Tuesday 9 June 2015

গ্লোবাল সামিট লন্ডনঃ ৭১এর যে নৃশংসতার কথা পৃথিবীকে জানতেই হবে

                                                                                                        শুরুর কয়েকটি কথাঃ

আমার এই লেখাটি শুরু করবার আগে আমি বিখ্যাত অভিনেত্রী এঞ্জেলিনা জোলির নিজের লেখা একটি প্রবন্ধের অনুবাদ শুরুতেই এই লেখায় তুলে দিতে চাই। ২০০৮ সালে ব্রিটিশ জার্নাল দি ইকোনোমিস্টে “এ ইয়ার অফ একাউন্টিবিলিটি” শীর্ষক প্রবন্ধে জোলি লিখেছিলেন কিছু অবাক করে দেবার মত কথা। জোলি UNHR এর গুড উইল এম্বাসেডর হিসেবে মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদ এর পূর্বাঞ্চলে গিয়েছিলেন শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনে। শাদ এই শরণার্থীরা এসেছিলেন সুদান থেকে। ২০০৩ থেকে সুদানের লিবারেশন মুভমেন্ট আর্মি এবং জাস্টিস এন্ড ইকুয়ালিটি মুভমেন্ট দুইটি গেরিলা দল অস্ত্র তুলে নেয় সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ অসংখ্য। বঞ্চনা, ডিস্ক্রিমিনেশন, নির্যাতন, দীর্ঘদিনের অবহেলা, সবকিছু মিলে দক্ষিন সুদানের অধিবাসীরা চাইলো স্বাধীন দক্ষিন সুদান আর শুরু হলো যুদ্ধ। যুদ্ধ হলে সাধারণত যা হয় তাই হোলো। অসংখ্য নিরীহ মানুষকে খুন হতে হয়, নারী-শিশুরা হয় ধর্ষিত, লক্ষ কোটি মানুষ হয় ঘর হারা, স্বপ্ন হারা, পথ হারা। সুদানের রাষ্ট্রপতি ওমর আল বশির এই বিদ্রোহ মেনে নিতে চাইলো না আর শুরু হোলো সেই অঞ্চলের মানুষদের উপর গণহত্যা। ঠিক এমন করেই দক্ষিন সুদানের অসংখ্য মানুষ তাদের সীমান্ত নিকটবর্তী দেশ শাদে আশ্রয় নিলেন।

এঞ্জেলিনা জোলি সেই শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন শেষেই ইকোনোমিস্টে সেই প্রবন্ধটি লিখেন। যেখানে তিনি বলেন-

“ UNHR এর প্রতিনিধি হিসেবে সাম্প্রতিক এক মিশনে আমার শাদের শরণার্থী ক্যাম্পে যাবার সুযোগ হয়েছিলো। এই শরণার্থী ক্যাম্প সুদানের সীমান্তের নিকটবর্তী। একদল শরণার্থীদের সাথে যখন আমি বসে কথা বলছিলাম তখন আমি তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে তাদের কি লাগবে। এই শরণার্থীরা হচ্ছেন তাঁরা যারা নিজের চোখে দেখেছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের কি করে মেরে ফেলা হয়েছিলো, তাঁরা দেখেছেন প্রতিবেশীদের ধর্ষিত হতে, পুরো গ্রাম জ্বলতে আর লুট-পাট হতে আর দেখেছেন তাদের পুরো একটি কমিউনিটিকে কি করে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো তাদেরই নিজের ভূমি থেকে। সুতরাং আমি মোটেই অবাক হতাম না যদি এই শরণার্থীরা আমার কাছে এমন কিছু চাইতো যেগুলো দিতে তাদের জীবন-মানের সামান্য হলেও উন্নতি হয়। অনেকে চাইলোও তাই। একজন ভালো তাবু চাইলো, একজন আবার চাইলো ভালো মেডিক্যাল ব্যাবস্থা। কিন্তু সেই শরণার্থীদের মধ্যে এক কিশোর দাঁড়িয়ে সরল অথচ দৃপ্ত কন্ঠে বলল, “Nous voulons un procès.”, আমরা বিচার চাই”

