইমাফেসি” এভিডেন্সিয়াল উপকরন রয়েছে কি না, অন্য অংশের তা দেখাতে হয়না। তাদেরই এই Prima Facie Eveidencial Case দেখাতে হয়না যারা ইতিমধ্যেওই European Convention of Extradition 1957 এর সাক্ষরকারী দেশ। বাংলাদেশ এই কনভেনশনের সাক্ষরকারী দেশ না বিধায়-ই বাংলাদেশকে প্রথমেই দেখাতে হবে যে ব্যাক্তিকে তারা চাইছে তার ব্যাপারে অভিযোগ রয়েছে, তার ব্যাপারে প্রাইমা ফেসি [আপাতঃ দৃষ্টিতে] এভিডেন্সিয়াল case রয়েছে। উক্ত আইনের ৮৪ ধারা মোতাবেক এই ব্যাপারটিও আবার প্রমাণ করতে যেতে হবে আদালতে যেখানে জাজ এই প্রাইমাফেসি এভিডেন্সিয়াল কেইসের পুরো ব্যাপারটি যাচাই করে দেখবেন। বাংলাদেশ যেহেতু ক্যাটাগোরি-২ ভুক্ত দেশ এবং আলোচ্য কনভেনশনেরও সিগ্নেটোরী দেশ নয় সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রথমে যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে এই মইনুদ্দিনের ব্যাপারে আবেদন করতে হবে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে যা যা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে সেগুলোও সাবমিট করতে হবে এই আবেদনের সাথে।

সবকিছু ঠিক থাকলে সেক্রেটারী অফ স্টেট এই আবেদন পাঠাবেন বিচারপতির কাছে। বিচারপতি এই ক্ষেত্রে অভিযুক্তের ব্যাপারে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করতে পারবেন। এই গ্রেফতারী পরোয়ানার পর আদালতে এই ব্যাপারে শুনানী হবে এবং সে প্রেক্ষিতে আদালত দেখবেন যে সাংবিধানিক কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ হবার কারনে এই ক্ষেত্রে কোনো ক্ষেত্রে উক্ত অভিযুক্তকে পাঠাবার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা রয়েছে কি না। বাঁধা না থাকলে বিচারপতি এই বিষয়ে সেক্রেটারী অফ স্টেটকে অভিহিত করবেন এবং তিনিই পরবর্তী ব্যাবস্থা নেবেন। সেক্রেটারী অফ স্টেট অতি অবশ্যই একটি ব্যাপার লক্ষ্য রাখবেন যে আলোচ্য আইনের ৯৩(২) ধারার প্রেক্ষিতে তার কোনো আইনী বাধ্য বাধকতা রয়েছে কি না। এই বাধ্য বাধকতার একটি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড। যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে অভিযুক্ত মইনুদ্দিন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়েছে সেহেতু আলোচ্য এই ইউকে’র এক্সট্রাডিশন আইনের ৯৪(১) ধারা মোতাবেক উক্ত অভিযুক্তের ক্ষেত্রে এক্সট্রাডিশন অর্ডার দিতে পারবেন না যদিও ওই একই আইনের ৯৪(২) এ রয়েছে যে যদি আবেদনকারী রাষ্ট্র যুক্তরাজ্যকে এই নিশ্চয়তা দেয় যে অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে আবেদনকারী রাষ্ট্রে পাঠালে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে না তবে সেক্ষেত্রে তিনি এক্ট্রাডিশন অর্ডার দিতে পারেন। এর মধ্য এটিও উল্লেখ্য যে আলোচ্য আইনের ৯৩(২) ধারাতে বর্ণিত কোনো বিষয়াদি যেটার প্রেক্ষিতে সেক্রেটারী অফ স্টেট এই এক্সাডিশন করতে অপারগ সেক্ষেত্রে তিনি এক্সট্রাডিশন অর্ডার দিতে পারবেন না, অন্যথায় তিনি এই অর্ডার দিবেন এবং এই ক্ষেত্রে অভিযুক্তের পক্ষে কোনো ডিস্ক্রিশনও প্রয়োগ হবে না।

আদতে একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার যে, এই ট্রাইবুনালে শাস্তি হিসেবে যে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে সেটি বহাল থাকলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দেশ সমূহের এই বিষয়ে যে নীতি সেক্ষত্রে মইনুদ্দিনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। তবে এই কথা অনস্বীকার্য যে দুই দেশের কূটনীতিক পর্যায়ে আন্তরিক আলোচনার মাধ্যমে অনেক কিছুই সম্ভব।