জোলির সেই প্রবন্ধটিতে আরো অনেক বর্ণনাই ছিলো, তাঁর অনুভূতির কথা ছিলো কিন্তু আমি জানিনা কেন, তাঁর প্রবন্ধের এই শুরুর অংশটুকু আমাকে তীব্র ভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। এই অংশটুকু আসলে নিরবে অনেক কথাই বলে। মনে করিয়ে দেয় অসংখ্য স্মৃতি, অসংখ্য কথা। বছর দুয়েক আগে আমি একটি চলচ্চিত্র দেখেছিলাম, চলচ্চিত্রটির নাম “হোটেল রুয়ান্ডা”। আমি দীর্ঘদিন এই ছবির ভেতরের বেদনা নিয়ে রাতে ঘুমোতে গিয়েছি, দীর্ঘদিন আমার মাথার ভেতরে ঘুরেছে হতভাগ্য তুতসী নারীটির অদ্ভুত সরল মুখখানি। আমি আজও, এই মুহূর্ত পর্যন্ত এই চলচ্চিত্রটির কথা ভুলতে পারিনি। হতে পারে এটি একটি চলচ্চিত্র। কিন্তু এর ভেতরের গল্প জীবন্ত। এর ভেতরের যে উপখ্যান, যে বেদনা, যে যাতনার কথা রয়েছে সেটি আমাকে বিদীর্ণ করে, আমাকে যন্ত্রণায় যন্ত্রণায় মুচড়ে ফেলে প্রতিটিক্ষণ। রুয়ান্ডাতে ১৯৯৪ সালে হুতু জনগোষ্ঠী তাদের-ই দেশের তুতসী আর “মডারেট” হুতু জনগোষ্ঠীর উপর চালায় ভয়াবহ গণহত্যা। যেই গণ হত্যার কথা শুনলে একজন স্বাভাবিক মানুষ হয়ত মানসিকভাবেই মুষড়ে পড়বেন, ভেঙ্গেচুরে যাবেন।

এই রুয়ান্ডার গণহত্যা যখন কিছুটা থেমে গেলো, যখন জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে বিচার হোলো হুতু নেতাদের এবং যারা যারা পালিয়ে গেলো পৃথিবীর নানান দেশে তার কিছুদিন পরেই আবার গণহত্যা শুরু হোলো কঙ্গো তে। রুয়ান্ডার ঠিক পাশের দেশ কঙ্গোতে অসংখ্য হুতু পালিয়ে নিজেদের আবাসন তৈরী করেছিলো এবং সেখানে গিয়েও তারা শুরু করেছিলো যুদ্ধ, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।

Newham Recorder এ, আমাদের এই ক্যাম্পেইনের সংবাদ


ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সাংবাদিক রস কেম্প তাঁর “এক্সট্রিম ওয়ার্ল্ড” নামক টিভি সিরিজে কঙ্গোকে নিয়ে এক্টি পর্ব তৈরী করেছিলেন। এই পর্বটির কথা আমি আসলে লিখে আপনাদের বুঝাতে পারব সেই দুঃসাহস করিনা, আমি আপনাদের বলেও যে বুঝাতে পারব এমন কল্পনাও করিনা। কিছু কিছু ঘটনা থাকে যেগুলো বলা যায়না, ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না। কেবল নিজস্ব অনুভূতিতে জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার হতে হয় অবিরত। অহর্নিশ।

আমি শুধু রস কেম্পের সেই পর্বটিতে ডক্টর ডেনিস মিকিউয়েগের কয়েকটি কথা বাংলায় অনুবাদ করে দেই। ডক্টর ডেনিস সেই যুদ্ধে হতাহত নারী ও শিশুদের জন্য যেই হাসপাতালটি তৈরী করেছেন সেই হাসপাতালে আসা নারীদের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন-

“নারীদের ধর্ষন করবার পর তাদের যোনীদ্বারে আগুন দিয়ে দেয়া হয়েছে, ছুরি দিয়ে কেটে কেটে তাদের যোনীদ্বার টুকরো টুকরো করা হয়েছে, সেখানে ঢোকানো হয়েছে গরম প্লাস্টিকের পাইপ”

এই বর্ণনাটুকুর পর আমি আর এই ব্যাপারে কিছু লিখতে চাইনা। বলতে চাইনা। যদি আপনি সাহসী হয়ে থাকেন তবে সেই পর্বটি নীচ থেকে দেখে নিতে পারেন।



উপরে যে অত্যাচার, অবিচার, গণহত্যা তথা নৃশংসতার বর্ণনা দিয়েছি সেগুলো যতটিবার আমি নিজে জেনেছি ততবার আমি ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে গিয়েছি একাত্তরের নৃশংসতার চিত্রে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমার জন্ম হয়নি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন পরবর্তী সময়ে আমাদের প্রজন্ম এই যুদ্ধের ভয়াবহতার যে চিত্র দেখে, পড়ে কিংবা জেনে বড় হয়েছি সেটিই আমাদের কাছে মূর্ত হয়ে রয়েছে। হোটেল রুয়ান্ডাতে যে নির্যাতিত নারীদের দেখানো হয়েছে কিংবা রস কেম্পের টিভি সিরিজে ডক্টর ডেনিসের বয়ানে নারীদের উপর যে নৃশংসতার কথা বলা রয়েছে ঠিক তেমনই ইতিহাস আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। পাকিস্তানী আর্মি ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের উপর যে অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতনের উৎসবে মেতে উঠেছিলো সেইসব ঘটনার সাথে আজকের রুয়ান্ডা, সুদান কিংবা কঙ্গোর ঘটনা একেবারেই আলাদা কিছু নয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্রের ৮ম খন্ড যেটি গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছে সেই বইয়ের ৪৪ পৃষ্ঠা থেকে আমি চুন্নু ডোমের কিছু কথা বলতে চাই। চুন্নু ডোম ২৯ শে মার্চ ১৯৭১ সালে তার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেবের নির্দেশে ঢাকার মিডফোর্ড হসপিটালে যান। সেখান থেকে তিনি অসংখ্যা নারী পুরুষের পঁচা, গলা, বিকৃত লাশ ক্রমাগত ট্রাকে উঠাতে থাকেন তার সাথে থাকা আরো অনেক ডোমের সাথে। সেই লাশ উঠাবার কাহিনী বড় মর্মান্তিক, বড় যন্ত্রনার। আমি কেবল চুন্ন ডোমের বর্ণনায় উঠে আসা নারীদের লাশের বর্ণনা দিচ্ছি এই অংশে।

“আমরা লাশ ঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ, শিশু, কিশোরের স্তুপীকৃত লাশ দেখলাম। আমি এবং বদলু ডোম লাশঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জড়ো করেছি। আর গণেশ,রঞ্জিত(লাল বাহাদুর) এবং কানাই লোহার কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে পচা,গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। প্রতিটি লাশ গুলিতে গুলিতে ঝাঝরা দেখেছি, মেয়েদের লাশের কারো স্তন পাই নাই, যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত এবং পছনের মাংস কাটা দেখেছি। মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে তাদের হত্যা করার পূর্বে তাদের স্তন সজোরে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, যোনিপথে লোহার রড কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুবতী মেয়েদের যোনিপথের এবং পেছনের মাংস যেন ধারালো চাকু দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে”

এই বর্ণনাটুকু আমি এর আগে একবার পড়েছিলাম হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস “জোছনা ও জননীর গল্প” পড়তে গিয়ে আর আজকে এই লেখার জন্য আমাকে এই বীভৎস অংশটুকু আরেকবার পড়তে হোলো। আমরা হয়ত নিজেদের অজান্তেই এই গ্লানি ভুলে থাকতে চাই, এই বেদনা ভুলে থাকতে চাই বলে এসব বর্ণনা এড়িয়ে যেতে চাই। ওই যে উপরে একটি শব্দ ব্যবহার করেছি “হয়ত”, সেটিও মিথ্যে। হয়ত শব্দটি বলে সম্ভাবনাওকে সূচিত না করে সত্য কথাটাই বলি, আমরা আসলেই এই গ্লানি ভুলে থাকতে চাই। আমরা আসলেই এই অত্যাচারের কথা ভুলে থাকতে চাই। আর চাই বলেই স্বাধীনতার পর গুনে গুনে চারটি দশক তথা ৩৯ বছর লেগেছে এইসব বীভৎস হত্যাকান্ডের বিচার করবার জন্য।