আমার জানামতে যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের কোনো বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই কিংবা এই মইনুদ্দিন বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের কি আদৌ কোনো যোগাযোগ বা আলোচনা হয়েছে কিনা সেটির ক্ষেত্রেও আমরা অন্ধকারে রয়েছি। এখানে এই আইনের মার প্যাঁচে যদি মইনুদ্দিনের মত এত বড় একজন খুনীর সাজা না হয় কিংবা সে শাস্তি না ভোগ করতে পারে তবে একদিকে যেমন “মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়” এই জুরিস্প্রুডেনশিয়াল ধারনা মার খেয়ে যাবে তেমনি আইনের ফাঁকে পড়ে একজন অপরাধী সাধারন নাগরিকদের মত যুক্তরাজ্যে ঘুরে বেড়াবে, এটি যুক্তরাজ্যের পত এমন একটি সভ্য দেশের জন্য ক্ষতিকর। একজন খুনী যখন সামাজিক ভাবে আইনের জটিলতায় মুক্ত অবস্থায় ঘুরতে পারে সেটি ওই দেশের সাধারণ নাগরিকদের জন্য হুমকি ও শংকারও বটে। আগামী দিনে যদি বৃটেনের ইতিহাসে লেখা হয় যে বৃটেন কিংবা ইউরোপ এই ধরনের অপরাধীদের জন্য স্বর্গস্বরূপ তবে সেটি পুরো মানব সভ্যতার জনই লজ্জার হয়ে দাঁড়াবে।

এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে ২০০৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৩৩ জন বৃটিশ নাগরিককে আমেরিকায় এক্সট্রাডিক্ট করা হয়েছে যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এই পরিসংখ্যান থেকেই এটি বোঝা যায় যে আন্তঃদেশীয় উষ্ণ সম্পর্ক, কূটনৈতিক ভাবে ভালো যোগাযোগ, এপ্রোচ কিংবা রাজনৈতিক কিংবা ভূ-রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নানা কৌশলের মাধ্যমেও এই ধরনের আপাতঃ দৃষ্টিতে জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব।

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অভিযুক্ত আশরাফুজ্জামানের ক্ষেত্রেও আইন যুক্তরাজ্যের মতই বলা যায় এক রকম যদিও যুক্তরাষ্ট্র এর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি যুক্তরাজ্য থেকে কম এবং আমেরিকা এই ব্যাপারে অনেকটা লিনিয়েন্ট আচরন করে। আমেরিকান একজন নাগরিক Amanda Knox ইটালিয়ান একজন নাগরিককে সেই দেশে খুন করে আমেরিকায় পালিয়ে এলে ইটালী দীর্ঘদিন ধরে আমান্ডার এক্সট্রাডিশনের জন্য আমেরিকার কাছে বলে আসছে। এই ব্যাপারে প্রসিজিওরাল অবস্থানটা দেখলে আশরাফুজ্জামানের ক্ষেত্রে অবস্থানটাও কিছুটা পরিষ্কার হতে পারে।

Any request to extradite Amanda Knox would go to the U.S. State Department, which would evaluate whether Italy has a sufficient case for seeking Knox’s return. If so, the State Department would transfer the case to the Justice Department, which would represent the interests of the Italian government in seeking her arrest and transfer in U.S. District Court. American courts have limited ability to review extradition requests from other countries, but rather ensure the extradition request meets basic legal requirements, said Mary Fan, a former U.S. federal prosecutor who teaches law at the University of Washington in Seattle.

আশরাফুজ্জামান এখন আমেরিকান নাগরিক। যদিও এই ক্ষেত্রে আমেরিকার আইন 18 U.S. Code § 3196 অনুযায়ী 

Extradition of United States citizens:If the applicable treaty or convention does not obligate the United States to extradite its citizens to a foreign country, the Secretary of State may, nevertheless, order the surrender to that country of a United States citizen whose extradition has been requested by that country if the other requirements of that treaty or convention are met.

যুক্তরাষ্ট্রের উপরে উল্লেখিত আইন দ্বরাই স্পস্ট বুঝতে পারা যায় এক্সট্রাডিশনের ব্যাপারে তাদের অবস্থান। আগেই বলেছি কিছু ক্ষেত্রে তাদের নাগরিক সত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এক্সট্রাডিশন আইনের প্রতি শিথিল। এ ব্যাপারে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে কি লেখা থাকবে বা রয়েছে তার উপর নির্ভর করে পুরো প্রক্রিয়া। বলা যেতে পারে বল এখন বাংলাদেশ সরকারের কোর্টে। আশরাফুজ্জামান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ কতটা এক্সটেন্টে কিংবা কিভাবে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালাবে, সেটার উপর নির্ভর করবে এই খুনী তার এইসব ঘৃণ্য কর্মকান্ডের শাস্তি বাংলাদেশের মাটিতেই ভোগ করতে পারবে কি পারবে না।

একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে ইটালী ইউরোপিয়ান ইউনিয়িনভুক্ত দেশ এবং সেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড না থাকবার ফলেও আমান্ডার এক্সট্রাডিশন বিলম্বিত হচ্ছে অনেকটা রাজনৈতিক কারনেই বলে মনে করছেন অনেকেই। এর আগেও বঙ্গবন্ধুর খুনী মহিউদ্দিনকে আমেরিকা থেকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে। সুতরাং আশরাফুজ্জামানের ক্ষেত্রে এই ধরনের একটা প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। সুতরাং এই ক্ষেত্রে আইনী জটিলতা ইউরোপিয়ান দেশগুলোর চাইতে কম। এই ক্ষেত্রে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও তার প্রেক্ষিতে যোগাযোগ।

No comments:

Post a Comment