১৯৭১ সালে যে মহান নারীরা দেশের জন্য তাঁদের সর্বস্ব দিলেন, ত্যাগ করলেন, সেইসব নারীদের জন্য স্বাধীনতার এই চারটি দশক পর ইনফ্যাক্ট আমরা কি করতে পেরেছি ? মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পর পরেরই একটি চিত্র তুলে ধরছি নীলিমা ইব্রাহিমের বিখ্যাত গ্রন্থ “আমি বীরাঙ্গনা বলছি” থেকে-

বীরাঙ্গনা রীনা লেখক নীলিমা ইব্রাহিমকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্মৃতি থেকে বলেন-

“বাংকার থেকে আমাকে যখন ভারতীয় বাহিনীর এক সদস্য অর্ধ উলঙ্গ এবং অর্ধমৃত অবস্থায় টেনে তোলে তখন আশেপাশের দেশবাসীর চোখে মুখে যে ঘৃণা ও বঞ্চনা আমি দেখেছিলাম তাতে দ্বিতীয়বার আর চোখ তুলতে পারি নি।জঘন্য ভাষায় যেসব মন্তব্য আমার দিকে তারা ছুড়ে দিচ্ছিল. . . ভাগ্যিস বিদেশীরা আমাদের সহজ বুলি বুঝতে পারে নি”

প্রশ্ন এসেই যায় স্বাভাবিক ভাবে, আমরা কি আদৌ আমাদের এই তৃতীয় শ্রেণীর মানসিকতা থেকে বের হতে পেরেছি? উত্তরটা সোজা। আমরা পারিনি। আর পারিনি বলেই স্বাধীনতার এতটা বছর পর মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত, নিগৃহিত, নিষ্প্রেষিত, অবহেলিত নারীদের কথা আমরা না পেরেছি দেশের মানুষকে সঠিকভাবে জানাতে, বোঝাতে, উপলব্ধি করাতে। না পেরেছি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে।

যা বলতে এসেছিঃ

উপরে যে ক্ষোভের কথা, দুঃখের কথা কিংবা বেদনা আর যন্ত্রনার উপ্যাখ্যান শুনিয়ে আপনাদের বিরক্ত করেছি সেটির জন্য আমি বিনীত ক্ষমাপ্রার্থী। এই বিষ্ময়কর আই প্যাড এয়ার, আইফোন, ফেসবুক, হোয়াটসএপ, ভাইবার, ট্যাঙ্গো কিংবা ইন্সটাগ্রাম প্রজন্মে এইসব উপাখ্যান খানিকটা বিরক্তইর-ই সামিল হয়ত। সুতরাং এই উপলব্ধি আমি বরং মূল কথায় আসি।

আগামী ১০-ই জুন থেকে ১৩-ই জুন পর্যন্ত লন্ডনের ডকল্যান্ডের এক্সেল এক্সিবিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হবে গ্লোবাল সামিট-২০১৪। [ Global Summit to End Sexual Violence in Conflict] এই সামিটের হোস্ট ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী উইলিয়াম হেগ। আর UNHR এর বিশেষ দূত এঞ্জেলিনা জোলি এই সামিটে আসবেন অতিথি হয়ে। যুদ্ধকালীন সময়ে নারীদের উপর নানাবিধ যৌন নির্যাতন বন্ধ করবার সংকল্পে তথা এই ব্যাপারে পুরো পৃথিবী ব্যাপী একটি বৈশ্বিক জনমত গড়ে তুলবার লক্ষ্যে এই গ্লোবাল সামিট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সামিটের মূল লক্ষ্যগুলো হচ্ছে-


• To improve investigations/documentation of sexual violence in conflict;


• To provide greater support and assistance and reparation for survivors, including child survivors, of sexual violence;


• To ensure sexual and gender based violence responses and the promotion of gender equality are fully integrated in all peace and security efforts, including security and justice sector reform; and


• To improve international strategic co-ordination.


জাতিসংঘের দুই তৃতীয়াংশ সদস্য রাষ্ট্র এই উদ্যোগের প্রেক্ষিতে গৃহীত প্রকল্পে সাক্ষর করে এই ইনশিয়েটিভের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। পুরো পৃথিবী থেকে প্রায় ৬০ জন মন্ত্রী এবং প্রায় ২৩০ জন সরকারী কর্মকর্তা এই সামিটে যোগ দেবেন। বলা বাহুল্য পাকিস্তান থেকেও আসবেন প্রতিনিধি। মোট কথা এই সামিটে পুরো পৃথিবী থেকেই বলতে গেলে প্রত্যেকটি দেশ তাদের প্রতিনিধি পাঠাবেন।


এই সামিট সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে পাবেন এখানে-


লক্ষ্য করলে দেখবেন যে যে অবজেকটিভগুলোওকে কেন্দ্র করে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেই অবজেকটিভস গুলোর সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন নারীদের ও শিশুদের উপর অত্যাচারের অংশ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। আপনারা যদি এই সামিটের দ্বিতীয় অবজেকটিভের দিকে লক্ষ্য করেনতাহলে বলতে হয় যেই লক্ষ্যের কথা এখানে বলা হচ্ছে সেটা আমাদের দেশে আজও অর্জিত হয়নি। যেসব নারীরা ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত হয়ে তীব্র মানসিক, শারিরীক, সামাজিক আঘাতে জর্জরিত হয়ে সময় পার করে দিচ্ছেন তাঁদের প্রতি রাষ্ট্র কখনই সঠিকভাবে তার দায়িত্ব করেনি। সুতরাং এখন আমাদের আন্তর্জাতিক ভাবেই এই ইস্যুগুলো তুলে ধরতে হবে। জাতিসঙ্ঘের এই বিষয়ক ডিক্লারেশন অফ কমিটমেন্টটিওযদি আপনি পড়ে দেখেন তাহলেও সেখানে দেখবেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখা রয়েছে। সেগুলো হলো-


1) Ensure that sexual violence prevention and response efforts are prioritised and adequately funded from the first phase and throughout all responses to conflict and humanitarian emergencies.


2) Provide better, more timely and comprehensive assistance and care, including health and psychosocial care that addresses the long-term consequences of sexual violence in conflict, to female, male and child victims and their families, including children born as the result of sexual violence.


3) Ensure that all peace, security and conflict mediation processes explicitly recognise the need to prevent, respond to and reduce crimes of sexual violence in conflict and stressed the need to exclude such crimes from amnesty provisions.


4) Promote women’s full participation in all political, governance and security structures, as well as all decision-making processes, including peace negotiations, peacebuilding, prevention and accountability efforts, recognising the important contribution that National Action Plans on UN Security Council Resolution 1325 can play in this regard, and ensure that such processes also take into full consideration the needs and rights of women and children.


5) Strengthen UN efforts to address sexual violence in conflict and provide further support to the Special Representative of the Secretary-General on Sexual Violence in Conflict as chair of UN Action against Sexual Violence in Conflict.


6) Strengthen and support the efforts of regional organizations to prevent and respond to sexual violence in conflict in their peacemaking, peacekeeping and peacebuilding initiatives.


7) Support conflict-affected states in strengthening their capacity to prevent and respond to sexual violence in conflict and to develop and implement national security sector and justice reform programmes that take into full consideration the needs and rights of women and children.


8] Support the deployment of national and international expertise at the request of host governments, the UN and other international organisations to build national capacity to hold perpetrators to account and to improve the response and support to victims and their access to justice.


9) Ensure our national military and police doctrine and training is in accordance with international law so as to enable a more effective prevention and response to sexual violence in conflict.


10) Encourage and improve the safe and ethical collection of data and evidence relating to acts of sexual violence committed in conflict, to inform national and international responses.


11) Encourage, support and protect the efforts of civil society organizations, including women’s groups and human rights defenders, to improve the monitoring and documentation of cases of sexual violence in conflict without fear of reprisal and empower victims to access justice.


12) Support and encourage the development of the International Protocol on the documentation and investigation of sexual violence in conflict at national, regional and international levels, with a view to its conclusion in 2014.


২০১৩ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর এই ডিক্লারেশন অফ কমিটমেন্টটি গৃহীত হয় জাতিসংঘের সাধারণ সভায়। বিশেষ করে উপরের ২ এবং ৮ নাম্বার পয়েন্টের দিকে যদি আপনারা একটু লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন এই দুইটি পয়েন্ট কি পরিমাাণ তাৎপর্য বহন করে। এইসব নির্যাতিত নারীদের রিহ্যাবিলিটেশন, পর্যাপ্ত চিকিৎসা, সঠিক সেবা-যত্ন এবং যারা এই নির্যাতনের জন্য দায়ী তাদেরকে আইনের কাঠগড়ায় নেবার জন্য জাতি সংঘ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সুতরাং জাতিসঙ্ঘের এই প্রতিজ্ঞা, এই ডিক্লারেশন এসব সব কিছুর প্রেক্ষিতে, আলোকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন নারীদের উপর বর্বর অত্যাচারের কথা তুলে ধরা, সেগুলোর জন্য ক্ষতিপূরন চাওয়া, সকল অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আমাদের প্রেশার ক্রিয়েট করতে হবে। আর এসব কারনেই এই সামিটের গুরুত্ব আমাদের জন্য অনেক বেশী।
সামিটে আমরা যে লিফলেটটি বিতরন করেছি তার সামনের প্রচ্ছদ

সামিটে আমরা যে লিফলেটটি বিতরন করেছি তার পেছনের পাতা


এই সামিট ঘিরে আমাদের লক্ষ্যঃ

আমরা যুক্তরাজ্যের সচেতন বাংলাদেশীরা এই সামিটকে কেন্দ্র করে একটি পরিকল্পনা নিয়েছি। এই সামিট হচ্ছে লন্ডনের ডকল্যান্ডের এক্সেল এক্সিবিশন সেন্টারে এবং এই সামিট সবার জন্য উন্মুক্ত। আমরা এই এক্সিবিশন সেন্টারের সামনে অবস্থান নিয়ে এই সামিটে আগত অতিথিদের লিফলেট বিতরণ করব। যেই লিফলেটে লেখা থাকবে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নারীদের উপর পাকিস্তানী আর্মিদের অত্যাচার করবার ইতিহাস আর তার সকল বর্ণনা। একটি লিফলেটে স্থান সংকুলানের ব্যাপার রয়েছে বিধায় আমাদের হয়ত এখানে মূল বক্তব্যটুকুই তুলে ধরতে হবে। আমরা পৃথিবীকে জানাব ৪৩ বছর আগে হয়ে যাওয়া এক নৃশংস অধ্যায়ের কথা। যে অধ্যায়ের প্রতিটি মুহুর্তেই রয়েছে দীর্ঘ এক যন্ত্রণা, অত্যাচার আর বীভৎসতার করুন ইতিহাস। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমরা পৃথিবীকে জানাতে চাই ১৯৭১ সালের কথা। সে সময়ের তান্ডবের কথা। আমরা বলতে চাই যে নারীদের উপর যুদ্ধকালীন নির্যাতন বন্ধে আজ বিশ্ব সজাগ, আজ বিশ্ব এক হয়েছো, আমরা সেই নির্যাতনের অংশ। আমরা সেই নির্যাতনের কথা তোমাদের বলতে চাই, আমরা সেই নির্যাতনের বিচার চাই। আমরা সেই বিচারের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরী করতে চাই।

 বাংলাদেশের প্রসঙ্গ কি থাকবে এই সামিটে?

উত্তর হচ্ছে এখন পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রসঙ্গ থাকবে। এই সংঘঠকদের মাধ্যমে জানতে পারা যায় যে, ডারহাম ইউনিভার্সিটির সোশাল এনথ্রপোলজি’র রিডার ডক্টর নয়নিকা মুখার্জী এই সামিটে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যা, নারীদের উপর বিভিষীকাময় অত্যাচার নিয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করবেন বলে কথা রয়েছে। ডক্টর মুখার্জী দীর্ঘদিন বাংলাদেশের গণহত্যার উপর গবেষনায় নিয়োজিত রয়েছেন। শর্মিলা বসুর মত ইতিহাস বিকৃতকারী যখন আমাদের গণহত্যা নিয়ে কাল্পনিক ও মিথ্যে প্রোপাগান্ডায় মিডিয়া ভাসিয়ে দিচ্ছিলো তখন কলম হাতে নিয়েছিলেন ডক্টর মুখার্জী। এই বিষয়ে তাঁর একটি লেখা পাওয়া যাবে এখানে

আপনারা যারা যুক্তরাজ্যে থাকেন এবং যেভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারেনঃ

আমরা এই সামিটকে ঘিরে লিফলেট বিতরন আর জনমত গঠনের পরিকল্পনা করেছি সামিটের প্রতিটি দিন ব্যাপী। [যদিও এই সামিটের পরে আমাদের আরো পরিকল্পনা রয়েছে যেগুলো যথারীতি চলবে]। এই সামিট চলবে ১০ ই জুন ২০১৪ থেকে ১৩-ই জুন ২০১৪ সকাল ১২ টা থেকে রাতের ৮টা পর্যন্ত। এই চারদিনের পুরো সময়ে আমরা বিভিন্ন সময়কালীন গ্রুপ, উপ গ্রুপে ভাগ হয়ে সম্মেলন স্থানে লিফলেট বিতরণ করব। আগেই বলেছি লিফলেটে কি লেখা থাকবে। এখন আপনারা আমাদের সাহায্য করতে পারেন একজন ভলেন্টিয়ার হয়ে। আপনারা যারা যুক্তরাজ্যে থাকেন তারা যদি এই চারদিনের মধ্যে সময় বের করে [ সকাল ১২ টা থেকে রাত ৮টা] আমাদের প্রতিদিন ১ ঘন্টা বা দুইটা ঘন্টা দিতে পারেন তবে আমরা একটা বড় ভলেন্টিয়ার দল গড়ে তুলতে পারি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতে পারছেন এই পুরো পরিকল্পনায় প্রচুর ভলেন্টিয়ার প্রয়োজন যারা লড়বেন দেশের জন্য। আপনারা যদি এই গ্লোমাল সামিটে লিফলেট বিতরনে আগ্রহী হয়ে থাকেন তবে দয়া করে আমাকে কিংবা অজন্তা দেব রায়কে জানাতে পারেন জানাতে পারেন আমার ইমেইলে। আমার ইমেইল ঠিকানা হচ্ছে- nijhoom.majumder@gmail.com, অজন্তা দেব রায়ের ইমেইল ঠিকানাঃ ajanta_dream@yahoo.com

এই উদ্যোগকে কেন্দ্র করে একটি ফেসবুক ইভেন্ট খুলেছেন সংগঠকরা। সেই ইভেন্টের ঠিকানা হচ্ছে-





শেষের কিছু কথাঃ

সুদান, রুয়ান্ডা, কঙ্গোর যুদ্ধে নারীদের উপর যে ভয়াবহ নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেছি এই লেখাটির শুরুতে সেই ভয়াবহতার একটা অংশ আমি কিংবা আপনি তথা আমরা বাংলাদেশীরা। কেননা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমরা এই নির্যাতনের সাক্ষী। এই অত্যাচার, এই অন্যায়, এই লাঞ্ছনা, বিভীষিকা আমরাও ৪৩ বছর আগে পেরিয়ে এসেছি। অবশ্য পেরিয়ে এসেছি কথাটা সঠিক নয়। সেই অত্যাচারের যেই মাত্রা সেটি আজও আমরা বহন করে চলেছি। গত ৭-ই মে ২০১৪ সালে দৈনিক কালের কন্ঠে প্রকাশিত একটি সংবাদের দিকে একটু তাকাই-


মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারের ছোঁড়া গুলি এসে লেগেছিল মোমেনা বেগমের গলায়। তাঁর বয়স তখন প্রায় ১৫ বছর। আহত অবস্থায় বাবা মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যান স্থানীয় এক গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে। এরপর ধীরে ধীরে সে সুস্থ হয়ে উঠলেও গুলিটি থেকে যায় মোমেনার গলায়। যুদ্ধ থেমে যায়। মোমেনার বিয়ে হয়। হয় সংসার। কিন্তু দরিদ্র এই গৃহবধূ অভাবের কারণে বের করতে পারেননি সেই গুলি। মোমেনার এখন বয়স প্রায় ৫৮ বছর। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গলার সমস্যা বাড়তে থাকে। মাঝেমধ্যে ব্যথা হলে ব্যথানাশক ওষুধ খেতেনে। কিন্তু সম্প্রতিক সময়ে এতে আর কোনো কাজ হচ্ছিল না। ফলে আত্মীয়স্বজন ও এলাকার লোকজনের সহায়তায় গত মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় একজন চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মোমোনার গলার বাম দিকে আবিষ্কার করেন একটি গুলি। এরপর তাঁকে ভর্তি করা হয় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখাসে গত মঙ্গলবার অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসক মোমেনার গলা থেকে বের করে আনেন সেই গুলিটি। মোমেনার বাড়ি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার মধ্য গড্ডিমারী গ্রামে। স্বামী-সন্তান না থাকায় মোমেনা তাঁর ছোট বোন মনোয়ারা বাড়িতে থাকেন। তাঁর দিন চলে অন্যের সহায়তায়।


৪৩ বছর আগের নৃশংসতা যেন আক্ষরিক ভাবেই বহন করে এসেছেন মোমেনা বেগম। পাকিস্তানী খুনীদের বর্বরতার একটি নিদর্শন যেভাবে গলায় বহন করেছেন আমাদের মা মোমেনা বেগম ঠিক একই ভাবে এই কষ্ট মানসিক ভাবে বহন করে চলেছেন বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী, তারা ব্যানার্জী,মেহেরজান,রীনা,শেফা,ফাতেমা,ময়না,মিনা’রা। যাঁরা একাত্তরে দেশের জন্য দিয়েছেন সব। বীরাঙ্গনা শেফা নীলিমা ইব্রাহিমকে রাজাকার ফারুকের স্বাধীনতা-পরবর্তী অবস্থান বর্ণনা করেন এভাবে-

‘ফারুক এখন জজ সাহেব।আর কখনো হাফ হাতা শার্ট পরে না।কেউ হাতের দাগ দেখে ফেললে বলে মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়েছিল বেয়োনেট চার্জে। ”

এই ফারুক হচ্ছে সেই ফারুক যে কিনা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যদের কাছে তুলে দিয়েছিলো শেফাকে। যেই হাতের দাগ হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের বেয়নেট চার্জে, সেই হাত যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে হয়ে গিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার হাত। সেই হাতের ক্ষত এসেছে অন্য ইতিহাস হয়ে। বলা হয়েছে ফারুক মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হয়েছে।

ঘরের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস, স্বাধীনতা বিরোধীদের সন্তানেরা সব ঘিরে ফেলেছে আর ফেলছে ক্রমাগত, আন্তর্জাতিক ভাবে এখনো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিগণিত হয় সিভিল ওয়ার হিসেবে। আজও পৃথিবীর মানুষ জানেনা আমাদের মায়েদের উপর পাকিস্তানী আর্মি আর তাদের এই দেশীয় দোসরদের সহায়তায় কি করে অত্যাচার করা হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। আজো এই অধ্যায়টি বড় বেশী অস্পস্ট, ধোঁয়াশে, অন্ধকারাচ্ছন্ন।

আমরা পুরো পৃথিবীকে জানাতে চাই আমাদের মায়েদের উপর নৃশংস অত্যাচারের কথা, আমাদের বোনদের উপর অত্যাচারের কথা। আমরা পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে চাই কি করে পাকিস্তানী আর্মিরা আমাদের নারীদের উপর অত্যাচার করেছে, নির্যাতন করেছে। আজ সেই জানাবার জন্য একটি বড় সুযোগ হয়েছে। এমন সুযোগ হয়ত প্রতিদিন আসবেনা কিংবা বছরে একবারও আসেনা। আমাদের মায়েরা লড়েছে দেশের জন্য, বোনেরা লড়েছে এবং সব দিয়ে দিয়েছে দেশের জন্য।

এবার আমরা লড়ব তাঁদের জন্য, এবার আমরা লড়ব পুরো পৃথিবীকে এই অত্যাচারের কথা জানাবার জন্য।

No comments:

Post a Comment